নিঃস্বঙ্গতার ১০০ বছর

তোমায় খোজে খোজে একশো বছর মনে হচ্ছে পার করিয়া ফেলেছি।

আমি তখন এক বইয়ের দোকানে পার্টটাইম কাজ করি।এতে দুটো লাভ হয়, টিউশনির চেয়ে কিছু টাকা বেশি পাওয়া যায়। ফ্রিতে বই পড়া যায়। প্রথম প্রথম সংকোচ হতো, মাস খানেক যেতেই সংকোচ কেটে গেল। কাস্টোমার আসে, বই খোঁজে। অনেকে সাজেশন চায়। টুকটাক পড়ার অভ্যাস থাকার কারণে আমি সাজেশন দেই। অনেক পাঠক পরে এসে প্রশংসা করে আমার রুচির, আমি হাসি। আসলে প্রশংসা, যতো ছোটই হোক না কেন, এর বিপরীতে কি বলতে হয় আমি কখনো খুঁজে পাইনি। দোকানের মালিকের সাথেও এজন্য সম্পর্কটা ভালোর দিকে।

একদিন এক মেয়ে এলো দোকানে। আমি তখন মানিকের পুতুল নাচের ইতিকথা পড়ছিলাম। মেয়েটা প্রথমেই বললো, ‘আপনি এখনও এই বই পড়েননি?’

মেয়েটার প্রশ্নে একটু বিব্রত হলাম। যেন এই বই এতোদিনে না পড়াটা অপরাধ। আর এভাবে কেউ কাউকে জিজ্ঞাসা করে? অবশ্য বইটা শেষ করে বুঝেছিলাম, এই বই না পড়াটা পড়ুয়াদের জন্য অপরাধ হলেও হতে পারে। সে যাই হোক, আমি বিব্রতবোধটা লুকানোর চেষ্টা করে বললাম, ‘না, আসলে আগে পড়া হয়ে ওঠেনি।’

মেয়েটা কিছুক্ষণ মুখে দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘ওহ! কিছু মনে করবেন না, আপনাকে বোধয় বিব্রত করে ফেললাম!’

আমি মাথা ঝাঁকালাম, ‘আরে না না ঠিক আছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বললাম, বইটা কি খুবই ভালো না কি?’

‘আমার কাছে এটা একটা অসাধারণ বই। খুব সাধারণ কিন্তু কি চমৎকারভাবে মানিকবাবু সব লিখে ফেলেছেন!’ যেন আপনমনেই বললো। আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম। হঠাৎ যেন খেই ফিরে পেয়েছে এমন ভাবে বললো, ‘আপনি কি নতুন না কি? আগে কখনও দেখিনি তো!’

‘জ্বী। মাস খানেক পার হলো এখানে এসেছি।’

‘কই? গতো মাসেও তো এলাম, দেখলাম না তো?’

‘কখন এসেছিলেন?’

‘এই দুপুরের একটু পর।’ 

‘আসলে আমি পার্টটাইম থাকি তো, বিকেল চার-পাঁচটার পরে আসি সাধারণত।’

‘ও আচ্ছা।’ 

এই প্রথম বোধয় কোনো কাস্টোমারের সাথে আমার এরকম একটা খোলামেলা আলোচনা হলো। মেয়েটা বই দেখতে শুরু করলো। নতুন কি এসেছে, পুরোনো কি আছে, লেখকের নাম ধরে খোঁজ নিল। কটা বই নেড়েচেড়ে দেখলো। দুটো পছন্দ করলো। তারপর আচমকা জিজ্ঞাসা করলো, ‘আপনি পার্টটাইম জব করেন কেন?’

আমি বিস্মিত হলাম, বললাম, ‘দিনে ক্লাস থাকে তাই।’

‘লেখাপড়া করছেন?’

‘জ্বী।’ 

এরপর কথায় জানতে পারলাম আমি আর মেয়েটা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ব্যাচে পড়ি, আলাদা বিভাগে। মেয়েটা অবাক হয়ে গেল আমি এখানে পার্টটাইম চাকরি করি দেখে, আমার একটু কুন্ঠা হতে লাগলো। সহপাঠি না হলেও ব্যাচমেট তো। কি ভাবলো না ভাবলো এসব ভেবে আমি কাহিল হয়ে যাচ্ছি। আমাকে যেন আরও কাহিল করে দিতে মেয়েটা বললো, ‘তুমি করে বললে সমস্যা আছে?’

আমি মাথা নাড়লাম, না নেই।

‘এই দেখো, নামটাই তো জানা হলো না! আমি তপতী।’ বলে আমার দিকে জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আমি কাচুমাচু স্বরে বললাম, ‘রুমি।’ আমি প্রায় ধরেই নিয়েছিলাম, তপতী বলবে, আরে, এটাতো মেয়েদের নাম! তারপর হাসবে। 

ও আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, ‘বাহ! তা তুমি রুমি পড়েছো কখনও?’ 

আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। ও বললো, ‘কি পড়োনি?’

আমি স্বীকার করলাম, ‘ওর কথা শুনেছি, পড়া হয়নি।’ 

ও হঠাৎ বলে উঠলো, ‘ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলে মনে হচ্ছে! কি ভেবেছিলে? বলবো রুমি মেয়েদের নাম?’ বলে খিলখিল করে হেসে উঠলো। 

আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম!

এরপর ওর সাথে ক্যাম্পাসে, দোকানে সময়ে অসময়ে দেখা হতে লাগলো। ও তারাশঙ্কর-সুনীল-মানিক বেশি পড়তো। আমি পড়তাম দশমিশালি, বিশেষ করে কন্টেম্পরারি। ততোদিনে অবশ্য রুমি পড়েছি কিছুটা, কিছু আত্মস্থ করেছি। বিনয়-শক্তি-উৎপল ধরেছি নতুন, আবুল হাসান পালে জোর হাওয়া দিচ্ছে। আর মূল স্রোতটা যেন ছিল তপতী। তপতীর জন্যই যেন এভাবে ভেসে বেড়াচ্ছি! একলা একলা আওড়াচ্ছি, 

‘সে কি জানিতো না যতো বড় রাজধানী

তত বিখ্যাত নয় এ হৃদয়পুর

সে কি জানিতো না আমি তারে যত জানি 

আনখ সমুদ্দুর।’

একদিন তপতী হাবেভাবে বুঝে গেছে, এক অখ্যাত হৃদয়পুর স্বেচ্ছায় তার উপনিবেশ হয়ে গিয়েছে, ওকে বানিয়েছে ঔপনিবেশিক। আমি রুমিকে অনুবাদ করে ফেলেছি- ‘এক ফোঁটা জলে তুমি আস্ত সমুদ্দুর’। এসব জেনেও তপতী চুপ থাকলো। আর আমি তো বরাবরের মতোই চুপ! কিছু বলতেও পারি না, আবার মানতেও পারি না। বসে বসে লিখে ফেলি- ‘না জ্যন্ত, না লাশ- আস্ত প্রেমিক করে রেখে দিলে!’ কিন্তু মুখফুটে কিছু বলি না।

একদিন ক্লাস শেষ করে তপতীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। দেখা হলো ক্যাম্পাসের এক টঙে। দু কাপ চা নিয়ে একটু নির্জনে গিয়ে বসলাম। ও একটা বই চেয়েছিল, সেটা দিলাম। ও আমাকে একটা বই দিল। বললো উপহার। প্রথম আমি কোনো উপহার পেলাম ওর থেকে, তাও বই। আমি নিশ্চিত বইয়ের মধ্যে কিছু লিখে দিয়েছে। কি হবে? সন্ধিপ্রস্তাব? না কি প্রত্যাখ্যান? আমার হৃৎপিন্ড তখন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। আমি বইটা খুলতে যাচ্ছিলাম। ও মানা করলো। বললো, ‘পরে দেখো।’

কিন্তু আমি মন বসাতে পারছিনা কিছুতেই। কখন দেখবো কখন দেখবো অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। তপতী পরে বললো, আচ্ছা খোলো। আমি খুললাম। জয় গোস্বামি ছিল প্রথম পৃষ্ঠায়,

‘প্রথমে বুঝিনি, কিন্তু আজ বলো, দশক শতক ধ’রে ধ’রে

ঘরে পথে লোকালয়ে স্রোতে জনস্রোতে আমাকে কি

একাই খুঁজেছো তুমি? আমি বুঝি তোমাকে খুঁজিনি?’

আমার মনে পড়লো, আমি কদিন আগে বোধহয় আক্ষেপ করেই বলেছিলাম, আমরা যাকে খুঁজি, যাকে কাছে পেতে চাই, তারা হয়তো আমাদের চায় না। তারা চায় অন্য কাউকে। সে শুধু শুনে গিয়েছিল। পরে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কি খুঁজছো?’

আমার খারাপ লেগেছিল, ও কি জানেনা কি খুঁজছি? বলেছিলাম, ‘জানিনা। শুধু জানি, মনে হচ্ছে অনেকদিন ধরে খুঁজছি!’

আসলেই হয়তো অনেকদিন ধরে খুঁজছিলাম! কি খুঁজছিলাম? প্রেমিকা? না। শুধু প্রেমিক-প্রেয়সী-প্রেম না। একটা অবলম্বন হতে পারে সেটা। হতে পারে ভানহীনভাবে কথা বলার মানুষ। হতে পারে আমার আপন, নিজস্ব পৃথিবী! কতো কি হতে পারে! আমি শুধু জানি যে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, যা পেলে নিজেকে হঠাৎ অসহায় লাগবে না। মনে হবে, কেউ আছে, কেউ তো আছে!

আমি জানতে পারলাম, তপতীও আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আমি চুপ করে লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি। তাকিয়েই আছি। তপতীর ডাকে হুশ হলো, বললো, ‘কি হলো?’

‘কিছু না, পড়ছি।’

‘ভালোবাসো?’

আমি ঘোরের মধ্যেই বললাম, ‘ভালোবাসা দিতে পারি, তুমি কি গ্রহণে সক্ষম?’

‘সন্দেহ আছে?’ 

এ কি! আমি এ কি বললাম! মনে মনে বিনয়কে খুব করে ভৎসর্না করলাম, বললাম, ‘না নেই।’ 

তপতী বললো, ‘হ্যা, ভালোবাসতে এবং ভালোবাসা গ্রহণ করতে সক্ষম, যদি তুমি থাকো।’

সেদিনের পর পৃথিবী প্রায় দুবার সূর্যের চারদিকে ঘুরে এসেছে, গাছের পাতা পড়ে আবার নতুন পাতা এসেছে। দুজনের আরও কিছু পড়া হয়েছে, কিছু ঝগড়াঝাটি হয়েছে। আবার সেসব মিটিয়ে কতোশত বারের মতো দুজন হাত ধরে ব্যস্ততম রাস্তাটা পার হয়েছি তার হিসাব নেই। হিসাব নেই ভালোবাসি কবার বলেছি তার। আরও অনেক কিছুর হিসাবই আমাদের নেই। হিসাব করে আমরা টাকা আর সময় খরচ করি, প্রেম-ভালোবাসা করি বেহিসেবি। এ দুটো যে ফুরানোর নয়! বরং খরচ করলে বাড়ে।

পুরোনো অনেক কথা মনে পড়ে গেল টঙে বসে। টিউশনি শেষ করে এখানে বসা অভ্যাস। পকেটে মাসের বেতন। পুরো তিন হাজার টাকা। পকেটে আরেকবার হাত দিয়ে দেখলাম, নাহ, টাকাটা জায়গামতোই আছে, ছ’টা পাঁচশো টাকার নোট। দুটো টিউশনি করাই, মাসে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা পাই। এই টাকাতেই চলতে হয়। খুব চেপেচুপে হিসাব করি, পাই টু পাই মেপে চলি, তাও মাসের শেষে প্রায়ই টাকার হিসাব মেলাতে পারি না। ভাবতে ভাবতে স্ক্রিনভাঙা ফোনটা বের করে সময় দেখি, রাত সাড়ে আটটা। ম্যাসেজ চেক করি। কোনো ম্যাসেজ আসেনি। ততোক্ষণে চা চলে আসে, ফোনটা রেখে চায়ে মনোযোগ দেই। সিগারেট ধরাই। আর ভাবি। ছ-সাতশ’ টাকা আলাদা করতে হবে। তপতীকে একটা বই কিনে দিব।

চা শেষ করে আমি ওখান থেকে আমার পুরোনো সেই বইয়ের দোকানে যাই। এখানে প্রায় কেনাদামে বই কিনতে পারি। আমি ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ বইটা কিনে বাসায় আনি। এটা আমি এখনও পড়িনি। তপতী যখন এটা পড়া শুরু করেছিল, আমাকে বলেছিল এটা না কি জাদুবাস্তব উপন্যাস। তারপর জাদুবাস্তবতা কি আমাকে বুঝিয়ে বলেছিল। ও যেটা পড়েছিল, সেই অনুবাদ না কি খুব একটা ভালো ছিল না। তাও পড়েছে। কোন অনুবাদটা ভালো হবে সেটাও ও বলেছিল। সেটাও এটা খুব বেশিদিন আগের কথা না। আমি তখনই ভেবেছিলাম বইটা আমি ওকে কিনে দেব।

আমার প্রায়ই এসব মনে পড়ে আজকাল, আজ যেমন সব মনে পড়লো। মনে পড়লেই মনে হয়, আমি কোনোদিন জাদুবাস্তব কিছু লিখতে পারবো না হয়তো, কারণ আমি নিজেই এক জাদুবাস্তব গল্পের চরিত্র। তপতীকে পাওয়াটা আমার জন্য জাদুবাস্তবতাই! বাস্তবেই পেয়েছি, কিন্তু পেয়েছি যেন কোনো জাদুবলে! নইলে আমার মতো চালচুলোহীন এবং হাল ভাষায় ‘স্ট্রাগল’ করা কারো জন্য কেউ কেন এতোটা মায়া পুষে রাখবে?

তপতী মায়া পুষে রাখলেও, ভালোবাসলেও, আমিও তাকে প্রায় তার কাছাকাছি ভালোবাসলেও পৃথিবীর নিয়মেই কিছু সমস্যা তৈরি হয়। আপাতত সমস্যা হচ্ছে, গতো প্রায় একমাস আমাদের দেখা হয়নি। ক্যাম্পাস বন্ধ। মাঝেমাঝে ফোনে ম্যাসেজ এসেছে। গতো সপ্তাহখানেক তাও আসেনি। কেন আসেনি আমি জানি। জানি এবার হয়তো আর আসবে না। আমি তাও অপেক্ষা করি। অপেক্ষা করতে করতে দিনটা চলেই আসে। দুদিন পর ওর জন্মদিন। ও জন্মদিনে নিশ্চয় অনেক কিছু করবে। ওদের বাসায় আনন্দ হবে। কেক কাটবে। সদ্য বিবাহিত তরুণীর জন্মদিনে তার স্বামীর অনেক কিছু করার কথা। অনেক দামী দামী উপহার পাওয়ার কথা। কারণ ওর হবু স্বামী না কি ভালোই বড়লোক। আমার গন্ডি সেই দু-তিনশ থেকে ছ-সাতশতে গিয়ে আটকেছে, তাই হয়তো ইশ্বর চাননি তপতী বিয়ের পরও কম দামী উপহার পাক। অবশ্য আমি এখনও খোঁজ পাইনি, বিয়েটা হলো কি না। তপতী বলেছিল, বিয়ে হোক বা না হোক, সে নিজে এসে আমাকে জানাবে। এর মাঝে হয়তো আমাদের কথা হবে না।

আচ্ছা, ইশ্বর কি জানেন, তপতী দু’শটাকার বইয়ের পাতার গন্ধেই আমার সাথে অনেক সুখী ছিল? সুখী ছিল আমার সাথে আটপৌরে মধ্যবিত্ত প্রেমে। আমরা বিকেলে ভ্রাম্যমাণ ফ্লাস্কের চা খেতাম, পুরোনো বইয়ের দোকানে ঢু মারতাম। কখনও-সখনও ভালো সিনেমা আসলে দেখতে যেতাম। ক্যাম্পাসে মাঠে বসে পার করে দিতাম ক্লাসের ব্রেক। তখন সুখী সুখী চোখে সে স্বপ্ন দেখতো একটা ঘরের, যেখানে আমরা দুজন থাকলে সংসার হয়ে যাবে। আমরা ঝগড়া করতাম। ঝগড়া শেষে ফিরে আসার মধ্যে যে অদ্ভুত আনন্দ ছিল, ইশ্বর কি তা জানেনে? ইশ্বরের জানা উচিত। অন্তত তপতীর জানা উচিত, আমি ভেতরে খানখান হয়ে গেলেও নির্লিপ্তভাবেই সম্পর্ক শেষ মেনে নেব। মেন নেব, আমার দেয়া বইগুলো আমাদের মুহূর্তের দায় নিয়ে কেজিদরে বিক্রি হয়ে যাবে। কেউ হয়তো সেই বই কিনে ফেললে, দেখে নস্টালজিক হয়ে পড়বে।

জীবনে আমি ভয়ানক অসহায় হলেও, অসহায়ত্ব মেনে নিতে শিখেছি সহজভাবে।

আমি বইটা খুলে বসি। কভারের পরেই যে সাদা পৃষ্ঠা, সেখানে লিখি, 

‘তোমার জন্য এই বইটা কিনলাম শেষ হয়ে যাওয়া টিউশনির বেতন দিয়ে। ওই টিউশনিটা আমি আর পড়াবো না, এসএসসি পরীক্ষার্থী ছেলেটার সাথে আর দেখা হবে না। তোমার সাথেও আর হবে না। দুটো সম্পর্কের সমাপ্তি বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছি আমি। একটা নিশ্চিত, একটা অনিশ্চিত। বিয়েটা কি হয়ে গিয়েছে? জানি না!

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এই বইটা আমি তোমাকে দিতে পারবো। আমাদের গল্প আবার নতুন করে শুরু হবে।’

আরও কিছু লিখতে ইচ্ছা করছে। কি লিখতে ইচ্ছা করছে বুঝতে পারছি না। বুঝতে পারি না, বইয়ের এই সাদা পৃষ্ঠা দেখলেই কেন প্রিয়জনের জন্য কিছু লিখতে ইচ্ছে করে? এগুলো তো সেই ফুটপাথে বিশ ত্রিশ টাকাতেই বিক্রি হবে! শুধু বুঝি, আমি নিঃস্বঙ্গ একশ বছর কাটিয়ে ফেলছি তপতীকে ছাড়া। আমি ওকে খুঁজে বেড়াই। আমার কিছু ভালো লাগে না। আমি সিগারেট ধরাই। চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিং দেখি। মনে পড়ে ও বলেছিল, যতো যাই হয়ে যাক, ও আমাকে ছাড়বে না। অন্য কোথাও বিয়ে ঠিক হলে ও পালিয়ে আসবে। আমি হেসেছি শুধু। ও কটমট করেছে। বকাঝকা করেছে। আমি ছেলেমানুষী হিসেবে ধরে নিয়েছি। হেসে দেয়া ছাড়া বেশি কিছু করার সামর্থ্য আমার নেই।

 

আমি সিলিং এ সমুদ্র দেখছিলাম, এমন সময় মেসের ম্যানেজার এসে দরজায় ধাক্কা দিল, বললো, রুমি ভাই, আছেন? 

হ্যা, বলেন।

নিচে আপনার জন্য এক আপা দাঁড়াই আছে।

আমি সিলিং-সমুদ্র দেখতে দেখতে বললাম, আচ্ছা। যান, আসছি আমি।

ম্যানেজার চলে গেল। আমি সমুদ্র দেখতে লাগলাম। আমাকে নিচে যেতে হবে। কোথায় যাবো আমি? ‘এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া...’ সমুদ্রে আমি পথ হারিয়ে টাল-মাতাল হয়ে আছি, একজন এসে আমার হাল ধরছে। হাত ধরছে পরম মমতায়। কে? তপতী না?

আমি নিচে নামতে সময় নেই। নিচে নামলেই তো জেনে ফেলবো কে এসেছে! কেন এসেছে! কে খুঁজছে, কেন খুঁজছে! তপতী এসেছে? বিয়ের খবর দিতে? হয়তো বরসহ যাচ্ছিল, বরকে বলে গাড়ি থামিয়েছে, এই মেসে এক অসহায় অপ্রেমিক থাকে, যার ওকে পাওয়া হয়নি। ভারী বেনারসি পরে জানিয়ে দিতে এলো তার চড়ুই সংসারের খবর। না কি এসেছে যেন আমি ওকে নিয়ে কাজী অফিস চলে যাই? এসেছে একটা সুতি শাড়ি পরেছে, সাজগোজহীন, উত্তেজনায় ঠাসা এক আটপৌরে প্রেমিকা হয়ে, যার সামনে অকূল পাথার, যে আমাকে ভরসা করে, যার হাত আমি কখনও ওরমত মমতা দিয়ে ধরতে পারিনি। আমার তপতীর হাত ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে ইচ্ছে করে।

আমি বইটা হাতে নিয়ে তিনতলা থেকে ধীরপায়ে নামতে থাকি। বইয়ের নাম, ‘নিঃস্বঙ্গতার একশ বছর।’

 

~ সিলিং-সমুদ্র কিংবা সিড়িতে একশ বছর


Akhi Akter Mim

313 Blog posts

Comments