কলামে মেয়েদের অধিকার এবং স্বাধীনতা বিষয়ে দীর্ঘদিন হল লিখছি। পাঠকের প্রতিক্তিয়া জানতে চেয়েছিলাম একদিন, পত্রিকা অফিস থেকে জানিয়ে দেওয়া হল আমার লেখার সবচেয়ে বেশি নিন্দা করছে মেয়েরা। ‘যার জন্য করি চুরি, সেই বলে চোর।’ নাহ, আমার জন্য এই দুঃসংবাদটিও নতুন কিছু নয়।
আমাকে অনেকে বলেছে, ‘মেয়েদের দোষের কথা কিছু লেখো তো।’ সবচেয়ে মজার কথা, মেয়েরাই বলেছে।
‘মেয়েদের আবার দোষ কী?’ আমি বলি।
‘ওদের কোনও দোষ দেখ না?’ চোখ কপালে তুলে মেয়েরা বলে। ‘ভিকটিমদের আবার দোষ কী!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি।
ভিকটিমদের দোষ না লিখলে আমার উপায় নেই। পুরুষরাও বলছে, মেয়েদের দোষের কথা লিখতে। মেয়েরাও বলছে। কিছুদিন আগে নবনীতা দেবসেনএর সমালোচনা করে আমি যে লেখাটা লিখেছি, সেটির জন্য নারী ও পুরুষ উভয় পক্ষ থেকেই যত বাহবা আমি পেয়েছি, অন্য কোনও লেখার জন্য তত পাইনি। যারা মেয়েদের দোষের কথা আমি লিখি, চায়, সেই নারী এবং পুরুষের মধ্যে আমি কোনও তফাৎ করতে পারি না। তাদের ভাষা একই রকম, একই রকম ইঙ্গিত। নারী যখন পুরুষের প্রতিনিধিত্ব করে, এবং পুরুষতন্ত্রের সমর্থক এবং সহায়কের ভূমিকায় সক্তিয়, তখন নারী আর পুরুষকে আলাদা করে চেনা যায় না। পুরুষতন্ত্র মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, নারীর এত সহায়তা না পেলে, এত সহযোগিতা আর সাহায্য না পেলে শুধু পুরুষের ষড়যন্ত্রে এবং চক্তান্তে, শুধু পুরুষের বুদ্ধিতে ও শক্তিতে টিকে থাকতে পারতো না।
বউ শাশুড়ির ঝগড়ার কথা ভারতীয় উপমহাদেশেই শুনি। যে সমাজে শ্বশুরবাড়িতে মেয়েরা থাকে না, এবং মেয়েরা অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর, এবং লিঙ্গবৈষম্যের শিকার নয়, সেখানে বউ শাশুড়ির মধ্যে তো কোনও ঝগড়া হয় না! ঝগড়ার পেছনে পরনির্ভরতা এবং পিতৃতন্ত্রের একটা বড় ভূমিকা আছে।
এখানকার সংস্কৃতিটা হল বিয়ে হওয়ামাত্র স্বামীর সঙ্গে সে্বামীর বাড়িতে বা শ্বশুরবাড়িতে জীবন যাপন করতে হবে মেয়েদের। শ্বশুরবাড়িতে, শ্বশুর তো বটেই, শাশুড়িও, যেহেতু তারা স্বামীর আত্মীয়, স্বামীর প্রতিনিধি। পুরুষের প্রতিনিধিত্ব যে করে, মোষ হোক, মুষিক হোক, সমান জোর। পিতৃতন্ত্রকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পুত্র যদি অপারগ হয়, তবে পুজ্ঞের হয়ে পুজ্ঞের মা-ই তা সাধন করে। বউ হচ্ছে আপাতত দাসী। শুরুটা করতে হয় দাসত্ব দিয়ে। দাসত্ব যদি নির্ভুলভাবে করে যেতে পারে, তবেই হবে তার প্রতিনিধিত্বে উত্তরণ। কোনও কোনও সংসারে পুরুষেরা নিজের মায়ের বদলে স্ত্রীকে নিজের প্রতিনিধি নির্বাচন করে, সেখানে কিন্তু শাশুড়ির হাল মোটেও সুবিধের নয়। ঝগড়াটা মূলত পুরুষটায় আমার অংশ বেশি তোমার অংশ কম, এ নিয়ে। যে সমাজে লিঙ্গবৈষম্য নেই, সে সমাজে পুরুষ নিয়ে কাড়াকাড়িটা হয় না। কারণ পুরুষ যে মূল্য ধরে, নারীও একই মূল্য ধরে। পরনির্ভর মেয়েদের লড়াই করতে হয়, যার ওপর নির্ভরশীলতা, তার মনোরঞ্জন করে খানিকটা অনুকম্পা বেশি পাওয়ার জন্য। এ অনেকটা বেঁচে থাকার লড়াই।
ভাই ভাইয়ের হিংসা, শ্বশুর জামাইয়ের ঝগড়া, ভায়রা ভাইদের দ্বন্দ্ব, কাকা ভাইপোর মারামারি, স্বামী প্রেমিকের তাজ্জব — তুমুল হলেও এগুলো নিয়ে নিন্দা করার লোক নেই। কিন্তু মেয়েদের মধ্যে সামান্য কথা কাটাকাটি হলেই ছিছিত্তার। যেন মেয়েদের হতে হবে এই জগতের বাইরের কিছু। মেয়েদের আমরা পাকে ফেলবো, পজ্ঞে ডোবাবো, কিন্তু থাকতে হবে তাদের পূত পবিত্ত। বলিহারি আহ্লাদ।
মেয়েদের হাই প্রোফাইল ঝগড়াটা (বউ শাশুড়ি) একধরনের প্রফেশানাল জেলাসি। পরনির্ভরতা যাদের প্রফেশন, তাদের তো ও করেই খেতে হয়। মেয়েদের পরনির্ভর প্রফেশনিটা কার চাপে হচ্ছে? পিতৃতন্ত্রের চাপে। পিতৃতন্ত্রের কাঠামোটা কাদের তৈরি? পুরুষদের! শুধু তাই নয়, বউ শাশুড়ির ঝগড়ার মূলেও ওই একই জিনিস, পুরুষ। জেলাসি বা ঈর্ষাটা যদি থাকতেই হয়, তবে কর্মক্ষেত্র স্বনির্ভর মেয়েদের একে অপরকে ডিঙিয়ে ওপরে ওঠার প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকুক। সে ক্ষেত্রে পুরুষকে ডিঙিয়ে ওপরে ওঠার প্রতিযোগিতা এবং এই নিয়ে ঈর্ষা হলে তো কথাই নেই।
স্বনির্ভর না হলে, পুরুষের সমকক্ষ না হলে, পুরুষের নিচে অবস্থানকারীদের সঙ্গে মেয়েদের বচসা বেশি হয়। আর এ সমাজে পুরুষের নিচে