"কত টাকা লাগবে বললে?"
"এইতো বাবা, শুরুতে পাঁচ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। এটা ওদের এড ফি। তারপর প্রতি মাসে ইনকাম হবে ৩০ হাজার করে। শুধুমাত্র এড দেখে মাসে ত্রিশ হাজার টাকা! বাড়তি সময় দিতে পারলে বাড়তি ইনকামেরও সুযোগ আছে।"
আজমল শেখ ছেলের দিকে তাকালেন। তার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে "পাঁচ হাজার লিখতে শূন্য হয় জানো?" কিন্তু জিজ্ঞেস করলেন না। কারণ তার ইন্টার পড়ুয়া ছেলে এইটা জানে বলেই তার ধারণা।
তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন,
"লোকটার সাথে তোমার পরিচয় কীভাবে?"
"ফেসবুকে, বাবা।"
একটা অচেনা অজানা লোককে তুমি পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দিবে?"
"তুমি ই তো বলো যে কোনো কিছুর জন্য ইনভেস্টমেন্ট অবশ্যই দিতে হয়। যেমন ভালো রেজাল্টের জন্য ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে খেলা, আড্ডা বাদ দিয়ে পড়তে হয়। এটাও তেমনই এক ইনভেস্টমেন্ট বলতে পারো। দেখি ই না কী হয়?"
"তুমি একটা টাকাও ওকে দেবে না।"
বলে উঠেন আনোয়ারা বেগম। ছেলের দিকে তাকিয়ে ধমকে বললেন,
"তোর এইটুকু বয়স। এই বয়সে এত টাকার চিন্তা কেন তোর? শুধু টাকা আর টাকা..."
অপমানে, লজ্জায় তন্ময়ের মুখ লাল হয়ে উঠলো তন্ময়ের। অভিমানী স্বরে বলল,
"বারবার সবকিছুর জন্য বাবার কাছ থেকে টাকা চাইতে লজ্জা করে। তাই আমি চাই নিজেই উপার্জন করতে চাই।"
আজমল শেখ মৃদু হাসলেন। এই বয়সে তার নিজেরও বাবার কাছ থেকে টাকা চাইতে কেমন যেন লজ্জাবোধ করতো। একই বিষয় নিজের ছেলের মধ্যেও দেখতে পারছেন তিনি।
"ঠিক আছে। আমি টাকা দিবো। তবে ধার হিসেবে। এই টাকা কবে নাগাদ আমাকে ফেরত দেবে বলো?"
তন্ময় কিছুটা বিস্মিত হলো। তার বাবা তাকে ধার হিসেবে টাকা দেবে! খুব সহজেই সেই বিস্মিত ভাব কেটেও গেলো। মাস শেষে তো ভালো একটা আয় হবেই তার। সেখান থেকে পাঁচ কেন প্রয়োজন হলে ডাবল করে দশ ফেরত দেবে।
বাবার দিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে বলল,
"আগামী মাসের মধ্যেই দিয়ে দিতে পারব।"
"ঠিক আছে। এটা লিখিত দাও।"
"মানে!"
"এই যে আমি তোমাকে পাঁচ হাজার দেবো, সেটার একটা প্রমাণ থাকা দরকার না? একটা কাগজে আমাকে লিখিতো দেবে যে তুমি আমার থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিচ্ছো। আর সেটা আগামী মাসের মধ্যে ফেরত দেবে। আর না দিতে পারলে তোমার ফোন আমাকে একেবারের জন্য দিয়ে দিতে হবে।"
তন্ময় কিছুক্ষণ বাবার দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো তার বাবা তার সাথে কোনো রসিকতা করছে কিনা। কিন্তু নাহ, বাবাকে বেশ সিরিয়াস বলেই মনে হলো তার। এরপর সে উঠে দাঁড়ালো। নিজের রুম থেকে একটা কাগজ কলম নিয়ে এসে লিখতে লাগলো,
"আমি তন্ময় শেখ, আজমল শেখের একমাত্র পুত্র। আমি তাহার নিকট হতে পাঁচ হাজার টাকা ধার হিসেবে লইলাম। এই টাকা আমি আগামী মাসে ৪-১২-২৪ তারিখের মধ্যে ফেরত দিবো। যদি দিতে না পারি আমার মোবাইলের মালিকানা আজীবনের জন্য তাহার হয়ে যাইবে।"
এটা লিখে নিচে নিজের নামও সাইন করলো।
আজমল শেখ কাগজ নিজের চোখের সামনে মেলে ধরলেন। পুরোটা পড়ার পর বললেন,
"লেখার মধ্যে তো সাধু আর চলিত মিলিয়ে গুরুচন্ডালী পাকিয়ে ফেলেছো। হয় সাধু ভাষায় লিখো নয়ত চলিত ভাষায়।"
এই একই লিখা তাকে আরো কয়েকবার লিখতে হলো। তন্ময় ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে। সে শুনেছিলো তরুণ বয়সে তার বাবা টিউটর ছিলেন। সেই রেশটা এখনো যায়নি হয়ত।
শেষে বিরক্ত হয়ে বলল,
"বাবা, এক কাজ করি। লেখার সাথে সাথে ছবিও তুলে রাখি।"
অত:পর আনোয়ারা বেগমকে ছবিও তুলে দিতে হলো। ছবিতে দেখা যাচ্ছে আজমল শেখ তার একমাত্র পুত্র তন্ময় শেখের হাতে কড়কড়ে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দিচ্ছেন।
ছেলে চলে যেতেই আজমল শেখকে আনোয়ারা বেগম কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
"তুমি টাকাটা কেন দিলে? তুমি বুঝতে পারছো না এটা যে একটা স্ক্যাম। পাঁচ হাজার টাকা পুরো জলে গেল।"
" ওর যেই বয়স, আমার ধারণা ও এখনো চোর, বাটপার দেখেনি। তারা কেমন হয় সেটারও একটা এক্সপিরিয়েন্স হোক। যাতে সে বুঝে হুট করে কাউকে বিশ্বাস করতে নেই।"
"তুমি তো সরাসরি তাকে বলতে পারতে যে এটা স্ক্যাম। টাকাগুলো নষ্ট করেই কেন বুঝাতে হবে?"
"কোনো কিছু প্র্যাকটিক্যালি বুঝলে সেটা আজীবন মনে থাকে।"
আনোয়ারা কঠিন স্বরে বলতে চাচ্ছিলেন,
"তুমি একটা শিক্ষিত গাধা।"
কিন্তু বলতে পারলেন না। তার আগেই পোড়া একটা গন্ধ তার নাকে এসে লাগলো। চুলায় ডাল বসিয়ে এসেছিলেন সেটা বেমালুম ভুলে গেছিলেন।
টাকাটা বিকাশে পাঠানোর পর পরই আর কোনো রেসপন্স পাচ্ছে না তন্ময়। অনেকবার কল দেয়া হলেও সেটা রিসিভড হলো না। অথচ এই সকাল অব্ধি একবার রিং হওয়ার সাথে সাথেই লোকটা কল ধরেছে।
"ভাই, আমাকে তো গ্রুপে এড করলেন না।"
এক ঘন্টা পর উত্তর আসলো,
"করব, ভাই। তার আগে আরো চার হাজার টাকা বিকাশ করেন।"
"এটা কেন লাগবে?"
তন্ময় জানতে চাইলো।
"ট্রেনিং এর জন্য।"
"অদ্ভুত! এড দেখার জন্য আবার কিসের ট্রেনিং?"
"আছে ভাই অনেক নিয়ম কানুন। সেসব শিখতে হবে।"
"আমার কাছে আর টাকা নাই।"
"জোগাড়ের ব্যবস্থা করেন।"
"আমি এই টাকা আমার মোবাইল বন্ধক রেখে জোগাড় করেছি। আরো টাকা নিতে গেলে কিডনি বন্ধক রাখা লাগবে।"
এরপর আর কোনো উত্তর আসলো না। তন্ময় মেসেজ দিয়েই যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলো তাকে ব্লক করা হয়েছে। ফোন দেয়ার পর সেটাও বন্ধ বলছে।
দুইদিন ধরে বাবার মুখোমুখি হচ্ছে না তন্ময়। পাওনাদার দের টাকা ফেরত দিতে না পারলে মানুষ যেমন পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়, তন্ময়ও তেমন বাবার থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তার শখের ফোনটা সে হাতছাড়া করতে চায় না।
আজমল শেখ বুঝতে পারলেন তার ছেলের হয়ত শিক্ষা হয়েছে। নিজেই গেলেন ছেলের রুমে।
"আসবো, তন্ময়?"
তাকে দেখে তন্ময় একটু ইতস্তত বোধ করতে লাগল। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,
হ্যাঁ, বাবা। আসো।"
"যেই গ্রুপে এড হওয়ার কথা বললে সেখানে এড হয়েছো?"
তন্ময় কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
"না বাবা। আমাকে ব্লক করে দিয়েছে। ওইটা একটা বাটপার। স্ক্যাম করেছে। পাঁচ হাজার টাকা আমি তোমাকে ফেরত দিতে পারব না। তুমি কি আমার ফোনটা আজকেই নিয়ে নেবে?"
আজমল শেখের কেমন যেন মায়া হলো। বলল,
"নাহ, ফোন নিতে আসিনি। কিছু কথা বলতে এসেছি।"
"বলো।"
"শোনো তন্ময়, টাকা আয় করা এত সহজ না। যেই কাজটা পৃথিবীর সবাই পারে এমন কাজ দিয়ে তুমি আয় করতে পারবে না। যেমন শ্বাস নিতে সবাই পারে। তুমি শ্বাস নিয়ে আয় করতে পারবে না৷ তোমাকে এমন কোনো কিছু করতে হবে যেটা কেউ কেউ পারে, কেউ কেউ পারে না।"
তন্ময় কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না। সে কী লোভী হয়ে উঠেছিল কিছু সময়ের জন্য। মাসে ত্রিশ হাজার টাকা আয়ের স্বপ্নে সে বিভোর ছিলো। সেটা এত সহজেই ভেঙে যাবে সে ভাবতে পারেনি।
আজমল শেখ বলে চললেন,
"এখন পড়াশুনায় মন দাও। পড়াশুনা শেষ করো। সাথে স্কিল ডেভেলপ করো। তারপর নাহয় দেখা যাবে।"
"ঠিক আছে, বাবা।"
"তোমার পরীক্ষা কবে?"
"১০ দিন পর।"
"ঠিক আছে। পড়তে বসো। আমি আসি।"
নিজের রুমে আসতেই আনোয়ারা বেগম প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
"তারপর ছেলেকে বুঝাতে পারলে?"
"হ্যাঁ, বুঝিয়েছি। আশা করি এসব উল্টাপাল্টা ফাঁদে পা দিবে না।"
"বাহ, বেশ। পা না দিলেই ভালো।"
একটা নোটিফিকেশনের শব্দে মোবাইলটা হাতে নিলেন আনোয়ারা। আজমল শেখ মজার ছলে বললেন,
"কে মেসেজ দিলো? তোমার কোনো পুরাতন প্রেমিক নাকি?"
আনোয়ারা ধমক দিয়ে বলল,
"ধুর। সবসময় মজা করবে নাতো। দেখো একটা আইডি থেকে একটা লিংক পাঠিয়েছে। বলছে এখানে গেলে নাকি দশ হাজার টাকা পাওয়া যাবে। একবার দেখি ই না কী হয়। কী বলো? আগে থেকেই তো আর কোনো টাকা চাইছে না।"
আমজাদ শেখ হতাশ চোখে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালেন। একবার দেখতে যেয়ে পরবর্তীতে যা হবে তা আর দেখার মত হবে না। ভাবছেন এবার স্ত্রীকে তিনি প্র্যাক্টিক্যালি বুঝাবেন নাকি মুখে বলবেন?