মানুষ আর মানুষ নেই

খবরটা এরকম, ‘অন্তঃসঙ্গে্বা স্ত্রী ভাত বেড়ে দিয়েছিল। খেতে বসে স্বামী দেখলো, ভাতে একটা চুল। খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লো

খবরটা এরকম, ‘অন্তঃসঙ্গে্বা স্ত্রী ভাত বেড়ে দিয়েছিল। খেতে বসে স্বামী দেখলো, ভাতে একটা চুল। খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লো স্বামী আকের শেখ। স্ত্রী জ্যোৎস্নাবিবিকে চুলের মুঠি ধরে মারতে মারতে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দিল।’ মুর্শিদাবাদের এক গ্রামে ঘটেছে ঘটনাটা। শুনে আমার কিছু চেনা লোক বললো, ‘মুসলমানরা মানুষ না। এরাই পারে এসব জঘন্য কাজ করতে।’ তাকে আমি আর তাপসী মালিকের ঘটনা স্মরণ না করিয়ে বরং সেদিনেরই আরেকটা খবর বললাম, ‘প্রেমিকা সুমনা বসু কথা শোনেনি, তাই তার গলায় ক্ষুর চালিয়েছে প্রেমিক অভিষেক চৌধুরী।’ চেনা সেই লোকদের আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম, ‘হিন্দু মুসলমানের ব্যাপার নয় এগুলো। এগুলো লিঙ্গবৈষম্যের ব্যাপার। নারীকে পুরুষের দাসী এবং যৌনবস্তু ভাবার যে মানসিকতা, সেই মানসিকতার ব্যাপার। সব ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যেই নারীকে অপদস্থ করা, অবহেলা করা, এবং অপমান করার সবরকম পরিবেশ আছে।’

 

চেনা লোকগুলো চলে গেল। আমার কথার তারা কতটুকু বুঝলো কী বুঝলো জানি না। যদি বাসটিতে ওরা থাকতো, আমার বিশ্বাস, ওরাও আর সবার মতোই আচরণ করতো, নীরবে দেখতো সব, কিছু বলতো না। সেই বাসটির কথা বলছি, যে বাসে একটি মেয়েকে যৌন হেনস্থা করছিল দুটো ছেলে, দেখেও বাসের কেউই প্রতিবাদ করেনি, শুধু জগন্নাথ আর শুভেন্দু নামের দুজন প্রতিবাদ করতে এগিয়ে এলে দুটো ছেলের সঙ্গে বাসের চারটে ছেলে যোগ দিয়ে জগন্নাথদের বীভৎস ভাবে মারছিল। মার যখন খাচ্ছে, বাসের সবাই চুপ করে বসে ছিল। প্রতিবাদ করেনি। এমনকী তখনও প্রতিবাদ করেনি যখন চোখের সামনে দেখলো যে ছটি ছেলেকে বাস থেকে জোর করে নামিয়ে দেওয়া হল এবং ভালো করেই বুঝলো যে নামিয়ে দিলে খারাপ ছেলেগুলো ভালোগুলোকে আরও নির্বিঘ্নে মারতে পারবে, এমনকী প্রাণেও মেরে ফেলতে পারে।

 

যৌন হেনস্থাকে এই ভারতীয় উপমহাদেশেই ‘ইভ টিজিং’ বলা হয়। সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট বা যৌন হেনস্থার মতো ভয়াবহ কুৎসিত জিনিসকে ‘ইভ টিজিং’ আখ্যা দিয়ে একে রোমান্টিসাইজ করার পেছনের কারণটি কি এর ভয়াবহতা কায়দা করে কমিয়ে দেওয়া নয়? রোমান্টিক জুটি আদম-ইভএর ইভকে তুলে এনে তার সঙ্গে টিজ বা খুনসুটি করাকে খুব মন্দ কিছু মনে হওয়ার কোনও কারণ নেই, বরং শুনলে যে কারও মনে হবে দারুন রোমান্টিক। রোমান্টিক বলেই তো ভারতীয় চলচ্চিত্রে নায়িকার পেছনে লাগা, শিস দেওয়া, চোখ টেপা, বিরক্ত করা পুরুষগুলোকে রীতিমত হিরো হিসেবে দেখানো হয়, এবং নায়িকার সঙ্গে দিব্যি তাদের প্রেমও হয়ে যায় আর অচিরে দুজন হাত পা ছুড়ে নাচতে শুরু করে আর কোটি কোটি ভারতীয় দর্শকের হৃদয়ে অনাবিল শান্তির বর্ষণ শুরু হয়। এই ভারতবর্ষে যৌন হেনস্থা কী কারণে অপরাধ বলে বিবেচিত হবে, শুনি? যে ছেলেরা যৌন হেনস্থা করছে, তারা তো একে ‘স্বাভাবিক’ জেনেই করছে, বাসভর্তি লোকেরা যখন প্রতিবাদ করে না, বরং দুচারজন এগিয়ে আসে যৌন হেনস্থাকারীর পাশে, তখন তো আরও তারা নিশ্চিত হয় যে, কাজটা তারা ভালো বই মন্দ করছে না। মুখ বুজে বসে থাকা যে একধরনের সমর্থন, তা যেমন হেনস্থাকারীরা জানে, তেমন মুখ বোজাগুলোও জানে।

 

ভদ্রলোকেরা বেশ অবাক বনছেন, বাসের কেউ কেন প্রতিবাদ করেনি! আমার বিশ্বাস প্রতিবাদ ওই বাসের পুরুষেরা করেনি, কারণ ছেলে দুটো ওই একলা মেয়েটিকে যখন হেনস্থা করছিল, ওরা খুব উপভোগ করছিল। উপভোগ করছিল বলে প্রতিবাদ করা হয়ে ওঠেনি। আর যে নারীরা প্রতিবাদ করেনি, তারা, খুব স্বাভাবিক যে নিজেরা হেনস্থা হওয়ার ভয়ে করেনি। এবং তারা হেনস্থা হলে বাসের ভেতর থেকে যে কোনও প্রতিবাদ হবে না, এ অনুমান করতে নিশ্চয়ই তাদের কোনও অসুবিধে হয়নি।

 

হেনস্থার প্রতিবাদ যে করে, সে নির্বিবাদে মার খায়। তার মার খাওয়ার বিরুদ্ধেও কেউ কিছু বলে না। ‘সাহস হয় না’ তা আমি মানি না। দেশের লোক নানা কাজে ‘সাহস’ দেখাচ্ছে। দেদারসে দুর্নীতি করছে, সাহস হচ্ছে না? সোনাগাছিতে লাইন দিচ্ছে? সাহস না থাকলে দিতে পারে? পরস্ত্রীর ওপর মারের ভয় না করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, সাহস নেই কে বলে? বাচ্চা মেয়েকে ফুসলিয়ে যৌন নির্যাতন করতে যে সাহসের দরকার হয়, সেটি তো আছে। আইনের চোখে অপরাধ জেনেও এই যে গৃহনিগ্রহ, নারী পাচার, গণধর্ষণ, শিশুধর্ষণ, যৌন হেনস্থা দিনের পর দিন করে যাচ্ছে পুরুষেরা, তা কি সাহস ছাড়া আপনাতেই হয়ে যাচ্ছে নাকি? এই পশ্চিমবঙ্গে নারীনিগ্রহের হার অন্য রাজ্যের তুলনায় বেশি। আর বাসে বসা প্রতিবাদ না করা লোকগুলোকে কী কারণে ভাবা হচ্ছে যে তারা বউ পেটায় না, যৌন নির্যাতন করে না, নারী পাচারের সঙ্গে যুক্ত নেই এবং যৌন হেনস্থাকে তারা অপরাধ বলে মনে করে? আমার তো বিশ্বাস তারা ওই দুটো ছেলের সঙ্গে তো মনে মনে যোগ দিয়েছেই, বাসের অপরিসর জায়গায় সংঘবদ্ধ যৌন হেনস্থা সম্ভব হয়নি বলে বরং মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে, এবং স্থান সংকুলান হলে হেনস্থা তো সাধ মিটিয়ে করতে পারতোই, আর, গণধর্ষণের আয়োজন হলে হাসিমুখে অংশগ্রহণ করতে একেক জন হয়তো মরিয়াও হয়ে উঠতো।

 

‘সাহস নেই, ভীরু, ভীতু’, ইত্যাদি


Rx Munna

447 Blog posts

Comments