আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
ভূমিকা: জাতীয়তার প্রধান উপাদান মাতৃভাষা। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। এ ভাষায় কথা বলার স্বাধীনতার জন্য আমাদের বহু সংগ্রাম এবং জীবন দিতে হয়েছে। ভাষার জন্য আমাদের প্রথম রক্ত দিতে হয়েছে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে। ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে UNESCO’র সাধারণ পরিষদে মহান ভাষাদিবস একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস ’ ঘোষণা করায় বাংলা ভাষা আজ মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
পটভূমি: পৃথিবীতে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে তার মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর পরই পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার উদ্যোগ নেয়। ১৯৪৭ সালে এক সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু তখনো পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি মানুষ বাংলায় কাথা বলে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলায় ভাষার দাবিতে প্রথম বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। এতে শেখ মুজিব গ্রেফতার হয়। তাই ১১ মার্চ কে তখন “ভাষা দিবস” হিসেবে পালন করা হত। ২১ মার্চ ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্ণর উর্দুকে পাকিস্তানের এক মাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। সাথে সাথে হয় প্রতিবাদ। ২৪ মার্চ ১৯৪৮ সালে আবার ঘোষনা করা হয় “পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম হতে হবে উর্দু”। তখন থেকে শুরু হয় মহাপ্রতিবাদের আন্দোলন। পরিস্থিতি খারাপ দেখে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সমগ্র ঢাকায় ১৪৪ ধারা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় শুরু হয় সভা-মিছিল। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সভা আর মিছিলে মিছিলে ভরে গেলে চালানো হয় গুলি এবং শহীদ হন ছালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউর সহ আরো অনেকে। এরই প্রেক্ষাপটে মাওলানা ভাসানির নেতৃত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা পরিষদ ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে “ভাষা দিবস” পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
স্বীকৃতির উদ্যোক্তা: কানাডান প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন “Mother Language Of The World” সর্বপ্রথম এ ধরনের উদ্যোগ গহণ করে। কিন্তু জাতিসংঘের পরামর্শ মতে তারা বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ ধরনের একটি উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করে। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়ার পর ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব UNESCO এর সদর দপ্তরে পাঠানো হয়। ১৯৯৯ সালের ২৮ অক্টোবর উনেস্কোর সাধারণ পরিষদে শিক্ষা মন্ত্রি একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ’ ঘোষণা করার প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। এ প্রস্তাবের পক্ষে ২৭টি দেশ সমর্থন দেয়। ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে উনেস্কোর ৩১তম সম্মেলনে “২১শে ফেব্রুয়ারি” কে “আন্তর্জাতিক মার্তভাষা দিবস ’ হিসেবে পালনের স্বীকৃতি পায়। এরই হাত ধরে আজ বাংলা ভাষা পৃথিবীর মধুরতম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস: প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালত হবে। বিশ্বের ১৮৮টি দেশ “১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি” তে আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হবে। যার মাধ্যমে বিশ্বের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি ও দেশসহ সকল জাতিই তার মাতৃভাষাকে রক্ষার ও তার ঐতিহ্য বহন করার দৃঢ় শপথে উদ্দীপ্ত হবে।
‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ’ এর তাৎপর্য: সাংস্কৃতির ঐতিহ্য সংরক্ষণের ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য ও বহু ভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না। তা ভাষাগত ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যের উন্নয়ন ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। পারস্পরিক বোঝাপড়া, সহনশীলতা ও সংলাপের উপর ভিত্তি করে বিশ্ব সংহতি আরও জোরদান হবে। তাই ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ মাতৃভাষার উন্নয়ন ও বিস্তারে সচবছেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এতে পৃথিবীর সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিও তাদের ভাষাকে আরো সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হতে উদ্বুদ্ধ করবে। অপর দিকে বাঙালি জাতি হিসেব আমরা পরিচিত হব আন্তর্জাতিক পরিমন্তলে, হব গর্বিত।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপন: প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা তাদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শহীদের বেদিতে শ্রদ্ধাভরে ফুল অর্পণ করি। হৃদয়ের সকল আকুতি পবিত্রতা ও শভ্রতা দিয়ে শহীদের বেদিতে ফুল দিয়ে আমরা উদ্যাপন করি মাতৃভাষা দিবস। আমাদের মত পৃথিবীর ১৮৮ টি দেশেও আমাদের দেশের মত পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। হৃদয়ের সমস্ত শুভ্রতা উৎসারিত করে তারা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে আমাদের ভাষা শহীদদের । এর চেয়ে বড় পাওয়া, বড় চাওয়া আর কি আছে আমাদের? সত্যিই আমরা গর্বিত জাতি। আমরা গর্বিত আমাদের মাতৃভাষার জন্য। শহীদরা আমাদের পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বের সম্মান জনক স্থানে। সার্থক হয়েছে তাদের রক্তদান। আজ বিশ্ব দরবারে সহস্র প্রাণে বেঁজে ওঠে-
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?”
উপসংহার: মাতৃভূমি একটি প্রস্ফুটিত ফুল আর তার সুবাস হচ্ছে মাতৃভাষা। তাই মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার সাথে মানুষ আবদ্ধ হয় বিনি সুতোর মালার এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনের। মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই একটি জাতি লালিত ও বিকশিত হয়। জাতীর ভাব, কল্পনা, আত্মার আকুলতা, ব্যাকুলতা, হৃদয়ের প্রেম ভালোবাসা মাতৃভাষার মাধ্যমেই রূপায়িত হয়। তাই মাতৃভাষা মায়ের মত। আর এই মাতৃভাষাকে যারা কেড়ে নিতে চায়, রক্তের বিনিময়ে হলেও তাদের প্রতিহত করতে হয়। তারই ইতিহাস গড়েছিল আমাদের দামল ছেলেরা। আমাদের এই গৌরভ গাঁথা ইতিহাসটিকে শুধু আমরা নই, বিশ্ববাসিও পালন করে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে।