প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে নারী পুরুষের আনুপাতিক হার সাধারণত এমনই থাকে, নারী বেশি, পুরুষ কম। একহাজার পুরুষে একহাজার পাঁচ-এর মতো নারী। সুস্থ সমাজ হলে তাই থাকে। কিন্তু অসুস্থ হলে হেরফের হয়। অসুস্থতা ভারতে আগেই ছিল কিছু কিছু সম্প্রদায়ে, এখন সেটি মহামারির আকার ধারণ করেছে। বিশ্বাস কারও হোক বা না হোক, এটি সত্য।
উনিশশ বিরানব্বই সালে জয়ললিতা মুখ্যমন্ত্রী থাকা কালীন তামিলনাড়ুর সরকার একটি দোলনা-ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। অনাকাঙ্ক্ষিত মেয়েশিশুদের ওই দোলনায় রেখে যাবে লোকেরা। কিন্তু সাতাত্তরটি শিশু সে বছর দোলনায় জোটে বটে, দত্তক দেওয়ার আগে বেঁচে থাকে মাত্র কুড়িটি। এই ব্যবস্থার প্রতি কারও আর আস্থা থাকেনি। উনিশশ তিরানব্বই সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর অবধি দেখা গেছে তামিলনাড়ুর ওই অঞ্চলে এগারোশ চুরানব্বইটি মেয়ে শিশু জন্ম নেয়, একশ ছাপ্পান্নটি মেয়েশিশুকে হত্যা করা হয়েছে, ২৪৩টি মেয়েহত্যা রোধ করা হয়েছে, আর দোলনায় জুটেছে মাত্র সাতটি শিশু। দোলনা প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়।
ভারতের উত্তরাঞ্চলের চেয়ে দক্ষিণাঞ্চলে চিরকালই মেয়েদের মর্যাদা তুলনায় বেশি ছিল। কেরালায় এমনকী মাতৃকুলভিত্তিক সমাজ ছিল এক সময়। মায়ের সম্পত্তি মেয়ে পেত। বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর বাড়ি ঘর করতে যেত না। নিজের বাড়িতে দাপট নিয়ে থাকতো, স্বামী এসে মাঝে মাঝে কিছুদিন কাটিয়ে যেত। ওই মাতৃকুলভিত্তিক সমাজ ভেঙে গেলেও কেরালায় মেয়েদের মান মর্যাদা ভারতের অন্য যে কোনও রাজ্য থেকেই বেশি ছিল। ছেলের অনুপাতে মেয়ে বেশি ছিল। মেয়েরা শিক্ষিতও বেশি, স্বনির্ভরও বেশি। মেয়েদের এমন স্বর্গরাজ্য কেরালাতেও এখন মেয়েহত্যা চলছে। তামিলনাডু, অন্ধপ্রদেশ, কর্নাটকও বদলে যাচ্ছে। বিশেষ করে তামিলনাড়ু। এই রাজ্যের কিছু গ্রামে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হচ্ছে মেয়েদের, সম্ভব হলে জন্মানোর আগে, সম্ভব না হলে পরে। উসিলামপত্রি, সালেম, ধরমপুর, উত্তর আরকট, পেরিয়ার, দিন্দিজ্ঞুল, মাদুরাই অঞ্চলগুলো মেয়েশিশুহত্নঅঞ্চল বলে চিহ্নিত। তামিলনাড়ুর কিছু অঞ্চলে মেয়েশিশুকে হত্যা করার একটি নাকি ঐতিহ্যই আছে। মা ঠাকুরমারা সদ্যজাত কন্যার মুখে দুধের ফোঁটা দেয়, যে দুধে মিশিয়ে দেয় হলুদ করবীর গুঁড়ো। যারা খুব বিত্তানী বিশ্বাসী, তারা দুধের সঙ্গে কিছু ঘুমের ওষুধ গুঁড়ো করে মিশিয়ে দেয়, নয়তো সামান্য কীটনাশক। মেয়েশিশু হত্যা কেবল ওই কিছু অঞ্চলেই নয়। ঐতিহ্যটি যেন দেশ জুড়েই। তবে হত্যার পদ্ধতিটি একেক জায়গায় একেকরকম। গুজরাটে মায়েরা তাদের কন্যাদের দুধের মধ্যে ডুবিয়ে মারে, আর পাত্তাবে মাটির হাঁড়িতে কন্যাকে পুরে সেই হাঁড়ির ঢাকনা ভালো করে বন্ধ করে হাঁড়ি মাটির তলায় পুতে রাখে। অনেকে জানে না যে মেয়েশিশু হত্যা কোনও অপরাধ। এটিকে খুব স্বাভাবিক কাজ বলেই অনেক সম্প্রদায়ের ধারণা।
শিশুহত্যা নৃশংস। আজকাল আবার থানা পুলিশের ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। তাই সবচেয়ে নিরাপদ মেয়েভ্রুণ হত্যা। যেহেতু দেখতে নৃশংস নয়, অপরাধবোধের প্রশ্ন ওঠে না। স্ক্যানিং এখন সস্তায় করা যাচ্ছে। গহন গ্রামের ভেতরেও ঢুকে গেছে লিঙ্গ নির্ণয় আর গর্ভপাতের সব রকমের আধুনিক ব্যবস্থা। আগে মানুষ মন্দিরে মন্দিরে দৌড়োতো ভগবানের কাছে ছেলে চাইতে, সাধু সন্ন্যাসীর পেছনে টাকা ঢালতে হত, এখন আর তুকতাকের দরকার নেই, ভগবানের চেয়েও শক্তিশালি মাধ্যম এসে গেছে ভারতে, বিজ্ঞান। স্ক্যান মেশিন, অ্যামনিওসেনথেসিস, এবং আরও কিছু বৈত্তানিক পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ুর ভ্রূণের লিঙ্গ দেখে, ‘ঠিক লিঙ্গ’ না হলেই জরায়ু থেকেই বিদায়। ঠিক লিঙ্গ পুং, বেঠিক লিঙ্গ স্ত্রী। সুস্থ লিঙ্গ পুং, পঙ্গু লিঙ্গ স্ত্রী।
তামিলনাড়ুর মেয়েরা স্বীকার করছে তারা তাদের কন্যাদের হত্যা করছে, মোটেও তারা দুঃখিত নয় এ কাজে। একটুও অনুশোচনা কেউ করছে না। ক্রোধী ক্রোন্দসীরা বলছে, ‘তোমরা কী চাও? কী করবো আমাদের মেয়েদের? কেন তাদের আমরা বাঁচতে দেব? যেন নির্যাতিত হয়, যেমন আমরা হচ্ছি? যেন যন্ত্রণায় ভোগে জীবনভর, যেমন আমরা ভুগছি?’
সমাজে মেয়েরা এই শিক্ষা পেতে পেতে বড় হয় যে মেয়েদের জীবনের আদৌ কোনও মূল্য নেই, পুরুষকে সুখী এবং তৃপ্ত করতে না পারলে মেয়েরা অক্ষম অথর্ব এবং অর্থহীন জীব হিসেবে সামাজিক নিন্দা ঘৃণার শিকার হবে। এ তো সত্যিই যে, মেয়েদের বোধ বুদ্ধি বিচক্ষণতার, দক্ষতা পারদর্শিতার কোনও মূল্য দেওয়া হয় না, মেয়েদের যৌনতাকে পণ্য করা হয়, চরিত্রকে দুর্বল বলে ভাবা হয়, মেয়েদের জাতটাকেই ‘নিচু জাত’ বলে বিশ্বাস করা হয়। মেয়ে হয়ে জন্মালে কীরকম দুর্বিষহ হয়ে ওঠে জীবন, তা জেনে বুঝে মেয়েরা কেবল পুত্রসন্তান চাইছে, কোনও কন্যা সন্তান চাইছে না। পারিবারিক এবং সামাজিক চাপই মেয়েদের বাধ্য করছে কন্যাহত্যা বা কন্যাভ্রুণহত্যা করতে। মেয়েরা এই হত্যাযজ্ঞে অংশ গ্রহণ করছে ঠিকই, কিন্তু দোষ কেন তাদের দেব! তারা এই খেলায় ঘুঁটি মাত্র। আইনে এই হত্যা অপরাধ। সত্যিকার অপরাধিকে শাস্তি না