সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নদী

বৃষ্টি, প্রস্রবণ, হিমবাহ, হ্রদ আর তুষার গলা পানি থেকে ছোট ছোট ধারার সৃষ্টি হয়- তারই মিলিত রূপ নদী। এবং আমরা জানি ?

সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নদী

যে মাটিতে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এই ভূ-খণ্ডের মানুষের সাথেও নদীর নিবিড় সম্পর্ক। পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা- এই চারটি প্রধান নদী ছাড়াও মাথাভাঙা, ইছামতি, কুমার, গড়াই মধুমতি, আড়িয়াল খাঁ, তিস্তা, ধলেশ্বরী, করতোয়া, আত্রেয়ী, সুরমা, কুশিয়ারা, তিতাস, গোমতিসহ বিভিন্ন উপনদী ও শাখা-প্রশাখা বাংলাদেশের চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে পার্বত্য নদী কর্ণফুলী, সাংগু, মাতামুহুরী, হালদা আর নাফ। আবহমানকাল থেকে বাংলাদেশের মানুষ নদীর ভাঙা-গড়ার খেলার সাথে একাত্ম। সর্পিল নদীর জলের আঘাতে একদিকে পাড় ভাঙে তো অন্যদিকে জেগে ওঠে নতুন জমি। নদীকে কেন্দ্র করে যাদের জীবিকা তারা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে। বাঙালির জীবনের সাথে নদীর সম্পৃক্ততার কারণেই সাহিত্য, শিল্প আর সংস্কৃতিতে এর প্রবল উপস্থিতি সহজেই চোখে পড়ে। উপন্যাসে, ছোটগল্পে, পত্রসাহিত্যে, স্মৃতিকথাতে, কবিতা আর ছড়াতে, গানে এবং চলচ্চিত্রে নদী আপন মহিমায় ভাস্বর। বাংলা উপন্যাসে নদী কখনো প্রসঙ্গক্রমে এসেছে, কখনো তার রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’, সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’এবং অদ্বৈত মল্ল বর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ নদীর একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। পাঠক যখন পড়ে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র ‘দিন কাটিয়া যায়। জীবন অতিবাহিত হয়। ঋতুচক্রে সময় পাক খায়, পদ্মার ভাঙন ধরা তীরে মাটি ধ্বসিতে থাকে, নদীর বুকে জল ভেদ করিয়া জাগিয়া উঠে নতুন চর, অর্ধ-শতাব্দীর বিস্তীর্ণ চর পদ্মার জলে আবার বিলীন হইয়া যায়।... এ জলের দেশ। বর্ষাকালে চারদিক জলে জলময় হইয়া যায়। প্রত্যেক বছর কয়েকটা দিনের জন্য এই সময়ে মানুষের বাড়ি-ঘর আর উঁচু জমিগুলি ছাড়া সারাটা দেশ জলে ডুবিয়া থাকে। জল যেবার বেশি হয় মানুষের বাড়ির উঠানও সেবার রেহাই পায় না। পথঘাটের চিহ্নও থাকে না। একই গ্রামে এ পাড়া হইতে ও-পাড়ায় যাইতে হয় নৌকায়। কয়েকদিন পর জল কমিয়া যায়, জলের ভিতর হইতে পথগুলি স্থানে স্থানে উঁকি দিতে আরম্ভ করে। কিন্তু আরো এক মাসের মধ্যে পথগুলি ব্যবহার করা চলে না’— তখন প্রমত্তা পদ্মার ভয়ঙ্কর রূপ, বর্ষার বেগবান প্রকৃতি তার সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে। এ উপন্যাস পাঠে সে উপলব্ধি করতে পারে, পদ্মাকে কেন্দ্র করে মৎস্যজীবী মানুষের জীবনসংগ্রাম। এ ছাড়া হুমায়ূন কবিরের ‘নদী ও নারী’, তারাশংকার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতি’, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’, অমর মিত্রের ‘সুবর্ণ রেখা’, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ এবং ইমদাদুল হক মিলনের ‘নদী উপাখ্যান’ উপন্যাসেও নদীর তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা চোখে পড়ে। পাশাপাশি আবার কোনো কোনো উপন্যাসে নদী কেবলমাত্র একটি বিশেষ ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করে। যেমন, রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে নির্জন চরের দৃশ্য শচীনের ধ্যানের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আবার কয়েকটি উপন্যাসে নদীকে বিশেষ শিল্প কৌশলের প্রয়োজনে আনা হয়েছে, এখানে নদী উপন্যাসের বহিরঙ্গ গুণ হিসেবে পরিমণ্ডলে অবস্থান করে। উদাহরণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’, ‘নৌকাডুবি’, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিষবৃক্ষ’ বা ‘কপালকুণ্ডলা’র কথা বলা যায়। বাংলা সাহিত্যের বেশ কয়েকটি গল্পে নদীর নান্দনিক উপস্থিতি চোখে পড়ে। যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’, ‘অতিথি’, ‘সমাপ্তি’, ‘নিশীথে’; কাজী নজরুল ইসলামের ‘জিনের বাদশা’, নব্যেন্দু ঘোষের ‘নাগিনী’, সমরেশ বসুর ‘লড়াই’, মনীন্দ্রলাল বসুর ‘মালতী’প্রভৃতি গল্পে নদী কোথাও পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, কোথাও গল্পের বহিরঙ্গ গুণ হিসেবে পরিমণ্ডলে অবস্থান করেছে, আবার কোথাও বিশেষ শিল্প কৌশলের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়েছে। সমরেশ বসুর ‘পাড়ি’ গল্পে, যেখানে একজন পুরুষ একজন নারী- দুজন নিম্ন শ্রেণীর মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম দেখানো হয়েছে, এখানে নদীর পটভূমিকা অত্যন্ত জোরালো। ‘আষাঢ়ের গঙ্গা। অম্বুবাচীর পর রক্ত ঢল নেমেছে তার বুকে। মেয়ে গঙ্গা মা হয়েছে। ভারী হয়েছে, বাড় লেগেছে, টান বেড়েছে, দুলছে, নাচছে, আছড়ে আছড়ে পড়ছে। ফুলছে, ফাঁপছে, যেন আর ধরে রাখতে পারছে না নিজেকে। বোঝা যাচ্ছে আরো বাড়বে। স্রোত সর্পিল হচ্ছে। বেঁকেছে হঠাৎ। তারপর লাটিমটির মতো ঠেক করে পাক খেয়ে যাচ্ছে। স্রোতের গায়ে ওগুলি ছোট ছোট ঘূর্ণি। মানুষের ভয় নেই, মরণ নেই ওতে পশুর। শুকনো পাতা পড়ে, কুটো পড়ে। অমনি গিলে নেয় টপাস করে। বড় ঘূর্ণি হলে মানুষ গিলত। এই ঘূর্ণি-ঘূর্ণি খেলা। যেন তীব্র স্রোত ছুটে এসে একবার দাঁড়াচ্ছে। আবার ছুটছে তরতর করে’— এখানে গঙ্গা যেন স্বয়ং একটি চরিত্র, তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ কঠিন জীবনের নদীর চমৎকার উপস্থিতি বলা যায় তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের নদীর রূপ পরিস্ফুটিত রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’-এ এবং বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিকথাতে।আমার ছেলেবেলা’তে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন: ‘নোয়াখালির মেঘনার মতো এমন হতশ্রী নদী পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখি নি। রুক্ষ পাড়ি, ঘাট নেই কোথাও, কেউ নামে না স্নান করতে, কোনো মেয়ে জল নিতে আসে না। তরণীহীন, রঙিন পালে চিহ্নিত নয়, জেলে ডিঙ্গির সঞ্চরণ নেই- একটি মাত্র খেয়া-নৌকা দেহাতি ব্যাপারিদের নিয়ে সকালে-সন্ধ্যায় পারাপার করে। শহরের এলাকাটুকু পেরোলেই নদীর ধারে-ধারে বনজঙ্গল, নয়তো শুধু বালুডাঙ্গা, মাঝে মাঝে চোরাবালিও লুকিয়ে আছে- শীতে গ্রীষ্মে বিস্তীর্ণ চরের ফাঁকে-ফাঁকে শীর্ণ জলধারা বয়ে যায়। বর্ষার স্ফীত হয়ে ওঠে নদী- বিশাল অন্য তীর অদৃশ্য।


Kader 11

42 Blog posts

Comments