কেন‘আনী জীবনের ২য় পরীক্ষা
২য় পরীক্ষা: সারাকে অপহরণ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
দুর্ভিক্ষ তাড়িত কেন‘আন হতে অন্যান্যদের ন্যায় ইবরাহীম (আঃ) সস্ত্রীক মিসরে রওয়ানা হ’লেন। ইচ্ছা করলে আল্লাহ তাঁর জন্য এখানেই রূযী পাঠাতে পারতেন। কিন্তু না। তিনি মিসরে কষ্টকর সফরে রওয়ানা হলেন। সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল এক কঠিন ও মর্মান্তিক পরীক্ষা এবং সাথে সাথে একটি নগদ ও অমূল্য পুরষ্কার।
ঐ সময় মিসরের ফেরাঊন ছিল একজন নারী লোলুপ মদ্যপ শাসক। তার নিয়োজিত লোকেরা রাস্তার পথিকদের মধ্যে কোন সুন্দরী মহিলা পেলেই তাকে ধরে নিয়ে বাদশাহকে পৌঁছে দিত। যদিও বিবি ‘সারা’ ঐ সময় ছিলেন বৃদ্ধা মহিলা, তথাপি তিনি ছিলেন সৌন্দর্য্যের রাণী। মিসরীয় সম্রাটের নিয়ম ছিল এই যে, যে মহিলাকে তারা অপহরণ করত, তার সাথী পুরুষ লোকটি যদি স্বামী হত, তাহলে তাকে হত্যা করে মহিলাকে নিয়ে যেত। আর যদি ভাই বা পিতা হ’ত, তাহ’লে তাকে ছেড়ে দিত। তারা ইবরাহীমকে জিজ্ঞেস করলে তিনি সারাকে তাঁর ‘বোন’ পরিচয় দিলেন। নিঃসন্দেহে ‘সারা’ তার ইসলামী বোন ছিলেন। ইবরাহীম তাকে আল্লাহর যিম্মায় ছেড়ে দিয়ে সালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন ও আল্লাহর নিকটে স্বীয় স্ত্রীর ইয্যতের হেফাযতের জন্য আকুলভাবে প্রার্থনা করতে থাকলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ নিশ্চয়ই তার স্ত্রীর ইয্যতের হেফাযত করবেন।
সারাকে যথারীতি ফেরাঊনের কাছে আনা হল। অতঃপর পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
فلمَّا دَخلتْ سارةُ على الْمَلِكِ قامَ إليها فأَقبلتْ تتوضأُ و تُصَلىِّ وتقولُ: أللَّهم إِنْ كنتَ تعلمُ أَنِّي آمنتُ بِكَ وبرسولكَ وأَحْصنتُ فَرْجِي إلا على زوجي فلا تُسلِّطْ علىَّ الكافرَ ু رواه البخارىُّ و أحمد بإِسنادٍ صحيحٍ-
‘যখন সারা সম্রাটের নিকটে নীত হলেন এবং সম্রাট তার দিকে এগিয়ে এল, তখন তিনি ওযূ করার জন্য গেলেন ও সালাতে রত হয়ে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! যদি তুমি জেনে থাক যে, আমি তোমার উপরে ও তোমার রাসূলের উপরে ঈমান এনেছি এবং আমি আমার একমাত্র স্বামীর জন্য সতীত্ব বজায় রেখেছি, তাহলে তুমি আমার উপরে এই কাফিরকে বিজয়ী করো না’বুখারী হা/২২১৭ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়; আহমাদ, সনদ সহীহ]
সতীসাধ্বী স্ত্রী সারার দো‘আ সঙ্গে সঙ্গে কবুল হয়ে গেল। সম্রাট এগিয়ে আসার উপক্রম করতেই হাত-পা অবশ হয়ে পড়ে গিয়ে গোঙাতে লাগলো। তখন সারাহ প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! লোকটি যদি এভাবে মারা যায়, তাহ’লে লোকেরা ভাববে আমি ওকে হত্যা করেছি’। তখন আল্লাহ সম্রাটকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু শয়তান আবার এগিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে আবার মরার মত পড়ে রইল।
এভাবে সে দুই অথবা তিনবার বেহুঁশ হয়ে পড়লো আর সারা-র দো‘আয় বাঁচলো। অবশেষে সে বলল, তোমরা আমার কাছে একটা শয়তানীকে পাঠিয়েছ। যাও একে ইবরাহীমের কাছে ফেরত দিয়ে আসো এবং এর খেদমতের জন্য হাজেরাকে দিয়ে দাও। অতঃপর সারাহ তার খাদেমা হাজেরাকে নিয়ে সসম্মানে স্বামী ইবরাহীমের কাছে ফিরে এলেন’(ঐ)। এই সময় ইবরাহীম সালাতের মধ্যে সারার জন্য প্রার্থনায় রত ছিলেন। সারা ফিরে এলে তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। আল-হামদুলিল্লাহ! যে আল্লাহ তাঁর বান্দা ইবরাহীমকে নমরূদের প্রজ্জ্বলিত হুতাশন থেকে বাঁচিয়ে এনেছেন, সেই আল্লাহ ইবরাহীমের ঈমানদার স্ত্রীকে ফেরাঊনের লালসার আগুন থেকে কেন বাঁচিয়ে আনবেন না? অতএব সর্বাবস্থায় যাবতীয় প্রশংসা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য।
‘আবুল আম্বিয়া’ (أبو الأنبياء ) হিসাবে আল্লাহ পাক যেভাবে ইবরাহীমের পরীক্ষা নিয়েছেন, উম্মুল আম্বিয়া (أم الأنبياء ) হিসাবে তিনি তেমনি বিবি সারা-র পরীক্ষা নিলেন এবং উভয়ে পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হলেন। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
ধারণা করা চলে যে, ফেরাঊন কেবল হাজেরাকেই উপহার স্বরূপ দেয়নি। বরং অন্যান্য রাজকীয় উপঢৌকনাদিও দিয়েছিল। যাতে ইবরাহীমের মিসর গমনের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যায় এবং বিপুল মাল-সামান ও উপঢৌকনাদি সহ তিনি কেন‘আনে ফিরে আসেন।
শিক্ষণীয় বিষয় :
━━━━━━━━━━
উপরোক্ত ঘটনার মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, বান্দা যখন নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপরে সোপর্দ করে দেয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যেই সকল কাজ করে, তখন আল্লাহ তার পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে নেন। তার জান-মাল-ইয্যত সবকিছু তিনিই হেফাযত করেন। আলোচ্য ঘটনায় ইবরাহীম ও সারাহ ছিলেন একেবারেই অসহায়। তারা স্রেফ আল্লাহর উপরেই নির্ভর করেছেন, তাঁর কাছেই কেঁদেছেন, তাঁর কাছেই চেয়েছেন। ফলে আল্লাহ তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন।
দ্বিতীয় শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, বান্দার দায়িত্ব হল, যেকোন মূল্যে হক-এর উপরে দৃঢ় থাকা ও অন্যকে হক-এর পথে দাওয়াত দেওয়া। ইবরাহীম দারিদ্রে্যর তাড়নায় কাফেরের দেশ মিসরে গিয়েছিলেন। কিন্তু নিজেরা যেমন ‘হক’ থেকে বিচ্যুত হননি, তেমনি অন্যকে দাওয়াত দিতেও পিছপা হননি। ফলে আল্লাহ তাঁকে মর্মান্তিক বিপদের মধ্যে ফেলে মহা পুরষ্কারে ভূষিত করলেন।কেন‘আনী জীবনের ৩য় পরীক্ষা
৩য় পরীক্ষা: হাজেরাকে মক্কায় নির্বাসন :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
মিসর থেকে ফিরে কেন‘আনে আসার বৎসরাধিককাল পরে প্রথম সন্তান ইসমাঈলের জন্ম লাভ হয়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তিনি শিশু সন্তান ও তার মা হাজেরাকে মক্কার বিজন পাহাড়ী উপত্যকায় নিঃসঙ্গভাবে রেখে আসার এলাহী নির্দেশ লাভ করেন। বস্ত্ততঃ এটা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক পরীক্ষা। এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিম্নরূপ:
হযরত ইবরাহীম (আঃ) যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে শিশু পুত্র ইসমাঈল ও তার মাকে মক্কায় নির্বাসনে রেখে আসার নির্দেশ পান, তখনই তার অন্তরে বিশ্বাস জন্মেছিল যে, নিশ্চয়ই এ নির্দেশের মধ্যে আল্লাহর কোন মহতী পরিকল্পনা লুক্কায়িত আছে এবং নিশ্চয়ই তিনি ইসমাঈল ও তার মাকে ধ্বংস করবেন না।
অতঃপর এক থলে খেজুর ও এক মশক পানি সহ তাদের বিজনভূমিতে রেখে যখন ইবরাহীম (আঃ) একাকী ফিরে আসতে থাকেন, তখন বেদনা-বিস্মিত স্ত্রী হাজেরা ব্যাকুলভাবে তার পিছে পিছে আসতে লাগলেন। আর স্বামীকে এর কারণ জিজ্ঞেস করতে থাকেন। কিন্তু বুকে বেদনার পাষাণ বাঁধা ইবরাহীমের মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুলো না। তখন হাজেরা বললেন, আপনি কি আল্লাহর হুকুমে আমাদেরকে এভাবে ফেলে যাচ্ছেন? ইবরাহীম ইশারায় বললেন, হ্যাঁ। তখন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে অটল বিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে হাজেরা বলে উঠলেন, إذَنْ لايُضَيِّعُنَا اللهُ ‘তাহ’লে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না’। ফিরে এলেন তিনি সন্তানের কাছে। দু’একদিনের মধ্যেই ফুরিয়ে যাবে পানি ও খেজুর। কি হবে উপায়? খাদ্য ও পানি বিহনে বুকের দুধ শুকিয়ে গেলে কচি বাচ্চা কি খেয়ে বাঁচবে। পাগলপরা হয়ে তিনি মানুষের সন্ধানে দৌঁড়াতে থাকেন সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের এ মাথা আর ও মাথায়। এভাবে সপ্তমবারে তিনি দূর থেকে দেখেন যে, বাচ্চার পায়ের কাছ থেকে মাটির বুক চিরে বেরিয়ে আসছে ঝর্ণার ফল্গুধারা, জিব্রীলের পায়ের গোড়ালি বা তার পাখার আঘাতে যা সৃষ্টি হয়েছিল। ছুটে এসে বাচ্চাকে কোলে নিলেন অসীম মমতায়। স্নিগ্ধ পানি পান করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। হঠাৎ অদূরে একটি আওয়ায শুনে তিনি চমকে উঠলেন। উনি জিবরীল। বলে উঠলেন, لا تخافوا الضَّيعةَ، إنَّ هذا بيتُ الله يَبْنى هذا الغلامُ و أبوه وإن الله لايُضيعُ أهلَه- ‘আপনারা ভয় পাবেন না। এখানেই আল্লাহর ঘর। এই সন্তান ও তার পিতা এ ঘর সত্বর পুনর্নির্মান করবেন। আল্লাহ তাঁর ঘরের বাসিন্দাদের ধ্বংস করবেন না’। বলেই শব্দ মিলিয়ে গেল’।
অতঃপর শুরু হল ইসমাঈলী জীবনের নব অধ্যায়। পানি দেখে পাখি আসলো। পাখি ওড়া দেখে ব্যবসায়ী কাফেলা আসলো। তারা এসে পানির মালিক হিসাবে হাজেরার নিকটে অনুমতি চাইলে তিনি এই শর্তে মনযুর করলেন যে, আপনাদের এখানে বসতি স্থাপন করতে হবে। বিনা পয়সায় এই প্রস্তাব তারা সাগ্রহে কবুল করল। এরাই হ’ল ইয়ামন থেকে আগত বনু জুরহুম গোত্র। বড় হয়ে ইসমাঈল এই গোত্রে বিয়ে করেন। এঁরাই কা‘বা গৃহের খাদেম হন এবং এদের শাখা গোত্র কুরায়েশ বংশে শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আগমন ঘটে।
ওদিকে ইবরাহীম (আঃ) যখন স্ত্রী ও সন্তানকে রেখে যান তখন হাজেরার দৃষ্টির আড়ালে গিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন এই বলে,
رَّبَّنَا إِنِّيْ أَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّيَّتِيْ بِوَادٍ غَيْرِ ذِيْ زَرْعٍ عِنْدَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيْمُوا الصَّلاَةَ فَاجْعَلْ أَفْئِدَةً مِّنَ النَّاسِ تَهْوِيْ إِلَيْهِمْ وَارْزُقْهُم مِّنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُوْنَ- (ابراهيم ৩৭)-
‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমি আমার পরিবারের কিছু সদস্যকে তোমার মর্যাদামন্ডিত গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় বসবাসের জন্য রেখে যাচ্ছি। প্রভুহে! যাতে তারা সালাত কায়েম করে। অতএব কিছু লোকের অন্তরকে তুমি এদের প্রতি আকৃষ্ট করে দাও এবং তাদেরকে ফল-ফলাদি দ্বারা রূযী দান কর। সম্ভবত: তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে’।[ইবরাহীম ১৪/৩৭; বুখারী ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত দীর্ঘ হাদীছের সারসংক্ষেপ; ‘নবীদের কাহিনী’ অধ্যায় হা/৩৩৬৪]
শিক্ষণীয় বিষয় :
━━━━━━━━━━
(১) ইবরাহীম (আঃ) তাঁর স্ত্রী ও দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে জনমানব শূন্য ও চাষাবাদহীন এক শুষ্ক মরু উপত্যকায় রেখে আসলেন, কোন সুস্থ বিবেক এ কাজকে সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু যারা আল্লাহতে বিশ্বাসী, তাদের জন্য বিষয়টি মোটেই আশ্চর্যজনক নয়। আর সেকারণেই হাজেরা গভীর প্রত্যয়ে বলেউঠেছিলেন, إذَنْ لا يُضَيِّعُنِيَ اللهُ ‘তাহলে আল্লাহ আমাকে ধ্বংস করবেন না’। আল্লাহ যে কেবল বিশ্বাসের বস্ত্ত নয়, বরং তিনি সার্বক্ষণিকভাবে বান্দার তত্ত্বাবধায়ক, ইবরাহীমের উক্ত কর্মনীতির মধ্যে তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। অতি যুক্তিবাদী ও বস্ত্তবাদীদের জন্য এর মধ্যে রয়েছে বড় ধরনের এক শিক্ষণীয় বিষয়।
(২) ইবরাহীমের দো‘আ আল্লাহ এমন দ্রুত কবুল করেছিলেন যে, দু’একদিনের মধ্যেই সেখানে সৃষ্টি হয় পানির ফোয়ারা, যা যমযম কূয়া নামে পরিচিত হয় এবং যার উৎসধারা বিগত প্রায় সোয়া চার হাযার বছর ধরে আজও সমভাবে বহমান। কিন্তু এই পানির রূপ-রস-গন্ধ কিছুরই কোন পরিবর্তন হয়নি। এ পানির কোন হরাস-বৃদ্ধি নেই। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এ পানিতে এমন সব উপাদান রয়েছে, যা মানুষের জন্য খাদ্য ও পানীয় উভয় চাহিদা মেটাতে সক্ষম। পৃথিবীর অন্য কোন পানিতে এ গুণ নেই। দৈনিক লাখ লাখ গ্যালন পানি ব্যয় হওয়া সত্ত্বেও এ পানির কোন ক্ষয় নেই, লয় নেই, কমতি নেই। এর কারণ অনুসন্ধানে বছরের পর বছর চেষ্টা করেও বৈজ্ঞানিকেরা ব্যর্থ হয়েছেন। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।
(৩) তখন থেকে অদ্যাবধি মক্কা মু‘আয্যমায় চাষাবাদের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। কিন্তু সারা পৃথিবী হতে তাবৎ ফল-ফলাদি সর্বদা সেখানে আমদানী হয়ে থাকে এবং সর্বদা অধিকহারে মওজূদ থাকে। আধুনিক বিশ্বের কোন শহরই এর সাথে তুলনীয় নয়। নিঃসন্দেহে এটা হ’ল ইবরাহীমের দো‘আর অন্যতম ফসল।
(৪) ইবরাহীম (আঃ)-এর দো‘আয় বলা হয়েছিল, ‘আমি আমার সন্তানকে এখানে রেখে যাচ্ছি যেন তারা এখানে সালাত কায়েম করে’। আল্লাহর রহমতে সেদিন থেকে অদ্যাবধি এখানে সালাত, ত্বাওয়াফ ও অন্যান্য ইবাদত সর্বদা জারি আছে।
(৫) দো‘আয় তিনি বলেছিলেন, ‘মানব সমাজের কিছু অংশের হৃদয়কে তুমি এদের প্রতি ঝুঁকিয়ে দাও’। নিঃসন্দেহে সেই অংশটি হল সারা বিশ্বের মুসলিম সমাজ। ইবরাহীম (আঃ) জানতেন যে, বিশ্বের সমস্ত লোক কখনো মুমিন হবে না। তাছাড়া তাবৎ বিশ্ব যদি কা‘বার প্রতি ঝুঁকে পড়ত, তাহ’লে সেখানে বসবাস, স্থান সংকুলান ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার সংকট দেখা দেওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল। তখন থেকে এযাবত সর্বদা একদল শক্তিশালী ও ধর্মপরায়ণ মানুষ মক্কার সুরক্ষা ও নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। দেড় হাযার বছর পূর্বে খৃষ্টান গভর্ণর আবরাহার সকল প্রচেষ্টা যেমন ব্যর্থ হয়েছিল, ক্বিয়ামত অবধি শত্রুদের সকল চক্রান্ত এভাবেই ব্যর্থ হবে ইনশাআল্লাহ।কেন‘আনী জীবনের ৪র্থ পরীক্ষা
৪র্থ পরীক্ষা: খাৎনা করণ :
━━━━━━━━━━━━━━━
ইবরাহীমের প্রতি আদেশ হল খাৎনা করার জন্য। এসময় তাঁর বয়স ছিল অন্যূন ৮০ বছর। হুকুম পাওয়ার সাথে সাথে দেরী না করে নিজেই নিজের খাৎনার কাজ সম্পন্ন করলেন।[বুখারী, আবু হুরায়রা হতে হা/৩৩৫৬, ৬২৯৭; কুরতুবী হা/৬৫১-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য] বিনা দ্বিধায় এই কঠিন ও বেদনাদায়ক কাজ সম্পন্ন করার মধ্যে আল্লাহর হুকুম দ্রুত পালন করার ও এ ব্যাপারে তাঁর কঠোর নিষ্ঠার প্রমাণ পাওয়া যায়।
খাৎনার এই প্রথা ইবরাহীমের অনুসারী সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে আজও চালু আছে। বস্ত্ততঃ খাৎনার মধ্যে যে অফুরন্ত কল্যাণ নিহিত রয়েছে, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীগণ তা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন। এর ফলে খাৎনাকারীগণ অসংখ্য অজানা রোগ-ব্যাধি হতে মুক্ত রয়েছেন এবং সুস্থ জীবন লাভে ধন্য হয়েছেন।বাবেল জীবনের পরীক্ষা সমূহ
ইবরাহীম (আঃ)-এর বাবেল জীবনের পরীক্ষা সমূহের মধ্যে
(১) মূর্তিপূজারী নেতাদের সাথে তর্কযুদ্ধের পরীক্ষা
(২) পিতার পক্ষ থেকে বহিষ্কারাদেশ প্রাপ্তির পরীক্ষা
(৩) স্ত্রী ও ভাতিজা ব্যতীত কেউ তাঁর দাওয়াত কবুল না করা সত্ত্বেও তীব্র সামাজিক বিরোধিতার মুখে একাকী দাওয়াত চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অটল থাকার মাধ্যমে আদর্শ নিষ্ঠার কঠিন পরীক্ষা
(৪) তারকাপূজারীদের সাথে যুক্তিগর্ভ তর্কযুদ্ধের পরীক্ষা
(৫) কেন্দ্রীয় দেবমন্দিরে ঢুকে মূর্তি ভাঙ্গার মত দুঃসাহসিক পরীক্ষা
(৬) অবশেষে রাজদরবারে পৌঁছে সরাসরি সম্রাটের সাথে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার পরীক্ষা এবং বিনিময়ে
(৭) জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করার মর্মান্তিক শাস্তি হাসিমুখে বরণ করে নেবার অতুলনীয় অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়া। এছাড়াও সমাজ সংস্কারক হিসাবে জীবনের প্রতি পদে পদে যে অসংখ্য পরীক্ষার সম্মুখীন তাঁকে হর-হামেশা হতে হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।অতঃপর (পিতা-পুত্র) উভয়ে যখন আত্মসমর্পণ করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে শায়িত করল’। ‘তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহীম’! ‘তুমি তোমার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছ। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলগণের প্রতিদান দিয়ে থাকি’। ‘নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা’। ‘আর আমি তার পরিবর্তে একটি মহান যবহ প্রদান করলাম’ ‘এবং আমি এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’। ‘ইবরাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হৌক’ (ছাফফাত ৩৭/১০৩-১০৯)। বর্তমানে উক্ত মিনা প্রান্তরেই হাজীগণ কুরবানী করে থাকেন এবং বিশ্ব মুসলিম ঐ সুন্নাত অনুসরণে ১০ই যুলহিজ্জাহ বিশ্বব্যাপী শরী‘আত নির্ধারিত পশু কুরবানী করে থাকেন।
শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :
━━━━━━━━━━━━━
১) ইবরাহীমকে আল্লাহ স্বপ্নাদেশ করেছিলেন, সরাসরি আদেশ করেননি। এর মধ্যে পরীক্ষা ছিল এই যে, স্বপ্নের বিভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারত। যেমন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা মহাপাপ। অধিকন্তু পিতা হয়ে নির্দোষ পুত্রকে নিজ হাতে হত্যা করা আরও বড় মহাপাপ। নিশ্চয়ই এমন অন্যায় কাজের নির্দেশ আল্লাহ দিতে পারেন না। অতএব এটা মনের কল্পনা-নির্ভর স্বপ্ন (أضغاث أحلام ) হতে পারে। কিন্তু ইবরাহীম ঐসব ব্যাখ্যায় যাননি। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, এটা ‘অহি’। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি পরপর তিনদিন একই স্বপ্ন দেখেন। প্রশ্ন হতে পারে, আল্লাহ জিব্রীল মারফত সরাসরি নির্দেশ না পাঠিয়ে স্বপ্নের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠালেন কেন? এর জবাব এই যে, তাহলে তো পরীক্ষা হত না, কেবল নির্দেশ পালন হত। ইবরাহীমকে তার স্বপ্নের কাল্পনিক ব্যাখ্যার ফাঁদে ফেলার জন্যই তো শয়তান মাঝপথে বন্ধু সেজে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। এর দ্বারা আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর নির্দেশ পালনের সময় অহেতুক প্রশ্ন সমূহ উত্থাপন ও অধিক যুক্তিবাদের আশ্রয় নেওয়া যাবে না। বরং সর্বদা তার প্রকাশ্য অর্থের উপরে সহজ-সরলভাবে আমল করে যেতে হবে।
(২) আল্লাহর মহববত ও দুনিয়াবী কোন মহববত একত্রিত হলে সর্বদা আল্লাহর মহববতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং দুনিয়াবী মহববতকে কুরবানী দিতে হবে। ইবরাহীম এখানে সন্তানের গলায় ছুরি চালাননি। বরং সন্তানের মহববতের গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন। আর এটাই ছিল পরীক্ষা। যদি কেউ আল্লাহর মহববতের উপরে দুনিয়াবী মহববতকে অগ্রাধিকার দেয়, তখন সেটা হয়ে যায় الإشراك في المحبة বা ভালোবাসায় শিরক। ইবরাহীম ও ইসমাঈল দু’জনেই উক্ত শিরক হতে মুক্ত ছিলেন।
(৩) পিতা ও পুত্রের বিশ্বাসগত সমন্বয় ব্যতীত কুরবানীর এই গৌরবময় ইতিহাস রচিত হত না। ইসমাঈল যদি পিতার অবাধ্য হতেন এবং দৌড়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যেতেন, তাহলে আল্লাহর হুকুম পালন করা ইবরাহীমের পক্ষে হয়তবা আদৌ সম্ভব হত না। তাই এ ঘটনার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, সমাজের প্রবীণদের কল্যাণময় নির্দেশনা এবং নবীনদের আনুগত্য ও উদ্দীপনা একত্রিত ও সমন্বিত না হলে কখনোই কোন উন্নত সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়।
(৪) এখানে মা হাজেরার অবদানও ছিল অসামান্য। যদি তিনি ঐ বিজন ভূমিতে কচি সন্তানকে তিলে তিলে মানুষ করে না তুলতেন এবং স্রেফ আল্লাহর উপরে ভরসা করে বুকে অসীম সাহস নিয়ে সেখানে বসবাস না করতেন, তাহলে পৃথিবী পিতা-পুত্রের এই মহান দৃশ্য অবলোকন করতে পারত না। এজন্যেই বাংলার বুলবুল কাজী নজরুল ইসলাম গেয়েছেন,
মা হাজেরা হৌক মায়েরা সব
যবীহুল্লাহ হৌক ছেলেরা সব
সবকিছু যাক সত্য রৌক
বিধির বিধান সত্য হৌক।
বলা চলে যে, এই কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ইবরাহীম (আঃ) বিশ্ব নেতৃত্বের সম্মানে ভূষিত হন। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيْمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّيْ جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَاماً، (بقرة ১২৪)-
‘যখন ইবরাহীমকে তার পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তাতে উত্তীর্ণ হলেন, তখন আল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করলাম’ (বাক্বারাহ ২/১২৪)।অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী
বাবেল জীবনে ৭টি ও কেন‘আন জীবনে ৫টি বড় বড় পরীক্ষা বর্ণনার পর এবারে আমরা ইবরাহীম (আঃ)-এর জীবনের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ও শিক্ষণীয় ঘটনাবলী বিবৃত করব।-
(১) ইসহাক জন্মের সুসংবাদ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━
পুত্র কুরবানীর ঘটনার পরে ইবরাহীম (আঃ) কেন‘আনে ফিরে এলেন। এসময় বন্ধ্যা স্ত্রী সারাহ্-র গর্ভে ভবিষ্যৎ সন্তান ইসহাক জন্মের সুসংবাদ নিয়ে ফেরেশতাদের শুভাগমন ঘটে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, উক্ত ফেরেশতাগণ ছিলেন হযরত জিবরাঈল, মীকাঈল ও ইসরাফীল। তারা মানুষের রূপ ধারণ করে এসেছিলেন। এ বিষয়ে কুরআনী বক্তব্য নিম্নরূপ:
وَلَقَدْ جَاءَتْ رُسُلُنَا إِبْرَاهِيْمَ بِالْبُـشْرَى قَالُوْا سَلاَماً قَالَ سَلاَمٌ فَمَا لَبِثَ أَنْ جَاء بِعِجْلٍ حَنِيْذٍ- (هود ৬৯)-
‘আর আমাদের প্রেরিত সংবাদবাহকগণ (অর্থাৎ ফেরেশতাগণ) ইবরাহীমের নিকটে সুসংবাদ নিয়ে এল এবং বলল, সালাম। সেও বলল, সালাম। অতঃপর অল্পক্ষণের মধ্যেই সে একটা ভূণা করা বাছুর এনে (তাদের সম্মুখে) পেশ করল’ (হূদ ১১/৬৯)। ‘কিন্তু সে যখন দেখল যে, মেহমানদের হাত সেদিকে প্রসারিত হচ্ছে না, তখন সে সন্দেহে পড়ে গেল ও মনে মনে তাদের সম্পর্কে ভয় অনুভব করতে লাগল (কারণ এটা তখনকার যুগের খুনীদের নীতি ছিল যে, যাকে তারা খুন করতো, তার বাড়ীতে তারা খেত না)। তারা বলল, আপনি ভয় পাবেন না। আমরা লূত্বের কওমের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। তার স্ত্রী (সারা) নিকটেই দাঁড়িয়েছিল, সে হেসে ফেলল। আমরা তাকে ইসহাকের জন্মের সুখবর দিলাম এবং ইসহাকের পরে (তার পুত্র) ইয়াকূবেরও। সে বলল, হায় কপাল! আমি সন্তান প্রসব করব? অথচ আমি বার্ধক্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। আর আমার স্বামীও বৃদ্ধ। এতো ভারী আশ্চর্য কথা! তারা বলল, আপনি আল্লাহর নির্দেশের বিষয়ে আশ্চর্য বোধ করছেন? হে গৃহবাসীগণ! আপনাদের উপরে আল্লাহর রহমত ও প্রভূত বরকত রয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রশংসিত ও মহিমময়’ (হূদ ১১/৭০-৭৩)। একই ঘটনা আলোচিত হয়েছে সূরা হিজর ৫২-৫৬ ও সূরা যারিয়াত ২৪-৩০ আয়াত সমূহে।
উল্লেখ্য যে, অধিক মেহমানদারীর জন্য ইবরাহীমকে ‘আবুয যায়ফান’ (ابو الضيفان) বা মেহমানদের পিতা বলা হত। এই সময় বিবি সারাহর বয়স ছিল অন্যূন ৯০ ও ইবরাহীমের ছিল ১০০ বছর। সারাহ নিজেকে বন্ধ্যা মনে করতেন এবং সেকারণেই সেবিকা হাজেরাকে স্বামীর জন্য উৎসর্গ করেছিলেন ও তাঁর সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন সন্তান লাভের জন্য। অথচ সেই ঘরে ইসমাঈল জন্মের পরেও তাকে তার মা সহ মক্কায় নির্বাসনে রেখে আসতে হয় আল্লাহর হুকুমে। ফলে সংসার ছিল আগের মতই নিরানন্দময়। কিন্তু আল্লাহর কি অপূর্ব লীলা! তিনি শুষ্ক নদীতে বান ডাকাতে পারেন। তাই নিরাশ সংসারে তিনি আশার বন্যা ছুটিয়ে দিলেন। যথাসময়ে ইসহাকের জন্ম হ’ল। যিনি পরে নবী হ’লেন এবং তাঁরই পুত্র ইয়াকূবের বংশধারায় ঈসা পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হাযার হাযার নবী প্রেরিত হ’লেন। ফলে হতাশ ও বন্ধ্যা নারী সারাহ এখন কেবল ইসহাকের মা হ’লেন না। বরং তিনি হ’লেন হাযার হাযার নবীর মা বা ‘উম্মুল আম্বিয়া’ (ام الأنبياء)। ওদিকে মক্কায় ইসমাঈলের বয়স তখন ১৩/১৪ বৎসর। যাকে বলা হয়ে থাকে ‘আবুল আরব’ (ابو العرب) বা আরব জা
তির পিতা।২) মৃতকে জীবিত করার দৃশ্য প্রত্যক্ষকরণ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
বন্ধ্যা স্ত্রী সারাহর বৃদ্ধ বয়সে সন্তান লাভের মাধ্যমে আল্লাহ যেভাবে তাদের ঈমান বর্ধিত ও মযবূত করেছিলেন। সম্ভবত: তাতে উৎসাহিত হয়ে ইবরাহীম (আঃ) একদিন আল্লাহর কাছে দাবী করে বসলেন, আপনি কিভাবে মৃতকে জীবিত করেন, তা আমাকে একটু দেখান, যাতে হৃদয়ে প্রশান্তি আসে। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ:
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيْمُ رَبِّ أَرِنِيْ كَيْفَ تُحْيِـي الْمَوْتَى قَالَ أَوَلَمْ تُؤْمِنْ قَالَ بَلَى وَلَـكِن لِّيَطْمَئِنَّ قَلْبِيْ قَالَ فَخُذْ أَرْبَعَةً مِّنَ الطَّيْرِ فَصُرْهُنَّ إِلَيْكَ ثُمَّ اجْعَلْ عَلَى كُلِّ جَبَلٍ مِّنْهُنَّ جُزْءاً ثُمَّ ادْعُهُنَّ يَأْتِيْنَكَ سَعْياً وَاعْلَمْ أَنَّ اللهَ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ- (البقرة ২৬০)-
‘আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে দেখাও কিভাবে তুমি (ক্বিয়ামতের দিন) মৃতকে জীবিত করবে। আল্লাহ বললেন, তুমি কি বিশ্বাস কর না? (ইবরাহীম) বলল, অবশ্যই করি। কিন্তু দেখতে চাই কেবল এজন্য, যাতে হৃদয়ে প্রশান্তি লাভ করতে পারি। বললেন, তাহ’লে চারটি পাখি ধরে নাও এবং সেগুলিকে নিজের পোষ মানিয়ে নাও। অতঃপর সেগুলোকে (যবেহ করে) সেগুলির দেহের একেকটি অংশ বিভিন্ন পাহাড়ের উপরে রেখে আস। তারপর সেগুলিকে ডাক দাও। (দেখবে) তোমার দিকে দৌড়ে চলে আসবে (উড়তে উড়তে নয়। কেননা তাতে অন্যান্য পাখির সাথে মিশে গিয়ে তোমার দৃষ্টি বিভ্রম ঘটতে পারে যে, সেই চারটি পাখি কোন্ কোন্টি)। জেনে রেখ যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রান্ত ও জ্ঞানময়’ (বাক্বারাহ ২/২৬০)।
উপরোক্ত ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ মুশরিক ও নাস্তিক সমাজকে দেখিয়ে দিলেন যে, কিভাবে মাটিতে মিশে যাওয়া মৃত মানুষকে তিনি ক্বিয়ামতের দিন পুনর্জীবন দান করবেন।
(৩) বায়তুল্লাহ নির্মাণ :
━━━━━━━━━━━━━
বায়তুল্লাহ প্রথমে ফেরেশতাগণ নির্মাণ করেন। অতঃপর হযরত আদম (আঃ) পুনর্নিমাণ করেন জিব্রীলের ইঙ্গিত মতে। তারপর নূহের তূফানের সময় বায়তুল্লাহর প্রাচীর বিনষ্ট হ’লেও ভিত্তি আগের মতই থেকে যায়। পরবর্তীতে আল্লাহর হুকুমে একই ভিত্তিভূমিতে ইবরাহীম তা পুনর্নির্মাণ করেন। এই নির্মাণকালে ইবরাহীম (আঃ) কেন‘আন থেকে মক্কায় এসে বসবাস করেন। ঐ সময় মক্কায় বসতি গড়ে উঠেছিল এবং ইসমাঈল তখন বড় হয়েছেন এবং বাপ-বেটা মিলেই কা‘বা গৃহ নির্মাণ করেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তখন থেকে অদ্যাবধি কা‘বা গৃহে অবিরত ধারায় হজ্জ ও ত্বাওয়াফ চালু আছে এবং হরম ও তার অধিবাসীগণ পূর্ণ শান্তি, নিরাপত্তা ও মর্যাদা সহকারে সেখানে বসবাস করে আসছেন। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা সমূহনিম্নরূপ:
আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيْمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَن لاَّ تُشْرِكْ بِيْ شَيْئاً وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِيْنَ وَالْقَائِمِيْنَ وَالرُّكَّعِ السُّجُوْدِ- (الحج ২৬)-
‘আর যখন আমি ইবরাহীমকে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়ে বলেছিলাম যে, আমার সাথে কাউকে শরীক করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রাখো তাওয়াফকারীদের জন্য, সালাতে দন্ডায়মানদের জন্য ও রুকূ-সিজদাকারীদের জন্য’ (হজ্জ ২২/২৬)। আল্লাহ বলেন,
وَأَذِّن فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالاً وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيْقٍ- لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ- (الحج ২৭-২৮)-
‘আর তুমি মানুষের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা জারি করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং (দীর্ঘ সফরের কারণে) সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত হ’তে। যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং (কুরবানীর) নির্দিষ্ট দিনগুলিতে (১০, ১১, ১২ই যিলহাজ্জ) তাঁর দেওয়া চতুষ্পদ পশু সমূহ যবেহ করার সময় তাদের উপরে আল্লাহর নাম স্মরণ করে। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং আহার করাও অভাবী ও দুস্থদেরকে’ (হজ্জ ২২/২৭-২৮)।
উপরোক্ত আয়াতগুলিতে কয়েকটি বিষয় জানা যায়। যেমন- (১) বায়তুল্লাহ ও তার সন্নিকটে কোনরূপ শিরক করা চলবে না (২) এটি স্রেফ তাওয়াফকারী ও আল্লাহর ইবাদতকারীদের জন্য নির্দিষ্ট হবে (৩) এখানে কেবল মুমিন সম্প্রদায়কে হজ্জের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
হযরত ইবরাহীম (আঃ) মাক্বামে ইবরাহীমে দাঁড়িয়ে এবং কোন কোন বর্ণনা মতে আবু কুবায়েস পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে দুই কানে আঙ্গুল ভরে সর্বশক্তি দিয়ে উচ্চ কণ্ঠে চারদিকে ফিরে বারবার হজ্জের উক্ত ঘোষণা জারি করেন।
ইমাম বাগাভী হযরত ইবনু আববাসের সূত্রে বলেন যে, ইবরাহীমের উক্ত ঘোষণা আল্লাহ পাক সাথে সাথে বিশ্বের সকল প্রান্তে মানুষের কানে কানে পৌঁছে দেন। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ইবরাহীমী আহবানের জওয়াবই হচ্ছে হাজীদের ‘লাববায়েক আল্লা-হুম্মা লাববায়েক’ (হাযির, হে প্রভু আমি হাযির) বলার আসল ভিত্তি। সেদিন থেকে এযাবত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হ’তে মানুষ চলেছে কা‘বার পথে কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ উটে, কেউ গাড়ীতে, কেউ বিমানে, কেউ জাহাযে ও কেউ অন্য পরিবহনে করে। আবরাহার মত অনেকে চেষ্টা করেও এ স্রোত কখনো ঠেকাতে পারেনি। পারবেও না কোনদিন ইনশাআল্লাহ। দিন-রাত, শীত-গ্রীষ্ম উপেক্ষা করে সর্বদা চলছে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ও সাফা-মারওয়ার সাঈ। আর হজ্জের পরে চলছে কুরবানী। এভাবে ইবরাহীম ও ইসমাঈলের স্মৃতি চির অম্লান হয়ে আছে মানব ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে। এক কালের চাষাবাদহীন বিজন পাহাড়ী উপত্যকা ইবরাহীমের দো‘আর বরকতে হয়ে উঠলো বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সম্মিলন স্থল হিসাবে। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ جَعَلْنَا الْبَيْتَ مَثَابَةً لِّلنَّاسِ وَأَمْناً وَاتَّخِذُوْا مِن مَّقَامِ إِبْرَاهِيْمَ مُصَلًّى وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيْمَ وَإِسْمَاعِيْلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِيْنَ وَالْعَاكِفِيْنَ وَالرُّكَّعِ السُّجُوْدِ- (البقرة ১২৫)-
‘যখন আমি কা‘বা গৃহকে লোকদের জন্য সম্মিলনস্থল ও শান্তিধামে পরিণত করলাম (আর বললাম,) তোমরা ইবরাহীমের দাঁড়ানোর স্থানটিকে সালাতের স্থান হিসাবে গ্রহণ কর। অতঃপর আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ই‘তেকাফকারী ও রুকূ-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র কর’ (বাক্বারাহ ২/১২৫)।
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيْمُ رَبِّ اجْعَلْ هَـَذَا بَلَداً آمِناً وَارْزُقْ أَهْلَهُ مِنَ الثَّمَرَاتِ مَنْ آمَنَ مِنْهُم بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ قَالَ وَمَن كَفَرَ فَأُمَتِّعُهُ قَلِيْلاً ثُمَّ أَضْطَرُّهُ إِلَى عَذَابِ النَّارِ وَبِئْسَ الْمَصِيْرُ - (البقرة ১২৬)-
‘(স্মরণ কর) যখন ইবরাহীম বলল, পরওয়ারদেগার! এ স্থানকে তুমি শান্তির নগরীতে পরিণত কর এবং এর অধিবাসীদেরকে তুমি ফল-ফলাদি দ্বারা রূযী দান কর- যারা তাদের মধ্যে আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের উপরে বিশ্বাস স্থাপন করে। (আল্লাহ) বললেন, যারা অবিশ্বাস করে, আমি তাদেরকেও কিছু ভোগের সুযোগ দেব। অতঃপর তাদেরকে আমি যবরদস্তি জাহান্নামের আযাবে ঠেলে দেব। কতই না মন্দ ঠিকানা সেটা’ (বাক্বারাহ ২/১২৬)।
ইবরাহীমের উপরোক্ত প্রার্থনা অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে সামান্য শাব্দিক পার্থক্য সহকারে। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيْمُ رَبِّ اجْعَلْ هَـذَا الْبَلَدَ آمِناً وَاجْنُبْنِيْ وَبَنِيَّ أَنْ نَّعْبُدَ الأَصْنَامَ- رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيراً مِّنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّيْ وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَّحِيْمٌ- (إبراهيم ৩৫-৩৬)-
‘যখন ইবরাহীম বলল, হে আমার পালনকর্তা! এ শহরকে তুমি শান্তিময় করে দাও এবং আমাকে ও আমার সন্তান-সন্ততিকে মূর্তিপূজা থেকে দূরে রাখ’ (ইবরাহীম ৩৫)। ‘হে আমার পালনকর্তা! এরা (মূর্তিগুলো) অনেক মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে। অতএব যে আমার অনুসরণ করে, সে আমার দলভুক্ত। আর যে আমার অবাধ্যতা করে, নিশ্চয়ই তুমি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ইবরাহীম ১৪/৩৬)।
অতঃপর কা‘বা গৃহ নির্মাণ শেষে পিতা-পুত্র মিলে যে প্রার্থনা করেন, তা যেমন ছিল অন্তরভেদী, তেমনি ছিল সুদূরপ্রসারী ফলদায়ক। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيْمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيْلُ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ- رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ- رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولاً مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيْهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ العَزِيزُ الحَكِيمُ- (البقرة ১২৭-১২৯)-
‘স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কা‘বা গৃহের ভিত নির্মাণ করল এবং দো‘আ করল- ‘প্রভু হে! তুমি আমাদের (এই খিদমত) কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’। ‘হে প্রভু! তুমি আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহে পরিণত কর এবং আমাদের বংশধরগণের মধ্য থেকেও তোমার প্রতি একটা অনুগত দল সৃষ্টি কর। তুমি আমাদেরকে হজ্জের নীতি-নিয়ম শিখিয়ে দাও এবং আমাদের তওবা কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি তওবা কবুলকারী ও দয়াবান’। ‘হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি এদের মধ্য থেকেই এদের নিকটে একজন রাসূল প্রেরণ কর, যিনি তাদের নিকটে এসে তোমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনাবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই তুমি পরাক্রমশালী ও দূরদৃষ্টিময়’ (বাক্বারাহ ২/১২৭-১২৯)।
ইবরাহীম ও ইসমাঈলের উপরোক্ত দো‘আ আল্লাহ কবুল করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে তাদের বংশে চিরকাল একদল মুত্তাকী পরহেযগার মানুষের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। তাঁদের পরের সকল নবী তাঁদের বংশধর ছিলেন। কা‘বার খাদেম হিসাবেও চিরকাল তাদের বংশের একদল দ্বীনদার লোক সর্বদা নিয়োজিত ছিল। কা‘বার খেদমতের কার
Akhi Akter Mim 10 w
সুবহানাল্লাহ