লজ্জায় আর এ-মুখ তুলিয়া তাঁহার মুখের পানে চাহিবে!
ঘরে আর একজন রোগিণী ছিল, সে বিরাজের কান্না দেখিয়া উঠিয়া আসিয়া বিস্ময়ের স্বরে প্রশ্ন করিল, কি হল গা? কেন কাঁদচ?
সে বিরাজের কান্নার হেতু জানিতে চায়!
বিরাজ তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া বসিল এবং কোনদিকে না চাহিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।
সেইদিন লোকপরিপূর্ণ শব্দমুখর রাজপথের এক প্রান্ত বাহিয়া যখন সে তাহার অনভ্যস্ত ক্লান্ত চরণ দুটিকে সারাজীবনের অনুদ্দিষ্ট যাত্রায় প্রথম পরিচালিত করিল, তখন বুক চিরিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস বাহির হইয়া আসিল। সে মনে মনে বলিল, ভগবান! হয়ত ভালই করিয়াছ। আর কেহ চাহিয়া দেখিবে না—এই মুখ, এই চোখ, হয়ত এই যাত্রারই উপযুক্ত। গ্রামের লোক জানিয়াছে, সে গৃহত্যাগিনী কুলটা। তাই, যে মুখ তুলিয়া তাহার গ্রামের মুখ, তাহার স্বামীর মুখ দেখা নিষিদ্ধ হইয়া গিয়াছে, সে মুখ হয়ত এমন হওয়াই তোমার মঙ্গলের বিধান! বিরাজ পথ চলিতে লাগিল।কতদিন গত হইয়া গিয়াছে। প্রথমে সে দাসীবৃত্তি করিতে গিয়াছিল, কিন্তু তাহার ভগ্নদেহ অসমর্থ হইল—গৃহস্থ বিদায় দিলেন। তখন হইতে ভিক্ষাই তাহার উপজীবিকা। সে পথে পথে ভিক্ষা করে, গাছতলায় রাঁধিয়া খায়, গাছতলায় শোয়। এই বর্তমান জীবনে, তাহার অতীতের তিলমাত্র চিহ্নও আর বিদ্যমান নাই। তাহার শতচ্ছিন্ন বস্ত্র, জটবাঁধা রুক্ষ একটুখানি চুল, মলিন ভিক্ষালব্ধ একখানি ছোট কাঁথা গায়ে। তাহার তেমনই দেহ, তেমনই বর্ণ,—তেমনই সব। অথচ এই তাহার পঁচিশ বৎসর মাত্র বয়স, এই দেহেরই তুলনা একদিন স্বর্গেও মিলিত না। অতীত হইতে ছিঁড়িয়া আনিয়া ভগবান তাহাকে একবারে নূতন করিয়া গড়িয়া দিয়াছেন। সে নিজেও সব ভুলিয়াছে। শুধু ভুলিতে পারে নাই দুটা কথা। ‘দাও’ বলিতে এখনও তাহার মুখে রক্ত ছুটিয়া আসে—আজও কথাটা গলা দিয়া স্পষ্ট বাহির করিতে পারে না। আর ভুলিতে পারে না যে, তাহাকে অনেক দূরে গিয়া মরিতে হইবে। মরণের সেই স্থানটুকু তাহার কোন্ দেশান্তরে তাহা সে জানে না বটে, কিন্তু এটা জানে, তাহা বহুদূরে। সেই সুদূরের জন্যই সে অবিশ্রাম পথ চলিয়াছে। সে যে কোনমতেই এ দশা তাহার স্বামীর দৃষ্টিগোচর করিতে পারিবে না, এবং দোষ তাহার যত অপ্রমেয়ই হউক, এ অবস্থা চোখে দেখিলে তাঁহার যে বুক ফাটিয়া যাইবে, তাহা এক মুহূর্তের তরেও বিস্মৃত হইতে পারে নাই বলিয়াই নিরন্তর দূরে সরিয়া যাইতেছিল।
একটা বৎসর পথ হাঁটিতেছে, কিন্তু কোথায় তাহার অপরিচিত গম্যস্থান? কোথায় কোন্ ভূমিশয্যায় এই লজ্জাহত তপ্ত মাথাটা পাতিয়া এই লাঞ্ছিত জীবনটা নিঃশব্দে শেষ করিতে পাইবে? আজ দুদিন হইতে সে একটা গাছতলায় পড়িয়া আছে—উঠিতে পারে নাই। আবার ধীরে ধীরে রোগ ঘিরিয়াছে—কাশি, জ্বর, বুকে ব্যথা। দুর্বল দেহে শক্ত অসুখে পড়িয়া হাসপাতালে গিয়াছিল, ভাল হইতে না হইতেই এই পথশ্রম, অনশন ও অর্ধাশন। তাহার বড় সবলদেহ ছিল বলিয়াই এখনও টিঁকিয়া আছে, আর বুঝি থাকে না। আজ চোখ বুজিয়া ভাবিতেছিল, এই বৃক্ষতলই কি সেই গম্যস্থান? ইহার জন্যই কি সে এত দেশ, এত পথ অবিশ্রাম হাঁটিয়াছে? আর কি সে উঠিবে না? বেলা অবসান হইয়া গেল, গাছের সর্বোচ্চ চূড়া হইতে অস্তোন্মুখ সূর্যের শেষ রক্তাভা কোথায় সরিয়া গেল , সন্ধ্যার শঙ্খধ্বনি গ্রামের ভিতর হইতে ভাসিয়া তাহার কানে পৌঁছিল, সেই সঙ্গে তাহার নিমীলিত চোখের সম্মুখে অপরিচিত গৃহস্থবধূদের শান্ত মঙ্গল মূর্তিগুলি ফুটিয়া উঠিল। এখন কে কি করিতেছে, কেমন করিয়া দীপ জ়ালিতেছে, হাতে দীপ লইয়া কোথায় কোথায় দেখাইয়া ফিরিতেছে, এইবার গলায় আঁচল দিয়া নমস্কার করিতেছে, তুলসীতলায় দীপ দিয়া কে কি কামনা ঠাকুরের পায়ে নিবেদন করিতেছে,—এ সমস্তই সে চোখে দেখিতে লাগিল, কানে শুনিতে লাগিল। আজ অনেকদিন পরে তাহার চোখে জল আসিল। কত সহস্র বৎসর যেন শেষ হইয়া গিয়াছে, সে কোন গৃহে সন্ধ্যাদ্বীপ জ্বালিতে পায় নাই, কাহারও মুখ মনে করিয়া ঠাকুরের পায়ে তাঁহার আয়ু ঐশ্বর্য মাগিয়া লয় নাই। এ-সমস্ত চিন্তাকে সে প্রাণপণে সরাইয়া রাখিত, কিন্তু আজ আর পারিল না। শাঁখের আহ্বানে তাহার ক্ষুধিত তৃষিত হৃদয় কোন নিষেধ না মানিয়া গৃহস্থবধূদের ভিতরে গিয়া দাঁড়াইল। তাহার মনশ্চক্ষে প্রতি ঘরদোর, প্রতি প্রাঙ্গনপ্রান্তর, বাঁধান তুলসীবেদী, প্রতি দীপটি পর্যন্ত এক হইয়া গেল—এ যে সমস্তই তাহার চেনা; সবগুলিতেই এখন যে তাহারই হাতের চিহ্ন দেখা যাইতেছে! আর তাহার দুঃখ রহিল না, ক্ষুধাতৃষ্ণা রহিল না, পীড়ার যাতনা রহিল না, সে তন্ময় হইয়া নিরন্তর বধূদের অনুসরণ করিয়া ফিরিতে লাগিল।
যখন তাহারা রাঁধিতে গেল, সঙ্গে গেল, রান্না শেষ করিয়া যখন স্বামীদের খাইতে দিল, সে চোখ মেলিয়া চাহিয়া দেখিল, তার পর সমস্ত কাজকর্ম সমাধা করিয়া অনেক রাত্রে যখন তাহারা নিদ্রিত স্বামীদের শয্যাপার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল, সেও কাছে দাঁড়াইতে গিয়া সহসা শিহরিয়া উঠিল—এ যে তাহারই স্বামী! আর তাহার চোখের পলক পড়িল না, একদৃষ্টে নিদ্রিত স্বামীর মুখপানে চাহিয়া রাত্রি কাটাইয়া দিল। গৃহ ছাড়িয়া পর্যন্ত এমন করিয়া একটি রাত্রিও ত তাহার কাছে আসে নাই! আজ তাহার ভাগ্যে এ কি অসহ সুখ! নিদ্রায় জাগরণে, তন্দ্রায় স্বপনে, এ কি মধুর নিশাযাপন! বিরাজ চঞ্চল হইয়া উঠিয়া বসিয়াছে। তখনও পূর্বগগন স্বচ্ছ হয় নাই, তখনও ধূষর জ্যোৎস্না শাখা ও পাতার ফাঁকে ফাঁকে নামিয়া বৃক্ষতলে, তাহার চারিদিকে শেফালিপুষ্পের মত ঝরিয়া রহিয়াছে। সে ভাবিতেছিল, সে যদি অসতী, তবে কেন তিনি আজ এমন করিয়া দেখা দিলেন? তাহার পাপের প্রায়শ্চিত্ত পূর্ণ হইয়াছে, তাহাই কি জানাইয়া দিয়া গেলেন? তবে ত একমুহূর্ত কোথাও সে বিলম্ব করিতে পারিবে না। সে উদ্গ্রীব হইয়া প্রভাতের জন্য অপেক্ষা করিয়া রহিল। আজিকার রাত্রি সহসা তাহার রুদ্ধদৃষ্টি সজোরে উদঘাটিত করিয়া সমস্ত হৃদয় আনন্দে মাধুর্যে ভরিয়া দিয়া গিয়াছে।আর দেখা হউক বা না হউক, আর ত তাহাকে এক নিমিষের জন্যও স্বামী হইতে বিছিন্ন করিয়া রাখিতে পারিবে না! এমন করিয়া তাঁহাকে যে পাবার পথ ছিল, অথচ, সে বৃথায় এতদিন স্বামীছাড়া হইয়া দুঃখ পাইয়াছে, এই ত্রুটিটা তাহাকে গভীর বেদনায় পুনঃ পুনঃ বিঁধিতে লাগিল। আজ কি করিয়া না জানি, তাহার স্থিরবিশ্বাস হইয়াছে তিনি ডাকিতেছেন।
বিরাজ দৃঢকন্ঠে বলিল, ঠিক ত! এই দেহটা কি আমার আপনার যে, তাঁর অনুমতি ভিন্ন এমন করিয়া নষ্ট করিতেছি! আমার বিচার করিবার অধিকার আমার নয়, তাঁর। যা করিবার তিনিই করিবেন, আমি সব-কথা তাঁর পায়ে নিবেদন করিয়া দিয়া ছুটি লইব। বিরাজ প্রত্যাবর্তন করিল।
আজ তাহার দেহ লঘু, পদক্ষেপ যেন কঠিন মাটির উপর পড়িতেছে না, মন পরিপূর্ণ, কোথাও এতটুকু গ্লানি নাই। হাঁটিতে হাঁটিতে সে বারংবার আবৃত্তি করিতে লাগিল, এ কি বিষম ভুল! এ কি অহঙ্কার তাহাকে পাইয়া বসিয়াছিল! এই কুরূপ কুৎসিত মুখ বিশ্বের সুমুখে বাহির করিতে লজ্জা হয় নাই, শুধু লজ্জা হইয়াছিল তাঁর কাছে, যাঁর কাছে প্রকাশ করিবার একমাত্র অধিকার তাহার নয় বৎসর বয়সে বিধাতা স্বয়ং নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছিলেন।