বিশ্ব ইতিহাসে প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী হিসাবে আল্লাহ পাক আদম (আলাইহিস সালাম)-কে নিজ দু’হাত দ্বারা সরাসরি সৃষ্টি করেন (ছোয়াদ ৩৮/৭৫)। মাটির সকল উপাদানের সার-নির্যাস একত্রিত করে আঠালো ও পোড়ামাটির ন্যায় শুষ্ক মাটির তৈরী সুন্দরতম অবয়বে রূহ ফুঁকে দিয়ে আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করেছেন।(মুমিনূন ২৩/১২; ছাফফাত ৩৭/১১)
অতঃপর আদমের পাঁজর থেকে তাঁর স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করেন।[1] আর এ কারণেই স্ত্রী জাতি স্বভাবগত ভাবেই পুরুষ জাতির অনুগামী ও পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট। অতঃপর স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে একই নিয়মে মানববংশ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। কুরআন-এর বর্ণনা অনুযায়ী প্রথম দিন থেকেই মানুষ পূর্ণ চেতনা ও জ্ঞান সম্পন্ন সভ্য মানুষ হিসাবেই যাত্রারম্ভ করেছে এবং আজও সেভাবেই তা অব্যাহত রয়েছে। অতএব গুহামানব, বন্যমানব, আদিম মানব ইত্যাদি বলে অসভ্য যুগ থেকে সভ্য যুগে মানুষের উত্তরণ ঘটেছে বলে কিছু কিছু ঐতিহাসিক যেসব কথা শুনিয়েসে নির্দেশ অমান্য করায় চিরকালের মত অভিশপ্ত হয়ে যায় (বাক্বারাহ ২/৩৪)। অথচ সে ছিল বড় আলেম ও ইবাদতগুযার। সেকারণ জিন জাতির হওয়া সত্ত্বেও সে ফিরিশতাদের সঙ্গে বসবাস করার অনুমতি পেয়েছিল ও তাদের নেতা হয়েছিল।[2] কিন্তু আদমের উচ্চ মর্যাদা দেখে সে ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে। ফলে অহংকার বশে আদমকে সিজদা না করায় এবং আল্লাহ ভীতি না থাকায় সে আল্লাহর গজবে পতিত হয়। এজন্য জনৈক আরবী কবি বলেন,
لوكان للعلم شرف من دون التقى
لكان أشرف خلق الله إبليسُ
‘যদি তাক্বওয়া বিহীন ইলমের কোন মর্যাদা থাকত,
তবে ইবলীস আল্লাহর সৃষ্টিকুলের সেরা বলে গণ্য হত’।
[1]. নিসা ৪/১; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩২৩৮ ‘বিবাহ’ অধ্যায় ‘নারীদের সাথে সদ্ব্যবহার’ অনুচ্ছেদ। আদম এর মূল উপাদান হ’ল মাটি, তাই তাকে ‘আদম’ বলা হয়। পক্ষান্তরে হাওয়ার মূল হ’লেন আদম, যিনি তখন জীবন্ত ব্যক্তি। তাই তাকে ‘হাওয়া’ বলা হয়, যা ‘হাই’ (জীবন্ত) থেকে উৎপন্ন (কুরতুবী), বাক্বারাহ ৩৫; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/৬২ পৃঃ।
[2]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (বৈরুত:দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) ১/৬৭।
আল্লাহ একদা ফেরেশতাদের ডেকে বললেন, আমি পৃথিবীতে ‘খলীফা’ অর্থাৎ প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই। বল, এ বিষয়ে তোমাদের বক্তব্য কি? তারা (সম্ভবতঃ ইতিপূর্বে সৃষ্ট জিন জাতির তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে) বলল, হে আল্লাহ! আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে আবাদ করতে চান, যারা গিয়ে সেখানে ফাসাদ সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা সর্বদা আপনার হুকুম পালনে এবং আপনার গুণগান ও পবিত্রতা বর্ণনায় রত আছি। এখানে ফেরেশতাদের উক্ত বক্তব্য আপত্তির জন্য ছিল না, বরং জানার জন্য ছিল। আল্লাহ বললেন, আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না (বাক্বারাহ ২/৩০)। অর্থাৎ আল্লাহ চান এ পৃথিবীতে এমন একটা সৃষ্টির আবাদ করতে, যারা হবে জ্ঞান ও ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন এবং নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি ও চিন্তা-গবেষণা সহকারে স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে আল্লাহর বিধান সমূহের আনুগত্য করবে ও তাঁর ইবাদত করবে। ফেরেশতাদের মত কেবল হুকুম তামিলকারী জাতি নয়।
(১) আল্লাহ তাকে নিজ দু’হাতে সৃষ্টি করেছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭৫)।
(২) আল্লাহ নিজে তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিয়েছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭২)।
(৩) আল্লাহ তাকে সকল বস্ত্তর নাম শিক্ষা দিয়েছেন (বাক্বারাহ ২/৩১)।
(৪) তাকে সিজদা করার জন্য আল্লাহ ফেরেশতাদের নির্দেশ দিয়েছেন (বাক্বারাহ ২/৩৪)।
(৫) আদম একাই মাত্র মাটি থেকে সৃষ্ট। বাকী সবাই পিতা-মাতার মাধ্যমে সৃষ্ট (সাজদাহ ৩২/৭-৯)।
ইবলীসের অভিশপ্ত হওয়ার কারণ ছিল তার ক্বিয়াস। সে আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে যুক্তি পেশ করে বলেছিল, ‘আমি আদমের চাইতে উত্তম। কেননা আপনি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দয়ে’ (হিজর ২৯)। মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন বলেন, اول من قاس ابليس ‘প্রথম ক্বিয়াস করেছিল ইবলীস’। হাসান বছরীও অনুরূপ বলেছেন।[আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/৬৬]
ইবলীসকে আল্লাহ মানুষের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ সৃষ্টি করেন এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার হায়াত দীর্ঘ করে দেন। মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুৎ করার জন্য ও তাকে ধোঁকা দেওয়াই শয়তানের একমাত্র কাজ। ‘সে মানুষকে বলে কুফরী কর’। কিন্তু যখন সে কুফরী করে, তখন শয়তান বলে ‘আমি তোমার থেকে মুক্ত। আমি বিশ্বপ্রভু আল্লাহ্কে ভয় করি’ (হাশর ৫৯/১৬)। অন্যদিকে যুগে যুগে নবী-রাসূল ও কিতাব পাঠিয়ে আল্লাহ মানুষকে সত্য পথ প্রদর্শনের ব্যবস্থা অব্যাহত রাখেন (বাক্বারাহ ২/২১৩)। আদম থেকে শুরু করে শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) পর্যন্ত এক লক্ষ চবিবশ হাযার পয়গাম্বর দুনিয়াতে এসেছেন[1] এবং বর্তমানে সর্বশেষ এলাহীগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের ধারক ও বাহক মুসলিম ওলামায়ে কেরাম শেষনবীর ‘ওয়ারিছ’ হিসাবে[তিরমিযী, আহমাদ, আবুদাঊদ মিশকাত হা/২১২] আল্লাহ প্রেরিত অহীর বিধান সমূহ বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দেবার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন (মায়েদাহ ৫/৬৭)। পৃথিবীর চূড়ান্ত ধ্বংস তথা ক্বিয়ামতের অব্যবহিত কাল পূর্ব পর্যন্ত এই নিয়ম জারি থাকবে। শেষনবীর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী পৃথিবীর এমন কোন বস্তি ও ঝুপড়ি ঘরও থাকবে না, যেখানে আল্লাহ ইসলামের বাণী পৌঁছে দেবেন না।(আহমাদ, মিশকাত হা/৪২ ‘ঈমান’ অধ্যায়) এতদসত্ত্বেও অবশেষে পৃথিবীতে যখন ‘আল্লাহ’ বলার মত কোন লোক থাকবে না, অর্থাৎ প্রকৃত তাওহীদের অনুসারী কোন মুমিন বাকী থাকবে না, তখন আল্লাহর হুকুমে প্রলয় ঘনিয়ে আসবে এবং ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে।[মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫১৬ ‘ফিতান’ অধ্যায়] মানুষের দেহগুলি সব মৃত্যুর পরে মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু রূহগুলি স্ব স্ব ভাল বা মন্দ আমল অনুযায়ী ‘ইল্লীন’ অথবা ‘সিজ্জীনে’ অবস্থান করবে (মুত্বাফফেফীন ৮৩/৭, ১৮)। যা ক্বিয়ামতের পরপরই আল্লাহর হুকুমে স্ব স্ব দেহে পুনঃপ্রবেশ করবে (ফজর ৮৯/২৯) এবং চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশের জন্য সকল মানুষ সশরীরে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দরবারে নীত হবে (মুত্বাফফেফীন ৮৩/৪-৬)।
মানুষের ঠিকানা হল তিনটি : ১- দারুদ দুনিয়া। অর্থাৎ যেখানে আমরা এখন বসবাস করছি ২- দারুল বরযখ। অর্থাৎ মৃত্যুর পরে কবরের জগত। ৩- দারুল ক্বারার। অর্থাৎ ক্বিয়ামতের দিন শেষ বিচার শেষে জান্নাত বা জাহান্নামের চিরস্থায়ী ঠিকানা।
অতএব পৃথিবী হল মানুষের জন্য সাময়িক পরীক্ষাগার মাত্র। জান্নাত থেকে নেমে আসা মানুষ এই পরীক্ষাস্থলে পরীক্ষা শেষে সুন্দর ফল লাভে পুনরায় জান্নাতে ফিরে যাবে, অথবা ব্যর্থকাম হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। অতঃপর সেখানেই হবে তাদের সর্বশেষ যাত্রাবিরতি এবং সেটাই হবে তাদের চূড়ান্ত ও চিরস্থায়ী ঠিকানা। আল্লাহ বলেন, ‘মাটি থেকেই আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি। ঐ মাটিতেই তোমাদের ফিরিয়ে নেব। অতঃপর ঐ মাটি থেকেই আমি তোমাদেরকে পুনরায় বের করে আনব’ (ত্বোয়াহা ২০/৫৫)। অতঃপর বিচার শেষে কাফেরদেরকে হাঁকিয়ে নেওয়া হবে জাহান্নামের দিকে এবং মুত্তাক্বীদের নেওয়া হবে জান্নাতে (যুমার ৩৯/৬৯-৭৩)। এভাবেই সেদিন যালেম তার প্রাপ্য শাস্তি ভোগ করবে এবং মযলূম তার যথাযথ প্রতিদান পেয়ে ধন্য হবে। সেদিন কারু প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না (বাক্বারাহ ২/২৮১)।
উল্লেখ্য যে, হযরত আদম (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ১০টি সূরায় ৫০টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[2]
এক্ষণে আদম সৃষ্টির ঘটনাবলী কুরআনে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তার আলোকে সার-সংক্ষেপ আমরা তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
[1]. আহমাদ, ত্বাবারাণী, মিশকাত হা/৫৭৩৭ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায় ‘সৃষ্টির সূচনা ও নবীগণের আলোচনা’ অনুচ্ছেদ।
[2]. যথাক্রমে সূরা বাক্বারাহ ২/৩১-৩৭= ৭; আলে ইমরান ৩/৩৩,৫৯; মায়েদাহ ৫/২৭-৩২= ৬; আ‘রাফ ৭/১১, ১৯, ২৬, ২৭, ৩১, ৩৫, ১৭২-৭৩= ৮; হিজর ১৫/২৬-৪২= ১৭; ইসরা ১৭/৬১, ৭০; ইয়াসীন ৩৬/৬০। সর্বমোট = ৫০টি।
তিনি বলেন, سَنَفْرُغُ لَكُمْ أَيُّهَا الثَّقَلاَنِ ‘হে জিন ও ইনসান! অতিসত্বর আমি তোমাদের ব্যাপারে মনোনিবেশ করব’ (রহমান ৫৫/৩১)। অর্থাৎ একটি বিশেষ মুহূর্তে দুনিয়াতে তোমাদের পরীক্ষা গ্রহণের এই ধারা সহসাই বন্ধ হয়ে যাবে এবং তোমাদেরকে পুনর্জীবিত করে হাশরের ময়দানে একত্রিত করা হবে। সেদিন আমার সুক্ষ্ম বিচারের হাত থেকে তোমরা কেউই রেহাই পাবে না।
জিনদের আল্লাহ আগেই সৃষ্টি করেন আগুন থেকে। তারাও ছিল স্বাধীন এখতিয়ার সম্পন্ন। কিন্তু তারা অবাধ্যতা করেছিল। অনেকে জিনকে চর্ম চক্ষুতে দেখতে পায় না বলে তাদেরকে অস্বীকার করে। অথচ বহু জিনিষ রয়েছে যা মানুষ বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখতে পায় না। তাই বলে তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। যেমন বিদ্যুৎ, বায়ু প্রবাহ, বস্ত্তর স্বাদ ও গন্ধ ইত্যাদি। মানুষের নবীই জিনদের নবী। তাদের মধ্যে মুমিন, কাফির, ফাসিক সবই রয়েছে। জিনেরা যে এলাকায় বাস করে সে এলাকার মানুষের ভাষা তারা বুঝে। নবুঅতের দশম বছরে ত্বায়েফ থেকে ফেরার পথে ‘নাখলা’ উপত্যকায় জিনেরা রাসূলের কণ্ঠে সূরা রহমান শুনেছিল ও যতবারই আল্লাহ فَبِأَىِّ آلاَءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ বলেছেন, ততবারই তারা জবাবে বলেছিল, লা বেশাইয়িন মিন নি‘আমিকা রববানা নুকাযযিবু ফালাকাল হামদ।[তিরমিযী হা/৩৫২২; সনদ হাসান, সিলসিলা সহীহাহ হা/২১৫০] তারা মানুষের কথা শোনে, বুঝে ও উপলব্ধি করে। আল্লাহর কিতাব জিন ও ইনসান সবার জন্য। অতএব তাদের পরিণতি ও মানুষের পরিণতি একই।
বস্তুতঃ আদম ও বনু আদম হল আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয় ও সেরা সৃষ্টি। মৃত্যুকাল অবধি তাকে এ দুনিয়ার পরীক্ষাগারে অবস্থান করতে হবে একজন সজাগ ও সক্রিয় পরীক্ষার্থী হিসাবে। মৃত্যুর পরেই তার ক্বিয়ামত শুরু হয়ে যাবে। ভাল-মন্দ কর্মের সুযোগ আর থাকবে না। তাই আল্লাহ প্রেরিত অহীর বিধান মেনে চলে কল্যাণময় জীবন পরিচালনার মাধ্যমে আল্লাহর সেরা সৃষ্টির মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় হওয়াই বুদ্ধিমান মানুষের কর্তব্য।
মনে রাখতে হবে যে, ‘আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁর দিকেই ফিরে যাব’ (বাক্বারাহ ২/১৫৬)। ‘আমাদের সালাত, আমাদের কুরবানী, আমাদের জীবন, আমাদের মরণ সবকিছুই কেবলমাত্র বিশ্বপ্রভু আল্লাহর জন্য’ (আন‘আম ৬/১৬২)। জান্নাত থেকে নিক্ষিপ্ত বনু আদম আমরা যেন পুনরায় জান্নাতে ফিরে যেতে পারি, করুণাময় আল্লাহ
আমাদের সেই তাওফীক দান করুন- আমীন!!