সত্যেন্দ্রনাথ বসু

সত্যেন্দ্রনাথ বসু

জন্ম : ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ
মৃত্যু : ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ

সত্যেন্দ্রনাথ বসু

 

জন্ম : ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ

মৃত্যু : ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ

 

অনেকে তাঁকে বলেন, সদ্যসমাপ্ত বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙাল প্রতিভা। রবীন্দ্রনাথের কথা মনে রেখেও তাঁর এই কথা উচ্চারণ করেন। তিনি হলেন আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু। যিনি গণিতে একশোর মধ্যে একশো দশ পেয়ে রেকর্ড করেছিলেন। যা আজও কিংবদন্তীর বিষয় হয়ে আছে।

 

জন্ম হয়েছিল তাঁর ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ১লা জানুয়ারি তারিখে। বাবার নাম সুরেন্দ্রনাথ বসু। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের একটি দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করতেন। কলকাতা থেকে আটচল্লিশ কিলোমিটার দূরে নদিয়া জেলার বড়ো জাগুলিয়া গ্রামে ছিল তাঁদের আদি বাড়ি। জীবিকার জন্য সুরেন্দ্রনাথ কলকাতায় এসেছিলেন। মায়ের নাম আমোদিনী দেবী।।

 

সত্যেন্দ্রনাথরা এক ভাই, ই বোন। তিনি সবার বড়ো। আট বছর বয়সে বাড়ির কাছে নরমান স্কুলে পড়াশোনা শুরু হয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথের। একসময় রবীন্দ্রনাথও ওই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ছোটোবেলা থেকেই সত্যেন্দ্রনাথ যন্ত্রপাতি নিয়ে খেলতে ভালোবাসতেন। একবার বাবার শখের হাতঘড়িটা খুলে ফেলেছিলেন। অফিস থেকে ফিরে এসে বাবা ছেলের ওই কাণ্ড দেখে তো অবাক। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ কী করেছিস?’ 

সত্যেন্দ্রনাথ একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে বাবাকে বলেছিলেন, “দেখো না বাবা কে টিকটিক করছে তা দেখার জন্য আমি ঘড়িটা খুলেছি।'

বাবা বুঝতে পেরেছিলেন, এই অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে

সত্যেন্দ্রনাথ একদিন মস্ত বড়ো বিজ্ঞানী হয়ে উঠবেন। গরিবার তখন থাকতেন গোয়াবাগানের ২২ নং লেনে তাঁদের নিজেদের বাড়িতে। ছাকাছি নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলে ভরতি হলেন তিনি। সেখান থেকে এলেন হিন্দু স্কুলে। সত্যেন্দ্রনাথ যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তখন পাঠ্যপুস্তক ছিঁড়ে ফেলার এক অদ্ভুত প্রবণতা দেখা গিয়েছিল তাঁর মধ্যে। মা খুব বকুনি দিতেন। সত্যেন্দ্রনাথ বলতেন, মা বই নেই তো কী হয়েছে? গোটা বইটাই আমি মুখস্থ করে ফেলেছি। পরীক্ষা করার জন্য পাশের বাড়ির একটি ছেলের কাছ থেকে মা পাঠ্যপুস্তক চেয়ে এনেছিলেন। প্রথম থেকে শেষ অবধি গড় গড় করে মুখস্থ বলেছিলেন সেদিনের বালক সত্যেন্দ্রনাথ। মা অবাক হয়ে গালে হাত দিয়েছিলেন।

 

শুধু তাই নয়, কোন্ পাতায় কোন্ প্রশ্নের কী উত্তর লেখা আছে তাও সত্যেন্দ্রনাথ মনে রেখেছিলেন। এমনই অবিশ্বাস্য ছিল তাঁর স্মরণশক্তি! আমৃত্যু তিনি এই অসাধারণ মেধা আর স্মৃতিশক্তি নিয়ে কাজ করে গেছেন। মাকেই বেশি ভালোবাসতেন তিনি। মাকে সম্বোধন করতেন ‘তুই’ বলে আর বাবাকে বলতেন 'আপনি'।

 

টেলিফোনের নম্বর যে টুকে রাখার মতো জিনিস সেটা সত্যেন জানতেন না। আসলে একটি নম্বর শুনলেই সঙ্গে সঙ্গে সেটি তাঁর মাথার মধ্যে গেঁথে যেত। একবার প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞানের অধ্যাপকেরা ভেবেছিলেন তরুণ ছাত্র সত্যেনের স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা নেবেন। তাই সংস্কৃত কলেজের -অধ্যাপক অশে৷ক শাস্ত্রীমহাশয় নিজের থেকে তৈরি করা একটি সনেট সত্যেন্দ্রনাথকে শুনিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ বলার পর শাস্ত্রী মহাশয় সত্যেন বসুকে বললেন—'স্যার আপনি কি সনেটটি এখন মুখস্থ বলতে পারবেন?

 

একমুখ হেসে সত্যেনবাবু পুরো সনেটটাই আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। এমন অনেক ঘটনাই আমরা বলতে পারি তাঁর জীবন থেকে। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ। চোদ্দো বছর বয়সে সত্যেন্দ্রনাথ প্রবেশিকা পরীক্ষা দেবেন। পরীক্ষার দুদিন আগে চিকেন পক্সে আক্রান্ত হলেন তিনি। তাই তাঁকে একবছর পরীক্ষা না দিয়ে ঘরে বসে থাকতে হয়েছিল। পরের বছর পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। জীবনে তিনি এই একটিমাত্র পরীক্ষাতে প্রথম হতে পারেননি। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ। সত্যেন বোল ভরতি হলেন স্বনামধন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখানে অধ্যাপক হিসেবে পেয়েছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে।

 

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র ইতিমধ্যেই সত্যেনের প্রতিভার কথা শুনেছিলেন। তিনি সত্যেনকে বেঞ্চে বসতে না দিয়ে নিজের পাশে টুলে বসাবার ব্যবস্থা করলেন। তাঁর মতে, সত্যেনের নতুন করে শেখবার দরকার ছিল না। অন্য ছাত্রদের সঙ্গে বসলে অনাবশ্যক প্রশ্নবাণে সত্যেন তাঁকে বিব্রত করবেন। তাই এইভাবে সত্যেনের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

 

১৯১১ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আই এস সি পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। এই পরীক্ষায় শারীরবিজ্ঞান ছিল তাঁর চতুর্থ বিষয়। তাতে তিনি একশোর মধ্যে একশো নম্বরই পেয়েছিলেন।

 

এবার এলেন বি এস সি ক্লাসে। ভরতি হলেন মিশ্র গণিতে। বি এস সি অনার্স পরীক্ষাতে তিনি প্রথম হয়েছিলেন। এখাে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বিজ্ঞানতাপস মেঘনাদ ছিলেন তাঁ ঘনিষ্ঠ প্রতিযোগী। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় স্থান দখল করতেন।

 

১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ। এম এস সি মিশ্র গণিতের পরীক্ষাতেও একই ফল হল। তিনি আটশোর মধ্যে সাতশো ছত্রিশ নম্বর পেয়ে এমন একটি রেকর্ড করলেন যা আজ অবধি কারোর পক্ষে ভাঙা সম্ভব হয়নি।

 

ইতিমধ্যে তাঁকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে। মেয়ের নাম ঊষাবতী, এগারো বছরের কনে। তাঁর বাবা ছিলেন খ্যাতনামা চিকিৎসক যতীন্দ্রনাথ ঘোষ।

এবার আমরা অন্য সত্যেন বোসকে দেখব। যাঁর মাথায় ছিল এক চলন্ত গবেষণাগায়। পেনসিল হল তাঁর স্ক্রু ড্রাইভার। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, পরাধীন ভারতবর্ষে ফলিত বিজ্ঞানের বিস্তার না ঘটলে ভারতবাসীর জাগতিক উন্নতি সম্ভব নয়। তখন থেকেই তিনি হাতেকলমে নানা বিষয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করেন। বিজ্ঞানের সাম্প্রতিকতম গবেষণাল ধ্যানধারণার কথা সরাসরি জানবেন বলে তিনি জার্মান ভাষা শিক্ষা করেন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে সাহা-বোন অবস্থা সমীকরণ' নামে তাঁর প্রথম গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। এতে তাঁর সহযোগী ছিলেন মেঘনাদ সাহা ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার পদে যোগ দেন। সেখানেই গবেষণাকালে বিখ্যাত জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাঙ্কের তত্ত্বের এক ভ্রান্তি তাঁর চোখে পড়ে। এ বিষয়ে একটা প্রবন্ধও লেখেন। কিন্তু দেশি-বিদেশি সব বিজ্ঞান পত্রিকা থেকে লেখাটি অমনোনীত হয়ে ফেরত আসে সত্যেন্দ্রনাথ বিচলিত হয়ে পড়েন। তারপরই তিনি এক দুঃসাহসী শিদ্ধান্ত নেন। অপেক্ষবাদের জনক আইনস্টাইনের কাছেই পাঠিয়ে দিলেন প্রবন্ধটি। ভারতীয় অধ্যাপকের গাণিতিক ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে বিস্মিত হলেন শতাব্দীশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। ১ হল বিশ্ববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সত্যেন্দ্রনাথের নিঃশঙ্ক পদচারণ।

 

এরই পাশাপাশি আমরা নানাভাবে সত্যেন্দ্রনাথকে দেখতে পেয়েছি। কখনও তিনি হয়ে উঠেছেন সমাজ সচেতক, কখনও 'আবার বিজ্ঞান প্রবন্ধকার। তাঁর সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল বাংলা ভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানকে সাধারণের কাছে পৌঁছে দেবেন। তাই তৈরি করেছিলেন 'বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ'। এখান থেকে নিয়মিতভাবে ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকা প্রকাশিত হত। আজও এং সংস্থাটি নিরলসভাবে বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে কাজ করে চলেছে।

 

অবশেষে পরিণত বয়সে তিনি মহাপ্রয়াত হন ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি। পার্থিব দেহে সত্যেন্দ্রনাথ বসু বেঁচে নেই, কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর তৈরি করা ‘বোসন'। আজও যখন আমরা কোনো কণার গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করি তখন অবশ্যই তাঁর নাম স্মরণ করি। এভাবেই তিনি আমা

দের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।


ALEX SAJJAD

82 Blog posts

Comments