অঙ্ক কষিতে বসিয়া একদিন তাহার কম্পাসের কথা মনে পড়িল; প্রমীলাকে কহিল, প্রমীলা! বড়দিদির কাছ থেকে কম্পাস নিয়ে এস।
কম্পাস লইয়া বড়দিদিকে কাজ করিতে হয় না, ইহা তাহার নিকট ছিল
না; কিন্তু বাজারে
তখনই সে লোক পাঠাইয়া দিল। সন্ধ্যার সময় বেড়াইয়া আসিয়া সুরেন্দ্রনাথ দেখিল, তাহার টেবিলের উপর প্রার্থিত বস্তু পড়িয়া রহিয়াছে। পরদিন সকালে প্রমীলা কহিল, মাস্টারমশাই, কাল দিদি ঐটে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
তাহার পর মধ্যে মধ্যে সে এমন এক-আধটা জিনিস চাহিয়া বসিত যে, মাধবী সেজন্য বিপদে পড়িয়া যাইত। অনেক অনুসন্ধান করিয়া তবে প্রার্থনা পূর্ণ করিতে হইত। কিন্তু কখনও সে বলে নাই, দিতে পারিব না।
কিংবা কখনও সে হঠাৎ হয়ত প্রমীলাকে কহিল, বড়দিদির নিকট হইতে পাঁচখানা পুরাতন কাপড় লইয়া এস; ভিখারীদের দিতে হইবে। নূতন-পুরাতন বাছিবার অবসর মাধবীর সব সময় থাকিত না; সে আপনার পাঁচখানা কাপড় পাঠাইয়া দিয়া, উপরের গবাক্ষ হইতে দেখিত–চারি-পাঁচজন দুঃখী লোক কলরব করিতে করিতে ফিরিয়া যাইতেহে–তাহারাই বস্ত্রলাভ করিয়াছে।
সুরেন্দ্রনাথের এই ছোটখাটো আবেদন-অত্যাচার নিত্যই মাধবীকে সহ্য করিতে হইত। ক্রমশ এ সকল এরূপ অভ্যাস হইয়া গেল যে, মাধবীর আর মনে হইত না, একটা নূতন জীব তাহার সংসারে আসিয়া দৈনন্দিন কার্যকলাপের মাঝখানটিতে নূতন রকমের ছোটখাটো উপদ্রব তুলিয়াছে।
শুধু তাহাই নহে। এই নূতন জীবটির জন্য মাধবীকে আজকাল খুবই সতর্ক থাকিতে হয়, বড় বেশি খোঁজ লইতে হয়। সে যদি সব জিনিস চাহিয়া লইত, তাহা হইলেও মাধবীর অর্ধেক পরিশ্রম কমিয়া যাইত; সে যে নিজের কোন জিনিসই চাহে না–এইটিই বড় ভাবনার কথা। প্রথমে সে জানিতে পারে নাই যে, সুরেন্দ্রনাথ নিতান্ত অন্যমনস্ক প্রকৃতির লোক। প্রাতঃকালে চা ঠান্ডা হইয়া যায়, সে হয়ত খায় না। জলখাবার হয়ত স্পর্শ করিতেও তাহার মনে থাকে না, হয়ত বা কুকুরের মুখে তুলিয়া দিয়া সে চলিয়া যায়। খাইতে বসিয়া অন্নব্যঞ্জনের সে কোন সম্মানই রাখে না, পাশে ঠেলিয়া
নিচে ফেলিয়া সরাইয়া রাখিয়া যায়; যেন কোন দ্রব্যই তাহার মনে ধরে না। ভৃত্যেরা আসিয়া কহে, মাস্টারবাবু পাগলা, কিছু দেখে না, কিছু জানে না–বই নিয়েই বসে আছে।
ব্রজবাবু মধ্যে মধ্যে জিজ্ঞাসা করেন, চাকরির কোনরূপ সুবিধা হইতেছে কি না। সুরেন্দ্র সে কথার ভাসা ভাসা উত্তর দেয়। মাধবী পিতার নিকট সেসব শুনিতে পায়, সে-ই কেবল বুঝিতে পারে যে, চাকরির জন্য মাস্টারবাবুর একতিল উদ্যোগ নাই, ইচ্ছাও নাই। যাহা আপাতত হইয়াছে, তাহাতেই সে পরম সন্তুষ্ট। বেলা দশটা বাজিলেই বড়দিদির নিকট হইতে স্নানাহারের তাগিদ আসে। ভাল করিয়া আহার না করিলে বড়দিদির হইয়া প্রমীলা অনুযোগ করিয়া যায়। অধিক রাত্রি পর্যন্ত বই লইয়া বসিয়া থাকিলে ভৃত্যেরা গ্যাসের চাবি বন্ধ করিয়া দেয়, বারণ করিলে শুনে না-বড়দিদির হুকুম।
একদিন মাধবী পিতার কাছে হাসিয়া বলিল, বাবা, প্রমীলা যেমন, তার মাস্টারও ঠিক তেমনি।
কেন মা?
দু’জনেই ছেলেমানুষ। প্রমীলা যেমন বোঝে না, তার কখন কি দরকার, কখন কি খাইতে হয়, কখন শুইতে হয়, কখন কি করা উচিত, তার মাস্টারও সেইরকম, নিজের কিছুই বোঝে না–অথচ, অসময়ে এমনি জিনিস চাহিয়া বসে যে, জ্ঞান হইলে তাহা আর কেহ চায় না।
ব্রজবাবু বুঝিতে পারিলেন না, মুখপানে চাহিয়া রহিলেন।
মাধবী হাসিয়া বলিল, তোমার মেয়েটি বোঝে কখন তার কি দরকার?
তা বোঝে না?
অথচ, অসময়ে উৎপাত করে ত?
তা করে।
মাষ্টারবাবু তাই করে–
ব্রজবাবু হাসিয়া বলিলেন, ছেলেটি বোধহয় একটু পাগল।
পাগল নয়। উনি বোধ হয় বড়লোকের ছেলে।
ব্রজবাবু বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন করিয়া
জানিলে?
মাধবী জানিত না, কিন্তু এমনি বুঝিত। সুরেন্দ্র যে নিজের একটি কাজও নিজ়ে করিতে পারে না, পরের উপর নির্ভর করিয়া থাকে, পরে করিয়া দিলে হয়, না করিয়া দিলে হয় না–এই অক্ষমতাই তাহাকে মাধবীর নিকটে ধরাইয়া দিয়াছিল। তাহার মনে হইত–এটা তাহার পূর্বের অভ্যাস। বিশেষ এই নূতন ধরনের আহার-প্রণালীটা মাধবীকে আরো চমৎকৃত করিয়া দিয়াছে। কোন খাদ্যদ্রব্যই যে তাহার মনোযোগ আকর্ষণ করিতে পারেনা, কিছুই সে তৃপ্তিপূর্বক আহার করে না–কোনটির উপরই স্পৃহা নাই, এই বৃদ্ধের মত বৈরাগ্য, অথচ বালকের ন্যায় সরলতা, পাগলের মত উপেক্ষা,–খাইতে দিলে খায়, না দিলে খায় না–এ সকল তাহার নিকট বড় রহস্যময় বোধ হইত। একটা অজ্ঞাত করুণাচক্ষুও সেই জন্য এই অজ্ঞাত মাষ্টারবাবুর উপর পডিয়াছিল। সে যে লজ্জা করিয়া চাহে না, তাহা নহে, তাহার প্রয়োজন হয় না, তাই সে চাহে না। যখন প্রয়োজন হয়, তখন কিন্তু আর সময়-অসময় থাকে না–একেবারে বড়দিদির নিকট আবেদন আসিয়া উপস্থিত হয়। মাধবী মুখ টিপিয়া হাসে, মনে হয়, এ লোকটি নিতান্ত বালকের মত সরল।