রোজ এমনই করিয়া সে আট আনা উপার্জন করিতেছিল, অথচ, স্বামীর কাছে লজ্জায় তাহা প্রকাশ করিতে পারিত না। তিনি ঘুমাইয়া পড়িলে, অনেক রাত্রে নিঃশব্দে শয্যা হইতে উঠিয়া আসিয়া এই কাজ করিত। আজ রাত্রেও তাহাই করিতে আসিয়াছিল এবং ক্লান্তিবশতঃ কোন এক সময়ে সেইখানে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। নীলাম্বর হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গিয়া শয্যায় কাহাকেও দেখিতে না পাইয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। বিরাজের হাতে তখনও কাদা মাখা, আশেপাশে তৈরী ছাঁচ পড়িয়া আছে এবং তাহারই একধারে হিমের মধ্যে ভিজা মাটির উপরে পড়িয়া সে ঘুমাইতেছে। আজ তিনদিন ধরিয়া স্বামী-স্ত্রীতে কথাবার্তা ছিল না। তপ্ত অশ্রুতে তাহার দুই চোখ ভরিয়া গেল, তৎক্ষণাৎ বসিয়া পড়িয়া বিরাজের ভূলুন্ঠিত সুপ্ত মাথাটি সাবধানে নিজের কোলের উপর তুলিয়া লইল। বিরাজ জাগিল না, শুধু একটিবার নড়িয়া-চড়িয়া পা-দুটি আরও একটু গুটাইয়া লইয়া ভাল করিয়া শুইল। নীলাম্বর বাঁ হাত দিয়া নিজের চোখ মুছিয়া ফেলিয়া অপর হাতে অদূরবর্তী স্তিমিত দীপশিখাটি আরও একটু উজ্জ্বল করিয়া দিয়া একদৃষ্টে পত্নীর মুখের পানে চাহিয়া রহিল। এ কি হইয়াছে! কৈ, এতদিন সে ত চাহিয়া দেখে নাই! বিরাজের চোখের কোণে এমন কালি পড়িয়াছে! ভ্রুর উপর, সুন্দর সুডৌল ললাটে দুশ্চিন্তার এত সুস্পষ্ট রেখা ফুটিয়াছে! একটা অবোধ্য, অব্যক্ত অপরিসীম বেদনায় তাহার সমস্ত বুকের ভিতরটা যেন মুচড়াইয়া উঠিতে লাগিল এবং অসাবধানে একফোঁটা বড় অশ্রু বিরাজের নিমীলিত চোখের পাতার উপর টপ করিয়া পড়িবামাত্রই সে চোখ চাহিয়া দেখিল। ক্ষণকাল নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল, তার পর দুই হাত প্রসারিত করিয়া স্বামীর বক্ষ বেষ্টন করিয়া ক্রোড়ের মধ্যে মুখ লুকাইয়া পাশ ফিরিয়া চুপ করিয়া শুইল। নীলাম্বর সেইভাবে বসিয়া থাকিয়া কাঁদিতে লাগিল। বহুক্ষণ কাটিল—কেহ কথা কহিল না। তারপর রাত্রি যখন আর বেশী বাকী নাই, পূর্বাকাশ স্বচ্ছ হইয়া আসিতেছে, তখন নীলাম্বর নিজেকে প্রকৃতিস্থ করিয়া লইয়া স্ত্রীর মাথার উপর হাত রাখিয়া সস্নেহে বলিল আর হিমে থেকো না বিরাজ, ঘরে চল।
চল, বলিয়া বিরাজ উঠিয়া পড়িল, এবং স্বামীর হাত ধরিয়া ঘরে আসিয়া শুইয়া পড়িল।
সকালবেলা নীলাম্বর বলিল, যা তোর মামার বাড়ি থেকে দিন-কতক ঘুরে আয় বিরাজ, আমিও একবার কলকাতায় যাই।
কলকাতায় গিয়ে কি হবে?
নীলাম্বর কহিল, কত রকম উপার্জনের পথ সেখানে আছে, যা হোক একটা উপায় হবেই—কথা শোন্ বিরাজ, মাস-কয়েক সেখানে গিয়ে থাক্ গে!
বিরাজ জিজ্ঞাসা করিল, কতদিনে আমাকে ফিরিয়ে আনবে?
নীলাম্বর বলিল, ছ’ মাসের মধ্যে ফিরিয়ে আনব, তোকে আমি কথা দিচ্ছি।
‘আচ্ছা’ বলিয়া বিরাজ সম্মত হইল।
দিন চার-পাঁচ পরে গরুর গাড়ি আসিল, মামার বাড়ি যাইতে আট-দশ ক্রোশ এই উপায়েই যাইতে হয়। অথচ বিরাজের ব্যবহারে যাত্রার কোন লক্ষণ প্রকাশ পাইল না।
নীলাম্বর ব্যস্ত হইতে লাগিল, তাগিদ দিতে লাগিল।
বিরাজ কাজ করিতে করিতে বলিয়া বসিল, আজ ত আমি যাব না—আমার অসুখ কচ্চে।
নীলাম্বর অবাক হইয়া বলিল, অসুখ কচ্চে কি রে?
বিরাজ বলিল, হাঁ, অসুখ কচ্চে—বড্ড অসুখ কচ্চে, —বলিয়া মুখ ভার করিয়া পিতলের কলসীটা কাঁকালে তুলিয়া লইয়া নদীতে জল আনিতে চলিয়া গেল। সেদিন গাড়ি ফিরিয়া গেল। রাত্রে অনেক সাধাসাধি, অনেক বোঝানোর পর সে দুদিন পরে যাইতে সম্মত হইল। দু’দিন পরে আবার গাড়ি আসিল।
নীলাম্বর সংবাদ দিবামাত্রই বিরাজ একেবারে বাঁকিয়া বসিল;—না, আমি কক্ষণ যাব না।
নীলাম্বর আরো আশ্চর্য হইয়া বলিল, যাবিনে, কেন?
বিরাজ কাঁদিয়া ফেলিল—না, আমি যাব না। আমার গয়না কৈ, আমি দীন-দুঃখীর মত কিছুতেই যাব না।
নীলাম্বর রাগিয়া বলিল, আজ তোর গয়না নাই সত্যি, কিন্তু যখন ছিল, তখন ত একদিন ফিরেও চাসনি?
বিরাজ চুপ করিয়া আঁচল দিয়া চোখ মুছিতে লাগিল।
নীলাম্বর পুনরায় কহিল, তোর ছল আমি বুঝি। আমার মনে মনে সন্দেহ ছিলই, তবে ভেবেছিলাম, দুঃখে-কষ্টে বুঝি তোর হুঁশ হয়েচে—তা দেখছি কিছুই হয়নি! ভাল, তুইও শুকিয়ে মর্, আমিও মরি।—বলিয়া সে বাহিরে গিয়া গাড়ি ফিরাইয়া দিল।
দুপুরবেলা নীলাম্বর ঘরের ভিতর ঘুমাইতেছিল, পীতাম্বর নিজের কাজে গিয়াছিল, ছোটবৌ বেড়ার ফাঁক দিয়া মৃদুস্বরে ডাকিয়া বলিল, দিদি, অপরাধ নিও না, তোমায় আমি আর বোঝাব কি, কিন্তু দু’দিন ঘুরে এলে না কেন?
বিরাজ মৌন হইয়া রহিল।
ছোটবৌ বলিল, ওঁকে বদ্ধ করে রেখো না দিদি, বিপদের দিনে একটিবার বুক বাঁধ, ভগবান দু’দিনে মুখ তুলে চাইবেন।
বিরাজ আস্তে আস্তে বলিল, আমি ত বুক বেঁধেই আছি, ছোটবৌ!
ছোটবৌ একটু জোর দিয়া বলিল, তবে যাও দিদি, ওঁকে পুরুষমানুষের মত উপার্জন করতে দাও—আমি বলচি, তোমার প্রতি ভগবান দু’দিনে প্রসন্ন হবেন।
বিরাজ একবার মুখ তুলিল, কি কথা বলিতে গেল, তার পর মুখ হেঁট করিয়া স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
ছোটবৌ বলিল, পারবে না যেতে?
এবার বিরাজ মাথা নাড়িয়া বলিল, না। ঘুম ভেঙ্গে উঠে ওঁর মুখ না দেখে আমি একটা দিনও কাটাতে পারব না। যা পারব না ছোটবৌ, সে কাজ আমাকে ব’লো না,—বলিয়া চলিয়া যাইবার উদ্যোগ করিতেই ছোটবৌ কাঁদ-কাঁদ হইয়া ডাকিয়া বলিল, যেও না দিদি, শোন, তোমাকে দিন-কতক এখান থেকে যেতেই হবে—না গেলে আমি কিছুতেই ছাড়ব না।
বিরাজ ফিরিয়া দাঁড়াইল, একমুহূর্ত স্থির থাকিয়া বলিল, ও বুঝেছি—সুন্দরী এসেছিল বুঝি?
ছোটবৌ মাথা নাড়িয়া বলিল, এসেছিল।
তাই চলে যেতে বলচ?
তাই বলচি দিদি, তুমি যাও এখান থেকে।
বিরাজ আবার ক্ষণকাল মৌন হইয়া রহিল; তার পরে বলিল, একটা কুকুরের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব?
ছোটবৌ বলিল, কুকুর পাগল হ’লে তাকে ভয় ত করতেই হয় দিদি! তা ছাড়া , তোমার একার জন্যেও নয়, ভেবে দেখ , এই নিয়ে আরও কত কি অনিষ্ট ঘটতে পারে।
বিরাজ আবার চুপ করিয়া রহিল। তারপর উদ্ধতভাবে মুখ তুলিয়া বলিল, না কোনমতেই যাব না,—বলিয়া ছোটবৌকে প্রত্যুত্তরের অবসরমাত্র না দিয়া দ্রুতপদে সরিয়া গেল। কিন্তু তাহার যেন ভয় করিতে লাগিল।
তাহাদের ঘাটের ঠিক পরপারে দু’দিন হইতে আড়ম্বর করিয়া একটা স্নানের ঘাট এবং নদীতে জল না থাকা সত্ত্বেও মাছ ধরিবারও মঞ্চ প্রস্তুত হইতেছিল। বিরাজ মনে মনে বুঝিল, এ-সব কেন।
নীলাম্বরও একদিন স্নান করিয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ওপারে ঘাট বাঁধলে কারা বিরাজ?
বিরাজ হঠাৎ রাগিয়া উঠিয়া বলিল, আমি কি জানি? —বলিয়াই দ্রুতপদে সরিয়া গেল।
তাহার ভাব দেখিয়া নীলাম্বর অবাক হইয়া গেল। কিন্তু সেইদিন হইতে বিরাজ যখন তখন জল আনিতে যাওয়া একেবারে বন্ধ করিয়া দিল। হয় অতি প্রত্যূষে, না হয় একটুখানি রাত্রি হইলে তবে সে নদীতে যাইত, এ ছাড়া সহস্র কাজ আটকাইলেও সে ও-মুখো হইত না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ঘৃণায়, লজ্জায়, ক্রোধে, তাহার প্রাণ যেন বাহির হইয়া যাইতে লাগিল। অথচ এই অত্যাচার ও অকথ্য ইতরতার বিরুদ্ধে সে স্বামীর কাছেও সাহস করিয়া মুখ খুলিতে পারিল না।
দিন-চারেক পরে নীলাম্বরই একদিন ঘাট হইতে আসিয়া হাসিয়া বলিল, নূতন জমিদারের সাজ-সরঞ্জাম দেখেচিস বিরাজ?
বিরাজ বুঝিতে পারিয়া অন্যমনস্কভাবে বলিল, দেখচি বৈ কি!
নীলাম্বর পুনরায় হাসিতে হাসিতে বলিল, লোকটা পাগল নাকি, তাই আমি ভাবচি।
নদীতে দুটো পুঁটিমাছ থাকবার জল নেই, লোকটা সকাল থেকে একটা মস্ত হুইল-বাঁধা ছিপ ফেলে সারাদিন বসে আছে।
বিরাজ চুপ করিয়া রহিল, সে কোনমতেই স্বামীর হাসিতে যোগ দিতে পারিল না।
নীলাম্বর বলিতে লাগিল, কিন্তু এ ত ঠিক নয়। ভদ্রলোকের খিড়কির ঘাটের সামনে সমস্ত দিন বসে থাকলে মেয়েছেলেরাই বা যায় কি করে? আচ্ছা, তোদের নিশ্চয়ই ত ভারী অসুবিধে হচ্ছে।
বিরাজ বলিল, হলেই বা কি করব?
নীলাম্বর ঈষৎ উত্তেজিত হইয়া বলিল, তাই হবে কেন? ছিপ নিয়ে পাগলামি করবার কি আর জায়গা নেই? না না, কাল সকালেই আমি কাছারিতে গিয়ে বলে আসব—শখ হয়, উনি আর কোথাও ছিপ নিয়ে বসে থাকুন গে; কিন্তু আমাদের বাড়ির সামনে ও-সব চলবে না।
স্বামীর কথা শুনিয়া বিরাজ ব্যস্ত হইয়া বলিল, না, না, তোমাকে ও-সব বলতে যেতে হবে না; নদী আমাদের একলার নয় যে, তুমি বারণ করে আসবে।
নীলাম্বর বিস্মিত হইয়া বলিল, তুই বলিস কি বিরাজ! নাই হ’ল নদী আমার; কিন্তু লোকের একটা ভালমন্দ বিবেচনা থাকবে না? আমি কালই গিয়ে বলে আসব, না শোনে নিজেই ঐসব ঘাট-ফাট টান মেরে ভেঙ্গে ফেলব, তার পরে যা পারে সে করুক।
কথা শুনিয়া বিরাজ স্তম্ভিত হইয়া গেল। তার পর ধীরে ধীরে বলিল, তুমি যাবে জমিদারের সঙ্গে বিবাদ করতে?
নীলাম্বর কহিল, কেন যাব না? বড়লোক বলে যা ইচ্ছে অত্যাচার করবে, তাই সয়ে থাকতে হবে?
অত্যাচার করচে তুমি প্রমাণ করতে পার?
নীলাম্বর রাগিয়া বলিল, আমি এত তর্কের ধার ধারিনে; স্পষ্ট দেখচি অন্যায় করচে, আর তুই বলিস প্রমাণ করতে পার? পারি, না পারি সে আমি বুঝব।
বিরাজ একমুহূর্ত স্বামীর মুখের পানে স্থিরভাবে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, দেখ, মাথাটা একটু ঠাণ্ডা কর। যাদের দুবেলা ভাত জোটে না, তাদের মুখে এ কথা শুনলে লোকে গায়ে থুথু দেবে। কিসে আর কিসে, তুমি চাও জমিদারের ছেলের সঙ্গে লড়াই করতে!
কথাটা এতই রূঢ়ভাবে বিরাজের মুখ দিয়া বাহির হইয়া আসিল যে, নীলাম্বর সহ্য করিতে পারিল না, সে একেবারে অগ্নিমূর্তি হইয়া উঠিল। চেঁচাইয়া বলিল, তুই আমাকে কি কুকুর-বেড়াল মনে করিস যে, যখন তখন সব কথায় ঐ খাবার খোঁটা তুলিস! কোন্ দিন তোর দুবেলা ভাত জোটে না?
দুঃখে-কষ্টে বিরাজের আর পূর্বের ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতা ছিল না, সেও জ্বলিয়া উঠিয়া জবাব দিল, মিছে চেঁচিও না। যা করে দু’বেলা ভাত জুটচে, সে তুমি জান না বটে, কিন্তু জানি আমি, আর জানেন অন্তর্যামী। এই নিয়ে কোন কথা যদি তুমি বলতে যাও ত আমি বিষ খেয়ে মরব। বলিয়াই মুখ তুলিয়া দেখিল, নীলাম্বরের মুখ একেবারে বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে, তাহার দুই চোখে একটা বিহ্বল হতবুদ্ধি দৃষ্টি—সে চাহনির সম্মুখে বিরাজ একেবারে এতটুকু হইয়া গেল। সে আর একটা কথাও না বলিয়া ধীরে ধীরে সরিয়া গেল। সে চলিয়া গেল, তবুও নীলাম্বর তেমনই করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর একটা সুদীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বাহিরে আসিয়া চন্ডীমন্ডপের একধারে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া পড়িল। তাহার প্রচন্ড ক্রোধ না বুঝিয়া একটা অনুচ্চ স্থানের মধ্যে সজোরে মাথা তুলিতে গিয়া তেমনই সজোরে ধাক্কা খাইয়া যেন একেবারে নিস্পন্দ অসাড় হইয়া গেল। কানে তাহার কেবলই বাজিতে লাগিল বিরাজের শেষ কথাটা—কি করিয়া সংসার চলিতেছে! এবং কেবলই মনে পড়িতে লাগিল, সেদিনের সেই অন্ধকারে গভীর রাত্রে ঘরের বাহিরে ভূশয্যায় সুপ্ত বিরাজের শ্রান্ত অবসন্ন মুখ। সত্যই ত! দিন যে কি করিয়া চলিতেছে এবং কেমন করিয়া যে তাহা ওই অসহায়া রমণী একাকিনী চালাইতেছে, সে কথা আর ত তাহার জানিতে বাকী নাই। অনতিপূর্বে বিরাজের শক্ত কথা শক্ত তীরের মতই তাহার বুকে আসিয়া বিঁধিয়াছিল, কিন্তু যতই সে বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল, ততই তাহার হৃদয়ের সেই ক্ষত, সেই ক্ষোভ শুধু যে মিলাইয়া আসিতে লাগিল তাহা নহে, ধীরে ধীরে শ্রদ্ধায় বিস্ময়ে রূপান্তরিত হইয়া দেখা দিতে লাগিল। তাহার বিরাজ ত শুধু আজকের বিরাজ নয়, সে যে কতকাল, কত যুগ-যুগান্তের। তাহার বিচার ত শুধু দুটো দিনের ব্যবহারে, দুটো অসহিষ্ণু কথার উপরে করা চলে না! সে-হৃদয় যে কি দিয়া পরিপূর্ণ, সে কথা ত তার চেয়ে আর কেউ বেশী জানে না! এইবার তাহার দুই চোখ বাহিয়া দরদর করিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়িল। সে অকস্মাৎ দুই হাত জোড় করিয়া ঊর্ধ্বমুখে রুদ্ধস্বরে বলিয়া উঠিল, ভগবান, আমার যা আছে সব নাও, কিন্তু আমার একে নিও না। বলিতেই একটা প্রচন্ড ইচ্ছার বেগ সেই মূহূর্তেই তাহার প্রিয়তমাকে বুকের মধ্যে চাপিয়া ধরিবার জন্যে তাহাকে যেন একেবারে ঠেলিয়া তুলিয়া দিল। সে ছুটিয়া আসিয়া বিরাজের রুদ্ধদ্বারের সন্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ, সে ঘা দিয়া আবেগ-কম্পিতকন্ঠে ডাকিল, বিরাজ!
বিরাজ মাটির উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া কাঁদিতেছিল, চমকিয়া উঠিয়া বসিল।
নীলাম্বর বলিল, কি কচ্চিস বিরাজ, দোর খোল!
বিরাজ সভয়ে নিঃশব্দে দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।
নীলাম্বর ব্যস্ত হইয়া বলিল, খুলে দে না বিরাজ!
এবার বিরাজ কাঁদ-কাঁদ হইয়া মৃদুস্বরে বলিল, তুমি মারবে না বল?
মারব!
কথাটা তীক্ষ্ণধার ছুরির মত নীলাম্বরের হৃদপিন্ডে গিয়া প্রবেশ করিল; বেদনায়, লজ্জায়, অভিমানে তাহার কন্ঠরোধ হইয়া গেল, সে সংজ্ঞাহীনের মত একটা চৌকাঠ আশ্রয় করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। বিরাজ তাহা দেখিল না; সে না জানিয়া ছুরির উপর ছুরি মারিয়া কাঁদিয়া বলিল, আর আমি এমন কথা ক’ব না—বল, মারবে না?
নীলাম্বর অস্ফুটস্বরে, কোনমতে একটা ‘না’ বলিতে পারিল মাত্র। সভয়ে ধীরে ধীরে অর্গল মুক্ত করিবামাত্রেই নীলাম্বর টলিতে টলিতে ভিতরে ঢুকিয়া চোখ বুজিয়া শয্যার উপর শুইয়া পড়িল। তাহার নিমীলিত চোখের দুই কোণ বাহিয়া হুহু করিয়া জল পড়িতে লাগিল। স্বামীর এমন মুখ ত বিরাজ কোন দিন দেখে নাই! সমস্তই বুঝিল। শিয়রের কাছে উঠিয়া আসিয়া পরম স্নেহে স্বামীর মাথা নিজের ক্রোড়ের উপর তুলিয়া আচঁল দিয়া চোখ মুছাইয়া দিতে লাগিল। ক্রমে সন্ধ্যার আধাঁর ঘরের মধ্যে গাঢ় হইয়া আসিতে লাগিল, তথাপি উভয়ের কেহই মুখ খুলিল না। তাহাদের কথা বোধ করি শুধু অন্তর্যামীই শুনিলেন।