আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু
জন্ম : ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ
মৃত্যু : ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ
তাঁকে বলা হয় বিশ্বের অন্যতম বিজ্ঞান পথিকৃৎ। বলা হয়, তিনি নাকি সময়ের আগেই পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। তাঁর যথার্থ বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন এখনও করা সম্ভব হয়নি। তিনি হলেন জগদীশচন্দ্র বসু। সাধারণের মাঝে তিনি পরিচিত
‘গাছের প্রাণ আছে' এই আবিষ্কারের মাধ্যমে। এছাড়াও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁর নিঃশঙ্ক পদচারণা আমাদের অবাক করে দেয়। একাধারে তিনি ছিলেন পদার্থবিদ এবং উদ্ভিদবিজ্ঞানী আমরা সাধারণত ভেবে থাকি, এই দুটি বিষয়ের মধ্যে গোল পার্থক্য আছে। জগদীশচন্দ্র কিন্তু প্রমাণ করেছিলেন, বিজ্ঞানে সব বিষয়গুলি একে অন্যের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত।
আমাদের দুর্ভাগ্য, পরাধীন দেশের বিজ্ঞানী হওয়াতে বিশ্ববিজ্ঞানসভাতে তাঁকে ঠিকাতো মূল্যায়িত করা হয়নি। এখন অবশ্য সারা পৃথিবী জুড়ে আবার নতুন করে ওই বিজ্ঞান-শুরু তাপসের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের পর্যালোচনা হয়েছে। অনেকে বলছেন, কেবল মার্কোনিকে আমরা বেতার তরঙ্গ উদ্ভাবনের জনক হিসেবে স্বীকৃতি দেব না, এরই পাশাপাশি তাঁর নামানে রাখতে হবে।
আশা করি তোমরা বুঝতে পারছ আমরা কার জীবনের কথা বলতে চাইছি? তিনি হলেন বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। গাছের প্রাণ আছে প্রমাণ করে যিনি বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে আলোড়ন তুলেছিলেন। স্থাপন করেছিলেন 'বসু বিজ্ঞান মন্দির'। সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় স্থাপিত এই কেন্দ্রটি আজ ভারতের অগ্রণী বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এসো আমরা জগদীশ চন্দ্রের ছোটোবেলার গল্প শুনে নিই।
তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল ১৮৫৮ স্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর তারিখে। জন্মেছিলেন তিনি বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত ময়মনসিংহ জেলার ওই একই নামের শহরে। জগদীশচন্দ্রের বাবার নাম ভগবানচন্দ্র। ভগবানচন্দ্র ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেছিলেন। সেই বছরই জগদীশচন্দ্রের জন্ম হল আর সেই বছরই ভগবানচন্দ্র ময়মনসিংহ জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ও ক্যালেক্টরের পদে নিযুক্ত হলেন।
জগদীশচন্দ্রের মায়ের নাম বামাসুন্দরী। ভগবানচন্দ্রের আদিনিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগনার রাঢ়িখাল গ্রামে। বসু পরিবার ছিলেন সেখানকার সম্মানিত পরিবার। তখনকার দিনে বিক্রমপুর ছিল শিক্ষাতে অগ্রণী গ্রাম। ভগবানচন্দ্র ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্ম। তখনকার ব্রাহ্ম সমাজে সকলেই ছিলেন স্বাধীনচেতা এবং প্রগতিমনের অধিকারী। ভগবানচন্দ্র এবং বামাসুন্দরী দুজনেই আধুনিক চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন। ছোট্টবেলা থেকেই জগদীশচন্দ্র মা ও তাঁর বাবার কাছ থেকে এই গুণ অর্জন করেছিলেন।
ভগবানচন্দ্রের মহানুভবতা তাঁর কর্মজীবনের বিভিন্ন ঘটনাতে প্রতিফলিত হয়েছে। এসো, তার থেকে একটি রোমহর্ষক গল্প শোনাই। এই গল্পটি শুনলে তোমরা বুঝতে পারবে যে কী ভীষণ আধুনিক মনের অধিকারী ছিলেন ওই ভদ্রলোক! একবার এক দুর্ধর্ষ ডাকাত ধরা পড়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেট ভগবানচন্দ্রের এজলাসে তার বিচার হয়েছিল। সাক্ষ্য প্রমাণে ঘটনার সঙ্গে ওই ব্যক্তির যোগসাজশ প্রমাণিত হল। ভগবানচন্দ্র তাকে কঠিন কঠোর সাজা দিয়েছিলেন। জেল খাটার মেয়াদ শেষ হয়ে গেল। লোকটি নিজের গ্রামে ফিরে গেল। জেলখাটা আসামী, তার ওপর দুর্ধর্ষ ডাকাত। পাড়ার লোক তাকে ঢুকতে দিল না। শেষপর্যন্ত লোকটি এল ভগবানচন্দ্রের কাছে। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আসছে জেলখাটা আসামী এই ব্যাপারটা ভাবতেই পারা যায় না। সব শুনে ভগবানচন্দ্র তাকে নিজের বাড়িতে চাকরি দিয়েছিলেন।
সে ছিল শিশু জগদীশচন্দ্রের একান্ত সহচর। তার কাজ ছিল শিশু জগদীশচন্দ্রডে বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া এবং ছুটির পর বাড়িতে নিয়ে আসা। ডাকাতের কাঁধে চড়ে বালক জগদীশচন্দ্র প্রত্যেকদিন স্কুলে যেতেন। যেতে যেতে ওই ভদ্রলোক তার ডাকাত জীবনের অনেক গল্প বলত। এইভাবেই শিশু জগদীশচন্দ্র বড়ো হতে থাকেন।
সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টে ম্যাজিস্ট্রেট ভগবানচন্দ্র খুবই অসহায় বোধ করতেন। তখন তিনি ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট। সেখানে একটিমাত্র জেলা স্কুল ছিল। জেলার সাধারণ মানুষ এসে ভগবানচন্দ্রকে ধরল সেখানে একটি বাংলা স্কুল স্থাপন করতে হবে। তাদের অনুরোধে ভগবানচন্দ্র একটি বাংলা স্কুল খুলেছিলেন। সেই স্কুলেই বালক জগদীশচন্দ্রকে ভরতি করা হল। তখনকার দিনে ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে সাধারণ বাংলা মাধ্যমের স্কুলে পড়ছে এটি এক আশ্চর্য ঘটনা! উচ্চশ্রেণির সবাই তখন ইংরাজি শিক্ষার দিকে ঝুঁকতেন। সেই ঠুনকো আভিজাত্যের ত্যাগ করে জগদীশচন্দ্রকে বাংলা স্কুলে ভরতি করে দিয়ে ভগবানচন্দ্র প্রমাণ করলেন, সব ব্যাপারেই তিনি নিজের পথেই হাঁটতে চান।
স্কুলে জগদীশচন্দ্রের ডাইনে বসত তাঁর পিতার এক মুসলমান টাপরাশির ছেলে। বাঁদিকে বসত এক ধীবরের ছেলে। তার কাছে বালক জগদীশচন্দ্র পশুপাখি এবং অন্যান্য জী জন্তুর জীবনবৃত্তান্ত শুনতেন স্তব্ধ বিস্ময়ে। এভাবে ছোটো থেকেই তিনি প্রকৃতিপিয়াসী হয়ে উঠেছিলেন।
বিদ্যালয়ে যাতায়াতের পথে পড়ত অজস্র গাছপালা, বনজঙ্গ ল। একদিন জগদীশচন্দ্র স্কুলে যাবার পথে লজ্জাবতী লতা দেখতে পেলেন। তাঁর সহপাঠী ম্যাজিক দেখাবার ছলে ওই লতাকে ছুঁয়ে দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ওই লতাটি নুইয়ে পড়ল। এই ঘটনা বালক জগদীশচন্দ্রকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। এরপর থেকে মাঝেমধ্যেই তিনি লজ্জাবতী লতাকে স্পর্শ করে দেখতেন গাছটি কেমন আচরণ করছে। এই ঘটনা দেখেই তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি গাছেরও প্রাণ আছে? তা নাহলে গাছ এইভাবে স্পর্শানুভূতিতে সাড়া দিচ্ছে কী করে?
পরবর্তীকালে এই বিষয়ে গবেষণা করে তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাহলেই বুঝতে পারছ, ছোট্টবেলার দু-একটি স্মৃতি কীভাবে আমাদের মনকে প্রভাবিত করে। একবার ঠিক করলেন, এবার থেকে আর কাঁধে চড়ে জগদীশচন্দ্র স্কুলে যাবেন না। তাঁর জন্য পিতা একটা টাট্টু ঘোড়া • কিনে দিলেন। ঘোড়ার পিঠে চড়ে বালক জগদীশচন্দ্র স্কুলে চলেছেন, এ এক মজার দৃশ্য বইকি!
সারাদিন নানা কাজে ভগবানচন্দ্রকে ব্যস্ত থাকতে হত। ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর একটা জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার গুরু দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়। তবু যত রাতই হোক, বাড়ি ফিরে এসে জগদীশচন্দ্রের সাথে কথা বলতেন তিনি। ছেলের পড়াশোনার ব্যাপারটা তিনি নিজেই দেখাশোনা করতেন। রাতের খাওয়া শেষ হবার পর তিনি পুত্রকে বিশ্ববিজ্ঞানের নানা কাহিনি শোনাতেন গল্পের ছলে। সমস্ত দিন বালক জগদীশচন্দ্র যা দেখেছেন সব অকপটে বলতেন পিতার কাছে। এভাবেই বয়সের সীমা অতিক্রম করে তাঁরা একে অন্যের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন।
জগদীশচন্দ্র প্রশ্ন করতেন, 'বনচাঁড়াল আর লজ্জাবতী গাছের লতা ছুঁয়ে দিলে নুইয়ে পড়ে। কিন্তু আম, জাম, কাঁঠাল গাছের পাতা তেমন আচরণ করে না কেন?
পিতা জবাব দিতেন—'হয়তো সব গাছের সাড়া দেবার পদ্ধতি একরকম নয়। তবে মুনিঋষিরা বলে গেছেন মানুষ এবং পশুপাখির যেমন প্রাণ আছে, গাছেরও তেমন প্রাণ আছে। তুমি বড়ো হয়ে এ ব্যাপারে আরও জানার চেষ্টা করো।” এভাবেই ভগবানচন্দ্র তাঁর শিশুপুত্রের মনের মধ্যে অনুসন্ধিৎসার আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন।
গাছপালার পাশাপাশি জীবজন্তু সম্পর্কেও বালক জগদীশচন্দ্র অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। পথের ধারে ডোবায় সহপাঠীদের সঙ্গে তিনিও মাছ ধরতেন। বিশেষভাবে লক্ষ্য করতেন, মাছ কেমন করে সাঁতার কাটে। সাঁতার কাটতে কাটতে মাঝেমধ্যে তারা কানকো খোলে আর বন্ধ করে। তাদের চোখের তারা কখনও বন্ধ হয় না।
এরই পাশাপাশি দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি জগদীশচন্দ্রের অনুরাগ গড়ে উঠেছিল। ভগবানচন্দ্র কোনোদিন চাননি যে তার পুত্র কেবল পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। ভারত মহান সভ্যতার ধারক ও বাহক। পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো এই সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সকলেই এই সভ্যতা সম্পর্কে জানবে, একে ভালবাসবে—এটাই ছিল ভগবানচন্দ্রের ঐকান্তিক ইচ্ছে। তাই তিনি ছোটো থেকেই রামায়ণ-মহাভারতের গল শোনাতেন জগদীশচন্দ্রকে। এই সবু মহাকাব্য অবলম্বনে যে যাত্রা হত সেখানে জগদীশচন্দ্রকে নিয়মিত নিয়ে যেতেন। বালক জগদীশচন্দ্রের কাছে রাম ছিলেন আদর্শ চরিত্র। রামের ছোটো ভাই লক্ষ্মণকে তাঁর ভালো লাগত।
মহাভারতের মধ্যে কর্ণ চরিত্রকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন জগদীশচন্দ্র। কর্ণের বীরত্ব তাঁকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। মাঝেমধ্যে গ্রামে যাত্রার আসর বসত। সেখানে প্রত্যেকবার জগদীশচন্দ্র কর্ণ হয়ে অভিনয় করতেন। পরবর্তীকালে যখন তিনি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতিমান হয়েছেন তখনও মাঝেমধ্যে কর্ণের চরিত্রের সংলাপ বলতেন। কর্ণের পাঠ তিনি ঘোর বার্ধক্যেও গড় গড় করে মুখস্থ বলে যেতে পারতেন। এর থেকেই প্রমাণিত হয় ওই চরিত্রটি তাঁকে কীভাবে আকৃষ্ট করেছিল।
কর্ণের আদর্শ তিনি তাঁর পিতার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। দেশবাসীর কল্যাণের জন্য ভগবানচন্দ্র অকাতরে দান করে গেছেন। নিজের ভালোমন্দের কথা চিন্তা করেননি। ভগবানচন্দ্রকে দেখে জগদীশচন্দ্রের মনে হয়েছিল সত্যি সত্যি ভগবানচন্দ্ৰ হলেন এ যুগের কর্ণ! কর্ণের পুরুষকার, বীরত্ব, মহর এবং পরহিতকর ব্রত ভগবানচন্দ্র মনেপ্রাণে অনুসরণ করতেন।
কর্মসূত্রে ভগবানচন্দ্র বর্ধমানে বদলি হয়ে যান। তখন বালক জগদীশচন্দ্রের বয়স মাত্র দশ বছর। ভগবানচন্দ্র ছেলেকে কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভরতি করে দিলেন। পরে সেখান থেকে জগদীশচন্দ্রকে আনা হল সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। এই স্কুলে তখন সাহেবদের ছেলেরা পড়ত। পড়াশোনা হত ইংরাজি ভাষাতে। তাই প্রথম প্রথম বাংলা ভাষায় অভ্যস্ত জগদীশচন্দ্রের খুবই অসুবিধে হত।
কিন্তু দশ বছরের বালক জগদীশচন্দ্রের নিজের ওপর ছিল অসীম আত্মবিশ্বাস। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তিনি ইংরাজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তখন জগদীশচন্দ্র থাকতেন একটি ছাত্রাবাসে। এই ছাত্রাবাসটি ছিল মির্জাপুরে। সে সময়কার ব্রাহ্ম পরিবারের ছেলেরা এখানে থাকা পছন্দ করতেন। ব্রাহ্ম ধর্মের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক আনন্দমোহন বসুর ছোটো ভাই মোহিনীমোহন বসু জগদীশচন্দ্রে। দেখাশোনার ভার বয়েছিলেন। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে ১৬ বছর বয়সে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করলেন। ভরতি হলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। সেখানে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন ফাদার লাফোঁ। ফাদার লাফো হাতেকলমে পদার্থ বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব ছাত্রদের বুঝিয়ে বলতেন। তাঁর ক্লাস করতে খুবই ভালো লাগত জগদীশচন্দ্রের। তিনি তন্ময় হয়ে ফাদার লাফোঁ-র দিকে তাকিয়ে থাকতেন আর ভাবতেন, আমি কবে ওঁর মতো মহান বিজ্ঞানী হতে পারব!
জগদীশচন্দ্র একের পর এক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেন। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে এফ এ এবং ১৮৮০ বি এ পাস করলেন। এইসব পরীক্ষাতে তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে অনামান্য পারদর্শীতার পরিচয় রেখেছিলেন। তারই পাশাপাশি একটি প্রাচীন ভারতীয় ভাষার প্রতিও তাঁর অনুরাগ পরিলক্ষিত হয়। তোমরা শুনলে হয়তো অবাক হয়ে যাবে, সেটি হল সংস্কৃত ভাষা।
এবার ঠিক করা হল, জগদীশচন্দ্রকে বিলেতে পাঠাতে হবে। ভগবানচন্দ্রের আর্থিক সামর্থ্য তখন পড়তির দিকে। স্বাস্থ্যের কারণে তিনি দীর্ঘদিনের জন্য ছুটি নিয়েছেন। বিলেতে পাঠাবার মতো স্বচ্ছলতা ভগবানচন্দ্রের ছিল না। জগদীশচন্দ্রের বয়স তখন মাত্র বাইশ বছর। তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বাবাকে আর্থিক দিক থেকে সাহায্য করা উচিত। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে তিনি ভাবলেন, বিলেতে গিয়ে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। ভগবানচন্দ্র নিজে ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি জানতেন পরাধীন সরকারের অধীনে চাকরি করার কত ঝামেলা। তাই তিনি পুত্রকে এই চাকরি করতে দিতে চাননি।
এভাবে কাজ করতে গেলে বিবেকের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করতে হয়। বিদেশি শাসক শক্তি যা বলে তাই শুনতে হয়। একজন স্বাধীনচেতা ভারতবাসী হিসেবে এমন কাজ করতে হয় যা কখনোই করা উচিত নয়। তখন জগদীশচন্দ্র প্রস্তাব দিলেন যে তিনি বিলেতে গিয়ে ডাক্তারি পড়বেন। এতে পিতা সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু অসুবিধা দেখা দিল আর্থিক দিক থেকে। তখনকার দিনে বিলেতে থেকে ডাক্তারি পড়ার খরচ অনেক ছিল। শেষপর্যন্ত স্থির হল মায়ের কিছু গয়না বিক্রি করা হবে। মাও কিন্তু ছেলের বিলে যাওয়াতে প্রথমে মত দিহে পারেননি। তাঁর ছোটো ছেলেটি দশ বছর বয়নে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে। জগদীশচন্তই তখন Tা-বাবার স্নেহ-একমাত্র সম্বল।
জগদীশচন্দ্র মায়ের স্থাপত্তিতে খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। তবে শেষ অবধি মা জগদীশ৷ ন্দ্রের বিলেত যাত্রাতে মত দেন। মায়ের অলংকার আর বিক্রি করতে হয়নি। কেন-না ততদিনে ভগবানচন্দ্র সুস্থ হয়ে উঠে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন।
১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে জদীশান্দ্র বিলেতের পথে পাড়িলেন। সমুদ্র যাত্রা তাঁর কাছে সুখদায় হয়নি। বিলেত যাবার আগে তিনি তাঁর এক জমিদা দুর অনুরোধে আসামে গিয়েছিলেন বাঘ শিকার করতে। সেখানে পৌঁছানোর দ্বিতীয় দিনে জগদীশচন্দ্র মারাত্মক কালাজ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বর এমা সাংঘাতিক হয়ে দাঁড়াল যে সকন সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে কলকাতায় ফিরে যেতে বলল। কিন্তু আসার কোনো উপায় ছিল না। কোে গাড়ি বা পালকি পাওয়া গেল না। শেষ অবধি এক অবা ঘোড়ায় চড়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে জগদীশচন্দ্র কলকাতায় এসে পৌঁছালেন।
ইংল্যান্ড যাহার সময়ও তাঁর জ্বর সম্পূর্ণ ছাড়েনি। সবাই ভেবেছিলেন সমুদ্রযাত্রাতে হয়তো তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু ফল হল সম্পূর্ণ বিপরীত। জগদীশচন্দ্রর জ্বর ক্রমশই বেড়ে চলল। ডাক্তার দেখাতে গিয়ে একদিন তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এই বিলেত যাত্রার সময় দুজন মহিলা তাঁকে সাহচর্য এবং সহানুভূতি দিয়েছিলেন এদের কথা জগদীশচন্দ্র চিরদিন মনে রেখেছিলেন।
লন্ডনে পৌঁছে তিনি মেডিকেল কলেজের প্রথম বার্ষিক শ্রেণিতে ভরতি হলেন। জুওলজি, বটানি এবং অ্যানাটমি নিয়ে পড়াশোনা শুরু হল। তাঁর শরীর তখন একেবারে ভেঙে গেছে। তখনকার দিনে কালাজ্বরের কোনো ওষুধ বের হয়নি। থিয়োরি ক্লাসের পাশাপাশি নির্ণমিত প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে যেতে হয়। ল্যাবোরেটরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে পরীক্ষা করতে হয়। শেষ অবধি অ্যানাটমির অধ্যাপক বললেন, তুমি ডাক্তারি পড়ার ধকল সহ্য করতে পারবে না। বিদেশ বিভুঁইতে এসে তোমার শরীর আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তুমি অন্য কোনো বিষয়ে ভরতি হও।
ডঃ সিংগার ছিলেন বিলেতের এক বিশিষ্ট চিকিৎসক। তিনিও নানাভাবে জগদীশচন্দ্রকে পরীক্ষা করে একই অভিমত পোষণ করলেন। হতাশ জগদীশচন্দ্র ঠিক কর, লন যে, তিনি লন্ডন শহর ছেড়ে দেবেন। কেমব্রিজে গিয়ে বিজ্ঞান পড়বেন। আনন্দমোহন বসু ছিলেন কেমব্রিজের প্রথম ভারতীয় র্যাংলার। তাঁর সুপারিশ নিয়ে জগদীশচন্দ্র বিখ্যাত ক্রাইস্ট কলেজে ভরতি হলেন। এই ঘটনাটি ঘটল ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে।
লন্ডন শহরের আবহাওয়া ছিল অত্যন্ত বিষাক্ত। যেখানে তখন জনবিস্ফোরণ ঘটে গেছে। বাতাস দুর্তি হয়ে উঠেছে। তার পাশাপাশি কেমব্রিজ এক পরিচ্ছন্ন মুক্ত হয়। সেখানকার নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশে জগদীশচন্দ্র স্বস্তি পে লন। তবে জ্বর আগের মতোই আসা-যাওয়া করতে লাগল। মাঝে মধ্যে তিনি নৌকো বাইতে শুরু করলেন। এতে প্রচুর পরিশ্রা হতে লাগল। খিদে বেড়ে গেল। শরীর সবল হল। কিন্তু জ্বর কেবারে পালিয়ে গেল না। প্রথম সপ্তাহে একবার জ্বর হতে লাগল। তারপর দু সপ্তাহে একবার। ইংল্যান্ড প্রবাসের দ্বিতীয় বছর তিনি সম্পূর্ণ সেরে উঠেছিলেন।
কেমব্রিজে এসে জগদীশচন্দ্র বিজ্ঞানে: পাঠ নিয়েছিলেন। প্রথম বছর কারও সাথে মিশতেন না। দ্বিতীয় বছর তাঁর ব্যক্তিত বিকশিত হতে থাকল। কলেজের অন্য ছাত্রদের সঙ্গে মেলামেশা করতে লাগলেন। কলেজের বাইরে যাতায় ত শুরু হল। যোগ দিলেন প্রকৃতিবিজ্ঞান ক্লাবে। সেখানে নিয়মিতভাবে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ পাঠ করতেন। বিজ্ঞানবিষয়ক আলোচনাতে তাঁর বক্তব্য সকলে মন দিয়ে শুনত। এইভাবে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর জীবন তার সম্ভাব্য পরিণতির দিকে এগিয়ে চলল।
বিজ্ঞানের কোন শাখায় পড়বেন সেটা জগদীশচন্দ্র প্রথমে ঠিক করতে পারেননি। বিজ্ঞানের সববিষয় তাঁর ভালো লাগত। তিনি ঠিক করলেন, সব অধ্যাপকের ক্লাস করবেন। পরীক্ষাগারে গিয়ে হাতেকলমে পরীক্ষা করবেন। শারীরবিদ্যায় অধ্যাপক ছিলেন মাইকেল ফস্টার। ভ্রূণ বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন অধ্যাপক বালফুট। জিওলজি অর্থং প্রাণীবিজ্ঞান সন্ধে পাঠ দিতেন অধ্যাপক হিউয়েস এবং তাঁর স্ত্রী। এঁদের সাহচর্য পেয়ে জগদীশচন্দ্র তাঁর জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।
কেমব্রিজে দ্বিতীয় বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে জগদীশচন্দ্র ঠিক করলেন যে, তিনি পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে পড়বেন। পদার্থবিজ্ঞান পড়াতেন লর্ড ব্যালে, রসায়ন পড়াতেন লিভিং এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন ভাইনস আর ফ্রান্সিস ডারউইন। এঁরা সকলেই স্ব স্বক্ষেত্রে এক-একজন দিকপাল ছিলেন।
দ্বিতীয় বছরের শেষের দিকে জগদীশচন্দ্র বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁর ব্যুৎপত্তির পরিচয় দিতে থাকেন। অধ্যাপকদের সঙ্গে তাঁর সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিন বছর পর জগদীশচন্দ্র কেমব্রিজ থেকে ট্রাইপোস পাশ করলেন এবং একই সঙ্গে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এস সি ডিগ্রি পেলেন।
বিলেতের পড়া শেষ হল। এবার স্বদেশে ফিরতে হবে। দীর্ঘ চারবছর তিনি প্রবাসে ছিলেন। ইতিমধ্যে ভগবানচন্দ্রের আর্থিক অবস্থার তেমন একটা হেরফের ঘটেনি। জগদীশচন্দ্র চাকরি করবেন বলে ঠিক করলেন। দেশে ফিরে এসে তিনি তখনকার গভর্নর জেনারেল লর্ড রিপনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। শেষ অব্দি অনেক টালবাহানার পর জগদীশচন্দ্ৰ প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। এইভাবে তাঁর বাল্য এবং কৈশোর কাল অতিক্রান্ত হয়ে যায়। এবার আমরা অন্য এক জগদীশচন্দ্রকে দেখব, জীবনের বিরাট প্রেক্ষাপটে যিনি উজ্জ্বল আলোক শিখার মতো জ্বলে উঠেছিলেন।
সার্থকতাও একদিন এল। দীর্ঘ অক্রান্ত গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন তথ্যের আবিষ্কার করে বিজ্ঞানের ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টি করলেন তিনি। বিদ্যুৎ-তরঙ্গ বিষয়ে তাঁর আবিষ্কার বিশ্বের বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করেছিল। আধুনিক ভারতের বিজ্ঞান সাধনার প্রথম পথিকৃৎ জগদীশচন্দ্র। বেতার গবেষণার কাজেও জগদীশচন্দ্র যখন ব্যস্ত ছিলেন একই সময়ে ইতালিয় বিজ্ঞানী মার্কোনিরও গবেষণার বিষয় ছিল অভিন্ন। বেতার আবিষ্কার করেছিলেন জগদীশচন্দ্ৰ। যদিও দুর্ভাগ্যবশতঃ তার গৌরব লাভ করেছিলেন ১৮৯৬ খ্রিঃ ইতালিয় বিজ্ঞানী মার্কোনি।
জড়ের মধ্যেও জীবন— ভারতীয় দর্শনের এই মূল সত্যটি জগদীশচন্দ্রের বস্তুবাদী পরীক্ষার মাধ্যমে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা তিনি বেশ কিছু সাড়া জাগানো তত্ত্ব
আবিষ্কার করেছিলেন। যেমন নিজের তৈরি পেজোন্যান্ট যন্ত্রের সাহায্যে প্রাণী ও উদ্ভিদের দেহে বৈদ্যুতিক উত্তেজনায় সাড়া দেওয়ার বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখান। ফটোসিন্থেটিক বাবলার ও রেকর্ডার যন্ত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করলেন উদ্ভিদ জগতের চিরকালীন সালে কসংশ্লেষ পদ্ধতি। আবিষ্কার করলেন ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্র। এই যন্ত্রে উদ্ভিদদেহের সূক্ষ্মতম সঞ্চালনকে অনেকগুণ বড় দেখায়। গাছের বৃদ্ধির হারকে দশ হাজার গুণ বাড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করা যায়, যুগান্তকারী এই আবিষ্কার তৎকালীন বিশ্বের প্রথম সারি বিজ্ঞানীদের স্বীকৃতি লাভ করে। পোটোমিটার ও স্ফিগমোগ্রাফ যন্ত্র দিয়ে তিনি উদ্ভিদের মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। জগদীশচন্দ্রের লেখা প্রথম গ্রন্থ 'Responses in the live ing and non-living', ১৯০৬ ও ১৯০৭ সালে তিনি রচনা করলেন ‘উদ্ভিদের সাড়া’ এবং ‘তুলনামূলক বৈদ্যুতিক শারীর বৃত্ত নামে দুটি গ্রন্থ।
মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম পথপ্রদর্শক ছিলেন জগদীশচন্দ্র। বাংলায় রচিত তাঁর নানা বিষয়ের বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলি সাহিত্যেরও অমূল্য সম্পদ রূপে স্বীকৃত। ১৯৩৭ খ্রিঃ ২৩শে নভেম্বর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের জীবনাবসান হয়।