শুরুর কথা
অনেক অনেক দিন আগের কথা।
তখন মক্কা নগরীতে এক ধনাঢ্য মহিলা বাস করতেন। তিনি ছিলেন বিধবা। কোন সন্তান-সন্ততি ছিলো না তাঁর। কিন্তু তাঁর ছিলো অগাধ ধনদৌলত। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী। দেশ বিদেশে তাঁর ব্যবসা ছিলো। তবে ব্যবসা উপলক্ষে তিনি কখনও বিদেশ যেতেন না।
তিনি ছিলেন খুবই বুদ্ধিমতী। শুধু কি তাই? যেমন ছিলো তাঁর রূপ তেমনই ছিলো গুণ। রূপে গুণে দেশজোড়া তাঁর সুনাম। মোটকথা রূপে গুণে সারা আরবে তাঁর জুড়ি ছিলো না। এমন নামীদামী মহিলা হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিয়ে করলেন এক এতীম যুবককে। ধনদৌলত, ঘরবাড়ি কিছুই ছিলো না তাঁর। যুবকটি ছিলো এমন সর্বহারা। এমন যুবককে বিয়ে করে সেই বুদ্ধিমতী মহিলা কি ভুল করলেন! আমাদের জ্ঞানে ও দৃষ্টিতে মনে হয়, তিনি মহাভুলই করলেন। তাই নয় কি? প্রকৃত বুদ্ধিমতী মহিলারা কখনও এত বড় ভুল করেন না। তিনিও ভুল করেননি। এ রহস্য সামনে গিয়ে বলছি। তখন বোঝা যাবে তিনি কত বুদ্ধিমতী ও দূরদর্শী মহিলা ছিলেন। শুধু বিয়েই নয়, বিয়ের পর মহিলার সমস্ত ধনদৌলত তাঁর যুবক স্বামীর হাতে তুলে দিলেন।
তোমরা কি বলতে পারো এই মহিলাটির নাম? আর যুবকটিই বা কে? বলতে পারছো না। মহিলাটির নাম 'হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহা'। আর যুবকটির নাম 'হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম'।
হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহার জীবন ঘাত-প্রতিঘাতে ও সংগ্রামে ভরা। এত প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেও নিরন্তর সুখ-শান্তি তাঁর ভাগ্যে বেশি দিন জোটেনি। তবে জীবন-সংগ্রামে তিনি জয়ী। সফল জীবন তাঁর। কারণ ধন-ঐশ্বর্যের মধ্যে থেকেও হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহা তাঁর জীবনকে তিনি আল্লাহর পছন্দমত তৈরি করেছিলেন। তাই আল্লাহ্ পাক তাঁকে 'সালাম' দিয়েছিলেন। দুনিয়ায় থাকতে আল্লাহ্ পাকের সালাম পাওয়া-এ কি চাট্টিখানি কথা! তাঁর জীবন কাহিনী যেমন বেদনাদায়ক, তেমনি আকর্ষণীয় ও নারী জীবনের আদর্শ। তিনি যে সমাজে থেকে পূত-পবিত্র জীবন গড়েছিলেন, সেই সমাজের কথা স্মরণ করলে গায়ের পশম কাঁটা দিয়ে ওঠে। তাঁর জীবন কাহিনী বলার আগে সেই সমাজের অবস্থার কথা বলছি।সামাজিক অবস্থা
ইসলামের পূর্ব যুগ।
এই যুগকে বলা হয় আইয়ামে জাহেলিয়া। আইয়াম অর্থ যুগ এবং জাহেলিয়া অর্থ অন্ধকার, অজ্ঞতা, বর্বরতা বা কুসংস্কার। সুতরাং সেটা ছিলো অন্ধকার বা অজ্ঞতার যুগ।
সেই আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের কথা।
তখন আরবের লোকেরা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিলো। আল্লাহর পরিবর্তে তারা বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করতো। এজন্যে কা'বা ঘরেই তারা ৩৬০টি মূর্তি তৈরি করে রেখেছিলো। কারণ আরবি বছর হয় ৩৬০ দিনে। যাতে প্রতিদিন তারা এক একটি দেবীর পূজা করতে পারে সেইজন্যে তারা ৩৬০টি মূর্তি তৈরি করেছিলো।
আরবের লোকেরা আল্লাহকে মানতো না। সমস্ত লোক গোমরাহ হয়ে গিয়েছিলো। আল্লাহর ভয় তাদের অন্তরে ছিলো না। পরকালের ভাবনা ভাবতো না। খাও-দাও ফুর্তি কর-এই ছিল তাদের কথা।
তাদের রাজ্য ছিলো; কিন্তু রাজা ছিলো না। লোকেরা গোত্রে গোত্রে বিভক্ত হয়ে বসবাস করতো। কোন আইন-কানুন তাদের ছিলো না। বিচার-ইনসাফ ছিলো না। ন্যায়-অন্যায়ের ভেদাভেদ ছিলো না। জোর যার মুল্লুক তার-এই ছিলো তাদের নীতি। সমাজে যার যেমন খুশি তেমনভাবে সে চলতো। কাউকে পরোয়া করতো না। একদম বেপরোয়া অর্থাৎ খেলার মাঠের সেই 'যেমন খুশি তেমন সাজো'-অবস্থা। ফলে ঝগড়া- বিবাদ, মারামারি, খুনাখুনি লেগেই থাকতো।
দয়ামায়া, স্নেহ-মমতা বলতে তাদের অন্তরে কিছুই ছিলো না। তারা যেমন ছিলো কঠোর, তেমনি ছিলো বদমেজাজী। এক একটা লোক ছিলো দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। এতটুকু অন্যায় কেউ বরদাশত করতো না। সামান্য কারণেই লেগে যেতো বিষম বিবাদ। যদি একবার কোনরকমে বিবাদ লেগেছে তো হয়েছে আর বন্ধ হওয়ার নামটি পর্যন্ত নেই। বংশ পরম্পরায় যুগ যুগ ধরে চলতো সেই বিবাদ। নিজে প্রতিশোধ নিতে
না পারলে
মৃত্যু কালে ছেলেকে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে ওসীয়ত করে যেতো।হযরত খাদীজা (রা)
অত্যাচার, অবিচার, ব্যভিচার, চুরি, ডাকাতি, মদ, জুয়া নারী হরণ, নারী বর্ষণ ইত্যাদি যত রকমের দুর্নীতি ও পাপ কাজ থাকতে পারে, তাদের সমাজে তার একটিরও অভাব ছিলো না। এর মধ্যে ডাকাতি, লুটতরাজ ও নারী হরণ-এই তিনটি ছিলো সবচেয়ে প্রশংসার কাজ যে ব্যক্তি অনায়াসে এই তিনটি কাজ করতে পারতো, লোকেরা তার তারাফ করতো। লোকেরা বাহবা দিতো। এমন কি তার বুকে একটা চাপড় দিয়ে বলতো। সাবাসা। বাহাদুর বটে নারী জাতির অবস্থা ছিলো আরও শোচনীয়। আরব সমাজে নারীর কোন
সামাজিক মর্যাদা ছিলো না নারীরা ছিলো পুরুষদের মন্থাবর ও ভোগের সামগ্রী মাত্র। পুরুষরা নারীদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করতো। এতে নারীদের টু শব্দটি পর্যন্ত কবার ফ্রেৎছিলো তা স্বামা সাতবার সুশি হতবার স্ত্রীকে তামার দিতে পারতো। আবার তাকে হত্যা তুশি হয়ে বিয়েও করতে পারতো। পিতার মৃত্যুর পর ছেলে তার বিমাতা মেনে কি পাড়া ও চাটিকেও তারা বিয়ে করতে একই সঙ্গে একাধিক স্বামী গ্রহণ করতে
সবথ চার মেলামেশা করা স্বামীর
ছিলো না মুহাদিতা বা স্বামীর সম্পত্তির
চলছে। তারা পশুর মত ব্যবহার করতো।
নেচের সাথে ভারন্ত নারীকে বেঁধে ঘোড়া
ডে চিৎকার শুরু করে দিতো। তখন অশ্বারোহী
ঘোড়াকে আরও জাত উদার চালা ভাড়া করতো। ঘোড়া দ্রুতবেগে ছুটতো।
হতভাগিনীর আয়ের চামড়া ও গোশত রাস্তার বুড়ি পাথরের সাথে লেগে ছিঁড়ে ছিঁড়ে
যেতো। তামাম রাস্তা রক্তে রক্তাক্ত হতো। তার গগনফাটা চিৎকারে আল্লাহর আরশ
পর্যন্ত কেঁপে উঠতো। কিন্তু পাষণ্ড অশ্বারোহীর প্রাণ একটুও কাঁপতো না। মায়াও
জাগতো না। বরং পৈশাচিক আনন্দের অট্টহাসিতে সে মেতে উঠতো। ঘোড়াকে আরও
দ্রুত ছুটাতো। এমনিভাবে ছুটতে ছুটতে এক সময় হতভাগিনীর প্রাণবায়ু বের হয়ে১০
হযরত খাদীজা (রা)
যেতো। এই হত্যাযজ্ঞ দেখার জন্যে বহু লোক রাস্তার দু'পাশে বসে আনন্দ উপভোগ করতো। এটা ছিলো তাদের একটা খেলা।
কন্যা সন্তানের জন্মকে আরবরা লোকলজ্জা ও দুর্ভাগ্যের কারণ বলে মনে করতো। কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছে সংবাদ শুনে পিতার মুখ দুঃখে ও ক্ষোভে বিবর্ণ হয়ে যেতো। বহু পিতা দারিদ্র্যের ভয়ে কন্যাকে করতো হত্যা। অনেক সময় কন্যার হৃদয়বিদারক চিৎকার উপেক্ষা করে পিতা তাকে জীবন্ত কবর দিতো। এমনি একটা ঘটনা শুনলে বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যাবে।
মদীনা নগরীর এক মসজিদ। নাম মসজিদে নববী। তারই এক কোণে বসে এক লোক আল্লাহ্র দরবারে হাত তুলে হু হু করে কাঁদছেন। চোখের পানিতে তাঁর বুক ভেসে যাচ্ছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নিকটে এলেন। দেখলেন হযরত দাহিয়া কলবী রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু। তিনি বললেনঃ হে দাহিয়া কলবী! তুমি এত কাঁদছো কেন? ইসলাম গ্রহণ করার পর তোমার অতীতের সমস্ত পাপ আল্লাহ্ পাক মাফ করে দিয়েছেন। এর পরও এত কাঁদছো কেন?
হযরত দাহিয়া কলবী রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহু! সব পাপ মাফ করলেও একটি পাপ কি তিনি মাফ করবেন?
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন: কোন্ পাপ?
তখন হযরত দাহিয়া কলবী রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু বললেন: হুযূর ! মেহেরবানী করে তাহলে শুনুন।
যখন আমি কাফির ছিলাম, তখন আমি বহু মেয়েকে জীবন্ত কবর দিয়েছি। সবশেষে আমার আট-নয় বছরের ফুটফুটে মেয়েটিকেও জীবন্ত কবর দিয়েছি। সে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা! যেদিন আমার মেয়েটিকে কবর দিতে নিয়ে যাই-সেদিনের কথা। সে দিন সকাল বেলা। স্ত্রীকে বললাম, মেয়েটিকে ভাল করে সাজিয়ে দাও। ওকে নিয়ে বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে যাবো। স্ত্রী মেয়েকে সাজিয়ে দিলো। হাসি-খুশি মেয়ে আমার সঙ্গে রওয়ানা হলো। মরুভূমির পথ-চলছি। মেয়ে আমার হাত ধরে চলছে। পথে নানান কথা জিজ্ঞেস করছে। আমি উত্তর দিচ্ছি। সে আরও প্রশ্ন করছে। তার কথা যেন শেষ হচ্ছে না
এমিনভাবে তার কচিমুখের কথা শুনতে শুনতে পথ চলছি।হযরত খাদীজা (রা)
১১
Z42 যখন মরুভূমির বহু দূর ভিতরে চলে এসেছি, তখন তাকে পাশে দাঁড় করিয়ে লুকিয়ে আনা অস্ত্র দিয়ে গর্ত খুঁড়তে লাগলাম। সে পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। আর আমাকে প্রশ্ন করছে : আব্বু। এ গর্ত খুঁড়ে কি করবেন? আপনার বন্ধুর বাড়ি যাবেন ? চলুন যাই। আর কত দূরে সে বাড়ি? আমি তার কথার কোন জবাব দিলাম না। ভাড়াতাড়ি গর্ত খোঁড়া শেষ করলাম। গর্ত থেকে উঠে এসে তার হাত-পা যখন বাঁধলাম, কখন সে চিৎকার দিয়ে বললো: আব্বু! আমার হাত-পা বাঁধছেন কেন? আমি ব্যথা আচ্ছি। আহ্! ব্যথা পাচ্ছি।
আমি চোখ রাঙ্গা করে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে খুব জোরে ধমক দিলাম। সে ভয়ে চিৎকার দিয়ে বললো: আব্বু! আমি মরে যাব। আমার হাত-পা খুলে দিন। আব্বু। গো! আব্বু ....
আমি তাকে গর্তে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। সে বড়ো বড়ো চোখ করে ভীষণ চিৎকার দিয়ে বললো: আব্বু গো! আব্বু আমাকে মারবেন না। আমাকে ছেড়ে দিন। আমি অনেক দূরে চলে যাবো। আর কোনদিন আপনার নিকট ফিরে আসবো না। আপনার কাছ থেকে বাইরে চলে যাবো। আর কোন দিন আপনার নিকট খাবার চাইবো না। কাপড় চাইবো না। তবুও আমাকে মারবেন না। গর্ত থেকে আমাকে তোলেন। আব্বু গো! আব্বু! আমাকে বাঁচান! বাঁচান! আম্মা গো! আম্মা! আআ
আমি দ্রুত তার ওপর মাটি দিতে লাগলাম। সে মাথা নেড়ে মুখের মাটি সরিয়ে চিৎকার দিয়ে দিয়ে আমাকে ডাকে। বাঁচতে চায়। আমি আরও তাড়াতাড়ি মাটি ফেলে তাকে মাটিচাপা দিলাম। গর্ত ভর্তি হলো। তার আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। যাক আপদ গেলো। মনে মনে খুব খুশি হয়ে বাড়ি ফিরলাম।
তার বহুদিন পর আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম। আমার প্রকৃত জ্ঞান ফিরে এলো। বিবেক খুলে গেলো। মনুষ্যত্ব ফিরে পেলাম। পাষাণ অন্তর কোমল হয়ে গেলো। অতীত জীবনের সমস্ত অন্যায় ও পাপের কথা স্মরণ হলো। পরিতাপ শুরু হলো। জীবনের দিক ঘুরে গেলো।
তখন থেকে যখনই আমি নির্জনে একাকী থাকি তখনই আমার মেয়ের অন্তিম কালের সেই কথাগুলো মনে পড়ে। চোখের সামনে সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে। তখন আমারহযরত খাদীজা (রা)
Z42 2024.09.18 08:53
১২
প্রাণ ফেটে যায়। চোখ দিয়ে বাঁধভাঙ্গা ঢলের মত অশ্রু আসে। সেই মেয়ের কথা মনে হলে আমার আর জ্ঞান থাকে না। তার সেই আর্তচিৎকার আজও আমার কানে বাজে। আহা বাছা আমার! বাঁচার জন্য আমার নিকট কত কাকুতি-মিনতি করেছে। আমি তাকে বাঁচতে দিই নি। বলতে বলতে তাঁর দু'চোখ অশ্রুতে ভরে গেলো। মাথা নিচু হয়ে গেলো।
আল্লাহর নিকট এ অন্যায় কাজের কি জবাব দেবো? এ পাপও কি আল্লাহ্ পাক মাফ করে দেবেন? বলুন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন: ইসলাম গ্রহণ করার পর আল্লাহ্ পাক তোমার অতীত জীবনের সমস্ত গোনাহই মাফ করে দিয়েছেন। তিনি বড়ো ক্ষমাশীল।
হযরত দাহিয়া কলবী রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহুর এই অনুশোচনাকে আল্লাহ্ পাক খুবই পছন্দ করেছেন। হযরত জীবরাঈল আলায়হি ওয়া সাল্লাম বেশির ভাগ সময়ই হযরত দাহিয়া কলবী রাদিআল্লাহু তা'আলা আন্হুর সুরৎ ধরে আসতেন। এবার সেই গোড়ার কথায় ফিরে যাওয়া যাক।
তখন হাটে-বাজারে দাসদাসী পশুর মত ক্রয়-বিক্রয় হতো। সামান্য ভুলত্রুটির
জন্যে মনিবরা দাসদাসীদের ওপর করতো অমানুষিক ও নির্মম অত্যাচার। যতক্ষণ মনিবের মনের রাগ না পড়তো, ততক্ষণ সে দাসদাসীদের ওপর গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে চাবুক মারতো। যতক্ষণ তাদের দেহে প্রাণ থাকতো, ততক্ষণ পিঠ পেতে সহ্য করতে হতো মনিবের নিদারুণ নির্যাতন। এমন নিষ্ঠুর অত্যাচারের প্রতিবাদ কেউ করতো না। প্রতিবাদ করার কোন নিয়ম তখন ছিলো না। কোন মনিব ইচ্ছা করলে তার দাসদাসীদের মারতে মারতে খতম করে দিতে পারতো।
দাসদাসীরা ইচ্ছামত বিয়ে করতে পারতো না। তাদের মধ্যে বিয়ে বৈধ ছিলো
না। বিয়ে নিষিদ্ধ ছিল। তবে কখনও কখনও মনিবের অনুমতিক্রমে দাসদাসীর বিয়ে হতো। বিয়ের পর কোন সন্তান হলে তার মালিক হতো মনিব। ঐ দাস-সন্তানের ওপর তার মাতাপিতার কোন অধিকার থাকতো না। সমস্ত অধিকার মনিবের ছিলো। মনিবেরা দাসীকে উপপত্নী হিসেবে ব্যবহার করতো।
মনিবের অত্যাচারে জর্জরিত সেই দাসদাসীদের আকাশফাটা চিৎকার আর বুকফাটা আর্তনাদে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠতো। তবু মনিবের অন্তর একটুওহযরত খাদীজা (রা)
১৩
নরম হতো না। তাদের মনে একটুও দয়া জাগতো না। এত নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলো তারা। আসলে মানুষগুলো পশু হয়ে গিয়েছিলো। ধর্ম দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিলো। সমস্ত পৃথিবী মূর্খতার অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিলো। এজন্য সে যুগকে 'আইয়ামে জাহেলিয়া' বা অন্ধকার যুগ বলা হয়।
তবে তাদের মধ্যে কিছু কিছু ভালো গুণও ছিলো। সাহসিকতা, উদারতা, একনিষ্ঠতা, আশ্চর্যজনক স্মৃতিশক্তি, কাব্য চর্চা, বাগ্মিতা (বক্তৃতা করার ক্ষমতা বা বাকপটুতা), স্বাধীনতাপ্রীতি, গোত্র ও গোত্রপতির প্রতি আনুগত্য, সারল্য, আতিথেয়তা প্রভৃতি গুণে আরবরা বিভূষিত ছিল। আরবদের আতিথেয়তা ও বদান্যতা জগতে বিখ্যাত। তারা অতিথিকে দেবতার দূত মনে করতো এবং সেই মতই ব্যবহার করতো। তাদের ভাল গুণের চেয়ে খারাপের পরিমাণ ছিলো অনেক বেশি। তাই ভালো গুণগুলো ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো। মোটকথা পাপাচার, কুসংস্কার ও অন্যায়-অবিচারে আরব সমাজ ছেয়ে গিয়েছিলো।
এই সমাজেই বাস করতেন মহীয়সী হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহা। এখন চিন্তার বিষয় হলো, তিনি কিভাবে কত সতর্কতার সাথে ঐ সমাজে নিজের সতীত্ব রক্ষা করেছিলেন। এটা মামুলী ব্যাপার নয়। এবার তাঁর সেই জীবন কাহিনী শুরু করা যাক।বংশ পরিচয়
আরবে তখন বহু গোত্রের লোক বসবাস করতো, বিশেষ করে মক্কায় তখন বিভিন্ন গোত্রের লোক বাস করতো। তার মধ্যে কুরায়শ গোত্রটি ছিল সবচেয়ে প্রতাপশালী। এই কুরায়শ গোত্রে আবার সেরা ব্যক্তিদের' নামে ছোট ছোট বংশের উৎপত্তি হয়। এর মধ্যে হাশিমী বংশ ছিল সর্বাপেক্ষা অধিক সম্মানিত ও প্রভাবশালী। কুরায়শ গোত্রের মধ্যে হাশিমীরা প্রধান।
কারণ আল্লাহ্র ঘর 'কাবা' রক্ষণাবেক্ষণের ভার ছিল হাশিমীদের ওপর। তারাই এই কা'বা ঘর দেখাশোনা করতো। কাজেই তারা ছিল সমগ্র আরবের ধর্মীয় নেতা। অপরদিকে যুদ্ধবিদ্যায়ও তারা ছিলো খুব পারদর্শী ও সুকৌশলী। এজন্যে আরবের অন্যান্য গোত্রের লোকেরা হাশিমীদেরকে খুব ভয় করতো এবং শ্রদ্ধাও করতো।
কুরায়শ বংশের কুসাই ইবনে কিলাবের ছিল তিন পুত্র। পুত্র তিনজনের নাম হলো-আব্দুল মন্নাফ, আব্দুদ্দার ও আব্দুল উয্যা। কুসাই-এর এই তিন পুত্রের মধ্যে আব্দুল মন্নাফের বংশে জন্মগ্রহণ করেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। অপরদিকে আব্দুল উযযার বংশে জন্মগ্রহণ করেন হযরত খাদীজা তাহিরা (রা)। সুতরাং দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে তাঁরা উভয়ই একই বংশের। শুধু তাই নয়, নূর নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম হযরত খাদীজা তাহিরা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহা-এর সম্পর্কে চাচাত ভাই।
মাতাপিতা
হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহার পিতার নাম খুয়ায়লিদ। তিনি প্রতি পুরুষ ছিলেন। স্বভাব-চরিত্রে তিনি সমাজের আর দশটি মানুষের মতো ছিলেন তিনি ছিলেন উদার, মহৎ ও ভদ্র। সততা ও ন্যায়পরায়ণতায় তাঁর জুড়ি ছিল না। লিখা, শিক্ষা-দীক্ষায় ছিলেন সুপণ্ডিত। অজ্ঞতা ও অন্ধকার যুগ হলে কি হবে? এই রের অধিকাংশ নারী-পুরুষ ছিলেন সুশিক্ষিত, মার্জিত ও ভদ্র।
খুয়ায়লিদ মূর্তিপূজা পছন্দ করতেন না। তিনি মূর্তিপূজার বিরোধী ছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন ঈসায়ী ধর্মাবলম্বী। তাঁর পূর্বপুরুষও ছিলেন হযরত ঈসা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ধর্মানুসারী। হযরত ঈসা আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর ধর্ম যাঁরা গ্রহণ করেছেন, তাঁদেরকে বলা হয় ঈসায়ী।
হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহার মাতার নাম ছিল ফাতিমা। তিনি যেমন ছিলেন রূপসী তেমনি ছিলেন গুণবতী ও শিক্ষিতা। তাঁর মত এমন সতী সাধ্বী ও পতিপ্রাণা রমণী আরবে খুব কমই ছিলেন। যেমন স্বামী তেমন স্ত্রী। যেন সোনায়- সোহাগা। সতীর সঙ্গে সৎ এবং সতের সঙ্গে সতী-এভাবেই আল্লাহ্ জুড়ি মিলিয়ে থাকেন। এটাই আল্লাহর বিধান। সুতরাং সতী স্ত্রী পেতে চাইলে সৎ হতে হবে এবং সৎ স্বামী পেতে হলে সতী হতে হবে।
খুয়ায়লিদ শুধু মক্কারই নয়, সমগ্র আরবের শ্রেষ্ঠ ধনী ও ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসাই ছিল তাঁর পেশা। দেশ-বিদেশে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য ছিলো। অগাধ ধন- সম্পদের মালিক তিনি। তাঁর ধনসম্পদ দ্বারা মক্কার অসংখ্য লোক উপকৃত হতো। এজন্যে লোকেরা খুয়ায়লিদের তারীফ ও মান্য করে।
শুধু দেশ জুড়েই নয়, বিদেশেও তাঁর সুনাম। আল্লাহ্ তাঁকে ধনদৌলত মান- ইজ্জত যথেষ্ট দিয়েছেন। পরম সুখ-শান্তিতে তাঁর দিন কাটছে। কোন কিছুর অভাব নেই। কোন কিছুর আফসোসও নেই। অভাব, আফসোস আর দুঃখ শুধু একটাই-তাঁর কোন ছেলেমেয়ে নেই। খুয়ায়লিদ দম্পতির এটাই বড় দুঃখ।খাদীজা (রা)-এর জন্ম
বিয়ের পর দীর্ঘ চৌদ্দ বছর গত হলো। কিন্তু খুয়ায়লিদ দম্পতির কোন সন্তানাদি হলো না। এজন্যে তাদের মনে ভীষণ দুঃখ। সন্তানের আশায় তাঁরা অনেক চিকিৎসা নিলেন। নানান রকম তদবীর নিলেন। দেশের ডাক্তার, হেকিম কাউকেও বাদ দিলেন না। অবশেষে যিনি যা বললেন, তাঁরা তাই করলেন। কিন্তু না, কিছুতেই কিছু হলো না। তাঁরা নিরাশ হলেন। কিন্তু নিরুপায় হলেন না। এখন আর কি করা যায় ভাবতে লাগলেন।
একদিন দু'জনে ঘরে বসে তাঁদের দুঃখের বিষয়টি আলাপ করছিলেন। সন্তানাদি না হওয়ার কথা বলতেই ফাতিমা লজ্জায় মাথা নত করলেন। মুখ দিয়ে তাঁর আর কোন কথা বের হলো না। খুয়ায়লিদের হঠাৎ খেয়াল হলো: ফাতিমা! একটা পথ খোলা আছে।
ফাতিমাঃ কি পথ?
খুয়ায়লিদ: দোয়া
ফাতিমাঃ হ্যাঁ। এই কাজটিই আমাদের বাকি আছে।
খুয়ায়লিদ : ঐ যে কথায় বলে, এক দোয়া হাজার দাওয়ার চেয়েও উত্তম। কারণ আল্লাহ্ পাকের তো অসীম ক্ষমতা! তিনি যা খুশি তাই করতে পারেন, কারো মুখাপেক্ষী নন। কোন কিছুই তাঁর ক্ষমতার বাইরে নয়। আমাদের বাসনা পূরণ করা তাঁর নিকট কিছুই নয়। এটাই আমাদের শেষ চেষ্টা। কি বল?
ফাতিমা : উত্তম প্রস্তাব। তা হলে কা'বা ঘরে গিয়ে দোয়া করাই ভাল। কারণ কা'বা ঘরের দোয়া আল্লাহ্ পাক অবশ্যই কবুল করেন।
খুয়ায়লিদ : আচ্ছা তাই হবে।
খুশিতে ফাতিমার মন ভরে উঠলো। খুয়ায়লিদেরও তাই। ঠিক হলো-পরদিন সকালে দু'জনে কা'বা ঘরে আল্লাহ্র নিকট প্রার্থনা করবেন।
পরদিন সকালে দু'জনে কা'বা ঘরে গিয়ে আল্লাহ্র নিকট একান্ত মনে প্রার্থনা করলেন। চোখের পানিতে তাঁদের বুক ভেসে গেলো। প্রশান্ত মন নিয়ে তাঁরা বাড়ি ফিরলন।হযরত খাদীজা (রা)
কিছু দিন পর ফাতিমা টের পেলেন, তিনি মা হতে যাচ্ছেন। আনন্দে ফাতিমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। এ সুসংবাদ স্বামীকে জানালেন। স্বামীও শুনে খুব খুশি হলেন। তাঁর মুখ ভর্তি হাসি ফুটে উঠলো। তারপর ফাতিমা বললেন: হযরত মরিয়মের মাতাপিতা সন্তানের জন্যে বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়ে দোয়া করেছিলেন। আল্লাহ্ পাক তাঁদের দোয়া কবুল করেছিলেন। এখন আমাদের দোয়াও আল্লাহ্ পাক কবুল করলেন। খুয়ায়লিদ মৃদু হেসে বললেন: তাঁরা চেয়েছিলেন পুত্র সন্তান। কিন্তু আল্লাহ
তা'আলা তাঁদেরকে দিয়েছিলেন কন্যা। শেষে আমাদেরও কি তা-ই হয় নাকি।
ফাতিমা হেসে বললেন: যদি আমাদেরও তাই হয়, তবে আমাদের মেয়েও হবে হযরত মরিয়মের মত পুণ্যময়ী, ভাগ্যবতী ও জগৎ বিখ্যাত। এতে চিন্তার কি আছে?
খুয়ায়লিদ হাসিমুখে মাথা নেড়ে ফাতিমার কথায় সায় দিলেন। তারপর বললেন: সবই আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছা। আমাদের করার কিছুই নেই।
গর্ভের অষ্টম মাস।
একরাতে ফাতিমা স্বপ্ন দেখলেন: এক বৃদ্ধ তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর হাসিভরা উজ্জ্বল মুখ। মাথার চুল পাকা। মুখে লম্বা সাদা দাড়ি। গায়ে ইয়া বড় লম্বা ধব- ধবে সাদা জুব্বা। বৃদ্ধ হলে কি হবে দেখতে খুবই সুন্দর। বৃদ্ধ মিষ্টি হেসে ফাতিমাকে বললেন: ফাতিমা! তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি তোমাদের পূর্বপুরুষ ইবরাহীম (আলায়হি ওয়া সাল্লাম)। তুমি বড় ভাগ্যবতী মা। তোমার গর্ভে এক সন্তান আছে। সে এমন হবে যে, জগৎ জুড়ে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। তাঁকে দেখে দুঃখ করো না মা!
কথা শেষ হতে না হতেই তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ফাতিমার ঘুম ভেঙে গেল। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন: কী আশ্চর্য! হযরত ইবরাহীম আলায়হি ওয়া সাল্লাম! কেন তিনি একথা বলে গেলেন! ব্যাপার কী! এ স্বপ্ন তো মিথ্যা হতে পারে না। কারণ শয়তান নবীর সুরত ধরতে পারে না। নিশ্চয়ই এটা সঠিক স্বপ্ন।
তাঁর পাশেই স্বামী গভীর ঘুমে অচেতন। ফাতিমার ইচ্ছা হলো তখনই স্বামীকে ডেকে স্বপ্নের কথা বলবেন। কিন্তু সামান্য কারণে স্বামীর এত আরামের ঘুম ভাঙতে তাঁর মন সায় দিল না। স্বামীর আরামে ব্যাঘাত হলে পাপ হবে। তাই তিনি স্থির করলেন। সকাল বেলা বলবেমন।৫৫৫ খৃস্টাব্দের এক শুভ সকাল বেলা। ফাতিমার কোলে এলেন এক কন্যা সন্তান। শিশুটি এত সুন্দর ও সুশ্রী যে, দেখলে চোখ জুড়ায়, প্রাণ শীতল হয় আশেপাশে সাড়া পড়ে গেল। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শীরা সব ছুটে এলো দেখতে। তারা সকলেই দেখে খুশি হলো। শিশু কন্যাটির রূপের তারীফ করতে লাগলো। তারা বললো: এমন নিখুঁত সুশ্রী মেয়ে আর কখনও দেখিনি।
একটি ঘটনা দেখে তারা আরও অবাক হয়ে গেলশৈশবকাল
শিশুরা সাধারণত কোলে কিংবা বিছানায় পেশাব পায়খানা করে থাকে। কিন্তু শিশু খাদীজা ছিলেন এর বিপরীত। তিনি অন্যান্য শিশুর মত কখনও বিছানায় কিংবা কোলে পেশাব-পায়খানা করতেন না। পেশাব-পায়খানার সময় হলে শিশু খাদীজা এক প্রকার ভাব প্রকাশ করতেন অথবা ভিন্ন ধরনের কান্না শুরু করে দিতেন। তাঁর এরূপ ভাব দেখলে মা টের পেতেন যে, শিশু এখন পেশাব বা পায়খানা করবে। মা তখন তাড়াতাড়ি করে তাঁকে বিছানা থেকে নামিয়ে দিলে তিনি পেশাব বা পায়খানা করতেন।
তাঁর হাসি-কান্নাও সাধারণ শিশুর মত ছিল না। হাসি-কান্না ছিল ভিন্ন ধরনের। পানাহারের মধ্যেও তাঁর একটা বিশেষ নিয়ম ছিল। নির্দিষ্ট সময় ব্যতীত তিনি মায়ের দুধ পান করতেন না। এমন কি যখন-তখন দুধ পান করার জন্যে কখনও কান্নাকাটি করতেন না। শিশু খাদীজার এই ধরনের ব্যতিক্রম দেখে তাঁর মাতাপিতা অবাক হয়ে যেতেন। তাঁরা ভাবতেন, এ মেয়ে সাধারণ মেয়ে নয়।