বাল্যকাল
বাল্যকালে ছেলেমেয়েরা সাধারণত দৌড়াদৌড়ি, ছুটাছুটি ও খেলাধুলা প্রিয় হয়ে থাকে। কিন্তু হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহা এসব একটিও পছন্দ করতেন না। তিনি একেবারে শান্ত প্রকৃতির ছিলেন। খেলাধুলা হৈ চৈ-এর ধারে-কাছেও নেই। তাঁকে খেলতে যেতে বললেও যেতেন না। এমন কি খেলাধুলারত মেয়েদের মাঝে রেখে এলেও তিনি তৎক্ষণাৎ মায়ের নিকট ছুটে আসতেন।
এজন্য তাঁর মা অনেক সময় কৌতূহল বশত হযরত খাদীজা (রা)-কে খেলারত মেয়েদের মধ্যে রেখে আসতেন। আর অমনি হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহা ছুটে আসতেন মায়ের নিকট। তাঁর মা অন্যান্য মহিলাকে এ ঘটনা দেখিয়ে হাসতে হাসতে বলতেন: দেখলে তো আমার মেয়ের কাণ্ড! খেলাধুলা করা তো দূরের কথা, খেলাধুলার কাছেও থাকতে চায় না। আজব মেয়ে আমার! ছেলেদের ধারেকাছে তো যায়ই না, মেয়েদের মধ্যে গিয়েও থাকতে চায় না। একটু খেলাধুলা করে না। সব সময় আমার আশেপাশে ঘোরে। তবে আমাকে উত্ত্যক্ত করে না।
একথা বলতে বলতে ফাতিমা খাদীজাকে বুকে তুলে নিয়ে তাঁর কপালে চুমু দিয়ে আদর করলেন।
হযরত খাদীজা (রা) সব সময় মায়ের পাশে পাশে থাকেন। মায়ের কাজকর্ম মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করেন। মাতা-পিতার কথা খুব মনোযোগ সহকারে শোনেন। একটু দুষ্টুমি না, কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদ না, মারামারি না। একটা মিথ্যা কথাও বলেন না। কি সুন্দর শান্ত স্বভাব তাঁর। আশেপাশের মানুষ ও আত্মীয়-স্বজনরা হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহার আচার-ব্যবহার দেখে অবাক হতেন। কি আশ্চর্য মেয়ে। সারা আরবে তো এমন চোখে পড়ে না! লোকের মুখে মুখে তাঁর প্রশংসা। এ জন্যে সকলেই তাঁকে খুব আদর করে।
বাল্যকালে হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহার চরিত্রের আরও কয়েকটি বিশেষ গুণ দেখা যায়। পরের দুঃখ দেখলে হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহার মন কাতর হয়ে পড়ে। পরের দুঃখ তাঁর কাছে নিজের দুঃখ বলে মনে
হযরত খাদীজা (রা)
হয়। শুধু তাই নয় পরের উপকার করাতেই তাঁর তৃপ্তি। আরবের শ্রেষ্ঠ ধনীর আদরের দুলালী হলেন হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহা এবং মাতাপিতার একমাত্র মেয়ে। এতদসত্ত্বেও পানাহারের প্রতি তাঁর মোটেই লোভ ছিল না। তিনি অল্প খাবার খেতেন। ভাল খাবারের জন্যে তিনি কখনও মাতা-পিতার নিকট বায়না ধরতেন না।
মা তাঁকে খাবার দিলে, দু-এক লোকমা খেয়ে বাকি খাবার হাতে নিয়ে বাড়ির ফটকে যেতেন এবং গরীব-দুঃখীকে দিয়ে দিতেন। ভাল খাবার হলে তো কথাই নেই। তা আরও বেশি করে গরীব-দুঃখীদের দেয়ার চেষ্টা করতেন। মাতা-পিতা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহা বলতেন: ভাল খাবারই তো গরীব-দুঃখীদেরকে বেশি করে দিতে হয়। কারণ, ওরা তো ভাল খাবার পেলে ভীষণ খুশি হয়। ওদের সেই হাসি মুখ দেখতে আমার খুব ভাল লাগে।
হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহার কথা শুনে তাঁর মা-বাবা মুচকি হাসেন আর ভাবেন, গরীব-দুঃখীদের প্রতি খাদীজার এত দরদ! দৌলত ও বংশ মর্যাদার জন্যে তার কোন গর্ব নেই! ধনী মাতাপিতার একমাত্র মেয়ে বলেও তাঁর কোন অহংকার নেই! বরং গরীব-দুঃখীদের প্রতি তাঁর দয়া। এমন মেয়ে ক'জনের আছে! সত্যিই আমরা ভাগ্যবান।
আনন্দে তাঁদের প্রাণ ভরে যায়। মানুষের মুখে মুখে মেয়ের সুনাম শুনে গর্বে তাঁদের বুক ফুলে ওঠে। সুসন্তান বংশের গৌরব। তা মেয়ে হউক আর ছেলেই হউক। খুয়ায়লিদ ও ফাতিমা মেয়ের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে দোয়া করলেন।
শিক্ষা লাভ
পড়ালেখা শেখার জন্যে হযরত খাদীজা (রা)-কে আর দূরে যেতে হলো না। কেননা তাঁর পিতা একজন সুশিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তি। তাঁর মাতাও সুশিক্ষিতা। তাছাড়া তাঁদের বংশের প্রায় সকলেই কমবেশি পড়ালেখা জানেন। কাজেই নিজ বাড়িতেই শুরু হলো তাঁর পড়ালেখা।
শুরু থেকেই হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহা পড়ালেখার প্রতি খুব মনোযোগী হলেন। পড়ালেখা করাই তাঁর প্রিয় কাজ। সব সময় বই-পুস্তক পড়তে তাঁর খুব ভাল লাগে। তিনি খুব মেধাবী ছাত্রী। কঠিন বিষয় অতি সহজেই আয়ত্তে আনতে পারেন। ফলে অতি অল্প সময়েই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হলো।
সে সময় আরবে তওরাত ও ইন্জীল নামক দু'খানি ধর্মগ্রন্থ ছিল। যদিও সেগুলো অনেক পরিবর্তিত ও বিকৃত ছিল; তথাপি তাঁদের মধ্যে এগুলোর চর্চা ছিল অনেক। অবশ্য খুব কম লোকই এ সব গ্রন্থ চর্চা করতেন। ইহুদীরা তওরাত পড়তো আর ঈসায়ীরা পড়তো ইন্জীল।
হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহার পিতা খুয়ায়লিদ তওরাত ও ইন্জীল কিতাবে সুপণ্ডিত ছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষার পর খাদীজাকে তিনি তওরাত ও ইন্জীল কিতাব শিক্ষা দিলেন। একমাত্র মেয়ে তাই তিনি অন্তর দিয়ে হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহাকে ইনজীল শিক্ষা দিলেন। এই ইন্ন্জীল-ই ছিল তাঁর ধর্মগ্রন্থ। কারণ, তিনি তো ছিলেন ঈসায়ী। হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহা ইন্ন্জীল কিতাব পড়ে নিজেকে সেই ভাবে গড়ে তুললেন।যৌবন কাল
মেয়েদের দেহটা স্বর্ণলতার মত বাড়ন্ত। তাদের দৈহিক গঠন খুব দ্রুত বদলায়। হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহার বেলায়ও এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটল না। শৈশব-কৈশোর পার হয়ে ধীরে ধীরে হযরত খাদীজা (রা) যৌবনে পদার্পণ করলেন। আস্তে আস্তে তাঁর শরীরের গঠন ও রূপসৌন্দর্য পরিপূর্ণ হতে লাগলো। তাঁর দেহের গঠন ছিলো সুন্দর ও নিখুঁত। আর গায়ের রং ছিলো লাল গোলাপের মতো।
ছেলেদের সাথে মিশতে হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহা একটুও পছন্দ করতেন না। এমন কি মেয়েদের সঙ্গেও তিনি বেশি মিশতেন না। সমস্ত খারাপ ও পাপ কাজ থেকে দূরে থাকতেন। মোটকথা তিনি পূত-পবিত্র জীবন-যাপন করতেন। তাঁর চরিত্র ছিলো নিষ্কলংক। জীবন ছিলো ফুলের মত পবিত্র ও সুন্দর। এজন্যে লোকে তাকে 'তাহিরা' বলে ডাকতো। তাহিরা অর্থ পবিত্রা।
তাঁর যেমন ছিলো রূপ তেমনই ছিলো গুণ। জ্ঞান ও বুদ্ধিও ছিলো তাঁর অসাধারণ। ফলে ক্রমে তাঁর সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। যেমন বসন্তের সকালে মৃদুমন্দ বাতাসে ফুটন্ত গোলাপের সৌরভ ছড়ায়, তেমনিভাবে হযরত খাদীজা (রা)-এর সুনাম চারদিক ছড়াতে লাগলো।
পনের-ষোল বছর বয়সে মেয়েদের পরিপূর্ণ যৌবন আসে। এই যৌবন বয়সটাই হলো তাদের উত্তম বয়স। তাদের পরিপূর্ণ রূপ-সৌন্দর্য ফুটে ওঠে এই যৌবনে। শরীরে ও প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নেমে আসে সৌন্দর্যের ঢল। তখন দেখতে খুবই সুশ্রী লাগে।
মহানবী (সা)-এর জন্ম
৫৭০ খৃস্টাব্দ। সম্ভবত ২০শে এপ্রিল। রবিউল আউয়াল মাসের বার তারিখ। রাতের আঁধারে ডুবে আছে পৃথিবী। মক্কা নগরীর সমস্ত জনপ্রাণী তখন ঘুমে অচেতন। কিন্তু ঘুম নেই কুরায়শ গোত্রের এক বধূর। তিনি কাতরাচ্ছেন প্রসব বেদনায়। নাম তাঁর হযরত আমিনা। সুবেহ সাদেকের সময়-তাঁর কোল আলো করে জন্ম নিলেন এক পুত্র সন্তান। মুহূর্তের মধ্যে হযরত আমিনা সমস্ত দুঃখ-ব্যথা-বেদনা ভুলে গেলেন। পুত্রলাভের আনন্দে তাঁর মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
শিশুর দেহে এত রূপ যে, দর্শকের মন কেড়ে নেয়, চোখ জুড়ায়। দেহে তাঁর এক অপরূপ সৌন্দর্য। শরীর থেকে যেন সর্বদা নূরের জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। এমন শিশু আরবে আর কখনও জন্মগ্রহণ করেননি। সমস্ত মক্কা নগরীতে সাড়া পড়ে গেল। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই দেখতে এলো। দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। এতো সুন্দর মানুষের সন্তান হতে পারে! এ যেন তাদের কল্পনার অতীত।
শিশুটির পিতা নেই। তিনি পূর্বেই ইন্তিকাল করেছেন। তাঁর নাম আবদুল্লাহ্। দাদা আছেন-নাম আবদুল মুত্তালিব। তিনি তখন কা'বা ঘরে ছিলেন। খবর শুনে ছুটে এলেন নবাগত পৌত্রকে দেখার জন্যে। পৌত্রকে দেখে তিনি ভীষণ খুশি হলেন। তাঁর মনে আনন্দ আর ধরে না। তিনি আরবের অশ্রুতপূর্ব নাম রাখলেন, 'মুহাম্মদ'। লোকেরা বলাবলি করতে লাগল এমন নাম তো ইতিপূর্বে আমরা কখনও শুনিনি। তিনি কোন দেব-দেবীর নামের সাথে মিলিয়ে পৌত্রের নাম রাখলেন না। কি আশ্চর্য।
মা হযরত আমিনা তাঁর স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী পুত্রের নাম রাখলেন 'আহমদ'। উভয় নামেই তিনি বিশ্বে পরিচিত। জন্মের পর কয়েকদিন আবু লাহাবের দাসী 'সুওয়ায়বা' শিশু মুহাম্মদকে তাঁর নিজের দুধ পান করালেন।
কয়েকদিন পর শিশু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে দেখার জন্যে হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহা এলেন। পরম স্নেহভরে তাঁকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর বললেন: আহা! আজ যদি চাচাজান বেঁচে থাকতেন, তাহলে কতই
হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহার বয়স সবেমাত্র পনরতে পা দিল। বাল্যকাল থেকেই হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহার গঠন আকৃতি ছিলো নিখুঁত সুন্দর। যৌবন এসে তাঁকে আরও চাঙ্গা করে তুললো। অর্থাৎ তাঁকে পরম সুন্দরী করে দিল। তিনি এখন আরবের পরমা সুন্দরী।
হযরত খাদীজা (রা)
না খুশি হতেন। একথা শুনে মা আমিনার চোখ দুটো অশ্রুতে ছল ছল করে উঠলো। জেগে উঠলো তাঁর মনে অতীত জীবনের অনেক ব্যথাভরা স্মৃতি। কিন্তু সেসব অতি কষ্টে চাপা দিয়ে হাসিমুখে হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহার সাথে কথা বললেন। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করার পর হযরত খাদীজা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহা বিদায় নিয়ে নিজ গৃহে চলে এলেন।
জন্মের সপ্তম দিবস। অভিজাত বংশের প্রথা অনুযায়ী তাঁকে লালন-পালনের জন্যে হালিমা নাম্নী এক ধাত্রীকে দেয়া হলো। তিনি হালিমার ঘরে লালিত-পালিত হতে লাগলেন। শিশু মুহাম্মদকে নেয়ার পর হালিমার সংসারে বরকত দেখা দিলো। হালিমার অভাব দূর হতে লাগলো।
মহানবী (সা)-এর জন্মের বছরই মক্কায় এক আজব ঘটনা ঘটে গেল। ঘটনাটি বড় আশ্চর্য।
আরবের দক্ষিণে ইয়ামেন। সেই ইয়ামেনের এক বাদশাহ ছিলো। নাম আবরাহা। সে ছিলো খৃস্টান। সে দেখলো প্রতি বছর হজ্জের সময় বহু লোক হজ্জ করার জন্যে মক্কায় যায় এবং কা'বা ঘর যিয়ারত তওয়াফ করে বহু টাকা-পয়সা নজরানা দেয়। এগুলোর প্রতি আবরাহার লোভ হলো। সে ভাবলো, মক্কার কা'বা ঘরের চেয়ে উত্তম ঘর তৈরি করে সকলকে এখানে হজ্জ করার জন্যে আদেশ দিতে হবে। তাতে সুনামও থাকবে, নজরানাও পাওয়া যাবে।
যেই কথা সেই কাজ। সোনা, রূপা, হীরা-জহরৎ, মণি-মুক্তা দ্বারা কারুকার্য খচিত এক বিশাল সুরম্য গির্জা সে তৈরি করলো। গির্জাটি এত উঁচু ছিল যে, কেউ এর নিচে দাঁড়িয়ে উচ্চতা পরিমাপ করতে পারতো না। আবরাহার মন খুশিতে নেচে উঠলো। সে দেশময় ঘোষণা করে দিলো: এখন থেকে কোন লোক মক্কায় হজ্জ করতে যেতে পারবে না। কা'বার পরিবর্তে সকলে এই গির্জা তওয়াফ ও হজ্জ করবে। মক্কার আদনান, কাহতান ও কুরায়শ গোত্রের লোকেরা এ ঘোষণা শুনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হলো।
হজ্জ মৌসুম পার হয়ে গেল। কিন্তু কেউই এখানে হজ্জ করতে এলো না। সকলেই মক্কায় গিয়ে হজ্জ করে এলো। অপরদিকে কে যেন রাতের আঁধারে গির্জার মধ্যে পেশাব-পায়খানা করে গেছে। একে তো কোন লোক বাদশাহর ঘোষণা মত হজ্জ।