নির্বাচিত কলাম – স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত
‘পতি ধর্ম, পতি কর্ম পতি সারাৎসার।
পতি ভিন্ন রমণীর গতি নাহি আর।
পতি আজ্ঞা, সতী পক্ষে, বেদের সমান।
পতি তুষ্ট হলে, তুষ্ট প্রভু ভগবান।’
বাঙালি গৃহস্থ ঘরের দেওয়ালে এক সময় এ জাতীয় সচিত্র ‘সতীর সার কথা’ সযত্নে শোভা পেত। মেয়েরা রঙিন সুতোয় লিখে রাখত—‘পুরুষ তমাল তরু প্রেম অধিকারী, নারী যে মাধবীলতা আশ্রিতা তাহারি।’ পৃথিবী বার বার আবর্তিত হচ্ছে, তবু পতি প্রাণ, পতি মান, পতিই ভূষণ সেই যে কবে মানুষের মস্তিষ্কের কোষে কোষে গেথে ছিল তা আজও অমলিন।
‘রমণীর পতি বিনা গতি নাই।
পতির বিষয়ে বিশেষ জানাই।
পতি যা বলেন তাহাই করিবে।
পরম যতনে পতিকে সেবিবে।
পতি খেলে খাবে, না খেলে খাবে না।
পতি শুলে শোবে, না শুলে শোবে না।’
এ ধরনের হিতোপদেশ মেয়েরা ধর্মের বাণীর মত মুখস্থ করত। নতমুখে বলত—‘পতির মহিমা আমি কী বণিতে পারি। না পারেন ভাগীরথি, আমি ক্ষুদ্র নারী।’ নারী নিজে মানে সে ক্ষুদ্র। নারী এই কথা অন্ধের মত বিশ্বাস করে যে সে ক্ষুদ্র, অতিশয় ক্ষুদ্র। যে স্বামীভক্তি বা পাতিব্ৰত্য চিত্র সেকালের নারীরা লালন করত, একালের নারীরা তাদের থেকে কোনও অংশে কম যায় না। কত সংস্কার ভাঙে, বদলায়—কিন্তু নারী নিয়ে যে সংস্কার তার কেবল বিস্তার আছে, বিলুপ্তি নেই। স্বামী শব্দের অর্থ প্রভু, মনিব, অধিপতি, মালিক ইত্যাদি। স্বামী শব্দটি বাংলা ভাষায় যতদিন ব্যবহৃত হবে পুরুষ ততদিন সঙ্গত কারণেই কর্তা, প্রভু, মনিব ও মালিক। বেগম রোকেয়া যুক্তি দিয়েছিলেন–‘দাসী শব্দে অনেক শ্ৰীমতী আপত্তি করিতে পারেন। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, স্বামী শব্দের অর্থ কী? দানকর্তাকে দাতা বলিলে যেমন গ্রহণকর্তাকে গ্রহীতা বলিতেই হয়, সেইরূপ একজনকে স্বামী, প্রভু, ঈশ্বর বলিলে অপরকে দাসী না বলিয়া আর কী বলিতে পারেন?’
মানুষকে দ্বিচক্র শকটের সঙ্গে তুলনা করে রোকেয়া তার অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধে লিখেছেন– ‘যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না—সে কেবল একই স্থানে (গৃহ কোণেই) ঘুরিতে থাকে।’
এদেশে বংশ নির্ধারণ হয় পৈত্রিক পরিচয়ের ভিত্তিতে। পৈত্রিক পরিচয়ই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে নারীর সতীত্বের উপর রাখা হয় কড়া নজর তাই যৌন শুচিতা পুরুষের জন্য না হলেও নারীর জন্য প্রয়োজনীয়। এইসব যুক্তি দেখিয়ে সমাজের ধূর্ত লোকগুলো নানা রকম সুবিধে নিচ্ছে, যারা সুবিধে নিচ্ছে তারা ‘স্বামী’ দলভুক্ত।
ধর্ম তাদের যথেচ্ছাচারী করেছে। আদিম থেকে আধুনিক সমাজ–সব সমাজই তাদের বিস্তর সুবিধে দিয়েছে। কারণ এ সবের রচয়িতা এবং নির্মাতা স্বামীদলভুক্ত পুরুষ। ইসলাম তাদের চার বিয়ে করবার অধিকার দিয়েছে। অনিতা নামে পাকিস্তানের এক মেয়ে সেদিন মেয়েদের চারটি বিয়ের কথা বলেছিল। শুনে আঁতকে উঠেছে স্বামীদলভুক্তরা। স্বরচিত আসন আবার টলে যায় কী না কে জানে।
শুধু ইহকালই নয়, পরকালেও নিজেদের ব্যবস্থা আরামপ্রদ করে রেখেছে তারা। সত্তর জন হুর বেষ্টিত জীবন শুধু তারাই ভোগ করবে, আর মেয়েদের কপালে ইহকালের স্বামীটিই জুটবে। যে কোন সচেতন মানুষের জন্য এই পক্ষপাতিত্ব অত্যন্ত পীড়াদায়ক। কিন্তু মানুষ সচেতন নয়। মানুষ সুবিধাভোগী, মানুষ স্বার্থপর। মানুষের স্নায়ুতন্ত্র এখন শুভ কাজে নয়, অশুভ কাজেই বিকশিত হয় বেশি। আর কিছু মানুষ, যাদের মেয়ে মানুষ’ বলতেই মানুষেরা পছন্দ করে, ওরা কেবল হাততালি দেয়। সবার নিচে, সবার পিছে, সবহারাদের কাতারে দাড়িয়ে ওদের কাজ শুধু হাততালি দেয়া। যে যা-ই বলে মেনে নেয়া।
ওরা আসলে মানুষ নয়। ওরা ভোগ্যবস্তু। ‘নারী, সন্তান, রাশিকৃত স্বর্ণরৌপ্য আর চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদি পশু এবং খেতখামারের