নারী-স্বাধীনতা, মানবাধিকার, মানবতা, মুক্ত চিন্তা, মতপ্রকাশের অধিকার, গণতন্ত্র এবং ধর্মমুক্ত জীবনাচরণের সঙ্গে ধর্ম, ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় কুসংস্কার, ধর্মীয় আইন, ধর্মীয় শাসন ইত্যাদির বিরোধ সবচেয়ে বেশি। এই বিরোধ আজকের নয়, যেদিন থেকে ধর্মের আবির্ভাব সেদিন থেকেই। নারীর অধিকারের কথা বলবো, কিন্তু ধর্মীয় মৌলবাদীরা আমার ওপর অসন্তুষ্ট হবে না, সুযোগ পেলে আক্রমণ করবে না, তা তো হতে পারে না। কেউ কেউ বলে, ওদের খোঁচাও কেন, বা উসকে দাও কেন, বা বাড়াবাড়ি করো কেন, তাই তো ওরা ফতোয়া দেয়, বা হত্যা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর অর্থ মৌলবাদের কারণে নারীরা নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হোক, মৌলবাদ সমাজে ত্রাসের সৃষ্টি করছে করুক, মৌলবাদ নারীকে শেকল পরাচ্ছে পরাক, নারীকে অন্ধকারে বন্দি করছে করুক, কিন্তু নারী যেন মুখ বুজে থাকে। মুখ বুজে না থাকলে মৌলবাদীরা আবার নাখোশ হবে, রাগ হবে, গালি দেবে, পাথর ছুঁড়ে মারবে। এর ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, তা তো কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না।
একটা সময় ছিল, যখন জগতে ছিল ধর্মের শাসন, সেই সময়কে বলা হয় ‘দ্য ডার্ক এজেস’ বা ‘অন্ধকার যুগ’। খ্রিস্টানেরা ডাইনি আখ্যা দিয়ে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারতো মেয়েদের। হিন্দুরা মেয়েদের জ্যান্ত পোড়াতো, স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে বাধ্য করতো তাদের, পুরুষের বহুবিবাহ তো ছিলই, উত্তরাধিকার এবং মানবাধিকার থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করা হত, যৌনদাসী আর পুত্র উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবেই শুধু ব্যবহৃত হত মেয়েরা। মেয়েদের জ্যান্ত না পোড়ালেও যৌনদাসী এবং পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করা আর সব ধর্মের মতো ইসলামেরও আদর্শ। জগতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দার্শনিক, যুক্তিবাদী, এবং মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসীরা ধর্মীয় শাসনের সমালোচনা করেছেন, সাম্যের কথা, সমানাধিকারের কথা মুখ ফুটে বলেছেন, এবং তাঁদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা হয়েছে সব কালেই, সব সমাজেই। গ্যালিলিও গ্যালিলেই, জিয়োর্দানো ব্রুনো থেকে শুরু করে বাংলার বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায় সকলের ওপরই আক্রমণ হয়েছে। অন্ধকার সমাজকে যে মানুষই আলোকিত করতে চেয়েছেন, তাদের মুণ্ডচ্ছেদ করার লোকের কোনওকালেই অভাব ছিল না। এখনও নেই।
যুক্তিবাদীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে নৈতিক এবং লৌকিক শিক্ষা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গেলেও এবং রাষ্ট্র ও ধর্মকে পৃথক করার ব্যবস্থা হলেও অধিকাংশ মুসলিম অঞ্চল আজও পড়ে আছে অনেক পেছনে। পুঁজিবাদী শক্তি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের স্বার্থে অনেককাল ধরে ব্যবহার করে আসছে। সাধারণ মানুষকে অজ্ঞতা আর অলৌকিকতার মধ্যে কৌশলে ডুবিয়ে রেখেই স্বার্থসিদ্ধি সম্ভব হয়েছে। মুসলিম শাসকদের স্বৈরাচার, ব্যক্তসি্বার্থ, অদূরদর্শিতা অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রকে এখনও সভ্যতা থেকে আলোকবর্ষ দূরে সরিয়ে রাখছে। মানবাধিকার, মানবতা, নারীর অধিকার, গণতন্ত্র, বাক্ স্বাধীনতার অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। ওখানে যা ঘটছে, তার প্রভাব পড়ছে বিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘু মুসলিম এলাকায়। এর ফলে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার বদলে মানুষ হয়ে উঠছে মৌলবাদী। তা ছাড়াও মুসলিম দেশগুলোয় বৃহৎ পরাশক্তির অহমিকার বোমা-বিস্ফোরণ মুসলিম যুবসমাজকে পথভ্রষ্ট করে মৌলবাদী হওয়ার পথে পা বাড়াতে সাহায্য করেছে। কমিউনিজমের পতনও দিগভ্রান্ত করেছিলো মানুষকে, ধর্মকেই আশ্রয় হিসেবে জেনেছে তারা।
বিপ্লব ছাড়া, গণজাগরণ ছাড়া মৌলবাদের দানবীয় শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করা আজ অসম্ভব। এদের ভয়ে যত কুঁকড়ে থাকবে মানুষ, সভ্যতার সংকট ততই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। বাইরে থেকে যেমন জোর করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না, জোর