কওমে ছামূদ-এর উপরে আপতিত গজবের বিবরণ
ইবনু কাছীর বর্ণনা করেন যে, হযরত সালেহ (আঃ)-এর নিরন্তর দাওয়াতে অতিষ্ঠ হয়ে সম্প্রদায়ের নেতারা স্থির করল যে, তাঁর কাছে এমন একটা বিষয় দাবী করতে হবে, যা পূরণ করতে তিনি ব্যর্থ হবেন এবং এর ফলে তাঁর দাওয়াতও বন্ধ হয়ে যাবে। সেমতে তারা এসে তাঁর নিকটে দাবী করল যে, আপনি যদি আল্লাহর সত্যিকারের নবী হন, তাহ’লে আমাদেরকে নিকটবর্তী ‘কাতেবা’ পাহাড়ের ভিতর থেকে একটি দশ মাসের গর্ভবতী সবল ও স্বাস্থ্যবতী উষ্ট্রী বের করে এনে দেখান।
এ দাবী শুনে হযরত সালেহ (আঃ) তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলেন যে, যদি তোমাদের দাবী পুরণ করা হয়, তবে তোমরা আমার নবুঅতের প্রতি ও আমার দাওয়াতের প্রতি ঈমান আনবে কি-না। জেনে রেখ, উক্ত মু‘জেযা প্রদর্শনের পরেও যদি তোমরা ঈমান না আনো, তাহলে আল্লাহর গজবে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে’। এতে সবাই স্বীকৃত হল ও উক্ত মর্মে অঙ্গীকার করল। তখন সালেহ (আঃ) সালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ পাক তার দো‘আ কবুল করলেন এবং বললেন, إِنَّا مُرْسِلُو النَّاقَةِ فِتْنَةً لَّهُمْ فَارْتَقِبْهُمْ وَاصْطَبِرْ ‘আমি তাদের পরীক্ষার জন্য একটি উষ্ট্রী প্রেরণ করব। তুমি তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখ এবং ধৈর্য ধারণ কর’ (ক্বামার ৫৪/২৭)। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ের গায়ে কম্পন দেখা দিল এবং একটি বিরাট প্রস্তর খন্ড বিস্ফোরিত হয়ে তার ভিতর থেকে কওমের নেতাদের দাবীর অনুরূপ একটি গর্ভবতী ও লাবণ্যবতী তরতাযা উষ্ট্রী বেরিয়ে এল।
সালেহ (আঃ)-এর এই বিস্ময়কর মু‘জেযা দেখে গোত্রের নেতা সহ তার সমর্থক লোকেরা সাথে সাথে মুসলমান হয়ে গেল। অবশিষ্টরাও হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করল। কিন্তু প্রধান ধর্মনেতা ও অন্যান্য সমাজ নেতাদের বাধার কারণে হতে পারল না। তারা উল্টা বলল, قَالُوا اطَّيَّرْنَا بِكَ وَبِمَن مَّعَكَ ...- ‘আমরা তোমাকে ও তোমার সাথে যারা আছে তাদেরকে অকল্যাণের প্রতীক মনে করি’ (নামল ২৭/৪৭)। হযরত সালেহ (আঃ) কওমের নেতাদের এভাবে অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে দেখে এবং পাল্টা তাঁকেই দায়ী করতে দেখে দারুণভাবে শংকিত হ’লেন যে, যেকোন সময়ে এরা আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি তাদেরকে সাবধান করে বললেন, قَالَ طَائِرُكُمْ عِنْدَ اللَّهِ بَلْ أَنتُمْ قَوْمٌ تُفْتَنُوْنَ- ‘দেখ, তোমাদের মঙ্গলামঙ্গল আল্লাহর নিকটে রয়েছে। বরং তোমরা এমন সম্প্রদায়, যাদেরকে পরীক্ষা করা হচ্ছে’ (নামল ২৭/৪৭)। অতঃপর পয়গম্বরসূলভ দয়া প্রকাশ করে বললেন,
هَـذِهِ نَاقَةُ اللّهِ لَكُمْ آيَةً فَذَرُوْهَا تَأْكُلْ فِيْ أَرْضِ اللّهِ وَلاَ تَمَسُّوْهَا بِسُوْءٍ فَيَأْخُذَكُمْ عَذَابٌ قَرِيْبٌ- (هود ৬৪)-
‘এটি আল্লাহর উষ্ট্রী। তোমাদের জন্য নিদর্শন স্বরূপ। একে আল্লাহর যমীনে স্বাধীনভাবে চরে বেড়াতে দাও। সাবধান! একে অসৎ উদ্দেশ্যে স্পর্শ করো না। তাহ’লে তোমাদেরকে সত্বর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি পাকড়াও করবে’ (হূদ ১১/৬৪)।
আল্লাহ উক্ত উষ্ট্রীর জন্য এবং লোকদের জন্য পানি বণ্টন করে দিয়েছিলেন। তিনি নবীকে বলে দেন,
َنَبِّئْهُمْ أَنَّ الْمَاءَ قِسْمَةٌ بَيْنَهُمْ كُلُّ شِرْبٍ مُّحْتَضَرٌ
‘হে সালেহ! তুমি ওদেরকে বলে দাও যে, কূপের পানি তাদের মধ্যে বণ্টিত হয়েছে। প্রত্যেক পালায় তারা হাযির হবে’ (ক্বামার ৫৪/২৮)।
لَّهَا شِرْبٌ وَلَكُمْ شِرْبُ يَوْمٍ مَّعْلُوْمٍ-
‘একদিন উষ্ট্রীর ও পরের দিন তোমাদের (পানি পানের) জন্য পালা নির্ধারিত হয়েছে’ (ক্বামার ৫৪/২৮; শো‘আরা ২৬/১৫৫)।
আল্লাহ তা‘আলা কওমে ছামূদ-এর জন্য উক্ত উষ্ট্রীকেই সর্বশেষ পরীক্ষা হিসাবে নির্ধারণ করেছিলেন। তিনি বলেন,
وَآتَيْنَا ثَمُوْدَ النَّاقَةَ مُبْصِرَةً فَظَلَمُوْا بِهَا وَمَا نُرْسِلُ بِالآيَاتِ إِلاَّ تَخْوِيْفًا-
‘আর আমি ছামূদকে উষ্ট্রী দিয়েছিলাম স্পষ্ট নিদর্শন হিসাবে। কিন্তু তারা তার প্রতি যুলুম করেছিল। বস্ত্ততঃ আমি ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই নিদর্শন সমূহ প্রেরণ করে থাকি’ (ইসরা ১৭/৫৯)।
ছামূদ জাতির লোকেরা যে কূপ থেকে পানি পান করত ও তাদের গবাদি পশুদের পানি পান করাত, এ উষ্ট্রীও সেই কূপ থেকে পানি পান করত। উষ্ট্রী যেদিন পানি পান করত, সেদিন কূয়ার পানি নিঃশেষে পান করে ফেলত। অবশ্য ঐদিন লোকেরা উষ্ট্রীর দুধ পান করত এবং বাকী দুধ দ্বারা তাদের সব পাত্র ভরে নিত। কিন্তু এই হতভাগাদের কপালে এত সুখ সহ্য হল না। তারা একদিন পানি না পাওয়াকে অসুবিধার কারণ হিসাবে গণ্য করল। তাছাড়া উষ্ট্রী যখন ময়দানে চরে বেড়াত, তখন তার বিশাল দেহ ও অপরূপ চেহারা দেখে অন্যান্য গবাদি পশু ভয় পেত। ফলে তারা উষ্ট্রীকে মেরে ফেলতে মনস্থ করল। কিন্তু আল্লাহর গজবের ভয়ে কেউ সাহস করল না।
ইবনু জারীর প্রমুখ মুফাসসিরগণের বর্ণনা মতে, অবশেষে শয়তান তাদেরকে সর্ববৃহৎ কুমন্ত্রণা দিল। আর তা হল নারীর প্রলোভন। ছামূদ গোত্রের দু’জন পরমা সুন্দরী মহিলা, যারা সালেহ (আঃ)-এর প্রতি দারুণ বিদ্বেষী ছিল, তারা তাদের রূপ-যৌবন দেখিয়ে দু’জন পথভ্রষ্ট যুবককে উষ্ট্রী হত্যায় রাজি করালো। অতঃপর তারা তীর ও তরবারির আঘাতে উষ্ট্রীকে পা কেটে হত্যা করে ফেলল। হত্যাকারী যুবকদ্বয়ের প্রধানকে লক্ষ্য করেই কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, إِذِ انْبَعَثَ أَشْقَاهَا ‘যখন তাদের সবচেয়ে হতভাগা লোকটি তৎপর হয়ে উঠেছিল’ (শাম্স ৯১/১২)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদা খুৎবায় উক্ত আয়াত পাঠ করে বলেন, ঐ লোকটি ছিল কঠোর হৃদয় ও দুশ্চরিত্র (رجل عزيز عارم )।[মুসলিম, হা/২৮৫৫; কুরতুবী হা/৩১০৬] কেননা তার কারণেই গোটা ছামূদ জাতি গজবে পতিত হয়। আল্লাহ বলেন,
فَنَادَوْا صَاحِبَهُمْ فَتَعَاطَى فَعَقَرَ، فَكَيْفَ كَانَ عَذَابِي وَنُذُرِ، إِنَّا أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ صَيْحَةً وَاحِدَةً فَكَانُوْا كَهَشِيْمِ الْمُحْتَظِرِ-
‘অতঃপর তারা তাদের প্রধান ব্যক্তিকে ডাকল। অতঃপর সে উষ্ট্রীকে ধরল ও বধ করল’ (২৯)। ‘অতঃপর কেমন কঠোর ছিল আমার শাস্তি ও ভীতি প্রদর্শন! (৩০)। ‘আমি তাদের প্রতি প্রেরণ করলাম একটিমাত্র নিনাদ। আর তাতেই তারা হয়ে গেল খোয়াড় মালিকের চূর্ণিত শুষ্ক খড়কুটো সদৃশ’ (ক্বামার ৫৪/২৯-৩১)।
উল্লেখ্য যে, উষ্ট্রী হত্যার ঘটনার পর সালেহ (আঃ) স্বীয় কওমকে আল্লাহর নির্দেশ জানিয়ে দিলেন যে,
تَمَتَّعُوْا فِيْ دَارِكُمْ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ ذَلِكَ وَعْدٌ غَيْرُ مَكْذُوْبٍ-
‘এখন থেকে তিনদিন তোমরা তোমাদের ঘরে আরাম করে নাও (এর পরেই আযাব নেমে আসবে)। এ ওয়াদার (অর্থাৎ এ সময়সীমার) কোন ব্যতিক্রম হবে না’ (হূদ ১১/৬৫)। কিন্তু এই হতভাগারা এরূপ কঠোর হুঁশিয়ারির কোন গুরুত্ব না দিয়ে বরং তাচ্ছিল্যভরে বলল,
يَا صَالِحُ ائْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الْمُرْسَلِيْنَ
‘হে সালেহ! তুমি যার ভয় দেখাচ্ছ, তা নিয়ে আস দেখি, যদি তুমি সত্যিকারের নবী হয়ে থাক’ (আ‘রাফ ৭/৭৭)। তারা বলল, আমরা জানতে চাই, এ শাস্তি কিভাবে আসবে, কোত্থেকে আসবে, এর লক্ষণ কি হবে? সালেহ (আঃ) বললেন, আগামীকাল বৃহষ্পতিবার তোমাদের সকলের মুখমন্ডল হলুদ হয়ে যাবে। পরের দিন শুক্রবার তোমাদের সবার মুখমন্ডল লালবর্ণ ধারণ করবে। অতঃপর শনিবার দিন সবার মুখমন্ডল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হয়ে যাবে। এটাই হবে তোমাদের জীবনের শেষ দিন।[তাফসীর ইবনু কাছীর, সূরা আ‘রাফ ৭৭-৭৮]
একথা শোনার পর হঠকারী জাতি আল্লাহর নিকটে তওবা করে ক্ষমা প্রার্থনার পরিবর্তে স্বয়ং সালেহ (আঃ)-কেই হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ভাবল, যদি আযাব এসেই যায়, তবে তার আগে একেই শেষ করে দিই। কেননা এর নবুঅতকে অস্বীকার করার কারণেই গজব আসছে। অতএব এই ব্যক্তিই গজবের জন্য মূলতঃ দায়ী। আর যদি গজব না আসে, তাহলে সে মিথ্যার দন্ড ভোগ করুক’। কওমের নয়জন নেতা এ নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্রের নেতৃত্ব দেয়। তাদের এই চক্রান্তের বিষয় সূরা নমলে বর্ণিত হয়েছে এভাবে যে,
وَكَانَ فِي الْمَدِيْنَةِ تِسْعَةُ رَهْطٍ يُفْسِدُوْنَ فِي الْأَرْضِ وَلاَ يُصْلِحُوْنَ، قَالُوْا تَقَاسَمُوْا بِاللَّهِ لَنُبَيِّتَنَّـهُ وَأَهْلَهُ ثُمَّ لَنَقُولَنَّ لِوَلِيِّهِ مَا شَهِدْنَا مَهْلِكَ أَهْلِهِ وَإِنَّا لَصَادِقُوْنَ-(نمل ৪৮-৪৯)-
‘সেই শহরে ছিল এমন নয় ব্যক্তি, যারা জনপদে অনর্থ সৃষ্টি করে বেড়াত এবং কোনরূপ সংশোধনমূলক কাজ তারা করত না’ (৪৮)। ‘তারা বলল, তোমরা পরস্পরে আল্লাহর নামে শপথ কর যে, আমরা রাত্রিকালে সালেহ ও তার পরিবার বর্গকে হত্যা করব। অতঃপর তার রক্তের দাবীদারকে আমরা বলে দেব যে, আমরা এ হত্যাকান্ড প্রত্যক্ষ করিনি। আর আমরা নিশ্চিতভাবে সত্যবাদী’ (নমল ২৭/৪৮-৪৯)।
তারা যুক্তি দিল, আমরা আমাদের কথায় অবশ্যই সত্যবাদী প্রমাণিত হব। কারণ রাত্রির অন্ধকারে কে কাকে মেরেছে, তা আমরা নির্দিষ্টভাবে জানতে পারব না। নেতৃবৃন্দের এ সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ও চক্রান্ত অনুযায়ী নয় নেতা তাদের প্রধান ক্বাদার বিন সালেফ-এর নেতৃত্বে রাতের বেলা সালেহ (আঃ)-কে হত্যা করার জন্য তাঁর বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা পথিমধ্যেই তাদেরকে প্রস্তর বর্ষণে ধ্বংস করে দিলেন। আল্লাহ বলেন,
وَمَكَرُوْا مَكْرًا وَمَكَرْنَا مَكْرًا وَهُمْ لاَ يَشْعُرُوْنَ، فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ مَكْرِهِمْ أَنَّا دَمَّرْنَاهُمْ وَقَوْمَهُمْ أَجْمَعِيْنَ- (نمل ৫০-৫১)-
‘তারা ষড়যন্ত্র করল। আমিও পাল্টা কৌশল করলাম। অথচ তারা কিছুই জানতে পারল না’। ‘তাদের চক্রান্তের পরিণতি দেখ। আমি অবশ্যই তাদেরকে ও তাদের সম্প্রদায়ের সবাইকে ধ্বংস করে দিয়েছিলাম’ (নমল ২৭/৫০-৫১)।
উল্লেখ্য যে, কুরআনে ঐ নয় ব্যক্তিকে تِسْعَةُ رَهْطٍ বা ‘নয়টি দল’ বলা হয়েছে। এতে বুঝা যায় যে, ওরা নয়জন নয়টি দলের নেতা ছিল এবং তারা ছিল হিজ্র জনপদের প্রধান নেতৃবৃন্দ (ইবনু কাছীর, সূরা নমল, ঐ)।
উপরোক্ত চক্রান্তের ঘটনায় একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, জাতির শীর্ষ দুষ্টমতি নেতারা কুফর, শিরক, হত্যা-সন্ত্রাস ও ডাকাতি-লুণ্ঠনের মত জঘন্য অপরাধ সমূহ নির্বিবাদে করে গেলেও তারা তাদের জনগণের কাছে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হতে রাজি ছিল না। আর তাই এক মিথ্যাকে ঢাকার জন্য শত মিথ্যার আশ্রয় নিতেও তারা কখনো কুণ্ঠাবোধ করে না।
যাই হোক নির্ধারিত দিনে গজব নাযিল হওয়ার প্রাক্কালেই আল্লাহর হুকুমে হযরত সালেহ (আঃ) স্বীয় ঈমানদার সাথীগণকে নিয়ে এলাকা ত্যাগ করেন। যাওয়ার সময় তিনি স্বীয় কওমকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
يَا قَوْمِ لَقَدْ أَبْلَغْتُكُمْ رِسَالَةَ رَبِّيْ وَنَصَحْتُ لَكُمْ وَلَكِن لاَّ تُحِبُّوْنَ النَّاصِحِيْنَ-
‘হে আমার জাতি! আমি তোমাদের কাছে স্বীয় পালনকর্তার পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি এবং সর্বদা তোমাদের কল্যাণ কামনা করেছি। কিন্তু তোমরা তোমাদের কল্যাণকামীদের ভালবাসো না’ (আ‘রাফ ৭/৭৯)।
গজবের ধরন
হযরত সালেহ (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী বৃহষ্পতিবার ভোরে অবিশ্বাসী কওমের সকলের মুখমন্ডল গভীর হলুদ বর্ণ ধারণ করল। কিন্তু তারা ঈমান আনল না বা তওবা করল না। বরং উল্টা হযরত সালেহ (আঃ)-এর উপর চটে গেল ও তাঁকে হত্যা করার জন্য খুঁজতে লাগল। দ্বিতীয় দিন সবার মুখমন্ডল লাল বর্ণ ও তৃতীয় দিন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেল। তখন সবই নিরাশ হয়ে গজবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। চতুর্থ দিন রবিবার সকালে সবাই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুততি নিয়ে সুগন্ধি মেখে অপেক্ষা করতে থাকে।[ইবনু কাছীর, সূরা আ‘রাফ ৭৩-৭৮] এমতাবস্থায় ভীষণ ভূমিকম্প শুরু হল এবং উপর থেকে বিকট ও ভয়াবহ এক গর্জন শোনা গেল। ফলে সবাই যার যার স্থানে একযোগে অধোমুখী হয়ে ভূতলশায়ী হল (আ‘রাফ ৭/৭৮; হূদ ১১/৬৭-৬৮) এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হল এমনভাবে, যেন তারা কোনদিন সেখানে ছিল না’। অন্য আয়াতে এসেছে যে, ‘আমি তাদের প্রতি একটিমাত্র নিনাদ পাঠিয়েছিলাম। তাতেই তারা শুষ্ক খড়কুটোর মত হয়ে গেল’ (ক্বামার ৫৪/৩১)।
কোন কোন হাদীছে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ছামূদ জাতির উপরে আপতিত গজব থেকে ‘আবু রেগাল’ নামক জনৈক অবিশ্বাসী নেতা ঐ সময় মক্কায় থাকার কারণে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু হারাম শরীফ থেকে বেরোবার সাথে সাথে সেও গজবে পতিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছাহাবায়ে কেরামকে মক্কার বাইরে আবু রেগালের উক্ত কবরের চিহ্ন দেখান এবং বলেন যে, তার সাথে একটা স্বর্ণের ছড়িও দাফন হয়ে গিয়েছিল। তখন কবর খনন করে তারা ছড়িটি উদ্ধার করেন। উক্ত রেওয়ায়াতে একথাও বলা হয়েছে যে, ত্বায়েফের প্রসিদ্ধ ছাক্বীফ গোত্র উক্ত আবু রেগালের বংশধর। তবে হাদীছটি যঈফ।[ইবনু কাছীর, আ‘রাফ ৭৮; আলবানী, যঈফ আবুদাঊদ; যঈফাহ হা/৪৭৩৬]
অন্য হাদীছে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন যে, ‘ছাক্বীফ গোত্রে একজন মিথ্যাবাদী (ভন্ড নবী) ও একজন রক্ত পিপাসুর জন্ম হবে।[মুসলিম, মিশকাত হা/৫৯৯৪] রাসূলের এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হয় এবং এই বংশে মিথ্যা নবী মোখতার ছাক্বাফী এবং রক্তপিপাসু কসাই ইরাকের উমাইয়া গবর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জন্ম হয়। কওমে ছামূদ-এর অভিশপ্ত বংশের রক্তধারার কু-প্রভাব হওয়াটাও এতে বিচিত্র নয়।
অন্য এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, ৯ম হিজরীতে তাবূক যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সিরিয়া ও হেজাযের মধ্যবর্তী ‘হিজ্র’ নামক সে স্থানটি অতিক্রম করেন, যেখানে ছামূদ জাতির উপরে গজব নাযিল হয়েছিল। তিনি ছাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশ দেন, কেউ যেন ঐ গজব বিধ্বস্ত এলাকায় প্রবেশ না করে এবং ওখানকার কূয়ার পানি ব্যবহার না করে’।[বুখারী হা/৪৩৩, মুসলিম, আহমাদ] এসব আযাব-বিধ্বস্ত এলাকাগুলিকে আল্লাহ তা‘আলা ভবিষ্যৎ মানবজাতির জন্য শিক্ষাস্থল হিসাবে সংরক্ষিত রেখেছেন, যাতে তারা উপদেশ হাছিল করতে পারে এবং নিজেদেরকে আল্লাহর অবাধ্যতা হতে বিরত রাখে।
আরবরা তাদের ব্যবসায়িক সফরে নিয়মিত সিরিয়া যাতায়াতের পথে এইসব ধ্বংসস্ত্তপ গুলি প্রত্যক্ষ করত। অথচ তাদের অধিকাংশ তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেনি এবং শেষনবীর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেনি। যদিও পরবর্তীতে সব এলাকাই ‘মুসলিম’ এলাকায় পরিণত হয়ে গেছে। আল্লাহ বলেন,
وَكَمْ أَهْلَكْنَا مِنْ قَرْيَةٍ بَطِرَتْ مَعِيْشَتَهَا فَتِلْكَ مَسَاكِنُهُمْ لَمْ تُسْكَن مِّن بَعْدِهِمْ إِلاَّ قَلِيلاً وَكُنَّا نَحْنُ الْوَارِثِيْنَ، وَمَا كَانَ رَبُّكَ مُهْلِكَ الْقُرَى حَتَّى يَبْعَثَ فِيْ أُمِّهَا رَسُولاً يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِنَا وَمَا كُنَّا مُهْلِكِي الْقُرَى إِلاَّ وَأَهْلُهَا ظَالِمُوْنَ- (القصص ৫৮-৫৯)-
‘আমি অনেক জনপদ ধ্বংস করেছি; যেসবের অধিবাসীরা তাদের বিলাসী জীবন যাপনে মত্ত ছিল। তাদের এসব আবাসস্থলে তাদের পরে মানুষ খুব সামান্যই বসবাস করেছে। অবশেষে আমিই এসবের মালিক রয়েছি’। ‘আপনার পালনকর্তা জনপদ সমূহকে ধ্বংস করেন না, যে পর্যন্ত না তার কেন্দ্রস্থলে রাসূল প্রেরণ করেন। যিনি তাদের কাছে আমার আয়াত সমূহ পাঠ করেন। আর আমি জনপদ সমূহকে তখনই ধ্বংস করি, যখন তার বাসিন্দারা (অর্থাৎ নেতারা) যুলুম করে’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৮-৫৯)।
উল্লেখ্য যে, উপরে বর্ণিত কাহিনীর প্রধান বিষয়গুলি পবিত্র কুরআনের ২২টি সূরায় ৮৭টি আয়াতে এবং কিছু অংশ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। কিছু অংশ এমনও রয়েছে যা তাফসীরবিদগণ বিভিন্ন ইস্রাঈলী বর্ণনা থেকে সংগ্রহ করেছেন, যা সত্য ও মিথ্যা দুই-ই হতে পারে। কিন্তু সেগুলি কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় এবং সেগুলির উপরে ঘটনার প্রমাণ নির্ভরশীল নয়।
কওমে ছামূদ-এর ধ্বংস কাহিনীতে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ
১. সমাজের মুষ্টিমেয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও শক্তিশালী শ্রেণী সবার আগে শয়তানের পাতানো ফাঁদে পা দেয় ও সমাজকে জাহান্নামের পথে আহবান করে এবং তাদেরকে ধ্বংসের পথে পরিচালনা করে। যেমন কওমে ছামূদ-এর প্রধান নয় কুচক্রী নেতা করেছিল (নামল ২৭/৪৮)।
২. দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা সাধারণতঃ অন্যদের আগে আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী হয় ও এজন্য যেকোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হয়ে যায়।
৩. অবিশ্বাসীরা মূলতঃ দুনিয়াবী স্বার্থে আল্লাহ প্রেরিত শরী‘আতে বিশ্বাস ও তদনুযায়ী আমল প্রত্যাখ্যান করে এবং নিজেদের কল্পিত শিরকী আক্বীদায় বিশ্বাস ও তদনুযায়ী আমলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এবং তারা সর্বদা তাদের বাপ-দাদা ও প্রচলিত প্রথার দোহাই দেয়।
৪. নবী ও সংস্কারকগণ সাধারণতঃ উপদেশদাতা হয়ে থাকেন- শাসক নন।
৫. নবী ও সংস্কারকদের বিরুদ্ধে শাসক ও সমাজ নেতাগণ যুলুম করলে সরাসরি আল্লাহর গজব নেমে আসা অবশ্যম্ভাবী।
৬. মানুষকে বিপথে নেওয়ার জন্য শয়তানের সবচাইতে বড় হাতিয়ার হল নারী ও অর্থ-সম্পদ।
৭. হঠকারী ও পদগর্বী নেতারা সাধারণতঃ চাটুকার ও চক্রান্তকারী হয়ে থাকে ও ঈমানদারগণের বিরুদ্ধে সাময়িকভাবে জয়ী হয়। কিন্তু অবশেষে আল্লাহর কৌশল বিজয়ী হয় এবং কখনো কখনো তারা দুনিয়াতেই আল্লাহর গজবে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। আর আখেরাতের আযাব হয় তার চাইতে কঠিনতর (ক্বলম ৬৮/৩৩)।
৮. আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাকে নে‘মতরাজি দান করেন তাকে পরীক্ষা করার জন্য। শুকরিয়া আদায় করলে সে আরও বেশী পায়। কিন্তু কুফরী করলে সে ধ্বংস হয় এবং উক্ত নে‘মত তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
৯. অহংকারীদের অন্তর শক্ত হয়। তারা এলাহী গজব প্রত্যক্ষ করার পরেও তাকে তাচ্ছিল্য করে। যেমন নয় নেতা ১ম দিন গজবে ধ্বংস হলেও অন্যেরা তওবা না করে তাচ্ছিল্য করেছিল। ফলে অবশেষে ৪র্থ দিন তারা সবাই ধ্বংস হয়ে যায়।
১০. আল্লাহ যালেম জনপদকে ধ্বংস করেন অন্যদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য।
১১. আল্লাহ সংশোধনকামী জনপদকে কখনোই ধ্বংস করেন না।
১২. কখনো মাত্র একজন বা দু’জনের কারণে গোটা সমাজ ধ্বংস হয়ে যায়। সালেহ (আঃ)-এর উষ্ট্রী হত্যাকারী ছিল মাত্র দু’জন। অতএব মুষ্টিমেয় কুচক্রীদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর সমাজকে সদা সতর্ক থাকতে হয়।
১৩. কুচক্রীদের কৌশল আল্লাহ ব্যর্থ করে দেন। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না। যেমন ছামূদ কওমের নেতারা বুঝতে না পেরে অযথা দম্ভ করেছিল (নামল ২৭/৫০-৫১)।
১৪. আল্লাহ মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্যই দুনিয়াতে ছোট-খাট শাস্তির আস্বাদন করিয়ে থাকেন ও তাদেরকে ভয় দেখান (ইসরা ১৭/৫৯; সাজদাহ ৩২/২১)।
১৫. সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্বে অবশেষে সত্য সেবীদেরই জয় হয়। যেমন হযরত সালেহ (আঃ) ও তাঁর ঈমানদার দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা এলাহী গজব থেকে নাজাত পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন ও মিথ্যার পূজারী শক্তিশালীরা ধ্বংস হয়েছিল।