আমি পড়া মুখস্থ করছিলাম। রুনা আপা আমার কাছ ঘেঁষে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে রইলেন, তারপর থমথমে গলায় বললেন, রিফাত আমার একটা উপকার করতে পারবি?
আমি পড়া থামিয়ে বললাম, কি করবো?
আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এই চিঠিটা রবিনকে চুপিচুপি দিয়ে আসবি, বলবি আমি পাঠিয়েছি। পারবি না?
আমি চিঠি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইলাম!
রুনা আপা দেখার মতো সুন্দরী। দুধে আলতা গায়ের রং। বেশ মেধাবী। পাড়ার বখাটে, চাঁদাবাজ রবিন প্রায়ই রুনা আপাকে ডিস্টার্ব করে । সে যখন কলেজ যায় বা কলেজ থেকে বাসায় ফিরে, রবিন তাকে নোংরা নোংরা ভাষায় কথা বলে। রুনা আপা বাসায় এসে কান্নাকাটি করে।
তাকে সাহায্য করার কেউ নাই।
রবিন এলাকার ডাকসাইটে মাস্তান।
আমি তখন ছোট। ক্লাস এইটে পড়ি। আমাদের কাছের আত্মীয়রা আমাদের খোঁজ রাখে না। এই তল্লাটে কেউ নাই, রবিনকে থামাতে পারে। আপা, মাঝে মাঝে বলতো, দেখিস, একদিন আমি রবিনকে খুন করে জেলে যাব।
সেই আপা রবিনকে চিঠি দিতে বলছে! আমার কেন যেন অবিশ্বাস্য লাগে।
আমরা দুই ভাই দুই বোন। মা মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। বড়ভাই অর্কমা। ছোটখাট যেটুকু কাজই করে, সেই টাকার বেশিরভাগ দিয়ে নেশা করে বেড়ায়। সংসারে না খাওয়া মুখগুলোর দিকে তার কোনই খেয়াল নাই।
ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি অভাবের সংসার। আমাদের জীবনে স্বাদ আহলাদ বলতে কিছুই নাই। বেঁচে থাকাই বড় আহলাদ।
মা মারা যাওয়ার পর, আমাদের জীবনে এমন দিন খুব কমই গেছে, যেদিন আমরা তিনবেলা ভালো করে মাছ মাংস দিয়ে ভাত খেতে পেরেছি।
যাও চলছিল, আমার অর্কমা নেশাখোর আমার বড়ভাই যখন বিয়ে করে বউ নিয়ে অন্যত্র সটকে পড়লো, তখন আমরা আরও অথৈ সাগরে পড়ে গেলাম। সংসারে উপার্জন কমে গেল। অসুস্থ রিকশাওয়ালা বাবার পক্ষে একা চারজনের সংসার টানা কঠিন হয়ে গেল। রুনা আপার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল। মা হীন সংসারে আমাদের ছোট দুটি ভাইবোনের অভিভাবক রুনা আপা।
বাবা প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। কাজে যেতে পারতেন না। কতদিন আমাদের না খেয়ে থাকতে হয়েছে তার হিসাব নাই। আমাদের করুন মুখের দিকে তাকিয়ে আপাকে বহুদিন চোখের পানি ফেলতে দেখিছি। ছোট একটা চাকরির জন্য হেন কোন জায়গা নাই যেখানে ধর্না দেননি। কোন লাভ হয় নাই। সবাই হয় ঘুষ চায়, না হলে আপার শরীর চায়।
যেহেতু সুন্দরি, আপার বিয়ের জন্য অনেক ভালো ভালো জায়গা থেকে সম্পর্ক আসতো। আমাদের দূরাবস্থা দেখে সবাই পালিয়ে যেতো। অনেকে এতো পরিমাণ যৌতুক চাইতো, আমার গরীব বাবার পক্ষে যা ছিল অসম্ভব!
হয়তো চলে গেলে সংসারে একজনের খাওয়া খরচ কমবে এই ধারণা নিয়ে একদিন রুনা আপা রবিনের হাত ধরে পালিয়ে গেলো। তাছাড়া বিয়ে দিতে টাকা খরচ হবে, সেটাও সে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল।
আপা চলে যাওয়ার পর আট বছরের ছোট বোনটার উপরে সংসারের দায়িত্ব এসে পড়লো। তার লেখা পড়াও বন্ধ হয়ে গেল। আমার অসুস্থ বাবা আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন।
আমাদের কোন আত্মীয় স্বজন আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখতে চাইতো না, পাছে কারও কাছে টাকা হাওলাত চেয়ে বসি। আপা, চলে যাওয়ার পর আরও যোগাযোগ কমিয়ে দিল। সবাই আপাকে খারাপ মেয়ে বলতো। আমরাও কারও বাসায় যেতাম না। বিয়ে বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে আমরা কখনোই দাওয়াত পেতাম না। অনেকেই আমাদের আত্মীয় পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করতো!
রুনা আপা পালিয়ে যাওয়ার চার বছর পর আমি টিউশনি করে নিজ খরচে এইচএসসি পাশ করলাম। টুকটাক সংসার খরচও চালাই। খুব ইচ্ছা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবো।
পড়াশোনার পাশাপাশি চারটা টিউশনি করি।
আজকে আমি বসে আছি একজনের ড্রয়িংরুমে। তারা হুলুস্থুল টাইপ বড়লোক। এই ড্রয়িংরুমের সোফার দামই বোধহয় কয়েক লাখ টাকা। টিভি বোধহয় পঁচাশি ইঞ্চি। বিশাল পর্দা। এর দাম কত হবে কে জানে!
এই বাসার একটা ছোট মেয়েকে সন্ধ্যার পর পড়াই। তারা গতমাসে ইউরোপ ট্যুর করে এসেছে। আগামীকাল যাবে নেপাল।
আজ মাসের আটাশ তারিখ। মাস পুরো হয়নি। ছাত্রীর মাকে অনুরোধ করে বলেছি, এই মাসের টাকাটা আগে দিতে। বাবা ভীষণ অসুস্থ, আজ ডাক্তারের কাছে না নিলেই নয়। ছাত্রীর মা আমাকে বসিয়ে রেখে সেই যে ভিতরে গেছেন আর খবর নাই।
আমি আধাঘণ্টা বসে থেকে বাইরে বেড়িয়ে এলাম। শহরের পিচঢালা পথ ধরে হাটতে লাগলাম বাসার দিকে। শহরের আলো আধারির খেলা আমাকে মুগ্ধ করে না। আমি বুঝে গেছি, এই শহর আমার জন্য নয়। এই শহরে জম্ম নেওয়া আমি কখনোই শহরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে পারিনি।
হাঁটতে গিয়ে এক জায়গায় টোকা লেগে পায়ের স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেলো। আগেই ছিঁড়েছিল, এতোদিন জোড়াতালি দিয়ে চলছিলাম।
পা থেকে স্যান্ডেল জোড়া খুলে দুরে ফেলে দিলাম।
দরজার সামনে ছোট বোনটা অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই দৌড়ে সামনে এসে বলল, ভাইয়া, টাকা এনেছিস? আমি কোন কথা না বলে শুধু মুখ থেকে একদলা থুতু ফেললাম।
ঘরের ভিতর থেকে বাবার গোঙ্গানির শব্দ আসছে। আসুক। এই লোকের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নাই। পৃথিবীতে লড়াই করে বাঁচতে হয়। যে লোক লড়াই করার সামর্থ্য হারিয়েছে তার বেঁচে থেকে কী লাভ?
আমি বাবার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো অনেক কথা বলতে চান, বলতে পারছেন না। বাবার অসহায় মুখটা দেখে বুকটা হু হু করে উঠলো। আমি কান্না চাপতে দরজার দিকে মুখ সরালাম।
খুট করে একটা শব্দ হল। আমি শব্দের উৎস খুঁজতে লাগলাম। দরজার সামনে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুনা আপা!
চার বছর আগের সেই সৌন্দর্য নেই। মনে হলো অনেক দিনের না খাওয়া মুখ। শরীর শুকিয়ে গেছে। মলিন কাপড় গায়ে। বুকটা ধ্বক করে উঠলো। আমি এগিয়ে গেলাম। তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম, তারপর হু হু করে কাঁদতে লাগলাম। বোন শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরেই রাখল, কোন শব্দ করল না, তার চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি বের হল না।
আমি বললাম, আপা, রবিন কই?
আপা কোন উত্তর দিল না।
কী রে, কথা বলছিস না কেন? রবিন কই?
আপা, অস্পষ্ট গলায় বললেন, নেই।
আমি চিৎকার করে বললাম, নেই মানে কী? মরে গেছে?
আপা এবারও কোন উত্তর দিল না।
আমি কান্না চেপে রেখে বললাম, তুই তাকে মেরে ফেলেছিস, ঠিক না আপা?
আপা অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তার চোখে অসহায়ত্ব, ক্ষোভ, ঘৃনা, কষ্ট। তার চোখ যেন অনেককিছুই বলতে চাইছে।
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, বাবা দেখ কে এসেছে!
রুনা আপা মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ করলো, বাবা!
শব্দ শুনে বাবা দরজার দিকে তাকালেন। একরাশ হতাশা এবং দুঃখ নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রুনা আপা কাছে এসে বাবার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, আমি এসেছি, বাবা!
বাবা কী যেন বলতে চাইলেন, পারলেন না,শুধু ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো। আমার মনে হল বাবা বলতে চাইছেন, আমাকে ক্ষমা করে দিস, মা। আমি তোর অযোগ্য বাবা। তোর মত মেয়ের বাবা হওয়ার কোন যোগ্যতাই আমার নাই। যে বাবা মেয়ের পেটে দু'বেলা খাবার দিতে পারে না, মেয়ের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারে না, সে আবার কীসের বাবা!
আমি কাছে গিয়ে তার আরেকটা হাত ধরলাম। তিনি বিস্ময় ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন,যেন বলতে চাইছেন, লালন পালন করার ক্ষমতা নাই, তোদেরকে দুনিয়ায় এনে বড় ভুল করেছি রে বাপ। পারলে ক্ষমা করিস।
তেল চিটচিটে নোংরা একটা বিছানায় শুয়ে আছেন বাবা। চোখ থেকে বেয়ে পড়ছে অশ্রু। আমি কান্না চাপতে অন্যদিকে মুখ লুকালাম। মনে মনে বললাম, হে বিধাতা! কাউকে দিয়েছো সম্পদের পাহাড়, কারও জন্য দুমুঠো খাবারের ব্যবস্থাও রাখনি। এ তোমার কেমন বিচার? এমন বিচারের রহস্য কী?
তুমি না দয়ালু!
আমি অশ্রুঝরা চোখে বাবার চোখের দিকে তাকালাম। অসহায় দূর্বল পিতার চোখ। অশ্রুকণা চিকচিক করছে।
দুই ভাইবোন শক্ত করে বাবার দুইহাত ধরে আছি। এক সময় লক্ষ্য করলাম, ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসছে আমার প্রিয় বাবার হাতটা!