আমি নারী

Comments · 8 Views

নারী মানেই পুরুষকে আগলে রাখা শক্তি,,
নারী মানেই মা
নারী মানেই অসহ্য কে সহ্য করা।

-“ভাবি,নিশ্চয়ই আপনার মেয়ের মাঝে কোনো সমস্যা ছিল তাই স্বামী ডির্ভোস দিয়ে আরেক বিয়ে করেছে। হয়তো স্বামীকে সুখ দিতে পারে নাই নাহলে এতো ভালো একটা স্বামী কীভাবে আরেক মেয়েকে পছন্দ করতে পারে?”

 

মাত্রই ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছিল অপরূপা। ড্রয়িং রুম থেকে পাশের বাসার আন্টির এরূপ কথা কর্ণপাত হতেই পরবর্তী ভাতের লোকমাটা আর মুখে দেওয়া হলো না। বিমর্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো খাবারের দিকে। গলা দিয়ে যেন এখন আর একবিন্দু খাবারও নামবে না। অপরূপার মা বিরক্ত নয়নে কাঠকাঠ গলায় বললেন,

 

-“আপনার অন্য কোনো কথা থাকলে বলেন আর যদি না থাকে তাহলে এক্ষুনি বাসা থেকে বেরিয়ে যান। আমার মেয়েকে নিয়ে আরেকটা কথাও আমি সহ্য করবো না। আপনার ভাগ্য ভালো যে অপরূপার বাবা এ কথাটা শুনেনি!”

 

পাশের বাসার সেই মহিলাটির মুখ থমথমে হয়ে যায়। কথা শোনাতে এসে নিজেই কথা শোনার মতো অবস্থা হলো। তিনি গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে কিছু না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। যাওয়ার আগে অপরূপার দিকে একবার ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে ভুলল না যেন। 

 

অপরূপার দলা পাকিয়ে কান্না আসছে। চোখের জলে সব নিমেষেই ঝাপসা ঠেকছে। চোখ থেকে গড়িয়ে এক ফোটা জল ভাতের প্লেটে পতিত হলো। অপরূপার মা মেয়ের কাছে এসে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বললেন,

 

-“তুই ওই মহিলার টাকায় খাসও না,পড়িসও না যে তোকে উনার কথায় কাঁদতে হবে। তুই তোর মতো চলবি,কারও কথায় পাত্তা দিবি না। এখন খেয়ে নে।”

 

অপরূপার কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো। সে দুচোখ মুছে বলল,

 

-“আমার জন্য তোমাদের এখন অনেক কথা শুনতে হয় তাই না মা?”

 

-“কে বলেছে কথা শুনতে হয়? মানুষ শোনালেও আমরা এক কান দিয়ে ঢুকাই আরেক কান দিয়ে বের করে দিই। তুই বেশি কথা না বলে খেয়ে নে।”

 

-“আমার আর খাবার গলা দিয়ে নামবে না গো,মা!”

 

এই বলে অপরূপা হাত ধুয়ে এক দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায়। অপরূপা বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা মায়ের চোখের মণি সে। তার ইচ্ছে ছিল সে অনেক পড়াশোনা করবে,জীবনে অনেক বড় হবে। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরই তার সেই ইচ্ছেটাকে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এক সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে তার বিয়ের প্রস্তাব আসে। পাত্র দেখতে শুনতে ভালো,কর্মজীবীও বটে। উনারা অপরূপাকে ভীষণ পছন্দ করেছিলেন। তাদের প্রস্তাব ছিল কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই তারা অপরূপাকে তাদের ঘরের বউ করতে চান। এতো ভালো একটা সম্বন্ধ অপরূপার বাবা-মা নাকচ করতে পারেনি ফলে অপরূপার শত ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সেই ইচ্ছে বিসর্জন দিয়ে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। অপরূপার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা বলেছিল বিয়ের পর তাকে পড়াশোনা করাবে যার জন্য অপরূপার বাবা-মা অপরূপাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিয়েতে রাজি করায়। কিন্তু বিয়ের পরই তার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের মত পাল্টে যায়। শাশুড়ির এক কথা,

 

-“বিয়ের পর এতো পড়াশোনা করলে সংসার কীভাবে সামলাবে? এতো পড়াশোনা করতে হবে না।”

 

শুধু শাশুড়ি নয় বাড়ির প্রতিটি সদস্যেরই একই মন্তব্য ছিল। অপরূপা ভেবেছিল স্বামী রাহাদের কাছ থেকে সমর্থন পাবে কিন্তু তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে রাহাদ সেদিন বলেছিল,

 

-“তোমার এতো পড়তে হবে না,অরু! এতো পড়ে কী করবে? চাকরি করবে? আমার কী কম টাকা? আমি যে টাকা উপার্জন করি তাতে আমাদের সারাজীবন চলে যাবে।”

 

শেষমেশ অপরূপার আর কোনো উপায়ন্তর থাকলো না। সে ও ধরে নিলো,মন দিয়ে কেবল সংসারটাই করবে। সে এখন বাড়ির বউ আর বউদের প্রধান দায়িত্ব হলো সংসার সামলে রাখা। তাই সে ও নিজেকে সংসারে সমর্পিত করলো। বিয়ের পর তার দিন ভালোই সুখে কাটছিলো। রাহাদ তাকে খুব ভালোবাসতো। প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় তার জন্য দুটো চকলেট ও একটি ফুলের গাজরা নিয়ে আসতো। কিন্তু এই সুখের সংসারটাতেই যেন কারো কুনজর পড়লো। দিনদিন অপরূপা লক্ষ্য করে রাহাদ আর আগের মতো তাকে ভালোবাসে না,তার যত্ন করে না। এখন আর তার জন্য নিয়ম করে চকলেট,গাজরা আনে না। কিছু বললে বলে,অফিসে কাজের চাপে আনতে মনে ছিল না। অথচ আগে শত কাজের চাপ থাকলেও এগুলো আনতে ভুলতো না। তার সাথে এখন আর ঠিকঠাক কথা বলে না,মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকায় না। রাহাদ যে তাকে আর একদমই ভালোবাসে না সেটার প্রমাণ পেয়েছিল সেদিন যেদিন রাহাদের পাশে অপর একজন মেয়েকে বধুসাজে দেখেছিল। অপরূপা সেদিন নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে এটাই কি তার আগের রাহাদ? যে রাহাদ তাকে কিছুক্ষণ না দেখলেই অস্থির হয়ে যেত,তাকে ভালোবাসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতো? রাহাদ তার চোখের সামনে দিয়ে তার সদ্য বিয়ে করা বউ নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। অপরূপা ক্রমে ক্রমে কেমন নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগলো। তার সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগলো এটা দেখে যে সেদিন কেউই রাহাদের এই কাজের জন্য তাকে তিরস্কার করেনি। বরং সবার চোখেমুখেই ছিল খুশির ঝলক। অপরূপার শাশুড়ি মা এসে বলেছিলেন,

 

-“তুমি চাইলে এ বাড়ি থেকে চলে যেতে পারো আবার চাইলে থাকতেও পারো। তবে খবরদার,তোমার জন্য যেন রাহাদের জীবনে কোনো অশান্তি না হয়।”

 

সে বুঝতে পারলো এ বাড়িতে তার দিন ফুরিয়ে এসেছে। এটাও বুঝতে পারলো সকলের সম্মতিতেই রাহাদ এই বিয়েটা করেছে কেবলমাত্র তার সম্মতি বাদে। সেদিনই নিজের সকল কাপড়চোপড় গুছিয়ে বাবার বাড়িতে চলে এলো। বাবার বাড়ি যাওয়ার পরপরই রাহাদ তাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়। শ্বশুরবাড়ি থেকে যাওয়ার আগে রাহাদ ও তার স্ত্রীকে সে এক পলক দেখে নেয়। শেষবারের মতো রাহাদকে জিজ্ঞেস করেছিল,

 

-“কেন করলে এমন? কী দোষ ছিল আমার?”

 

জবাবে রাহাদ বলেছিল,

 

-“তোমাকে আমার সাথে মানায় না অপরূপা!”

 

বাহ! অরু থেকে এখন অপরূপা! রাহাদ তাকে ভালোবেসে অরু ডাকতো। আর এখন সেই ভালোবাসা কিনা মানিয়ে নেওয়ায় ঠেকলো? এতোদিন তো খুব মানিয়েছে তাহলে এখন? তার বুকটা ফেটে যেতে লাগলো। যে ঘরটা এতোদিন নিজের মনমতো,নিজের ভালোবাসা দিয়ে সাজিয়েছে, সেই ঘরটিতে বিরাজ করবে এখন অন্য এক নারী। যে ভালোবাসা রাহাদ এতোদিন তাকে দিয়েছে সেই ভালোবাসার অধিকারী হবে এখন অন্য কেউ। অন্য এক নারীতে রাহাদ নিজের সুখ খুঁজে নিবে,নিজেকে উন্মুক্ত করে দিবে সেই নারীর মাঝে। এসব ভাবতেই অপরূপা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। তখন তার আপন বলতে ছিল কেবল দুজন মানুষ৷ তার বাবা-মা। উনারাই তখন অপরূপাকে বুকে আগলে নিয়েছিলেন।

 

ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে অপরূপা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এতক্ষণ রুমের দরজা লাগিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে অতীত মনে করে কেঁদেছে। মাঝে অপরূপার মা এমনকি তার বাবাও খাওয়ার জন্য ডেকেছে কিন্তু সে না করে দিয়েছে। সে এবার উঠে দাঁড়ায়। আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে ভালো করে পরখ করে। রাহাদ সেদিন বলেছিল তার সাথে মানায় না অথচ স্কুল লাইফে সে কতো প্রপোজাল পেয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। হতে পারে সে শ্যামবর্ণের কিন্তু তার মায়াবী চেহারার প্রেমে পড়তে যে কেউ বাধ্য। এখন,তার চেহারা আগের চেয়ে বেশ পাল্টে গেছে। তার গোলগাল মুখটা দিনদিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে,গায়ের রং আগের চেয়েও বেশ কালো হয়ে গেছে,চোখের নিচের কালো দাগটা আরও গাঢ় হয়েছে। এসবই ঠিকমতো না খাওয়া,না ঘুমানোর ফল। এখনও মাঝরাতে সে রাহাদের কথা মনে করে কাঁদে। সাথে পাড়া-প্রতিবেশীদের এরূপ নিষ্ঠুর কথাবার্তা তাকে আরও পীড়া দেয়। কিন্তু হঠাৎই কেন জানি সে নিজের মাঝে অদ্ভুত এক শক্তি খুঁজে পাচ্ছে। এইযে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে,তার মনে হচ্ছে এই অপরূপাটাকে পরিবর্তন করে এক নতুন অপরূপা সৃষ্টি করা দরকার। এতোদিন সবাই যে অপরূপাকে দেখেছে তার চেয়েও ভিন্নভাবে সে নিজেকে তৈরি করবে। সবার নাগালের বাইরে থাকবে সে। আর সে একজন বিশ্বাসঘাতককে মনে করে কষ্ট পাবে না। সে নিজে এবার সাবলম্বী হবে,মাথা উঁচু করে বাঁচবে,বাবা-মায়ের কষ্ট দূর করবে।

 

অপরূপা এখন মনপ্রাণ দিয়ে চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করছে। এর জন্যও তাকে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে,দিনরাত গাধার মতো পরিশ্রম করতে হচ্ছে। এতেও পাড়া-প্রতিবেশীদের যেন কথার শেষ নেই। দিনরাত তারা অপরূপার সমালোচনায় ব্যস্ত। কিন্তু অপরূপার সেদিকে মন নেই। সে নিজের চেষ্টায় অবিচল। কারণ অপরূপার বাবা-মা একদিনই বলে দিয়েছেন,

 

-“পাছে লোকে কিছু বলবেই তার জন্য তোমাকে পিছিয়ে পড়লে হবে না! তোমাকে তোমার লক্ষ্যে অটুট থাকতে হবে।”

 

বাবা-মা যেন অপরূপার কাছে অনুপ্রেরণার ভাণ্ডার। তারা পদে পদে অপরূপার খুঁটি হয়ে দাঁড়াচ্ছে যেন অপরূপা ভেঙে পড়লে তাদেরকে ধরে আবার উঠে দাঁড়াতে পারে। শেষমেশ,অপরূপার এতো পরিশ্রম সফল হলো৷ সে একটা চাকরিতে সিলেক্টেড হয়েছে। সেদিন অপরূপা তার বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে বেশ অনেকক্ষণ কেঁদেছে। সে কান্না কষ্টের নয়,সে কান্না সুখের। অপরূপা চাকরিতে জয়েন করে৷ বেশ কিছুদিন চাকরি করার পর অপরূপা বুঝতে পারে এই চাকরিতে কাজ করা মানে একটা পরাধীন জীবন ভোগ করা। এখানে,অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যাবে না,ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা যাবে না,এর কোনো একটা করলেই চাকরি হারানোর ভয়টা কর্মীদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়। কিন্তু অপরূপা তো এরকম জীবন চায়নি যেই জীবনে সে অন্যায়কে অন্যায় বলতে পারবে না,ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতে পারবে না। তাই সে নিজ ইচ্ছায় চাকরিটা ছেড়ে দেয়। চাকরিতে ভালো বেতন থাকলেও তাতে তার বিশেষ কোনো আক্ষেপ থাকেনি৷ বরং নিজেকে মুক্তপাখির মতো মনে হচ্ছিল। অপরূপা বাবা-মাকে সবটা বললে তারাও মেয়ের সিদ্ধান্তে খুশি হন। এবার অপরূপা সিদ্ধান্ত নিলো সে নিজ উদ্যোগে ব্যবসা করবে। হয়ে উঠবে একজন সেরা উদ্যোক্তা। কিন্তু ব্যবসাতে ইনভেস্ট করার জন্য বেশ টাকার প্রয়োজন,যে টাকাটা বর্তমানে তার কাছে নেই। মেয়ের এমন পরিস্থিতি দেখে অপরূপার বাবা নিজের শেষ সম্বল,নিজের জমিটুকু বিক্রি করে দেন। এতে অপরূপা বলে,

 

-“বাবা,এটা কী করলে? তোমার তো এই জমিটুকু ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। এটাও বিক্রি করে দিলে?”

 

অপরূপার বাবা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

 

-“সমস্যা নেই,মা। নিজের মেয়ের জন্যই করেছি অন্য কারো জন্য না। তুই এই টাকাটা দিয়ে ব্যবসা কর,আমার বিশ্বাস তুই সফল হবি!"

 

অপরূপা এই টাকা ইনভেস্ট করে একটা ছোটখাটো ব্যবসা দাঁড় করায়। একটা কাপড়ের দোকান দেয়,সাথে নানা কসমেটিকস। শেষে,এই টাকাতেও হচ্ছিল না বিধায় অপরূপার মা উনার সমস্ত গহনা বিক্রি করে টাকা দেন। মা-বাবার দেওয়া এই টাকাগুলো যেন অপরূপার কাছে মহামূল্যবান কিছু। প্রথম প্রথম অপরূপার ব্যবসার তেমন কোনো উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি যার দরুন অপরূপা প্রায় ভেঙে পড়েছিল কিন্তু তখন তার বাবা-মা তার খুঁটি হিসেবে কাজ করে। তাকে শক্তি জোগায়,উৎসাহ দেয়,ধৈর্য ধরতে বলে। কারণ ধৈর্যের ফল মিষ্টি হয়। হ্যাঁ,ধৈর্যের ফল মিষ্টি হয়েছে। ধীরে ধীরে অপরূপার ব্যবসার উন্নতি ঘটতে থাকে৷ কাস্টমার বাড়তে থাকে। অপরূপার ছোট্ট দোকানটি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং কয়েকবছর পর সেটি শহরের একটি বিখ্যাত মার্কেটে পরিণত হয়। এই মার্কেট এখন সবাই একনামে চেনে। এখানে সবচেয়ে উন্নতমানের পোশাক,কসমেটিকস পাওয়া যায়। অপরূপার এই মার্কেটটিতে এখন কাজ করে শত অসহায় নারী যাদের পাশে দিনশেষে দাঁড়ানোর মতো কেউ থাকে না। তারা যেন সাবলম্বী হতে পারে তাই তাদেরকেই কাজ দেওয়া হয়। অপরূপা এখন শহরে একটা বড় বাড়িতে তার বাবা-মাকে নিয়ে থাকছে। মাকে বছরের পর বছর নতুন নতুন গয়না বানিয়ে দিচ্ছে,বাবাকে নিত্যনতুন পাঞ্জাবি,পায়জামা কিনে দিচ্ছে। তাদেরকে মাথায় করে রাখছে সে। কারণ,তার দুঃসময়ে তারা পাশে না থাকলে সে আজকের অপরূপা হয়ে উঠতে পারতো না। অপরূপা আজ মনমতো সাজলো৷ একটা আকাশী কালারের শাড়ি পড়ে চুলগুলো বেণুনি করে নিলো। চোখভর্তি কাজল দিলো,ঠোঁটে লিপস্টিক,মুখে হালকা একটু প্রসাধনী দিলো। এতেই যেন অপরূপাকে রাজ্যের সুন্দরী লাগছে। অপরূপার চোখের নিচের সেই দাগটি আর নেই,শুকিয়ে যাওয়া মুখটি আবারও ভরে এলো। দুচোখে কেবল সে এখন সুখ দেখতে পায়। সে নিজেকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করতে পেরেছে। হ্যাঁ,সে এখন সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। সে নিজের মার্কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ পিছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো,

 

-"অপরূপা!"

 

এতো বছর পরও অপরূপা সেই চিরচেনা কণ্ঠ ভুলতে পারেনি৷ শোনামাত্রই চকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো রাহাদকে সাথে রাহাদের স্ত্রী নামিরা। রাহাদ অপরূপার দিকে এগিয়ে আসলো। আজ কেন জানি অপরূপার দিক থেকে তার চোখ সরছে না,ইচ্ছে করছে হাজার বছর ধরে এই শ্যামমোহিনীর দিকে তাকিয়ে থাকতে। রাহাদ একটু অবাকস্বরে বলল,

 

-“তুমি এখানে? কিছু কিনতে এসেছো নাকি?”

 

অপরূপা হাসলো। সে জবাব না দিয়ে বলল,

 

-“আপনি এখানে কী করছেন?”

 

রাহাদ ইতস্ততবোধ করলো। সত্যিটা বললে সে অপরূপার সামনে ছোট হয়ে যাবে তাই সত্যিটা লুকোলো। বলল,

 

-“আমি নামিরাকে নিয়ে মার্কেট করতে এসেছি। শুনেছি এটা নাকি অনেক উন্নতমানের মার্কেট। এখানে অনেক ভালো পোশাক পাওয়া যায়।”

 

তার মধ্যেই একজন কম বয়সী মেয়ে এসে অপরূপাকে বলল,

 

-“ম্যাডাম,আপনি আজ এসেছেন! ভালোই হয়েছে! একটু আসবেন দেখেন না কী একটা ঝামেলা হয়েছে!”

 

অপরূপাকে ম্যাডাম ডাকতে দেখে রাহাদ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

 

-“তুমি কি মেয়েটার কিছু হও? না,মানে তোমাকে ম্যাডাম ডাকছে যে!”

 

অপরূপা হেসে বলল,

 

-“আপনি যে মার্কেটটায় দাঁড়িয়ে আছেন সেই মার্কেটটার মালিক আমি। এটা আমার তিলতিল করে গড়া বহু আকাঙ্ক্ষার ফল!”

 

রাহাদ বিস্ময়ে হা হয়ে যায়। নামিরা মাথা নিচু করে ফেলল। সে শুনেছিল একজন নারীর বহু পরিশ্রমে এই মার্কেটটি গড়ে উঠে কিন্তু সেই নারী যে অপরূপা সেটা সে কখনো কল্পনাও করেনি। রাহাদ যে সত্যটা লুকোনোর চেষ্টা করছিল সেই সত্যটা বোধহয় আর লুকোনো যাবে না। সে এবার বলল,

 

-“বাহ! কংগ্রাচুলেশনস,অপরূপা!"

 

-“থ্যাংকস!”

 

রাহাদ একটু ইতস্ততবোধ করে বলল,

 

-“অপরূপা,তোমার সাথে একটু কথা ছিল!”

 

-“একটু পর বলেন। আমাকে এখন যেতে হবে।”

 

এই বলে অপরূপা সেই মেয়েটির সাথে চলে যায়। কিয়ৎক্ষণ পর এসে বলে,

 

-“কী জানি বলবেন?”

 

তখন ফাহাদের স্ত্রী নামিরা বলে,

 

-“আপু,শুনেছি এখানে নাকি অনেক অসহায় মেয়েদের কাজ দেওয়া হয় তাই আসলাম। আমাকে কি সেলসম্যান হিসেবে এখানে কাজ দেওয়া যাবে? আপু,প্লিজ না করো না। খুবই অভাবের মধ্যে আছি।”

 

অপরূপা নামিরাকে কিছু না বলে ফাহাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

 

-“আপনার স্ত্রী কাজ করলে সংসার কে দেখবে?”

 

ফাহাদ ধীর কণ্ঠে বলল,

 

-“আসলে আমার চাকরিটা আর নেই। বাড়িতে ভীষণ অভাব। চাকরির জন্য অনেক ট্রাই করছি কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না। তো,এখানে শুনলাম শুধু মেয়েদের কাজ দেওয়া হয় তা নাহলে আমিই করতাম এই কাজটা। তাই নামিরা এই কাজটা না করলে আর কোনো উপায় নেই।”

 

অপরূপার একটু খারাপ লাগলো। কিন্তু তারও এখন কিছুই করার নেই। কারণ তার এই মার্কেটে কর্মীর অভাব নেই। আরও কতো মেয়েরা আবেদন করে রেখেছে তাদেরই সে কাজ দিতে পারছে না! সে বলল,

 

-“দুঃখিত,এখানে কর্মীর কোনো অভাব নেই। সুতরাং,কাজটি দিতে পারছি না!”

 

ফাহাদ অনুরোধ করে বলল,

 

-“অপরূপা,একটু দেখো না কিছু করা যায় কিনা!”

 

-“কিছু করা গেলে আমি অবশ্যই করতাম! আমি এতোটাও নিষ্ঠুর নই যে মানুষ আমাকে কষ্ট দিবে দেখে বিনিময়ে তাদেরও কষ্ট দিবো। সত্যিই এখানে কাজ করার লোকের অভাব নেই। আরও অনেকেই আবেদন করেছে তাদেরকেই কাজ দিতে পারছি না,তো আপনার স্ত্রীকে কীভাবে দিবো বলুন?”

 

এই বলে অপরূপা চলে যেতে উদ্যত হলে আবারও পিছু ফিরে রাহাদের দিকে এগিয়ে আসে। হাসিমুখ করে বলে,

 

-“ধন্যবাদ আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য। তা নাহলে এই সুন্দর জীবনটি পেতাম না!”

 

এই বলে সে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। পিছনে ফিরলে হয়তো দেখতে পেতো দুইজোড়া চোখের অসহায়ত্ব। বাসায় ফিরতেই অপরূপার মা বলল,

 

-“তোর সেই প্রতিবেশী আন্টি এসেছিল৷ কীভাবে জানি বাসা চিনে এসেছে!”

 

-“পরে?”

 

-“পরে বলল,তোর মার্কেটে তার মেয়েকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে,তার মেয়ে নাকি খুবই অসহায়!”

 

-“পরে তুমি কী বললে?”

 

-“আমি এককথা বলে দিয়েছি,আমার মেয়ের মার্কেটে শত শত মেয়েরা কাজ করে সেখানে আপনার মেয়েকে কোনো কাজ দেওয়া যাবে না। তারপরও অনেক অনুরোধ করেছিল কিন্তু আমার না করাতে পরে চলে যায়।”

 

-“আসলেই,আমার মার্কেটে কোনো কর্মীর প্রয়োজন ছিল না!”

 

অপরূপা রাতের খাওয়া শেষে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। এখানে,রোজ ঠাণ্ডা হাওয়া তার শরীরে শিহরণ জাগায়। সে ভাবতে থাকে,একসময় যারা তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে আজ ভাগ্যের লীলাখেলায় তারাই তার কাছে এসে সাহায্য চাইছে। কী অদ্ভুত তাই না? সে আপনমনে বলে উঠলো,

 

“আমি নারী। নারী মানেই জলন্ত এক অগ্নিশিখা। যে তাকে স্পর্শ করতে চাইবে সে-ই অগ্নির উত্তাপে জ্বলে উঠবে। তাই নারীদেরকে জ্বালাতে এসো না, নিজেরাই জ্বলে উঠবে।”

 

                   সমাপ্ত

 

#আমি_নারী

 

#অনুগল্প 

 

গল্প লেখকের আইডি Dh Ome , যারা প্রতিদিন এমন অসাধারণ সব গল্প পড়তে চান,,তারা আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে রাখতে পারেন। আমি কথা দিলাম আমার গল্পগুলা আপনাদের মন ছুঁয়ে যাবে❤️ #Dh_-“ভাবি,নিশ্চয়ই আপনার মেয়ের মাঝে কোনো সমস্যা ছিল তাই স্বামী ডির্ভোস দিয়ে আরেক বিয়ে করেছে। হয়তো স্বামীকে সুখ দিতে পারে নাই নাহলে এতো ভালো একটা স্বামী কীভাবে আরেক মেয়েকে পছন্দ করতে পারে?”

 

মাত্রই ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছিল অপরূপা। ড্রয়িং রুম থেকে পাশের বাসার আন্টির এরূপ কথা কর্ণপাত হতেই পরবর্তী ভাতের লোকমাটা আর মুখে দেওয়া হলো না। বিমর্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো খাবারের দিকে। গলা দিয়ে যেন এখন আর একবিন্দু খাবারও নামবে না। অপরূপার মা বিরক্ত নয়নে কাঠকাঠ গলায় বললে

 

-“আপনার অন্য কোনো কথা থাকলে  বলেন আর যদি না থাকে তাহলে এক্ষুনি বাসা থেকে বেরিয়ে যান। আমার মেয়েকে নিয়ে আরেকটা কথাও আমি সহ্য করবো না। আপনার ভাগ্য ভালো যে অপরূপার বাবা এ কথাটা শুনেনি

 

পাশের বাসার সেই মহিলাটির মুখ থমথমে হয়ে যায়। কথা শোনাতে এসে নিজেই কথা শোনার মতো অবস্থা হলো। তিনি গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে কিছু না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। যাওয়ার আগে অপরূপার দিকে একবার ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে ভুলল না যেন

 

অপরূপার দলা পাকিয়ে কান্না আসছে। চোখের জলে সব নিমেষেই ঝাপসা ঠেকছে। চোখ থেকে গড়িয়ে এক ফোটা জল ভাতের প্লেটে পতিত হলো। অপরূপার মা মেয়ের কাছে এসে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বললে

 

-“তুই ওই মহিলার টাকায় খাসও না,পড়িসও না যে তোকে উনার কথায় কাঁদতে হবে। তুই তোর মতো চলবি,কারও কথায় পাত্তা দিবি না। এখন খেয়ে নে

 

অপরূপার কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো। সে দুচোখ মুছে বল

 

-“আমার জন্য তোমাদের এখন অনেক কথা শুনতে হয় তাই না মা

 

-“কে বলেছে কথা শুনতে হয়? মানুষ শোনালেও আমরা এক কান দিয়ে ঢুকাই আরেক কান দিয়ে বের করে দিই। তুই বেশি কথা না বলে খেয়ে নে

 

-“আমার আর খাবার গলা দিয়ে নামবে না গো,মা

 

এই বলে অপরূপা হাত ধুয়ে এক দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায়। অপরূপা বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা মায়ের চোখের মণি সে। তার ইচ্ছে ছিল সে অনেক পড়াশোনা করবে,জীবনে অনেক বড় হবে। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরই তার সেই ইচ্ছেটাকে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এক সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে তার বিয়ের প্রস্তাব আসে। পাত্র দেখতে শুনতে ভালো,কর্মজীবীও বটে। উনারা অপরূপাকে ভীষণ পছন্দ করেছিলেন। তাদের প্রস্তাব ছিল কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই তারা অপরূপাকে তাদের ঘরের বউ করতে চান। এতো ভালো একটা সম্বন্ধ অপরূপার বাবা-মা নাকচ করতে পারেনি ফলে অপরূপার শত ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সেই ইচ্ছে বিসর্জন দিয়ে তাকে  বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। অপরূপার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা বলেছিল বিয়ের পর তাকে পড়াশোনা করাবে যার জন্য অপরূপার বাবা-মা অপরূপাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিয়েতে রাজি করায়। কিন্তু বিয়ের পরই তার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের মত পাল্টে যায়। শাশুড়ির এক কথা

 

-“বিয়ের পর এতো পড়াশোনা করলে সংসার কীভাবে সামলাবে? এতো পড়াশোনা করতে হবে না

 

শুধু শাশুড়ি নয় বাড়ির প্রতিটি সদস্যেরই একই মন্তব্য ছিল। অপরূপা ভেবেছিল স্বামী রাহাদের কাছ থেকে সমর্থন পাবে কিন্তু তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে রাহাদ সেদিন বলেছি

 

-“তোমার এতো পড়তে হবে না,অরু! এতো পড়ে কী করবে? চাকরি করবে? আমার কী কম টাকা? আমি যে টাকা উপার্জন করি তাতে আমাদের সারাজীবন চলে যাবে

 

শেষমেশ অপরূপার আর কোনো উপায়ন্তর থাকলো না। সে ও ধরে নিলো,মন দিয়ে কেবল সংসারটাই করবে। সে এখন বাড়ির বউ আর বউদের প্রধান দায়িত্ব হলো সংসার সামলে রাখা। তাই সে ও নিজেকে সংসারে সমর্পিত করলো। বিয়ের পর তার দিন ভালোই সুখে কাটছিলো। রাহাদ তাকে খুব ভালোবাসতো। প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় তার জন্য দুটো চকলেট ও একটি ফুলের গাজরা নিয়ে আসতো। কিন্তু এই সুখের সংসারটাতেই যেন কারো কুনজর পড়লো। দিনদিন অপরূপা লক্ষ্য করে রাহাদ আর আগের মতো তাকে ভালোবাসে না,তার যত্ন করে না। এখন আর তার জন্য নিয়ম করে চকলেট,গাজরা আনে না। কিছু বললে বলে,অফিসে কাজের চাপে আনতে মনে ছিল না। অথচ আগে শত কাজের চাপ থাকলেও এগুলো আনতে ভুলতো না। তার সাথে এখন আর ঠিকঠাক কথা বলে না,মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকায় না। রাহাদ যে তাকে আর একদমই ভালোবাসে না সেটার প্রমাণ পেয়েছিল সেদিন যেদিন রাহাদের পাশে অপর একজন মেয়েকে বধুসাজে দেখেছিল। অপরূপা সেদিন নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে এটাই কি তার আগের রাহাদ? যে রাহাদ তাকে কিছুক্ষণ না দেখলেই অস্থির হয়ে যেত,তাকে ভালোবাসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতো? রাহাদ তার চোখের সামনে দিয়ে তার সদ্য বিয়ে করা বউ নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। অপরূপা ক্রমে ক্রমে কেমন নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগলো। তার সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগলো এটা দেখে যে সেদিন কেউই রাহাদের এই কাজের জন্য তাকে তিরস্কার করেনি। বরং সবার চোখেমুখেই ছিল খুশির ঝলক। অপরূপার শাশুড়ি মা এসে বলেছিলে

 

-“তুমি চাইলে এ বাড়ি থেকে চলে যেতে পারো আবার চাইলে থাকতেও পারো। তবে খবরদার,তোমার জন্য যেন রাহাদের জীবনে কোনো অশান্তি না হ

 

সে বুঝতে পারলো এ বাড়িতে তার দিন ফুরিয়ে এসেছে। এটাও বুঝতে পারলো সকলের সম্মতিতেই রাহাদ এই বিয়েটা করেছে কেবলমাত্র তার সম্মতি বাদে। সেদিনই নিজের সকল কাপড়চোপড় গুছিয়ে বাবার বাড়িতে চলে এলো। বাবার বাড়ি যাওয়ার পরপরই রাহাদ তাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়। শ্বশুরবাড়ি থেকে যাওয়ার আগে রাহাদ ও তার স্ত্রীকে সে এক পলক দেখে নেয়। শেষবারের মতো রাহাদকে জিজ্ঞেস করেছি

 

-“কেন করলে এমন? কী দোষ ছিল আমার

 

জবাবে রাহাদ বলেছি

 

-“তোমাকে আমার সাথে মানায় না অপরূপা

 

বাহ! অরু থেকে এখন অপরূপা! রাহাদ তাকে ভালোবেসে অরু ডাকতো। আর এখন সেই ভালোবাসা কিনা মানিয়ে নেওয়ায় ঠেকলো? এতোদিন তো খুব মানিয়েছে তাহলে এখন? তার বুকটা ফেটে যেতে লাগলো। যে ঘরটা এতোদিন নিজের মনমতো,নিজের ভালোবাসা দিয়ে সাজিয়েছে, সেই ঘরটিতে বিরাজ করবে এখন অন্য এক নারী। যে ভালোবাসা রাহাদ এতোদিন তাকে দিয়েছে সেই ভালোবাসার অধিকারী হবে এখন অন্য কেউ। অন্য এক নারীতে রাহাদ নিজের সুখ খুঁজে নিবে,নিজেকে উন্মুক্ত করে দিবে সেই নারীর মাঝে। এসব ভাবতেই অপরূপা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। তখন তার আপন বলতে ছিল কেবল দুজন মানুষ৷ তার বাবা-মা। উনারাই তখন অপরূপাকে বুকে আগলে নিয়েছিলে

 

ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে অপরূপা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এতক্ষণ রুমের দরজা লাগিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে অতীত মনে করে কেঁদেছে। মাঝে অপরূপার মা এমনকি তার বাবাও খাওয়ার জন্য ডেকেছে কিন্তু সে না করে দিয়েছে। সে এবার উঠে দাঁড়ায়। আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে ভালো করে পরখ করে। রাহাদ সেদিন বলেছিল তার সাথে মানায় না অথচ স্কুল লাইফে সে কতো প্রপোজাল পেয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। হতে পারে সে শ্যামবর্ণের কিন্তু তার মায়াবী চেহারার প্রেমে পড়তে যে কেউ বাধ্য। এখন,তার চেহারা আগের চেয়ে বেশ পাল্টে গেছে। তার গোলগাল মুখটা দিনদিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে,গায়ের রং আগের চেয়েও বেশ কালো হয়ে গেছে,চোখের নিচের কালো দাগটা আরও গাঢ় হয়েছে। এসবই ঠিকমতো না খাওয়া,না ঘুমানোর ফল। এখনও মাঝরাতে সে রাহাদের কথা মনে করে কাঁদে। সাথে পাড়া-প্রতিবেশীদের এরূপ নিষ্ঠুর কথাবার্তা তাকে আরও পীড়া দেয়। কিন্তু হঠাৎই কেন জানি সে নিজের মাঝে অদ্ভুত এক শক্তি খুঁজে পাচ্ছে। এইযে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে,তার মনে হচ্ছে এই অপরূপাটাকে পরিবর্তন করে এক নতুন অপরূপা সৃষ্টি করা দরকার। এতোদিন সবাই যে অপরূপাকে দেখেছে তার চেয়েও ভিন্নভাবে সে নিজেকে তৈরি করবে। সবার নাগালের বাইরে থাকবে সে। আর সে একজন বিশ্বাসঘাতককে মনে করে কষ্ট পাবে না। সে নিজে এবার সাবলম্বী হবে,মাথা উঁচু করে বাঁচবে,বাবা-মায়ের কষ্ট দূর করবে

 

অপরূপা এখন মনপ্রাণ দিয়ে চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করছে। এর জন্যও তাকে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে,দিনরাত গাধার মতো পরিশ্রম করতে হচ্ছে। এতেও পাড়া-প্রতিবেশীদের যেন কথার শেষ নেই। দিনরাত তারা অপরূপার সমালোচনায় ব্যস্ত। কিন্তু অপরূপার সেদিকে মন নেই। সে নিজের চেষ্টায় অবিচল। কারণ অপরূপার বাবা-মা একদিনই বলে দিয়েছে

 

-“পাছে লোকে কিছু বলবেই তার জন্য তোমাকে পিছিয়ে পড়লে হবে না! তোমাকে তোমার লক্ষ্যে অটুট থাকতে হবে

 

বাবা-মা যেন অপরূপার কাছে অনুপ্রেরণার ভাণ্ডার। তারা পদে পদে অপরূপার খুঁটি হয়ে দাঁড়াচ্ছে যেন অপরূপা ভেঙে পড়লে তাদেরকে ধরে আবার উঠে দাঁড়াতে পারে। শেষমেশ,অপরূপার এতো পরিশ্রম সফল হলো৷ সে একটা চাকরিতে সিলেক্টেড হয়েছে। সেদিন অপরূপা তার বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে বেশ অনেকক্ষণ কেঁদেছে। সে কান্না কষ্টের নয়,সে কান্না সুখের। অপরূপা চাকরিতে জয়েন করে৷ বেশ কিছুদিন চাকরি করার পর অপরূপা বুঝতে পারে এই চাকরিতে কাজ করা মানে একটা পরাধীন জীবন ভোগ করা। এখানে,অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যাবে না,ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা যাবে না,এর কোনো একটা করলেই চাকরি হারানোর ভয়টা কর্মীদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়। কিন্তু অপরূপা তো এরকম জীবন চায়নি যেই জীবনে সে অন্যায়কে অন্যায় বলতে পারবে না,ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতে পারবে না। তাই সে নিজ ইচ্ছায় চাকরিটা ছেড়ে দেয়। চাকরিতে ভালো বেতন থাকলেও তাতে তার বিশেষ কোনো আক্ষেপ থাকেনি৷ বরং নিজেকে মুক্তপাখির মতো মনে হচ্ছিল। অপরূপা বাবা-মাকে সবটা বললে তারাও মেয়ের সিদ্ধান্তে খুশি হন। এবার অপরূপা সিদ্ধান্ত নিলো সে নিজ উদ্যোগে ব্যবসা করবে। হয়ে উঠবে একজন সেরা উদ্যোক্তা। কিন্তু ব্যবসাতে ইনভেস্ট করার জন্য বেশ টাকার প্রয়োজন,যে টাকাটা বর্তমানে তার কাছে নেই। মেয়ের এমন পরিস্থিতি দেখে অপরূপার বাবা নিজের শেষ সম্বল,নিজের জমিটুকু বিক্রি করে দেন। এতে অপরূপা ব

 

-“বাবা,এটা কী করলে? তোমার তো এই জমিটুকু ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। এটাও বিক্রি করে দিলে

 

অপরূপার বাবা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে

 

-“সমস্যা নেই,মা। নিজের মেয়ের জন্যই করেছি অন্য কারো জন্য না। তুই এই টাকাটা দিয়ে ব্যবসা কর,আমার বিশ্বাস তুই সফল হবি

 

অপরূপা এই টাকা ইনভেস্ট করে একটা ছোটখাটো ব্যবসা দাঁড় করায়।  একটা কাপড়ের দোকান দেয়,সাথে নানা কসমেটিকস। শেষে,এই টাকাতেও হচ্ছিল না বিধায় অপরূপার মা উনার সমস্ত গহনা বিক্রি করে টাকা দেন। মা-বাবার দেওয়া এই টাকাগুলো যেন অপরূপার কাছে মহামূল্যবান কিছু।  প্রথম প্রথম অপরূপার ব্যবসার তেমন কোনো উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি যার দরুন অপরূপা প্রায় ভেঙে পড়েছিল কিন্তু তখন তার বাবা-মা তার খুঁটি হিসেবে কাজ করে। তাকে শক্তি জোগায়,উৎসাহ দেয়,ধৈর্য ধরতে বলে। কারণ ধৈর্যের ফল মিষ্টি হয়। হ্যাঁ,ধৈর্যের ফল মিষ্টি হয়েছে। ধীরে ধীরে অপরূপার ব্যবসার উন্নতি ঘটতে থাকে৷ কাস্টমার বাড়তে থাকে। অপরূপার ছোট্ট দোকানটি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং কয়েকবছর পর সেটি শহরের একটি বিখ্যাত মার্কেটে পরিণত হয়। এই মার্কেট এখন সবাই একনামে চেনে। এখানে সবচেয়ে উন্নতমানের পোশাক,কসমেটিকস পাওয়া যায়। অপরূপার এই মার্কেটটিতে এখন কাজ করে শত অসহায় নারী যাদের পাশে দিনশেষে দাঁড়ানোর মতো কেউ থাকে না। তারা যেন সাবলম্বী হতে পারে তাই তাদেরকেই কাজ দেওয়া হয়।  অপরূপা এখন শহরে একটা বড় বাড়িতে তার বাবা-মাকে নিয়ে থাকছে। মাকে বছরের পর বছর নতুন নতুন গয়না বানিয়ে দিচ্ছে,বাবাকে নিত্যনতুন পাঞ্জাবি,পায়জামা কিনে দিচ্ছে। তাদেরকে মাথায় করে রাখছে সে। কারণ,তার দুঃসময়ে তারা পাশে না থাকলে সে আজকের অপরূপা হয়ে উঠতে পারতো না। অপরূপা আজ মনমতো সাজলো৷ একটা আকাশী কালারের শাড়ি পড়ে চুলগুলো বেণুনি করে নিলো। চোখভর্তি কাজল দিলো,ঠোঁটে লিপস্টিক,মুখে হালকা একটু প্রসাধনী দিলো। এতেই যেন অপরূপাকে রাজ্যের সুন্দরী লাগছে। অপরূপার চোখের নিচের সেই দাগটি আর নেই,শুকিয়ে যাওয়া মুখটি আবারও ভরে এলো। দুচোখে কেবল সে এখন সুখ দেখতে পায়। সে নিজেকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করতে পেরেছে। হ্যাঁ,সে এখন সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। সে নিজের মার্কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ পিছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো

 

-"অপরূপা

 

এতো বছর পরও অপরূপা সেই চিরচেনা কণ্ঠ ভুলতে পারেনি৷ শোনামাত্রই চকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো রাহাদকে সাথে রাহাদের স্ত্রী নামিরা। রাহাদ অপরূপার দিকে এগিয়ে আসলো। আজ কেন জানি অপরূপার দিক থেকে তার চোখ সরছে না,ইচ্ছে করছ

Comments
Read more