ইতিহাস

ইব্রাহিম (আ.) এর জীবনী

ইবরাহিম (আঃ) - এর পরিচয়

ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ছিলেন হযরত নূহ (আঃ)-এর সম্ভবত: এগারোতম অধঃস্তন পুরুষ। নূহ থেকে ইবরাহীম পর্যন্ত প্রায় ২০০০ বছরের ব্যবধান ছিল। হযরত সালেহ (আঃ)-এর প্রায় ২০০ বছর পরে ইবরাহীমের আগমন ঘটে। ঈসা থেকে ব্যবধান ছিল ১৭০০ বছর অথবা প্রায় ২০০০ বছরের। তিনি ছিলেন ‘আবুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের পিতা এবং তাঁর স্ত্রী ‘সারা’ ছিলেন ‘উম্মুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের মাতা। তাঁর স্ত্রী সারার পুত্র হযরত ইসহাক্ব-এর পুত্র ইয়াকূব (আঃ)-এর বংশধর ‘বনু ইসরাঈল’ নামে পরিচিত এবং অপর স্ত্রী হাজেরার পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে জন্ম নেন বিশ্বনবী ও শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ(ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। যাঁর অনুসারীগণ ‘উম্মতে মুহাম্মাদী’ বা ‘মুসলিম উম্মাহ’ বলে পরিচিত।

 

বাবেল হতে তিনি কেন‘আনে (ফিলিস্তীন) হিজরত করেন। সেখান থেকে বিবি সারা-র বংশজাত নবীগণের মাধ্যমে আশপাশে সর্বত্র তাওহীদের দাওয়াত বিস্তার লাভ করে। অপর স্ত্রী হাজেরার পুত্র ইসমাঈলের মাধ্যমে বায়তুল্লাহ ও তার আশপাশ এলাকায় তাওহীদের প্রচার ও প্রসার হয় এবং অবশেষে এখানেই সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আগমন ঘটে। এভাবে ইবরাহীমের দুই স্ত্রীর বংশজাত নবীগণ বিশ্বকে তাওহীদের আলোয় আলোকিত করেন। শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর দেহসৌষ্ঠব ও চেহারা মুবারক পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর ন্যায় ছিল। যা তিনি মে‘রাজ থেকে ফিরে এসে উম্মতকে খবর দেন।[মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৬৬ ‘মে‘রাজ’ অনুচ্ছেদ]আবুল আম্বিয়া ও সাইয়েদুল আম্বিয়া

ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন ইহুদী-খৃষ্টান-মুসলমান সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পিতা। কেননা আদম (আঃ) হতে ইবরাহীম (আঃ) পর্যন্ত ১০/১২ জন নবী বাদে শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) পর্যন্ত ১ লাখ ২৪ হাযার পয়গম্বরের প্রায় সকলেই ছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

إنَّ اللّهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوْحاً وَآلَ إِبْرَاهِيْمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِيْنَ- (آل عمران ৩৩)-

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম, নূহ, আলে ইবরাহীম ও আলে ইমরানকে বিশ্ববাসীর উপরে নির্বাচিত করেছেন’ (আলে ইমরান ৩/৩৩)। এই নির্বাচন ছিল বিশ্ব সমাজে আল্লাহর তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য। ইবরাহীম ছিলেন নবীগণের পিতা এবং পুত্র মুহাম্মাদ ছিলেন নবীগণের নেতা, এ বিষয়টি সর্বদা মুমিনের মানসপটে জাগরুক রাখার জন্য দৈনিক সালাতের শেষ বৈঠকে পঠিত দরূদের মধ্যে ইবরাহীম ও মুহাম্মাদের উপরে এবং উভয়ের পরিবার বর্গের উপরে আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষণের জন্য দো‘আ করার বিধান রাখা হয়েছে। ইবরাহীমের বংশে বরকত হ’ল নবুঅত ও ঐশী কিতাবের বরকত এবং মুহাম্মাদের ও তাঁর বংশে বরকত হ’ল বিজ্ঞানময় কুরআন ও হাদীছ এবং তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থার বরকত।

 

ইবরাহীম ও তাঁর বংশধর সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

وَوَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوْبَ وَجَعَلْنَا فِيْ ذُرِّيَّتِهِ النُّبُوَّةَ وَالْكِتَابَ وَآتَيْنَاهُ أَجْرَهُ فِي الدُّنْيَا وَإِنَّهُ فِي الْآخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِيْنَ- (العنكبوت ২৭)-

‘আমি তাকে দান করলাম ইসহাক্ব ও ইয়াকূবকে এবং তার বংশধরগণের মধ্যে প্রদান করলাম নবুঅত ও কিতাব। তাকে আমি দুনিয়াতে পুরষ্কৃত করলাম। নিশ্চয়ই পরকালে সে সৎ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আনকাবূত ২৯/২৭)।

অতঃপর শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيراً- (الأحزاب ২১)-

‘যারা আল্লাহ ও শেষদিবসের (অর্থাৎ আখেরাতে মুক্তির) আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক হারে স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের (মুহাম্মাদের) মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে’ (আহযাব ৩৩/২১)। অতঃপর তাঁর পরিবার সম্পর্কে বলা হয়েছে,

إِنَّمَا يُرِيْدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيْراً-(الأحزاب ৩৩)-

‘হে নবী পরিবারের সদস্যগণ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে’ (আহযাব ৩৩/৩৩)। শেষ যামানায় ইমাম মাহদী আসবেন হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর বংশধরগণের মধ্য হতে এ বিষয়ে বহু সহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৪৫৩-৫৪] এইভাবে ইবরাহীম ও মুহাম্মাদের নাম পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্ত দিকে দিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হতে থাকবে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।নবী ইবরাহীম

আদম, ইয়াহ্ইয়া, ঈসা প্রমুখ দু’তিন জনের ব্যতিক্রম বাদে নূহ (আঃ) সহ অন্যান্য সকল নবীর ন্যায় ইবরাহীমকেও আমরা ধরে নিতে পারি যে, তিনি ৪০ বছর বয়সে নবুঅত লাভ করেন। উম্মতে মুসলিমার পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ) পশ্চিম ইরাকের বছরার নিকটবর্তী ‘বাবেল’ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। এই শহরটি পরবর্তীতে সুলায়মান (আঃ)-এর সময়ে জাদুর জন্য বিখ্যাত হয় (বাক্বারাহ ২/১০২)।

এখানে তখন কালেডীয় (كلدانى ) জাতি বসবাস করত। তাদের একচ্ছত্র সম্রাট ছিলেন নমরূদ। যিনি তৎকালীন পৃথিবীতে অত্যন্ত উদ্ধত ও অহংকারী সম্রাট ছিলেন। তিনি প্রায় চারশো বছর রাজত্ব করেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজে ‘উপাস্য’ হবার দাবী করেন।[তারীখুল আম্বিয়া পৃঃ ৬৮] আল্লাহ তারই মন্ত্রী ও প্রধান পুরোহিত ‘আযর’-এর ঘরে বিশ্বনেতা ও বিশ্ব সংস্কারক নবী ইবরাহীমকে মুখ্যত: কালেডীয়দের প্রতি প্রেরণ করেন। ইবরাহীমের নিজ পরিবারের মধ্যে কেবল সহধর্মিনী ‘সারা’ ও ভ্রাতুষ্পুত্র ‘লূত’ মুসলমান হন।

স্ত্রী ‘সারা’ ছিলেন আদি মাতা বিবি হাওয়ার পরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মহিলা। তিনি ১২৭ বছর বয়সে ‘হেবরনে’ মৃত্যু ববণ করেন ও সেখানেই কবরস্থ হন।[তারীখুল আম্বিয়া, পৃঃ ৭৪] সারার মৃত্যুর পরে ইবরাহীম ক্বানতূরা বিনতে ইয়াক্বতিন ও হাজূন বিনতে আমীন নামে পরপর দুজন নারীকে বিয়ে করেন এবং ৬ ও ৫ সন্তান মোট ১১টি সন্তান লাভ করেন।[আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/১৬৪ পৃ:] তিনি প্রায় দু’শো বছর জীবন পান বলে কথিত আছে।

উল্লেখ্য যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ২৫টি সূরায় ২০৪টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[1] নিম্নে আমরা আয়াত সমূহ থেকে নিয়ে সাধ্যতম সাজিয়ে কাহিনী আকারে পেশ করার চেষ্টা পাব ইনশাআল্লাহ্।

1]. যথাক্রমে সূরা বাক্বারাহ ২/১২৪-১৩৩=১০; ১৩৫, ১৩৬, ১৪০, ২৫৮, ২৬০; আলে ইমরান ৩/৩৩, ৩৪, ৬৫-৬৮=৪; ৮৪, ৯৫, ৯৬, ৯৭; নিসা ৪/৫৪, ১২৫, ১৬৩; আন‘আম ৬/৭৪-৮৩=১০; ১৬১; তওবাহ ৯/৭০, ১১৪; হূদ ১১/৬৯-৭৬=৮; ইউসুফ ১২/৬, ৩৮; ইবরাহীম ১৪/৩৫-৪১=৭; হিজর ১৫/৫১-৬০=১০; নাহ্ল ১৬/১২০-১২৩=৪; মারিয়াম ১৯/৪১-৫০=১০; ৫৮; আম্বিয়া ২১/৫১-৭৩=২৩; হজ্জ ২২/২৬, ৪৩, ৭৮; শো‘আরা ২৬/৬৯-৮৯=২১; আনকাবূত ২৯/১৬-২৭=১২; ৩১; আহযাব ৩৩/৭; ছাফফাত ৩৭/৮৩-১১৩=৩১; ছোয়াদ ৩৮/৪৫-৪৭=৩; শূরা ৪২/১৩; যুখরুফ ৪৩/২৬, ২৭; যারিয়াত ৫১/২৪-৩৪=১১; নাজম ৫৩/৩৭; হাদীদ ৫৭/২৬, ২৭; মুমতাহানা ৬০/৪-৬=৩; আ‘লা ৮৭/১৯, সর্বমোট = ২০৪টিসামাজিক অবস্থা

ইবরাহীমের আবির্ভাবকালীন সময়ে কালেডীয় সমাজ শিক্ষা ও সভ্যতায় শীর্ষস্থানীয় ছিল। এমনকি তারা সৌরজগত নিয়েও গবেষণা করত। কিন্তু অসীলা পূজার রোগে আক্রান্ত হয়ে তারা আল্লাহকে পাবার জন্য বিভিন্ন মূর্তি ও তারকা সমূহের পূজা করত। হযরত ইবরাহীম উভয় ভ্রান্ত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে প্রেরিত হন।

 

ইবরাহীম (আঃ)-এর দাওয়াত : মূর্তিপূজারী কওমের প্রতি-

সকল নবীর ন্যায় ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় কওমকে প্রথমে তাওহীদের দাওয়াত দেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

وََإِبْرَاهِيمَ إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاتَّقُوهُ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ، إِنَّمَا تَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ أَوْثَاناً وَتَخْلُقُونَ إِفْكاً إِنَّ الَّذِينَ تَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ لَا يَمْلِكُونَ لَكُمْ رِزْقاً فَابْتَغُوا عِندَ اللَّهِ الرِّزْقَ وَاعْبُدُوهُ وَاشْكُرُوا لَهُ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ-(العنكبوت ১৬-১৭)-

‘স্মরণ কর ইবরাহীমকে, যখন তিনি তার সম্প্রদায়কে বললেন, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁকে ভয় কর। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বুঝ’। ‘তোমরা তো আল্লাহর পরিবর্তে কেবল প্রতিমারই পূজা করছ এবং মিথ্যা উদ্ভাবন করছ। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করছ, তারা তোমাদের রিযিকের মালিক নয়। কাজেই আল্লাহর নিকটে রিযিক তালাশ কর। তাঁর ইবাদত কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তাঁরই নিকটে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (আনকাবূত ৩৩/১৬-১৭)।

ইবরাহীম (আঃ) উক্ত দাওয়াতের মধ্যে কেবল আল্লাহর স্বীকৃতি কামনা করেননি। বরং স্বীকৃতির ফলাফল (ثمرة الإقرار) আশা করেছিলেন। অর্থাৎ তারা যেন আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে মান্য করে এবং কোন অবস্থায় তা লংঘন না করে। কেননা স্বীকৃতির বিপরীত কাজ করা তা লংঘন করার শামিলপিতা ও ইবরাহীম

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيْقاً نَّبِيًّا، إِذْ قَالَ لِأَبِيْهِ يَا أَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لاَ يَسْمَعُ وَلاَ يُبْصِرُ وَلاَ يُغْنِي عَنكَ شَيْئاً، يَا أَبَتِ إِنِّي قَدْ جَاءنِيْ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَمْ يَأْتِكَ فَاتَّبِعْنِيْ أَهْدِكَ صِرَاطاً سَوِيّاً، يَا أَبَتِ لاَ تَعْبُدِ الشَّيْطَانَ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلرَّحْمَنِ عَصِيّاً، يَا أَبَتِ إِنِّيْ أَخَافُ أَن يَمَسَّكَ عَذَابٌ مِّنَ الرَّحْمَن فَتَكُوْنَ لِلشَّيْطَانِ وَلِيّاً-(مريم ৪১-৪৫)-

‘তুমি এই কিতাবে ইবরাহীমের কথা বর্ণনা কর। নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন সত্যবাদী ও নবী’(১৯/৪১)। ‘যখন তিনি তার পিতাকে বললেন, হে আমার পিতা! তুমি তার পূজা কেন কর, যে শোনে না, দেখে না এবং তোমার কোন উপকারে আসে না?(৪২)। ‘হে আমার পিতা! আমার কাছে এমন জ্ঞান এসেছে, যা তোমার কাছে আসেনি। অতএব তুমি আমার অনুসরণ কর। আমি তোমাকে সরল পথ দেখাব’(৪৩)। ‘হে আমার পিতা! শয়তানের পূজা করো না। নিশ্চয়ই শয়তান দয়াময়ের অবাধ্য’(৪৪)। ‘হে আমার পিতা! আমি আশংকা করছি যে, দয়াময়ের একটি আযাব তোমাকে স্পর্শ করবে, অতঃপর তুমি শয়তানের বন্ধু হয়ে যাবে’ (মারিয়াম ১৯/৪১-৪৫)।

অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيْمُ لأَبِيْهِ آزَرَ أَتَتَّخِذُ أَصْنَاماً آلِهَةً إِنِّيْ أَرَاكَ وَقَوْمَكَ فِيْ ضَلاَلٍ مُّبِيْنٍ- (الأنعام ৭৪)-

‘স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম তার পিতা আযরকে বললেন, তুমি কি প্রতিমা সমূহকে উপাস্য মনে কর? আমি দেখতে পাচ্ছি যে, তুমি ও তোমার সম্প্রদায় স্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছ’ (আন‘আম ৬/৭৪)।কিন্তু ইবরাহীমের এই প্রাণভরা আবেদন পিতা আযরের হৃদয় স্পর্শ করল না। রাষ্ট্রের প্রধান পুরোহিত এবং সম্রাটের মন্ত্রী ও প্রিয়পাত্র হওয়ায় সম্ভবত: বিষয়টি তার প্রেস্টিজ ইস্যু হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِذَا قِيلَ لَهُ اتَّقِ اللّهَ أَخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالإِثْمِ فَحَسْبُهُ جَهَنَّمُ وَلَبِئْسَ الْمِهَادُ، ‘যখন তাকে বলা হয়, আল্লাহকে ভয় কর, তখন তার সম্মান তাকে পাপে স্ফীত করে। অতএব তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট। আর নিঃসন্দেহে তা হ’ল নিকৃষ্টতম ঠিকানা’ (বাক্বারাহ ২/২০৬)। বস্ত্ততঃ অহংকারীদের চরিত্র সর্বত্র ও সর্বযুগে প্রায় একই হয়ে থাকে।

 

 

পিতার জবাব :

━━━━━━━━━

পুত্রের আকুতিপূর্ণ দাওয়াতের উত্তরে পিতা বলল,

قَالَ أَرَاغِبٌ أَنْتَ عَنْ آلِهَتِيْ يَا إِبْرَاهِيْمُ لَئِن لَّمْ تَنْتَهِ لَأَرْجُمَنَّكَ وَاهْجُرْنِيْ مَلِيًّا- (مريم ৪৬)-

‘হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? যদি তুমি বিরত না হও, তবে আমি অবশ্যই পাথর মেরে তোমার মাথা চূর্ণ করে দেব। তুমি আমার সম্মুখ হ’তে চিরতরের জন্য দূর হয়ে যাও’ (মারিয়াম ১৯/৪৬)।

 

 

ইবরাহীমের জবাব :

━━━━━━━━━━━

পিতার এই কঠোর ধমকি শুনে পুত্র ইবরাহীম বললেন,

قَالَ سَلاَمٌ عَلَيْكَ سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّي إِنَّهُ كَانَ بِي حَفِيّاً، وَأَعْتَزِلُكُمْ وَمَا تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ وَأَدْعُو رَبِّي عَسَى أَلاَّ أَكُونَ بِدُعَاء رَبِّي شَقِيّاً- (مريم ৪৭-৪৮)-

‘তোমার উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক! আমি আমার পালনকর্তার নিকটে তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব। নিশ্চয়ই তিনি আমার প্রতি মেহেরবান’। ‘আমি পরিত্যাগ করছি তোমাদেরকে এবং আল্লাহ ব্যতীত যাদের তোমরা পূজা কর তাদেরকে। আমি আমার পালনকর্তাকে আহবান করব। আশা করি আমার পালনকর্তাকে আহবান করে আমি বঞ্চিত হব না’ (মারিয়াম ১৯/৪৭-৪৮)।পিতাকে ও নিজ সম্প্রদায়কে একত্রে দাওয়াত

আল্লাহ বলেন,

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ إِبْرَاهِيْمَ، إِذْ قَالَ لِأَبِيْهِ وَقَوْمِهِ مَا تَعْبُدُوْنَ، قَالُوْا نَعْبُدُ أَصْنَاماً فَنَظَلُّ لَهَا عَاكِفِيْنَ، قَالَ هَلْ يَسْمَعُونَكُمْ إِذْ تَدْعُوْنَ، أَوْ يَنْفَعُوْنَكُمْ أَوْ يَضُرُّوْنَ، قَالُوْا بَلْ وَجَدْنَا آبَاءنَا كَذَلِكَ يَفْعَلُوْنَ، قَالَ أَفَرَأَيْتُم مَّا كُنْتُمْ تَعْبُدُوْنَ، أَنتُمْ وَآبَاؤُكُمُ الْأَقْدَمُوْنَ، فَإِنَّهُمْ عَدُوٌّ لِّي إِلاَّ رَبَّ الْعَالَمِيْنَ، الَّذِيْ خَلَقَنِيْ فَهُوَ يَهْدِيْنِ، وَالَّذِيْ هُوَ يُطْعِمُنِيْ وَيَسْقِيْنِ، وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِيْنِ، وَالَّذِيْ يُمِيْتُنِيْ ثُمَّ يُحْيِيْنِ، وَالَّذِيْ أَطْمَعُ أَن يَّغْفِرَ لِيْ خَطِيئَتِيْ يَوْمَ الدِّيْنِ، رَبِّ هَبْ لِيْ حُكْماً وَأَلْحِقْنِيْ بِالصَّالِحِيْنَ، وَاجْعَل لِّيْ لِسَانَ صِدْقٍ فِي الْآخِرِيْنَ، َاجْعَلْنِيْ مِن وَّرَثَةِ جَنَّةِ النَّعِيْمِ، وَاغْفِرْ لِأَبِيْ إِنَّهُ كَانَ مِنَ الضَّالِّيْنَ، وَلاَ تُخْزِنِيْ يَوْمَ يُبْعَثُوْنَ، يَوْمَ لاَ يَنفَعُ مَالٌ وَّلاَ بَنُوْنَ، إِلاَّ مَنْ أَتَى اللهَ بِقَلْبٍ سَلِيْمٍ، وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِيْنَ، وَبُرِّزَتِ الْجَحِيْمُ لِلْغَاوِيْنَ، وَقِيْلَ لَهُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ تَعْبُدُوْنَ، مِنْ دُوْنِ اللهِ هَلْ يَنْصُرُوْنَكُمْ أَوْ يَنْتَصِرُوْنَ، فَكُبْكِبُوْا فِيْهَا هُمْ وَالْغَاوُوْنَ، وَجُنُوْدُ إِبْلِيْسَ أَجْمَعُوْنَ، قَالُوْا وَهُمْ فِيْهَا يَخْتَصِمُوْنَ، تَاللهِ إِنْ كُنَّا لَفِيْ ضَلاَلٍ مُّبِيْنٍ، إِذْ نُسَوِّيْكُم بِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ، وَمَا أَضَلَّنَا إِلاَّ الْمُجْرِمُوْنَ، َمَا لَنَا مِنْ شَافِعِيْنَ، وَلاَ صَدِيْقٍ حَمِيْمٍ، فَلَوْ أَنَّ لَنَا كَرَّةً فَنَكُوْنَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ، إِنَّ فِيْ ذَلِكَ لَآيَةً وَمَا كَانَ أَكْثَرُهُم مُّؤْمِنِيْنَ- (الشعراء ৬৯-১০৪)-

 

‘আর তাদেরকে ইবরাহীমের বৃত্তান্ত শুনিয়ে দিন’(শো‘আরা ২৬/৬৯)। ‘যখন সে স্বীয় পিতা ও সম্প্রদায়কে ডেকে বলল, তোমরা কিসের পূজা কর’?(৭০)। তারা বলল, আমরা প্রতিমার পূজা করি এবং সর্বদা এদেরকেই নিষ্ঠার সাথে আঁকড়ে থাকি’(৭১)। ‘সে বলল, তোমরা যখন আহবান কর, তখন তারা শোনে কি’?(৭২)। ‘অথবা তারা তোমাদের উপকার বা ক্ষতি করতে পারে কি’?(৭৩)। ‘তারা বলল, না। তবে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি, তারা এরূপই করত’(৭৪)। ইবরাহীম বলল, তোমরা কি তাদের সম্পর্কে ভেবে দেখেছ, যাদের তোমরা পূজা করে আসছ’?(৭৫)। ‘তোমরা এবং তোমাদের পূর্ববর্তী পিতৃপুরুষেরা’(৭৬)। ‘তারা সবাই আমার শত্রু, বিশ্ব পালনকর্তা ব্যতীত’(৭৭)। ‘যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আমাকে পথ প্রদর্শন করেছেন’ (৭৮)। ‘যিনি আমাকে আহার দেশ ও পানীয় দান করেন’ (৭৯)। ‘যখন আমি পীড়িত হই, তখনতিনিই আমাকে আরোগ্য দান করেন’(৮০)। ‘যিনি আমার মৃত্যু ঘটাবেন, অতঃপর পুনর্জীবন দান করবেন’ (৮১)। ‘আশা করি শেষ বিচারের দিন তিনি আমার ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দিবেন’ (৮২)। ‘হে আমার পালনকর্তা! আমাকে প্রজ্ঞা দান কর এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত কর’(৮৩)। ‘এবং আমাকে পরবর্তীদের মধ্যে সত্যভাষী কর’ (৮৪)। ‘তুমি আমাকে নে‘মতপূর্ণ জান্নাতের উত্তরাধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর’(৮৫)। (হে প্রভু) ‘তুমি আমার পিতাকে ক্ষমা কর। তিনি তো পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত’(৮৬) (হে আল্লাহ) ‘পুনরুত্থান দিবসে তুমি আমাকে লাঞ্ছিত কর না’ (৮৭)। ‘যে দিনে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না’ (৮৮) ‘কিন্তু যে ব্যক্তি সরল হৃদয় নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে’ (৮৯)। ‘(ঐ দিন) জান্নাত আল্লাহভীরুদের নিকটবর্তী করা হবে’(৯০)। ‘এবং জাহান্নাম বিপথগামীদের সামনে উন্মোচিত করা হবে’(৯১)। ‘(ঐ দিন) তাদেরকে বলা হবে, তারা কোথায় যাদেরকে তোমরা পূজা করতে’?(৯২) ‘আল্লাহর পরিবর্তে। তারা কি (আজ) তোমাদের সাহায্য করতে পারে কিংবা তারা কি কোনরূপ প্রতিশোধ নিতে পারে’? (৯৩)। ‘অতঃপর তাদেরকে এবং (তাদের মাধ্যমে) পথভ্রষ্টদেরকে অধোমুখী করে নিক্ষেপ করা হবে জাহান্নামে’(৯৪) ‘এবং ইবলীস বাহিনীর সকলকে’ (৯৫)। ‘তারা সেখানে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে বলবে’(৯৬) ‘আল্লাহর কসম! আমরা প্রকাশ্য ভ্রান্তিতে ছিলাম’(৯৭), ‘যখন আমরা তোমাদেরকে (অর্থাৎ কথিত উপাস্যদেরকে) বিশ্বপালকের সমতুল্য গণ্য করতাম’(৯৮)।‘আসলে আমাদেরকে পাপাচারীরাই পথভ্রষ্ট করেছিল’ (৯৯)। ‘ফলে (আজ) আমাদের কোন সুফারিশকারী নেই’ (১০০) ‘এবং কোন সহৃদয় বন্ধুও নেই’(১০১)। ‘হায়! যদি কোনরূপে আমরা পৃথিবীতে ফিরে যাবার সুযোগ পেতাম, তাহলে আমরা ঈমানদারগণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম’(১০২)। ‘নিশ্চয়ই এ ঘটনার মধ্যে নিদর্শন রয়েছে। বস্ত্ততঃ তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী ছিল না’ (১০৩)। ‘নিশ্চয়ই আপনার পালনকর্তা পরাক্রান্ত ও দয়ালু’ (শো‘আরা ২৬/৬৯-১০৪)।দাওয়াতের সারকথা ও ফলশ্রুতি

মূর্তিপূজারী পিতা ও সম্প্রদায়ের নেতাদের নিকটে ইবরাহীমের দাওয়াত ও তাদের প্রদত্ত জবাবের সার কথাগুলি নিম্নরূপ:

 

 

১. ইবরাহীম তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে দাওয়াত দেন। তিনি মূর্তি পূজার অসারতার বিষয়টি তাদের সামনে বলে দেন। কেননা এটি ছিল সকলের সহজবোধ্য। কিন্তু তারা মূর্তিপূজার অসীলা ছাড়তে রাজি হয়নি। কারণ শিরকী প্রথার মধ্যে নেতাদের লাভ ছিল মাল-সম্পদ ও দুনিয়াবী সম্মানের নগদ প্রাপ্তি। পক্ষান্তরে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে এসবের প্রাপ্তি যোগ নেই। শিরকী পূজা-পার্বনের মধ্যে গরীবদের লাভ ছিল এই যে, এর ফলে তারা নেতাদের কাছ থেকে দুনিয়াবী সহযোগিতা পেত। এ ছাড়াও বিভিন্ন কাল্পনিক ও ভ্রান্ত বিশ্বাস তাদেরকে মূর্তিপূজায় প্ররোচিত করত। পক্ষান্তরে একনিষ্ঠ তাওহীদ বিশ্বাস তাদেরকে এসব থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। যেখানে এক আল্লাহর গোলামীর অধীনে বড়-ছোট সবার জন্য সামাজিক সমানাধিকার নিশ্চিত হয়ে যায়।

 

২. মূর্তিপূজারীদের কোন সঙ্গত জবাব ছিল না। তারা কেবল একটা কথাই বলেছিল যে, এটা আমাদের বাপ-দাদাদের আমল থেকে চলে আসা প্রথা।

 

৩. ইবরাহীমের এত কিছু বক্তব্যের পরেও এই অন্ধপূজারীরা বলল, আসলেই তুমি কোন সত্য এনেছ, না আমাদের সাথে কৌতুক করছ? কারণ অদৃশ্য অহীর বিষয়টি তাদের বাস্তব জ্ঞানে আসেনি। কিন্তু মূর্তিকে তারা সামনে দেখতে পায়। সেখানে সেবা ও পূজা করে তারা তৃপ্তি পায়।

 

৪. পিতা তাঁকে মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার হুমকি দিল এবং বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দিল। কিন্তু তিনি পিতার জন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনার ওয়াদা করলেন। এর মধ্যে পিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য বোধ ফুটে উঠেছে, যদিও তিনি মুশরিক হন। পরে পিতার কুফরী পরিষ্কার হয়ে গেলে তিনি বিরত হন (তওবাহ ৯/১১৪)।

 

৫. পিতা বহিষ্কার করলেও সম্প্রদায় তখনও বহিষ্কার করেনি। তাই তিনি পুনরায় দাওয়াতে মনোনিবেশ করলেন। যদিও তার ফলশ্রুতি ছিল পূর্বের ন্যায় শূন্য।তারকা পূজারীদের সাথে বিতর্ক

মূর্তি পূজারীদের সাথে বিতর্কের পরে তিনি তারকাপূজারী নেতাদের প্রতি তাওহীদের দাওয়াত দেন। কিন্তু তারাও মূর্তি পূজারীদের ন্যায় নিজ নিজ বিশ্বাসে অটল রইল। অবশেষে তাঁর সাথে তাদের নেতাদের তর্কযুদ্ধ আবশ্যিক হয়ে পড়ে। কেউ কেউ বলেছেন, ইবরাহীমের কওমের লোকেরা একই সাথে মূর্তি ও তারকার পূজা করত। সেটাও অসম্ভব কিছু নয়।

পবিত্র কুরআনে এই তর্কযুদ্ধ একটি অভিনব ও নাটকীয় ভঙ্গিতে প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে সহজে আরবীয় পাঠক হৃদয়ে রেখাপাত করে। কেননা হযরত ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন সমগ্র আরবের লোকদের পিতামহ। তাঁর প্রতি গোটা আরব জাতি সম্মান প্রদর্শন করত। অথচ তাদের পিতামহ যার বিরুদ্ধে জীবনভর লড়াই করলেন জাহিল আরবরা সেই সব শিরকে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। যে কা‘বা গৃহকে ইবরাহীম (আঃ) নির্মাণ করেন এক আল্লাহর ইবাদতের জন্য। তারা সেখানেই মূর্তিপূজা শুরু করে দিয়েছিল। অথচ মুখে আল্লাহকে স্বীকার করত এবং ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করত। আজকের মুসলমানদের জন্য এর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। কেননা তারাও মুখে আল্লাহকে স্বীকার করে এবং শেষনবীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে। অথচ নিজেরা কবর পূজা ও স্থানপূজার শিরকে লিপ্ত রয়েছে। আল্লাহর বিধানের অবাধ্যতা ও তার পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া বিধান সমূহের আনুগত্য তো রয়েছেই। এক্ষণে আমরা কুরআনে বর্ণিত ইবরাহীমের অপর বিতর্ক যুদ্ধটির বিবরণ পেশ করব।-

 

আল্লাহ বলেন,

وَكَذَلِكَ نُرِيْ إِبْرَاهِيْمَ مَلَكُوْتَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَلِيَكُوْنَ مِنَ الْمُوْقِنِيْنَ، فَلَمَّا جَنَّ عَلَيْهِ اللَّيْلُ رَأَى كَوْكَباً قَالَ هَـذَا رَبِّي فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لا أُحِبُّ الآفِلِيْنَ، فَلَمَّا رَأَى الْقَمَرَ بَازِغاً قَالَ هَـذَا رَبِّيْ فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لَئِن لَّمْ يَهْدِنِيْ رَبِّي لَأَكُوْنَنَّ مِنَ الْقَوْمِ الضَّآلِّيْنَ، فَلَمَّا رَأَى الشَّمْسَ بَازِغَةً قَالَ هَـذَا رَبِّيْ هَـذَا أَكْبَرُ فَلَمَّا أَفَلَتْ قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّيْ بَرِيءٌ مِّمَّا تُشْرِكُوْنَ، إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ حَنِيْفاً وَّمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ، وَحَآجَّهُ قَوْمُهُ قَالَ أَتُحَاجُّونِّي فِي اللهِ وَقَدْ هَدَانِ وَلاَ أَخَافُ مَا تُشْرِكُوْنَ بِهِ إِلاَّ أَن يَّشَآءَ رَبِّيْ شَيْئاً وَسِعَ رَبِّيْ كُلَّ شَيْءٍ عِلْماً أَفَلاَ تَتَذَكَّرُوْنَ، وَكَيْفَ أَخَافُ مَا أَشْرَكْتُمْ وَلاَ تَخَافُوْنَ أَنَّكُمْ أَشْرَكْتُمْ بِاللّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَاناً فَأَيُّ الْفَرِيْقَيْنِ أَحَقُّ بِالأَمْنِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ، الَّذِيْنَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوْا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَـئِكَ لَهُمُ الأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُوْنَ- (الأنعام ৭৫-৮২)-

‘আমি এরূপভাবেই ইবরাহীমকে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের অত্যাশ্চর্য বস্ত্তসমূহ দেখাতেলাগলাম, যাতে সে দৃঢ়বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়’ (আন‘আম ৬/৭৫)। ‘অনন্তর যখন রাত্রির অন্ধকার তার উপরে সমাচ্ছন্ন হল, তখন সে তারকা দেখে বলল যে, এটি আমার পালনকর্তা। অতঃপর যখন তা অস্তমিত হ’ল, তখন বলল, আমি অস্তগামীদের ভালবাসি না’ (৭৬)। ‘অতঃপর যখন চন্দ্রকে ঝলমল করতে দেখল, তখন সে বলল, এটি আমার পালনকর্তা। কিন্তু পরে যখন তা অস্তমিত হ’ল, তখন বলল, যদি আমার প্রতিপালক আমাকে পথ প্রদর্শন না করেন, তাহ’লে অবশ্যই আমি পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (৭৭)। ‘অতঃপর যখন উদীয়মান সূর্যকে ডগমগে দেখতে পেল, তখন বলল, এটিই আমার পালনকর্তা এবং এটিই সবচেয়ে বড়। কিন্তু পরে যখন তা ডুবে গেল, তখন বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যেসব বিষয়কে শরীক কর, আমি ওসব থেকে মুক্ত’ (৭৮)। ‘আমি আমার চেহারাকে ঐ সত্তার দিকে একনিষ্ঠ করছি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (৭৯)। ‘(তখন) তার সম্প্রদায় তার সাথে বিতর্ক করল। সে বলল, তোমরা কি আমার সাথে আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করছ? অথচ তিনি আমাকে সরল পথ দেখিয়েছেন। আর আমি ভয় করিনা তাদের, যাদেরকে তোমরা তাঁর সাথে শরীক কর, তবে আমার পালনকর্তা যদি কিছু (কষ্ট দিতে) চান। আমার প্রভুর জ্ঞান সবকিছুতেই পরিব্যপ্ত। তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না’? (৮০)। ‘কিভাবে আমি ঐসব বস্ত্তকে ভয় করব, যাদেরকে তোমরা তাঁর সাথে শরীক করেছ? অথচ তোমরা এ বিষয়ে ভয় পাওনা যে, তোমরা আল্লাহর সাথে এমন সব বস্ত্তকে শরীক করেছ, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তোমাদের প্রতি কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। এক্ষণে উভয় দলের মধ্যে কে বেশী নিরাপত্তা লাভের অধিকারী? যদি তোমরা জ্ঞানী হয়ে থাক’ (৮১)। ‘যারা ঈমান আনে এবং স্বীয় ঈমানকে শিরকের সাথে মিশ্রিত করে না, তাদের জন্যই রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই হ’ল সুপথপ্রাপ্ত’ (আন‘আম ৬/৭৫-৮২)।

 

উপরের বর্ণনা ভঙ্গিতে মনে হয় যেন ইবরাহীম ঐ দিনই প্রথম নক্ষত্র, চন্দ্র ও সূর্য দেখলেন এবং ‘এটি আমার পালনকর্তা’ বলে সাময়িকভাবে মুশরিক হয়েছিলেন। পরে শিরক পরিত্যাগ করে মুসলিম হ’লেন। অথচ ঘটনা মোটেই তা নয়। কেননা ঐ সময় ইবরাহীম (আঃ) অন্যূন সত্তরোর্ধ্ব বয়সের নবী। আর নবীগণ জন্ম থেকেই নিষ্পাপ ও শিরকমুক্ত থাকেন। আসল কথা হ’ল এই যে, মূর্তি পূজার অসারতা বুঝানো যতটা সহজ ছিল, তারকা পূজার অসারতা বুঝানো ততটা সহজ ছিল না। কেননা ওটা মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই ইবরাহীম (আঃ) এখানে বৈজ্ঞানিক পন্থা বেছে নিলেন এবং জনগণের সহজবোধ্য এমন একটি প্রমাণ উপস্থাপন করলেন, যাতে তাদের লা-জওয়াব হওয়া ব্যতীত কোন উপায় ছিল না। তিনি সৌরজগতের গতি-প্রকৃতি যে আল্লাহর হুকুমের অধীন, সে কথা না বলে তাদের অস্তমিত হওয়ার বিষয়টিকে প্রমাণ হিসাবে পেশ করেন। কারণ এটাই ছিল তাদের জন্যে সহজবোধ্য। তিনি বলেন, যা ক্ষয়ে যায়, ডুবে যায়, হারিয়ে যায়, নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারে না, ধরে রাখতে পারে না, বরং দৈনিক ওঠে আর ডোবে, সে কখনো মানুষের প্রতিপালক হ’তে পারে না। বরং সর্বোচ্চ পালনকর্তা কেবল তিনিই হ’তে পারেন, যিনি এসব কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও বিধানদাতা। আর তিনিই হ’লেন ‘আল্লাহ’। আমি তাঁর দিকেই ফিরে গেলাম এবং বাপ-দাদার আমল থেকে তোমরা যে শিরক করে আসছ, আমি তা থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করলাম।বলা বাহুল্য, এর অন্তর্নিহিত দাওয়াত ছিল এই যে, হে আমার জাতি! তোমরাও আমার মত আল্লাহর দিকে ফিরে এসো এবং শিরক হ’তে মুক্ত হও। কিন্তু ইবরাহীমের এই তর্কযুদ্ধ নিষ্ফল হ’ল। সম্প্রদায়ের নেতারা নিজ নিজ মতের উপরে দৃঢ় রইল। কেউ তাঁর আহবানে সাড়া দিল না।তারকা পূজারীদের সাথে বিতর্ক

মূর্তি পূজারীদের সাথে বিতর্কের পরে তিনি তারকাপূজারী নেতাদের প্রতি তাওহীদের দাওয়াত দেন। কিন্তু তারাও মূর্তি পূজারীদের ন্যায় নিজ নিজ বিশ্বাসে অটল রইল। অবশেষে তাঁর সাথে তাদের নেতাদের তর্কযুদ্ধ আবশ্যিক হয়ে পড়ে। কেউ কেউ বলেছেন, ইবরাহীমের কওমের লোকেরা একই সাথে মূর্তি ও তারকার পূজা করত। সেটাও অসম্ভব কিছু নয়।

পবিত্র কুরআনে এই তর্কযুদ্ধ একটি অভিনব ও নাটকীয় ভঙ্গিতে প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে সহজে আরবীয় পাঠক হৃদয়ে রেখাপাত করে। কেননা হযরত ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন সমগ্র আরবের লোকদের পিতামহ। তাঁর প্রতি গোটা আরব জাতি সম্মান প্রদর্শন করত। অথচ তাদের পিতামহ যার বিরুদ্ধে জীবনভর লড়াই করলেন জাহিল আরবরা সেই সব শিরকে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। যে কা‘বা গৃহকে ইবরাহীম (আঃ) নির্মাণ করেন এক আল্লাহর ইবাদতের জন্য। তারা সেখানেই মূর্তিপূজা শুরু করে দিয়েছিল। অথচ মুখে আল্লাহকে স্বীকার করত এবং ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করত। আজকের মুসলমানদের জন্য এর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। কেননা তারাও মুখে আল্লাহকে স্বীকার করে এবং শেষনবীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে। অথচ নিজেরা কবর পূজা ও স্থানপূজার শিরকে লিপ্ত রয়েছে। আল্লাহর বিধানের অবাধ্যতা ও তার পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া বিধান সমূহের আনুগত্য তো রয়েছেই। এক্ষণে আমরা কুরআনে বর্ণিত ইবরাহীমের অপর বিতর্ক যুদ্ধটির বিবরণ পেশ করব।-উপরের বর্ণনা ভঙ্গিতে মনে হয় যেন ইবরাহীম ঐ দিনই প্রথম নক্ষত্র, চন্দ্র ও সূর্য দেখলেন এবং ‘এটি আমার পালনকর্তা’ বলে সাময়িকভাবে মুশরিক হয়েছিলেন। পরে শিরক পরিত্যাগ করে মুসলিম হ’লেন। অথচ ঘটনা মোটেই তা নয়। কেননা ঐ সময় ইবরাহীম (আঃ) অন্যূন সত্তরোর্ধ্ব বয়সের নবী। আর নবীগণ জন্ম থেকেই নিষ্পাপ ও শিরকমুক্ত থাকেন। আসল কথা হ’ল এই যে, মূর্তি পূজার অসারতা বুঝানো যতটা সহজ ছিল, তারকা পূজার অসারতা বুঝানো ততটা সহজ ছিল না। কেননা ওটা মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই ইবরাহীম (আঃ) এখানে বৈজ্ঞানিক পন্থা বেছে নিলেন এবং জনগণের সহজবোধ্য এমন একটি প্রমাণ উপস্থাপন করলেন, যাতে তাদের লা-জওয়াব হওয়া ব্যতীত কোন উপায় ছিল না। তিনি সৌরজগতের গতি-প্রকৃতি যে আল্লাহর হুকুমের অধীন, সে কথা না বলে তাদের অস্তমিত হওয়ার বিষয়টিকে প্রমাণ হিসাবে পেশ করেন। কারণ এটাই ছিল তাদের জন্যে সহজবোধ্য। তিনি বলেন, যা ক্ষয়ে যায়, ডুবে যায়, হারিয়ে যায়, নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারে না, ধরে রাখতে পারে না, বরং দৈনিক ওঠে আর ডোবে, সে কখনো মানুষের প্রতিপালক হ’তে পারে না। বরং সর্বোচ্চ পালনকর্তা কেবল তিনিই হ’তে পারেন, যিনি এসব কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও বিধানদাতা। আর তিনিই হ’লেন ‘আল্লাহ’। আমি তাঁর দিকেই ফিরে গেলাম এবং বাপ-দাদার আমল থেকে তোমরা যে শিরক করে আসছ, আমি তা থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করলাম।

বলা বাহুল্য, এর অন্তর্নিহিত দাওয়াত ছিল এই যে, হে আমার জাতি! তোমরাও আমার মত আল্লাহর দিকে ফিরে এসো এবং শিরক হ’তে মুক্ত হও। কিন্তু ইবরাহীমের এই তর্কযুদ্ধ নিষ্ফল হ’ল। সম্প্রদায়ের নেতারা নিজ নিজ মতের উপরে দৃঢ় রইল। কেউ তাঁর আহবানে সাড়া দিল না।একটি সংশয় ও তার জওয়াব

৭৫ হতে ৮২ পর্যন্ত ৮টি আয়াতে যে বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে, এটি ইবরাহীমের শিশুকালে জ্ঞান-বুদ্ধির বয়স হবার সময়কার ঘটনা, নাকি নবী হবার পরের তর্কানুষ্ঠান, এ বিষয়ে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। ইবনু জারীর (মৃঃ ৩১০ হিঃ) প্রথমোক্ত মত পোষণ করেন। তিনি এ বিষয়ে আলী ইবনে ত্বালহার সূত্রে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বর্ণনা পেশ করেছেন। তবে এই বর্ণনাটির সনদ যঈফ।[কুরতুবী, আন‘আম ৭৬ টীকা]

মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক্ব (৮৫-১৫০ হিঃ) বর্ণিত কিছু অলৌকিক ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে, যা উক্ত মতকে সমর্থন করে। যেমন বাদশাহ নমরূদ যখন জানতে পারেন যে, অচিরেই একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করবে, যে তার রাজ্য হারানোর কারণ হবে, তখন তিনি নবজাতক সকল পুত্র সন্তানকে হত্যা করার নির্দেশ জারি করেন। ইবরাহীমের মা তখন একটি পাহাড়ের গোপন গুহায় লুকিয়ে ইবরাহীমকে প্রসব করেন এবং ইবরাহীম একাকী সেখানে বড় হন। ইবরাহীমের এক আঙ্গুল দিয়ে দুধ বের হ’ত, এক আঙ্গুল দিয়ে মধু বের হ’ত ও এক আঙ্গুল দিয়ে পানি বের হ’ত। এভাবে তিনি সেখানে তিন বছর কাটান। তারপর তিনি সেখান থেকে বের হয়ে এসে মাকে বলেন, আমার প্রভু কে? মা বললেন, নমরূদ। তিনি বললেন, নমরূদের প্রভু কে? তখন মা তাকে চড় মারলেন এবং তিনি বুঝলেন এটিই হল সেই ছেলে, যার সম্পর্কে বাদশাহ নমরূদ আগেই স্বপ্ন দেখেছেন। সুদ্দী, যাহহাক প্রমুখের বরাতে কাসাঈ স্বীয় ক্বাছাছুল আম্বিয়ার মধ্যে এ ধরনের অনেক অলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করেছেন (ইবনু কাছীর, কুরতুবী)। অতঃপর ইবরাহীম গুহা থেকে বের হয়ে প্রথম তারকা দেখলেন, তারপর চন্দ্র দেখলেন, তারপর সূর্য দেখলেন। অতঃপর সবকিছুর ডুবে যাওয়া দেখে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন যে, প্রকৃত পালনকর্তা তিনি, যিনি এগুলিকে সৃষ্টি করেছেন (কুরতুবী)। ইবনু জারীর দলীল এনেছেন ইবরাহীমের একথা দ্বারা, যেখানে তিনি বলেছেন, لَئِن لَّمْ يَهْدِنِي رَبِّي لأكُونَنَّ مِنَ الْقَوْمِ الضَّالِّينَ، ‘যদি আমার প্রতিপালক আমাকে পথ না দেখান, তাহলে অবশ্যই আমি পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (আন‘আম ৬/৭৭)।ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হিঃ) বলেন, বরং সঠিক কথা এই যে, ইবরাহীমের উপরোক্ত ঘটনা ছিল তার কওমের সাথে একটি তর্কানুষ্ঠান মাত্র। এটি কখনোই তার শিশুকালের ঘটনা নয় এবং তিনি ক্ষণিকের তরেও কখনো মুশরিক হননি। কেননা তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتاً لِلّهِ حَنِيفاً وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ، ‘নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিলেন একটি উম্মত এবং আল্লাহর প্রতি অনুগত ও


Bonolota

106 Blog posts

Comments