বিয়ের পাঁচ বছর পর আমাদের ওয়ালিমা অনুষ্ঠান হলো। বিয়ে হয়েছিল আমি সবে ভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি। তিনি তখন অন্য জেলার অন্য ভার্সিটির থার্ড ইয়ারে মাত্র উঠলেন। কী পেয়েছি? একজন সবথেকে কাছের বন্ধু। গোটা ভার্সিটি লাইফ একটা মানসিক সাপোর্ট পেয়েছি, ভার্সিটি লাইফের হাজার হাজার ফিতনা থেকে বেঁচেছি। শুধু সুসময়ের সঙ্গী নয়, ছাত্রজীবনের কঠিন সময়ে একে অন্যের পাশে থেকে নিজেদের মধ্যে বন্ধন আরও দৃঢ় করেছি। আমার ভরনপোষণ মোটামুটি আমার ফ্যামিলিই করত যতদিন সে কিছু একটা না করছে। মাঝে মধ্যে অকেশনালি তাকে দাওয়াত করা হতো আমার বাসায়। দুই ফ্যামিলির কোন ক্ষতি হয়নি, এই বয়সে ছেলেমেয়ের রিলেশন থাকলে ঠিক যেমনটা থাকে তারই হালাল ও পবিত্র রূপ। তারপর ছাত্রজীবন শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে এইতো ওয়ালিমা হলো বছর পাঁচেক পর।
নরমালি আমাদের সমাজে এরকমটা দেখা যায় না। এই পাঁচটা বছরে অনেকে আশাই ছেড়ে দিয়েছিল, এ প্রোগ্রাম আর হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের নিয়্যাত ছিল ভিন্ন। আজ আমাদের মুসলিমদের বিয়ের মধ্যে আমরা এত এত অপসংস্কৃতি প্রবেশ করিয়েছি যে একটি সুন্নাহসম্মত বিয়ে করতে গেলে অনেক ফাইট করতে হয়, একটু রাস টেনে ধরলে সবাই অবাক বনে যায়- এভাবেও বিয়ে হয় নাকি? চাইলে এত বছর পর এত লোকসমাগম না করলেও পারতাম, কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্যই ছিল এট লিস্ট আত্নীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী বা বন্ধু বান্ধব যত জন পারি তাদের সামনে অমুসলিম কালচারবর্জিত একটা সুন্দর ইসলামিক বিয়ে উপস্থাপন করা। কারণ এই মানুষগুলোকে নরমালি ইসলামের দাওয়াত দেয়ার খুব একটা সুযোগ হয় না, তারা চারপাশে প্রতিটা বিয়েতে নাচ-গান, বেপর্দা দেখতে দেখতে ধরেই নিয়েছে, 'বিয়েতে এসবে ছাড় আছে। অত ধর্ম দেখতে গেলে বিয়ের আনন্দ থাকে না। লোকে নানা কথা তোলে।'
চেষ্টা করেছি পরিবর্তন এর, যতটা পারি। পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে ছোট করে বলি।
১. বিয়ের বরযাত্রী ছিল মাত্র ২০ জন। যদিও বর বারবার চেয়েছিল ১০ জন নিয়ে আসতে, কিন্তু আমরাই চেয়েছিলাম তাঁরা আসুক, কারণ ওই দাওয়াত দেয়ার চেষ্টা, পাশাপাশি নিজ চোখে দেখলে তবেই না তারা আমার পর্দার বিষয়টা বুঝবে, ও বাড়িতে গেলে আমার কোন সমস্যা হবে না। আমার আম্মু নিজের সাধ্যমত তাদের আপ্যায়ন করেছে, বিন্দুমাত্র জুলুম ছিল না এখানে। এমনকি, আমার বাবা নাই, আম্মু আর ছোটভাই সবকিছুর দায়িত্বে, সবমিলিয়ে লোকবলের অভাব ছিল বলে আমার শশুরবাড়ির লোক নিজেরা বরযাত্রী হয়ে সবাইকে প্লেটে তুলে খাইয়েছেন, খাজনদারি করা যাকে বলে। তাদের প্রত্যেকটা স্টেপ, কথা, চাহনি সব কিছুতে প্রতিটা মুহূর্তে তাদের এমন মানসিকতা ফুটে উঠেছে যে আমাদের পরিবারের উপর যাতে কোন প্রেসার না পরে, বরং তারা যেন আমাদের হেল্প করতে পারে। দুই পরিবার থেকেই কেউ কারো ত্রুটি বের করা তো অনেক দূরের কথা, একে অপরের পাশে থাকার এরকম অনুষ্ঠান, মানসিকতা দেখা যায় না। এত অল্প খরচে, অপচয় না করেও দুপক্ষের সবাই এত এত খুশি আর সন্তুষ্ট বলার বাইরে।
২. বললাম যে, গোটা অনুষ্ঠানের বড় উদ্দেশ্য ছিল সবাইকে বিয়েতে প্রচলিত অপসংস্কৃতি সম্পর্কে জানানো, তাই উপস্থিত সবার জন্য আমি একটি কার্ড টাইপ বানাই যেখানে ইসলামিক বিয়ে কেমন হবে এবং আমাদের সমাজে বিয়েতে প্রচলিত গুনাহগুলো কুরআন হাদীসের রেফারেন্স সহকারে লিখেছিলাম। বরযাত্রী আসার পর প্রত্যেকের হাতে একটি করে কার্ড দেই আমরা৷ এর আগে আমার আত্নীয় সবাইকেও এক কপি দেয়া হয়েছিল। সবাই তো ভালোভাবে কার্ডটা পড়েছেই আলহামদুলিল্লাহ, কেউ কেউ লেখাটা এত পছন্দ করেছে যে তা বাড়ি নিয়ে গেছে অন্যদের পড়ানোর জন্য। এতে সুন্নাতি বিয়ে সম্পর্কে মানুষের একটা সবিস্তারে ধারণা হয়েছে যা অন্য কোনভাবে হয়তো সম্ভব ছিল না।
৩. বর আগেই নিষেধ করে দিয়েছিল, কোন সোনা যেন তাকে না দেয়া হয়, মূল কথা বর নামানো, গেট ধরা, বরের হাত ধুয়ে দেয়া, এরকম কোনরকম ফালতু কালচার করা হয়নি। বরকে আম্মু একটা ঘড়ি গিফট করে, আর সে যেহেতু আতর এবং বিভিন্ন সৌখিন আতরদানি খুব পছন্দ করে, তাই তাকে একটি খঞ্জর (আতরদানি) গিফট করা হয় যা পেয়ে সে অনেক বেশি খুশি।
৪. গোটা অনুষ্ঠান উপলক্ষে ওই কয়দিন আমার পর্দার কোন সমস্যা হয়নি আলহামদুলিল্লাহ। আমার আত্নীয় স্বজনরা আগেই জানত আমি পর্দার ব্যাপারে কতটা স্ট্রিক্ট, তাই আমার রুমে উঁকি ঝুকি দেয়ার সাহস কারো ছিল না। বিয়ের দিন দরজায় লেখা ছিল নন মাহরাম প্রবেশ নিষেধ। তাই সেদিনও কোন পক্ষেরই গায়রে মাহরাম কেউ প্রবেশ করেনি। আর ওদের বাসায় যাওয়ার পর আমার শাশুড়ি আগেই সবাইকে বলে রেখেছিলেন, বউ পর্দানশীল, তাই কারো সামনে যাওয়া, মুখ খুলে পরিচয়পর্ব কিচ্ছু ফেইস করতে হয়নি আমায়। আমি পর্দাবস্থায় শশুরবাড়ির নন-মাহরাম পুরুষদের সাথে পরিচিত হয়ে এসেছি একবার। এতে কেউ একটুও অসন্তুষ্ট না আলহামদুলিল্লাহ। এমনকি বরের ১৫ বছর বয়সি কাজিনও আমার চেহারা দেখেনি।
৫. পুরো বাড়িময় বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলো পোস্টার টানিয়ে রেখেছিলাম যে গুলোতে কেউ যেন বিয়ে উপলক্ষে সলাত মিস না করে, বেপর্দা না হয়, ছেলে মেয়ে আড্ডা না দেয়, আলাদা খেতে বসে, বর বা কনের ছবি না তোলে এগুলো বারবার লেখা ছিল। সবাই তা পালন করেছে আলহামদুলিল্লাহ। সবাই এই নতুনত্ব দেখে জাস্ট অবাক ছিল। পোস্টারগুলো এবং লিফলেট/কার্ডটা নিচে এড করে দিচ্ছি। কেউ পরবর্তীতে চাইলে ব্যবহার করতে পারেন।
৬. বউ পর্দা করে বলে সাজবে না ভাবছেন? আমি সাজতে খুব পছন্দ করি। বাসায় মাহরাম এর সামনে, নারীদের অনুষ্ঠানে আমি প্রচুর সাজি। বিয়ের দিন প্রচুর সেজেছিলাম। পার্লারে যাই নি, ওখানে ফলস ল্যাশ, ওয়াটারপ্রুফ মেকাপ করিয়ে দেয় যেগুলো জায়েজ না, প্লাস অনেক অপচয়। যেহেতু আমি প্রায়ই সাজি বাসায়, তাই মোটামুটি সব রকম মেকআপ আইটেম আমাকে কিনে দিয়েছিলেন তিনি, আমার রুমে সেজে বসে থাকা অবস্থায় বরপক্ষের মহিলারা সবাই এসে দেখে যায়। কেউ বুঝতেই পারে নি আমি বাড়িতে নিজে নিজে সেজেছি। পরে বের হবার সময় শ্রাগ/কোটি টাইপের বোরখা দেয়া ছিল, যেটা বিয়ের শাড়ির উপর পরে সবার সামনে যাই। সাথে নিকাব তো ছিলই। যোহরের সলাত পরে আমি সাজতে শুরু করি, এক ওজুতে আলহামদুলিল্লাহ মাগরিব পার করতে পারি। এশার সলাত শশুরবাড়ি গিয়ে আদায় করি।
৭. এদিকে বরও এমন কোন পোশাক বিয়েতে পরেনি যা আর কোনদিন পরতে পারবে না, অপচয় হবে। শেরোয়ানি বা এরকম 'সং'টাইপ কিছুতে খরচ করিনি আমরা। সে একটা পার্টি ওয়্যার পান্জাবি পরেছিল যেটা পরবর্তীতে নানা অনুষ্ঠানে সে পরতে পারবে। আর সে আফগান গেটআপ পছন্দ করে বিধায় ব্লাক পাগড়ি বেধেছিল মাথায়, আর হাতে আম্মু যখন খঞ্জরটা দিল আর কিছুর কমতি ছিল না মা শা আল্লাহ।
৮. আম্মুর কাছ থেকে কোন উপঢৌকন নেয়া হয়নি, বালিশ, কাঁথা বা ফার্নিচার, বরপক্ষের সবার জন্য এক গাদা জামাকাপড় কিচ্ছু না।
৯. কদমবুচি করতে হয় নি আমাদের কাউকে। সবাইকে কার্ডে অলরেডি এসব কালচার সম্পর্কে জানিয়েছিলাম। এমনকি আমার কিছু অবিবাহিত কাজিন (মেয়ে) ছিল। দুলাভাই এর পারসোনালিটি দেখে তারা বুঝে যায় এ ছেলে দৃষ্টির হেফাজত করে, ইয়ারকি ফাজলামি বা হাত ধোয়ানো তো দূরের কথা, কথা বলবে কিনা আদৌ সেই ভেবে তারা বরের ধারের কাছেও ঘেঁষে নি।
১০. ছোট বাচ্চারাসহ কিছু মুরুব্বি গায়ে হলুদ এর কথা বলছিল, সুন্দর করে বুঝিয়ে বললে তারা বুঝতে পারে, কোন কোন বাচ্চা মিউজিক এর সাথে নাচতে চাচ্ছিল, তাদেরকেও বোঝানো সম্ভব হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ, তাদের সবাইকে সাথে নিয়ে গল্প করতে বসি, গানের কলি খেলি, এতেই তাদের মন ভালো হয়ে যায়।
১০. অল্প কিছু ছবি তোলা হয়৷ ক্যামেরাম্যান ছিল আমার ছোট ভাই, কাজিনের ক্যামেরা, ছবি তোলার সময় আর কেউ উপস্থিত ছিল না, আর ছবিগুলোও শুধু আমাদের কাছেই সংরক্ষিত।
সবমিলিয়ে চেষ্টা করেছি প্রথা ভাঙার যতটা পারি। সুন্নাহভিত্তিক হয়নি পুরোপুরি। অনেক ত্রুটি আছে। তবে চারদিকে অপসংস্কৃতিময় এত এত বিয়ের ভীড়ে আমাদের নিজেদের কালচার যুগোপযোগী করে সবার সামনে তুলে ধরা খুব জরুরি। আহবান থাকবে, এখান থেকে ভালো কিছু যদি থাকে তা গ্রহণ করে, খারাপ বর্জণ করে, শরীয়ত মতে আরও সুন্দরভাবে সাজিয়ে আরো বিবাহ আয়োজন করার।
Mohammad Minar 12 w
আলহামদুলিল্লাহ সুন্দর উদ্যেঘ ছিল। আপনাদের দাম্পত্য জীবন সুখী ও সুন্দর কামনা করি। আল্লাহ তায়ালা আপনাদের দাম্পত্য জীবনে বারাকা দান করুক। ইনশাআল্লাহ আমার বিয়েতেও অপসংস্কৃতি দূর করে সুস্থ সুন্দর ইসলামি সংস্কৃতির পচলন করার চেষ্টা করব। ইনশাআল্লাহ