আল্লাহ বলেন ‘আর স্মরণ করো! তোমার প্রভু যখন ফেরেশতাদের বলেছিল, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি নিয়োগ করব।’ (সূরা বাকারাহ : ৩০।) জীবনের সবক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করাই প্রকৃত মুমিনের প্রধান বৈশিষ্ট। মুমিন চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো ওয়াদা রক্ষা করা। আরবি ‘আহদুন’ অর্থ অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি, ওয়াদা, চুক্তি ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায়, কোন মানুষ অপর মানুষকে দেয়া কথা বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করাকে ওয়াদা বলে। ওয়াদা রক্ষা করা পবিত্র কোরআনের নির্দেশ।
আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘আমার সঙ্গে করা ওয়াদা তোমরা পূর্ণ করো। আমিও তোমাদের সঙ্গে করা ওয়াদা পূর্ণ করব। আর আমাকেই ভয় করো।’ (সূরা বাকারা : ৪০।) অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহ এবং পরস্পরের সঙ্গে করা ওয়াদা পূর্ণ করো। আর আল্লাহকে সাক্ষী রেখে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করো না।’ (সূরা নাহল : ৯১) ওয়াদা রক্ষা করা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার গুণ। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।’ (সূরা আলে ইমরান : ৯ ও সূরা রা’দ : ৩১।) ‘এটা আল্লাহর ওয়াদা। আল্লাহ তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না।’ (সূরা রুম : ৬।)
পবিত্র কোরআনের আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর রঙ। আল্লাহর রঙের চেয়ে আর কার রঙ উত্তম হতে পারে?’ (সূরা বাকারা : ১৩৮।) নবী-রাসুলরা ছিল আল্লাহর রঙে রঙিন। তাইতো তারাও ছিল ওয়াদা রক্ষাকারী সত্যনিষ্ঠ মহা মানব। হজরত ইসমাইল (আ.) সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এই কিতাবে স্মরণ করো ইসমাইলের কথা। সে ছিল ওয়াদা রক্ষাকারী সত্যনিষ্ট নবী এবং রাসুল।’ (সূরা মারয়াম : ৫৪।)
আব্দুল্লাহ ইবনে হাসমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবুওয়াতের পূর্বে আমি রাসুল (সা.) থেকে কিছু দ্রব্য ক্রয় করি এবং বলি আপনি এখানে দাঁড়ান আমি টাকা নিয়ে আসছি। বাড়িতে গিয়ে আমি রাসুল (সা.) এর কথা ভুলে গেলাম। ৩দিন পর মনে হওয়া মাত্রই ওই স্থানে গিয়ে দেখি হুজুর (সা.) দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমাকে দেখে শুধু বললেন, তুমি আমাকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেললে। আমি তিন দিন পর্যন্ত তোমার জন্য এখানে অপেক্ষা করছি।’ (সুনানে আবু দাউদ : ৪৯৯৬, সুনানে কুবারা : ২০২২৯।)
পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে ওয়াদা রক্ষাকারীর প্রশংসা ও মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘প্রকৃত মোত্তাকীরা যখন ওয়াদা করে, তখন তা রক্ষা করে।’ (সূরা বাকার : ১৭৭।) ‘হ্যাঁ! কেউ যদি ওয়াদা রক্ষা করে এবং আল্লাহকে ভয় করে, তবে সে জেনে রাখুক, আল্লাহ এমন খোদাভিরুদের ভালোবাসেন।’ (সূরা আলে ইমরান : ৭৬।)
ওয়াদা রক্ষা না করা কবিরা গুনাহ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ওয়াদা রক্ষা না করার অপরাধে আমি বনি ইসরাইল সম্প্রদায়কে অভিশপ্ত জাতিতে পরিণত করেছি। আর তাদের অন্তরগুলোকে করে দিয়েছি কঠিন।’ (সূরা মায়েদা : ১৩।) ‘তিনি তাদের অন্তরে মুনাফিকি স্থায়ী করে দিলেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার দিন পর্যন্ত। কারণ তারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা রক্ষা করেনি বরং মিথ্যাচার করেছে।’ (সূরা তাওবা : ৭৭।)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুনাফিকের চিহ্ণ ৩টি। যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে খেলাফ করে এবং আমানত রাখলে খেয়ানত করে।’ (বুখারি : ৩৩, মুসলিম : ৫৯।) এ হাদিসের ব্যখায় ইমাম ইবনে রজব (রহ) বলেন, ‘ওয়াদা খেলাফ দুইভাবে হতে পারে। ১. কেউ ওয়াদা করল এবং নিয়ত করল সে তা রক্ষা করবে না। এটা হলো নিকৃষ্ট ওয়াদা খেলাফ। ২. কেউ ওয়াদা করার সময় বলল, আল্লাহ চাহেতো আমি এমনটি করব। কিন্তু মনে মনে না করার সংকল্প করল। তাহলে সে ওয়াদা খেলাফের সঙ্গে সঙ্গে সে মিথ্যাও বলল।
কিশোর সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসুল (সা.) আমাদের বাড়িতে আসলেন। আমার মা আমাকে ডেকে বললেন, এদিকে এসো। তোমাকে একটি জিনিস দেব। রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, হে আমেরের মা! তুমি তাকে কী দেবে? মা বললেন, তাকে একটি খেজুর দেব। রাসুল (সা.) বললেন, তুমি যদি তাকে কিছু না দিতে তবে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যার গুনাহ লেখা হত। (আবু দাউদ : ৪৯৯১, সিলসিলাতুস সহিহা : ৭৪৮।)
জীবন চলার পথে প্রতিনিয়ত আমরা একে অন্যকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি এসব প্রতিশ্রুতি এবং ওয়াদা রক্ষা করা একান্ত কর্তব্য। এ ব্যাপারে সামন্যতম শৈথিল্য প্রদর্শনও দুনিয়া-আখেরাতে মুসীবতের কারণ হতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা ওয়াদা রক্ষা কর। ওয়াদা রক্ষার ব্যপারে তোমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে।’ (সূরা বনি ইসরাঈল : ৩৩।) আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ধ্বংস তার জন্য! যে ওয়াদা করল অতঃপর তা রক্ষা করল না।’ (মু’জামুল আওসাত : ৩৬৪৮, তারিখে দিমাশক : ৫৬১১৯।