গৃহস্থ -কন্যারা মাটির দীপ সাজাইবার সময় যেমন তৈল ও সলিতা দেয়,তেমনি তাহারা গায়ে একটি কাঠি দিয়া দেয়।প্রদীপের শিখা যখন কমিয়া আসিতে থাকে,এই ক্ষুদ্র কাঠিটির তখন বড় প্রয়োজন-উসকাইয়া দিতে হয়,এটি না হইলে তৈল এবং সলিতা সত্ত্বেও প্রদীপের জ্বলা চলে না।
সুরেন্দ্রনাথের প্রকৃতিও কতটা এইরূপ। বল,বুদ্ধি, ভরসা তাহার সব আছে, তবু সে একা কোন কাজ সম্পূর্ণ করিতে পারে না।খানিকটা কাজ যেমন ওনি উৎসাহিতের সাথে সহিত করে, বাকিটুকু সে তেমন নীরব আলস্যভরে ছাড়িয়া দিয়া চুপ করিয়া থাকিতে পারে না।তখনই একজন লোকের প্রয়োজন-সে উসকায় দিবে।
সুরেন্দ্রের বাবা সুদূর পশ্চিমাঞ্চলে ওকালতি করিতেন,,এই বাংলাদেশের সহিত তাঁহার বেশি কিছু সম্বন্ধ ছিল না।
এখানেই সুরেন্দ্র তাহার কুড়ি বছর বয়সে এম.এ পাস করে,কতকটা তাহার নিজের গুনে,,কতকটা বিমাতার গুনে।
এ বিমাতাটি এমন অধ্যাবসায়ের সহিত তাহার পিছনে লাগিয়া থাকিতেন যে,সে অনেক সময় বুঝিতে পারিতো না যে তাহার নিজের স্বাধীনতা সত্তা কিছু আছে কিনা।।সুরেন্দ্র বলিয়া কোন স্বতন্ত্র জীব এ জগতে বাস করে,না এ বিমাতার ইচ্ছাই একটি মানুষর আকার ধরিয়া কাজকর্ম, শোয়া বসা পড়াশোনা পাস প্রভৃতি সারিয়া লয়। এই বিমাতাটি নিজের সন্তানের প্রতি কতকটা উদাসীন হইলেও,সুরেন্দ্রর হেফাজতের সীমা ছিলো না। থুথু ফেলাটি পযন্ত তাহার দৃষ্টি অতিক্রম করতো না। এই কর্তব্যপরায়ণা স্ত্রীলোকটির শাসনে থাকিয়া সুরেন্দ্র নামে লেখাপড়া শিখিল, কিন্তু আত্মনির্ভরতা শিখিল না।নিজের ওপর তাহার বিশ্বাস ছিলো না। কোন কর্মই যে তাহার দ্বারা সর্বাঙ্গসুন্দর এবং সম্পূর্ণ হইতে পারে, ইহা সে বুঝিত না।কখন যে তাহার জি প্রয়োজন হবে,,এবং কখন তাহাকে কি করিতে হবে, সে জন্য সে সম্পূর্ণ রুপে আরেক জনের ওপর নির্ভর করিত। ঘুম পাইতেছে,কি ক্ষুদা লাগছে,অনেক সময় সে নিশ্চিত এগুলো ঠাহর করিতে পারিত না।
জ্ঞান হওয়া অবধি,তাহাকে বিমাতার ওপর ভর করিয়া এই পঞ্চদশ বর্ষ কাটায় দিতে হইছে।
সুতরাং বুঝা যায় বিমাতা তাহার জন্য অনেক কাজ করিত। চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে ২২ ঘন্টার তিরস্কার, অনুযোগ, লাঞ্ছনা,তাড়না, মুখবিকৃতি, এতদ্ভিন্ন পরিক্ষার বৎসর,পূর্ব হইতেই তাহাকে সমস্ত রাত্রি সজাগ রাখিবার জন্য তাহার নিজের নিন্দ্রাসুখ বিসর্জন দিতে হইত। আহা, সপত্নীপুত্রের জন্য কে কবে এত করিয়া থাকে। পাড়া প্রতিবেশিরা একমুখে রায়গৃহিনির সখ্যাতি না করিয়া উঠিতে পারে না।
সুরেন্দ্রর উপর তাঁহার আন্তরিক যত্নের এতটুকু ত্রুটি ছিলা না-তিরষ্কার লাঞ্ছনার পর মুহূর্তে যদি তাহার চোখ-মুখ ছলছল করিত,রায়গৃহিনী সেটি জ্বরের পূর্বলক্ষন নিশ্চিত বুঝিয়া,তিন দিনের জন্য তাহার সাগু ব্যবস্থা করিয়া দিতেন।
মানসিক উন্নতি এবং শিক্ষাকল্পে, তাহার আরও তীক্ষ্ণদৃষ্টি ছিল। সুরেন্দ্রের অঙ্গে পরিষ্কার কিংবা আধুনিক রুচির অনুমোদিত বস্ত্রাদি দেখিলেই তাহার শখ এবং বাবুয়ানা করিবার গুপ্ত ইচ্ছা তাহার চক্ষে স্পষ্ট ধরা পড়িয়া যাইত,এবং সেই মুহূর্তে দুই-তিন সপ্তাহের জন সুরেন্দ্রের বস্ত্রাদি রজক ভবনে যাওয়া নিষিদ্ধ হইত।
এমনি ভাবে সুরেন্দ্রের দিন কাটিতেছিল।এমনি সস্নেহ-সর্তকতার মাঝে তাহার কখনও কখনও মনে হইত,এ জীবনটা বাঁচিবার মত নহে,,কখনও বা সে মনে মনে ভাবিত, বুঝি এমন করিয়াই সকলের জীবনর প্রভাতটা অতিবাহিত হয়।কিন্তু একএকদিন আশপাশের লোক গুলো গায়ে পড়িয়া তাহার মাথায় বিভিন্ন ধারনা গুজিয়ে দিয়া যাইত।
একদিন তাহাই হইল।একজন বন্ধু তাহাকে পরামর্শ দিল যে,তাহার মত বুদ্ধিমান ছেলে বিলেত যায়তে পারিলে ভবিষ্যতে অনেক উন্নতির আশা আছে।স্বদেশে ফিরিয়া আসিয়া সে অনেকের উপকার করিতে পারে। কথাটা সুরেন্দ্রের মন্দ লাগিলো না।বনের পাখিটার চেয়ে পিঞ্জরের পাখিটা বেশি ছটফট করে। সুরেন্দ্রের কল্পনায় চক্ষে যেন একটু মুক্ত বায়ু,,একটু স্বাধীনতার আলোক দেখিতে পাইতেছিল,তাই তাহার পরাধীন প্রাণটা উন্মত্তের মত পিঞ্জরের চতুর্দিকে ঝটপট করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগল।
সে তাহার পিতাকে আসিয়া নিবেদন করিল যে,তাহাকে বিলাত যাইবার সকল উপায় করিয়া দিতে হইবে।তাহাতে যে সকল উন্নতির আশা আছে তা ও তাহার পিতাকে বুঝিয়া বলিল। তাহার পিতা বললিলেন ভাবিয়া দেখিবে।কিন্তু গৃহিনীর ইচ্ছা একবারে প্রতিকূল। তিনি পিতাপুত্রের মাঝে ঝড়ের মত আসিয়া পড়িয়া এমন এমনি অট্টহাসি হাসিলেন?? যে দুজনেই স্তম্ভিত হইয়া গেলো??
গৃহিণী বলিলেন তবে আমাকেও বিলাত পাঠাইয়া দাও,,না হলে সুরেন্দ্রে সামলাবে কে?যে জানে না কখন তার খুদা লাগে তখন তাহাকে খেতে হবে,,এমন ছেলেকে একা কিভাবে বিলাত পাঠাবে;;
বাড়িতে থাকা ঘোড়াকে পাঠানো আর সুরেন্দ্রকে বিলাত পাঠানো একি কথা,,তবুও ঘোড়া গরু ক্ষুদা লাগলে হাকডাক করে কিন্তু তোমার পুত্র তো তাও পারে না।তারপর আবারো অট্টহাসি হাসিলেন,???
হাস্যের আধিক্য দর্শনে রায়মহাশয় বিষম লজ্জিত হইয়া পড়িলেন। সুরেন্দ্র মনে করিলো যে এরুপ অকাট্য যুক্তির বিপক্ষে কোনোরূপ প্রতিবাদ করা যায় না। বিলাত যাইবার আশা সে ত্যাগ করিলো,তাহার বন্ধু এ কথা শুনিয়া বিশেষ দুঃখিত হইল।তবে বিলাত যাইবার আর কোন উপায় আছে কিনা তাহাও সে বলিয়া দিতে পারিল না।কিন্তু অবশেষে কহিল যে এরুপ পরাধীনভাবে থাকার চেয়ে ভিক্ষা করিয়া খাওয়া শ্রেয়ঃ এবং ইহাও নিশ্চিত যে এরুপ সম্মানের সহিত এম এ পাস করিতে পারে-উদরান্নের জন তাহাকে লালায়ত হইতে হয় না।
একদিন গভীর রাতে সে স্টেশনে আসিয়া কলিকাতার টিকিট কিনিয়া গাড়িতে বসিল,এবং ডাকযোগে পিতাকে পত্র লিখিয়া দিল যে,কিছুদিনের জন্য সে বাড়ি ত্যাগ করিতেছে,অর্নথক অনুসন্ধান করিয়া বিশেষ লাভ হইবে না,এবং সন্ধান পাইলেও যে সে বাড়ি ফিরিয়া আসিবে এরুপ সম্ভাবনা নাই।
রায়মহাশয় গৃহিণীতে এ পত্র দেখাইলেন,,,তিনি বলিলেন সুরো এখন মানুষ হইয়াছে-বিদ্যা শিখিয়াছে, পাখা বাহির করিয়া এখন উড়িয়া পালাবে না তো আর কখন পালাব?
তথাপি তিনি অনুসন্ধান করিলেন কলকাতার যাহারা পরিচিত ছিল,তাহাদিগে পত্র দিলেন কিন্তু কোন উপায় হইলো না।সুরেন্দ্রের কোনো সন্ধান পাওয়া গেলো না।
কলিকাতার জনকোলাহলপূর্ণ রাজপথে পড়িয়া সুরেন্দ্র প্রমাদ গণিল।