পিসীমা রাগ করিয়া চলিয়া গেলেন। বলিতে বলিতে গেলেন, জানি ত ওকে—এমন ফাজিল মেয়ে গাঁয়ে আর দুটি আছে কি?
বিরাজ স্বামীকে ডাকিয়া বলিল, কবে আবার তুমি সুন্দরীর ওখানে গেলে?
নীলাম্বর ভয়ে শুষ্ক হইয়া গিয়া জবাব দিল, অনেকদিন আগে পুঁটির খবরটা নিতে গিয়েছিলাম।
আর যেও না। তার স্বভাব-চরিত্র শুনতে পাই ভারী মন্দ হয়েচে; বলিয়া সে নিজের কাজে চলিয়া গেল। তারপর কতদিন কাটিয়া গেল। সূর্যদেব ওঠেন এবং অস্ত যান, তাঁকে ধরিয়া রাখিবার জো নাই বলিয়াই বোধ করি শীত গেল, গ্রীষ্মও যাই-যাই করিতে লাগিল। বিরাজের মুখের উপর একটা গাঢ় ছায়া ক্রমশ গাঢ়তর হইয়া পড়িতে লাগিল, অথচ চোখের দৃষ্টি ক্লান্ত এবং খরতর। যে-কেহ তাহার দিকে চাহিতে যায়, তাহারই চোখ যেন আপনি ঝুঁকিয়া পড়ে। শূলবিদ্ধ দীর্ঘ বিষধর, শূলটাকে নিরন্তর দংশন করিয়া করিয়া, শ্রান্ত হইয়া এলাইয়া পড়িয়া যেভাবে চাহিয়া থাকে, বিরাজের চোখের দৃষ্টি তেমনই করুণ, অথচ তেমনই ভীষণ হইয়া উঠিয়াছে। স্বামীর সহিত কথাবার্তা প্রায়ই হয় না। তিনি কখন চোরের মতন আসেন যান, সেদিকে সে যেন দৃষ্টিপাতই করে না। সবাই তাহাকে ভয় করে, শুধু করে না ছোটবৌ। সে সুযোগ পাইলেই যখন তখন আসিয়া উপদ্রব করিতে থাকে। প্রথম প্রথম বিরাজ ইহার হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইবার অনেক চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু পারিয়া উঠে নাই। চোখ রাঙ্গাইলে সে গলা জড়াইয়া ধরে, শক্ত কথা বলিলে পা জড়াইয়া ধরে।
সেদিন দশহরা। অতি প্রত্যূষে ছোটবৌ লুকাইয়া আসিয়া ধরিল, এখনও কেউ ওঠেনি দিদি, চল না একবার নদীতে ডুব দিয়ে আসি।
ও-পারে জমিদারের ঘাট তৈরি হওয়া পর্যন্ত তাহার নদীতে যাওয়া নিষিদ্ধ হইয়াছিল।
দুই জায়ে স্নান করিতে গেল। স্নানান্তে জল হইতে উঠিয়াই দেখিল, অদূরে একটা গাছতলায় জমিদার রাজেন্দ্রকুমার দাঁড়াইয়া আছে। সে স্থানটা হইতে তখনো সমস্ত অন্ধকার চলিয়া যায় নাই, তথাপি দু’জনেই লোকটাকে চিনিল। ছোটবৌ ভয়ে জড়সড় হইয়া বিরাজের পিছনে আসিয়া দাঁড়াইল। বিরাজ অতিশয় বিস্মিত হইল। এত প্রভাতে লোকটা আসিল কিরূপে? কিন্তু পরক্ষণেই একটা সম্ভাবনা তাহার মনে উঠিল, হয়ত সে প্রত্যহ এমন করিয়াই প্রহরা দিয়া থাকে। মুহূর্তের এক অংশ মাত্র বিরাজ দ্বিধা করিল, তারপর ছোটজায়ের একটা হাত ধরিয়া টানিয়া বলিল, দাঁড়াস নে ছোটবৌ, চলে আয়।
তাহাকে পাশে লইয়া দ্রুতপদে দ্বার পর্যন্ত আগাইয়া দিয়া হঠাৎ সে কি ভাবিয়া থামিল, তারপর দৃঢ়পদে ফিরিয়া গিয়া রাজেন্দ্রের অদূরে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার দুই চোখ জ্বলিয়া উঠিল, অস্পষ্ট আলোকেও সে দৃষ্টি রাজেন্দ্র সহিতে পারিল না, মুখ নামাইল।
বিরাজ বলিল, আপনি ভদ্রসন্তান, বড়লোক, এ কি প্রবৃত্তি আপনার!
রাজেন্দ্র হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিল—জবাব দিতে পারিল না। বিরাজ বলিতে লাগিল, আপনার জমিদারি যত বড়ই হোক, যেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন সেটা আমার।
হাত দিয়া ওপারের ঘাটটা দেখাইয়া বলিল, আপনি যে কত বড় ইতর, তা সবাই জানে, আমিও জানি। বোধ করি, আপনার মা-বোন নেই। অনেকদিন আগে আমার দাসীকে দিয়ে এখানে ঢুকতে নিষেধ করেছিলাম, তা আপনি শোনেন নি।
রাজেন্দ্র এত অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল যে তখনও কথা কহিতে পারিল না।
বিরাজ বলিল, আমার স্বামীকে আপনি চেনেন না, চিনলে কখনই আসতেন না। তাই, আজ বলে দিচ্ছি, আর কখনও আসবার পূর্বে তাঁকে চেনবার চেষ্টা করে দেখবেন, বলিয়া বিরাজ ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। বাড়িতে ঢুকিতে যাইতেছে, দেখিল, পীতাম্বর একটা গাড়ু হাতে লইয়া দাঁড়াইয়া আছে।
বহুদিন হইতেই তাহার সহিত বাক্যালাপ ছিল না, তথাপি সে ডাকিয়া বলিল, বৌঠান, যার সঙ্গে এতক্ষণ কথা কইছিলে সে ও-ই জমিদারবাবু, না?
চক্ষের নিমেষে বিরাজের চোখ-মুখ রাঙ্গা হইয়া উঠিল; সে ‘হাঁ’ বলিয়া ভিতরে চলিয়া গেল।
ঘরে গিয়া নিজের কথা সে তখনই ভুলিল, কিন্তু ছোটবৌর জন্য মনে মনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। কেবলই ভাবিতে লাগিল, কি জানি, তাহাকে ঠাকুরপো দেখিতে পাইয়াছে কি না! কিন্তু অধিকক্ষণ ভাবিতে হইল না, মিনিট-দশেক পরে ও-বাড়ি হইতে একটি মারের শব্দ ও চাপা কান্নার আর্তস্বর উঠিল।
বিরাজ ছুটিয়া আসিয়া রান্নাঘরে ঢুকিয়া কাঠের মূর্তির মত বসিয়া পড়িল।
নীলাম্বর এইমাত্র ঘুম ভাঙ্গিয়া বাহিরে আসিয়া মুখ ধুইতেছিল; পীতাম্বরের তর্জন ও প্রহারের শব্দ মুহূর্তকাল কান পাতিয়া শুনিল, এবং পরক্ষণেই বেড়ার কাছে আসিয়া লাথি মারিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া ও-বাড়িতে গিয়া দাঁড়াইল।
বেড়া ভাঙ্গার শব্দে পীতাম্বর চমকিয়া মুখ তুলিয়া সুমুখেই যমের মত বড়ভাইকে দেখিয়া বিবর্ণ হইয়া থামিল।
নীলাম্বর ভূ-শায়িতা ছোটবধূকে সম্বোধন করিয়া বলিল, ঘরে যাও মা, কোন ভয় নেই।
ছোটবৌ কাঁপিতে কাঁপিতে উঠিয়া গেলে নীলাম্বর সহজভাবে বলিল, বৌমার সামনে আর তোর অপমান করব না, কিন্তু, এই কথাটা আমার ভুলেও অবহেলা করিস নে যে, আমি যতদিন ও-বাড়িতে আছি ততদিন এ-সব চলবে না। যে হাতটা তুই ওর গায়ে তুলবি, তোর সেই হাতটা ভেঙ্গে দিয়ে যাব।—বলিয়া ফিরিয়া যাইতেছিল।
পীতাম্বর সাহস সঞ্চয় করিয়া বলিয়া উঠিল, বাড়ি চ’ড়ে মারতে এলে, কিন্তু কারণ জান?
নীলাম্বর ফিরিয়া দাঁড়িইল, বলিল, না, জানতেও চাইনে।
পীতাম্বর বলিল, তা চাইবে কেন? আমাকে দেখচি তা হ’লে নিতান্তই ভিটে ছেড়ে পালাতে হবে।
নীলাম্বর তাহার মুখপানে অল্পক্ষণ চাহিয়া রহিল, পরে বলিল, ভিটে ছেড়ে কাকে পালাতে হবে, সে আমি জানি—তোকে মনে ক’রে দিতে হবে না। কিন্তু, যতক্ষণ তা না হচ্ছে, ততক্ষণ তোকে সবুর ক’রে থাকতেই হবে। সেই কথাটাই তোকে জানিয়ে গেলাম। বলিয়া আবার ফিরিবার উপক্রম করিতেই পীতাম্বর সহসা সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইল; বলিল, তবে তোমাকে জানিয়ে দিই দাদা, পরকে শাসন করবার আগে ঘর শাসন করা ভাল।
নীলাম্বর চাহিয়া রহিল। পীতাম্বর সাহস পাইয়া বলিতে লাগিল, ও পারের ঘাটটা কার জান ত? বেশ। আমি সেই থেকে ছোটবৌকে ঘাটে যেতে মানা ক’রে দিই। আজ রাত থাকতে উঠে বৌঠানের সঙ্গে নাইতে গিয়েছিলেন—এমনই হয়ত রোজই যান, কে জানে!
নীলাম্বর আশ্চর্য হইয়া বলিল, এই দোষে গায়ে হাত তুললি?
পীতাম্বর বলিল, আগে শোন। ওই জমিদারের ছেলে—কি জানি, রাজেনবাবু না কি নাম ওর—দেশ-বিদেশে সুখ্যাতি ধরে না। আজ যে বৌঠান তার সঙ্গে আধঘন্টা ধ’রে গল্প করছিলেন, কেন?
নীলাম্বর বুঝিতে না পারিয়া বলিয়া উঠিল, কে কথা কইছিল রে? বিরাজবৌ?
হাঁ, তিনিই।
তুই চোখে দেখেছিস?
পীতাম্বর মুখের ভাবটা হাসিবার মত করিয়া বলিল, তুমি আমাকে দেখতে পার না, জানি, —আমার সে বিচার সে নারায়ণ করবেন—কিন্তু—
নীলাম্বর ধমকাইয়া উঠিল, —আবার ঐ নাম মুখে আনে! কি বলবি বল।
পীতাম্বর চমকিয়া উঠিয়া ঈষৎ থামিয়া রুষ্টস্বরে বলিতে লাগিল, চোখে না দেখে কথা কওয়া আমার স্বভাব নয়। ঘর শাসন করতে না পার, পরকে তেড়ে মারতে এস না।
নীলাম্বরের মাথায় উপর অকস্মাৎ যেন বাড়ি পড়িল। ক্ষণকাল উদ্ভ্রান্তের মত চাহিয়া থাকিয়া শেষে প্রশ্ন করিল, আধঘন্টা ধরে গল্প করছিল, কে? বিরাজবৌ? তুই চোখে দেখেছিস? পীতাম্বর দু-এক পা ফিরিয়া গিয়াছিল, দাঁড়াইয়া পড়িয়া বলিল, চোখেই দেখেচি। আধঘন্টার হয়ত বেশী হতেও পারে।
কাঁদিয়া উঠিল।
নীলাম্বর কাঁদিতে নিষেধ করিল না। তাহার নিজের দু চোখও জলে ভিজিয়া উঠিয়াছিল, সে স্ত্রীর মাথার উপরে নিঃশব্দে ডান হাত রাখিয়া মনে মনে আশীবার্দ করিতে লাগিল। কিছুক্ষণে কান্নার প্রথম বেগ কমিয়া আসিলে সে মুখ না তুলিয়াই বলিল, কি তাকে বলেছিলুম জান?
নীলাম্বর সস্নেহে মৃদুস্বরে বলিল, জানি; তাকে আসতে বারণ করে দিয়েচ।
কে তোমাকে বললে?
নীলাম্বর সহাস্যে কহিল, কেউ বলেনি। কিন্তু একটা অচেনা লোকের সঙ্গে যখন কথা কয়েচ, তখন অনেক দুঃখেই কয়েচ। সে কথা ও-ছাড়া আর কি হতে পারে বিরাজ!
বিরাজের চোখ দিয়া আবার জল পড়িতে লাগিল।
নীলাম্বর বলিতে লাগিল, কিন্তু কাজটা ভাল করনি। আমাকে জানান উচিত ছিল, আমিই গিয়ে তাকে বুঝিয়ে দিতাম। আমি অনেকদিন পূর্বেই তার মনের ভাব টের পেয়েছি, কতদিন সকালে বিকালে তাকে দেখতেও পেয়েছি, কিন্তু তোমার নিষেধ মনে করেই কোনদিন কিছু বলিনি।
সেদিন সন্ধ্যা হইতেই আকাশে মেঘ করিয়া টিপিটিপি বৃষ্টি পড়িতেছিল, রাত্রে স্বামী-স্ত্রীতে বিছানায় শুইয়া আবার কথা উঠিল।
নীলাম্বর বলিল, আজ সারাদিন তাকে দেখবার প্রতীক্ষাতেই ছিলাম।
বিরাজ ভীত হইয়া বলিয়া উঠিল, কেন? কেন?
দুটো কথা না বললে ভগবানের নিকট অপরাধী হয়ে থাকতে হবে—তাই।
ভয়ে উত্তেজনায় বিরাজ উঠিয়া বসিয়া বলিল, না, সে হবে না, কিছুতেই হবে না; এই নিয়ে তুমি তাকে একটি কথাও বলতে পাবে না।
তাহার মুখচোখের ভাব লক্ষ্য করিয়া নীলাম্বর অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া বলিল, আমি স্বামী, আমার কি একটা কর্তব্য নেই?
বিরাজ কোনরূপ চিন্তা না করিয়াই বলিয়া বসিল, স্বামীর অন্য কর্তব্য আগে কর, তারপরে এ কর্তব্য করতে যেও।
কি? বলিয়া নীলাম্বর ক্ষণকাল স্তম্ভিত হইয়া থাকিয়া, অবশেষে মৃদুস্বরে ‘আচ্ছা’ বলিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া পাশ ফিরিয়া চুপ করিয়া শুইল।
বিরাজ তেমনইভাবে স্থির হইয়া ভাবিতে লাগিল, —এ কি কথা সহসা তাহার মুখ দিয়া আজ বাহির হইয়া গেল!
বাহিরে বর্ষার প্রথম বারিপাতের মৃদু শব্দ খোলা জানালার ভিতর দিয়া ভিজামাটির গন্ধ বহিয়া আনিতে লাগিল, ভিতরে স্বামী-স্ত্রী নির্বাক স্তব্ধ হইয়া রহিল।
বহুক্ষণ পরে নীলাম্বর গভীর আর্তকন্ঠে কতকটা যেন নিজের মনেই বলিল, আমি যে কত অপদার্থ, বিরাজ, তা তোর কাছে যেমন শিখি, তেমন আর কারও কাছে নয়।
বিরাজ কি কথা বলিতে চাহিল, কিন্তু তাহার গলা দিয়া শব্দ ফুটিল না।
বহুদিন পরে আজ এই অসহ্য দুঃখদৈন্যপীড়িত দম্পতিটির সন্ধির সূত্রপাতেই আবার তাহা ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল।