বিয়ে : মেধার অপচয় এবং প্রতিভার

তখন নবম শ্রেণীর ছাত্রী, এমন কোনও বয়স নয় যে মাঠে খেলতে যাব না, এমন কোনও বয়স নয় যে মেয়েদের আড্ডায়

তখন নবম শ্রেণীর ছাত্রী, এমন কোনও বয়স নয় যে মাঠে খেলতে যাব না, এমন কোনও বয়স নয় যে মেয়েদের আড্ডায়–অধিকাংশ সময় যেখানে সমবয়সী ছেলেছোকরা নিয়ে নানা আবেগ ও অনুভূতির গল্প হয় সেখানে যোগ দিয়ে আমিও টেবিল চাপড়ে হেসে উঠব না। সেই বয়সে আমার এক সহপাঠীর সঙ্গে প্রতিভার দশ দিক নিয়ে বয়সের চেয়ে গম্ভীর আলোচনায় ডুবে যেতাম, সেই সহপাঠীর নাম আমি বলব না, কেন বলব না তা এই রচনার শেষে বলব। তখন, আমার যদি রবীন্দ্রনাথ শেষ হয় তার হয় শেক্‌সপিয়র, ফরাসি চিত্রকলা নিয়ে কোনওদিন, কোনওদিন জার্মান চলচ্চিত্র, কোনওদিন রুশ সাহিত্য, বিজ্ঞানের নতুন প্রযুক্তি। পাঠ্য বইয়ের নিচে রেখে লুকিয়ে পড়েছি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যা পল সাত্রে। বাবার পায়ের শব্দ শুনে রসায়নবিদ্যা বইয়ের পাতা নেড়েছি দ্রুত। মেয়েটি আমার ঘরে প্রায়ই আসত, অঙ্ক করবার নাম করে সারা বিকেল মুখস্থ করতাম সুধীন দত্ত, টি.এস. এলিয়ট।

 

মেয়েটি স্কুল শেষ করে অধ্যাপক বাবার বদলির কারণে আরেক শহরে চলে গেল কলেজে ভর্তি হতে। সেই থেকে দীর্ঘ বছর একা ছিলাম। খবর পাই, কলেজ পাস করে মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছে। মেয়েটির এমন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, পরিশীলিত রুচি, মেধা ও মননের অগাধ সৌন্দর্য—আমি যে এত মেয়ে দেখেছি, এমন দেখিনি। একদিন এও খবর পাই, মেয়েটি বিয়ে করেছে। মনে মনে আমি ওই প্রেমিক পুরুষটির সৌভাগ্যকে ঈর্ষা না করে পারি না, যে ওই মেয়েটির জীবনের এত নিকটে এসেছে—যে নিকট থেকে তাকে সম্পূর্ণ দেখা যায়।

 

একাডেমিক পরীক্ষার পাট চুকেছে, ঘরের শাসন কিছু কমেছে তখন, বাবা-মা দুহাতে আমন আগলে রাখে না। তাই একদিন মেয়েটির সুখ দেখব বলে যাই এক শহর পেরিয়ে আরেক শহরে, তার ঘরে। ঘর বলতে একটি পাকা মেঝে, চারপাশে দেয়াল, ওপরে টিনের চাল। একটি বিছানা, একটি টেবিল, মেঝেয় কিছু থালাবাসন—এসব দেখবার আগে আমি মেয়েটিকে দেখি। তার গায়ের ফর্সা রং ময়লা হল কি না, তার ডাগর চোখের নিচে কালি পড়ল কি না, চুলে তার অযত্নের জট লাগল কি না, তার শরীরের অলঙ্কার এবং শাড়ি সস্তা ও মলিন কি না সেটি আমার দেখবার বিষয় নয়, অথবা একটি সচ্ছল পরিবার থেকে এসে তার এমন অসচ্ছল জীবনযাপন নিয়ে আমি সামান্য দুঃখিত নই। আমার দৃষ্টি যায় টেবিলের দিকে, দুটো মোমবাতি, একটি পানির জগ, আর একটি বাংলাদেশের ডায়রি ছাড়া কিছু নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, পড়াশোনা করিস না ?

 

সময় পাই না।

 

সময় পাই না কথাটি এমন শোনাল যে সময় না পাওয়ার জন্য তার কোনও আক্ষেপ নেই। আর সময় পেলেই সে ওই কাজটি করবে কি না এ ব্যাপারে মনে হয় তারও সন্দেহ আছে।

 

ছেলেটি কী করে ?

 

একটা দোকান নেওয়ার চেষ্টা করছে।

 

দোকানে কী বিক্রি হবে ?

 

ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি।

 

মেয়েটি চায়ের পানি দিল চুলোয়। আমি কিছুতেই কৈশোরের সেই মেধাবী মেয়েটিকে মেলাতে পারি না, মেয়েটি গল্প করে পাশের গলিতে আর একটি ভাল বাড়ি দেখেছে—সেই বাড়ি এবং ভাড়ার গল্প, গল্প করে কোনও এক শুক্রবারে সে নিউমার্কেট যাবে, বেশ কিছু কাচের বাসনপত্র কিনবে।

 

মেধার অপচয় এবং প্রতিভার পতন দেখে আমি ফিরে আসি। আসবার আগে একবার ভেবেছি জিজ্ঞেস করব—তোর রবীন্দ্রনাথ মনে আছে ? জীবনানন্দ দাশ ? জিজ্ঞেস করি না। এই লজ্জায় জিজ্ঞেস করি না যদি সে বলে এসব কবেকার কথা মনে নেই, মনে নেই। এই মনে নেই-এর জন্য তার স্বরে যদি কোন কষ্ট না থাকে, এই ভয়ে আমি জিজ্ঞেস করি না।

 

এর পর বছর গেছে, খবর পাই তার স্বামী ছেলেটি—যে ছেলেটি একটি ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতির দোকান দেবে বলেছে, রাতে মদ খেয়ে এসে মেয়েটিকে পেটায়। মেয়েটির শরীরে কারও চড়, কারও লাথি এসে পড়ছে—আমি টের পাই মেয়েটি কাঁদছে, মাতাল স্বামীর বমি পরিষ্কার করছে আর কিছু থাল-বাসনের স্বপ্ন দেখছে।

 

একদিন এও খবর পাই, মেয়েটিকে তাড়িয়ে দিয়ে ছেলেটি একটি বিয়ে করেছে। এসবের কোনও কারণ নেই, এসব হল জীবন নিয়ে মজা করা। ছেলেটি মজা চায়, মজা করে। আমার ছেলেবেলার এই বন্ধুটি সমস্ত প্রতিভা ও বৈভব বিসর্জন দিয়ে একটি সংসার চেয়েছিল, পায়নি। আত্মীয়-স্বজন আশ্রয় দেয়, নির্ভরতা দেয় না। আত্মীয়-স্বজন সাত্বনা দেয়, বুকের উত্তাপ দেয় না, আত্মীয়-স্বজন সমাজের কথা বলে, সংসার, সন্তান ও ভবিষ্যতের কথা বলে, ভালবাসার কথা বলে না, মেধা ও প্রতিভা সম্পর্কিত কোনও কথা উচ্চারণ করে না কারণ আমাদের সমাজে শিল্প-সাহিত্য দিয়ে মেয়েদের প্রতিভা বিচার হয় না। ঘরদের পরিষ্কার করা, নিয়মিত কাপড় কাচা, আলনা গোছানো, রান্নায় মসলার পরিমাণ ঠিক হওয়ায় যে সাংসারিক প্রতিভা লক্ষ্য করা যায়, লোকে সেটিকেই মেয়েদের প্রতিভা বিবেচনা করে।

 

এর মধ্যে মেয়েটি চাকরি নিয়েছে। ভাল চেয়ার, ভাল বেতন কিন্তু স্বস্তি নেই। অফিসের লোকেরা মেয়েটির অতীত নিয়ে চমকপ্রদ


Rx Munna

447 Blog posts

Comments