রমণীর দেহ লইয়া যাহার বীভৎস-লীলা এই বিশ বর্ষ ব্যাপিয়া অবাধে বহিয়াছে—কত শোভা, কত লজ্জা, কত মাধুর্যই যে এই ব্যভিচারের ঘূর্ণাবর্তের অতলে তলাইয়াছে, তাহার দাগটুকু পর্যন্ত পাষণ্ডের মনে নাই; লালসার সেই অগ্নিজিহ্বা আজ যখন অকস্মাৎ বাধা পাইল, তখন কিছুক্ষণের জন্য এই অপরিচিত বিস্ময়ে তাহার মদোন্মত্ত বিকৃত দৃষ্টি স্তব্ধ, গম্ভীর এবং আবিষ্ট হইয়া রহিল।
ভৈরবীকে মাথায় কাপড় দিতে নাই, সে অধোমুখে চোখ বুজিয়া হতজ্ঞানের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিল, কিন্তু জীবানন্দ নীরবে ফিরিয়া গিয়া আলোটা রাখিয়া দিল, এবং মদের বোতল হইতে কয়েক পাত্র উপর্যুপরি পান করিতে লাগিল।
মিনিট-পনর এইভাবে নিঃশব্দে কাটিয়া গেল, হঠাৎ এক সময়ে সে সোজা হইয়া উঠিয়া বসিল। মনে হইল এতক্ষণে সে তাহার মূর্ছিতপ্রায় পশুপ্রকৃতিটাকে চাবুক মারিয়া মারিয়া উত্তেজিত করিয়া তুলিয়াছে। প্রশ্ন করিল, তোমার নাম ষোড়শী, না?
এ পক্ষ হইতে কোন সাড়া আসিল না।
জীবানন্দ পুনশ্চ জিজ্ঞাসা করিল, তোমার বয়স কত?
কিন্তু তথাপি কোন উত্তর না পাইয়া তাহার কণ্ঠস্বর কঠিন হইল, কহিল, চুপ করে থেকে কোন লাভ হবে না। জবাব দাও।ষোড়শী অনেক কষ্টে মৃদুস্বরে কহিল, আমার বয়স আটাশ।জীবানন্দ বলিল, বেশ। তাহলে খবর যদি সত্য হয় ত এই উনিশ-কুড়ি বৎসর ধরে তুমি ভৈরবীগিরি করচ; খুব সম্ভব অনেক টাকা জমিয়েচ। দিতে পারবে না কেন?
ষোড়শী তেমনি আস্তে আস্তে উত্তর দিল, আপনাকে ত আগেই জানিয়েছি আমার টাকা নেই।
এই সশঙ্ক মৃদু কণ্ঠস্বরের মধ্যেও যে সত্যের দৃঢ়তা ছিল তাহা জমিদারের কানে বাজিল। সে এ লইয়া আর তর্ক করিল না; কহিল, বেশ, তা হলে আরও দশজনে যা করচে তাই কর। যাদের টাকা আছে তাদের কাছে জমি বাঁধা দিয়ে হোক, বিক্রি করে হোক দাও গে।ষোড়শী কহিল, তারা পারে, জমি তাদের। কিন্তু দেবতার সম্পত্তি বাঁধা দেবার, বিক্রি করবার ত আমার অধিকার নেই।
জীবানন্দ একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ হাসিয়া বলিল, নেবার অধিকার কি ছাই আমারই আছে? এক কপর্দকও না। তবুও নিচ্চি, কেননা আমার চাই। এই চাইটাই হচ্ছে সংসারের খাঁটি অধিকার! তোমার যখন দেওয়া চাই-ই তখন—বুঝলে?ষোড়শী নিঃশব্দে স্থির হইয়া রহিল, জীবানন্দ কহিতে লাগিল, ভাবে মনে হয় তুমি লেখাপড়া কিছু জানো; তা যদি হয় ত জমিদারের প্রাপ্যটা নিয়ে আর হাঙ্গামা করো না—দিয়ো।ষোড়শী এবার সাহস করিয়া মুখ তুলিয়া কহিল, ওটা কি আপনি জমিদারের প্রাপ্য বলতে চান?
জীবানন্দ কহিল, প্রাপ্য বলতে চাইনে; ওটা তোমাদের দেয় এই বলতে চাই। তোমার মনে হতে পারে বটে, অন্য জমিদারকে ত দিতে হয়নি। তার কারণ, তাঁরা আমার মত সরল ছিলেন না। স্পষ্ট করে দাবী করেন নি, কিন্তু প্রায় সমস্ত গ্রামখানাই ধীরে ধীরে বেদখল করে নিয়েছেন। তাঁরা একরকম বুঝেছিলেন, আমি একরকম বুঝি। যাক, এত রাত্র কি একা বাড়ি যেতে পারবে? যাদের সঙ্গে তুমি এসেছিলে তাদের আর সঙ্গে দিতে চাইনে।এতক্ষণ ও এতগুলা কথাবার্তায় ষোড়শীর ভয়টা কতকটা অভ্যাস হইয়া আসিতেছিল, সে সবিনয়ে কহিল, আপনার হুকুম হলেই যেতে পারি।জীবানন্দ সবিস্ময়ে কহিল, একলা? এই অন্ধকার রাত্রে? ভারী কষ্ট হবে যে! বলিয়া সে হাসিতে লাগিল।তাহার কথা ও হাসির ইঙ্গিত এতই স্পষ্ট যে, যে আশঙ্কা ষোড়শীর কমিতেছিল, তাহাই একবারে চতুর্গুণ হইয়া ফিরিয়া আসিল। সে মাথা নাড়িয়া ক্ষীণকণ্ঠে উত্তর দিল, না, আমাকে এখুনি যেতেই হবে। বলিয়া পা বাড়াইবার উদ্যোগ করিতেই জীবানন্দ তেমনি সহাস্যে কহিল, বেশ ত টাকা না হয় নাই দেবে ষোড়শী। তা ছাড়া আরও অনেক রকমের সুবিধে—
কিন্তু প্রস্তাব শেষ হইতে পাইল না। ইহার মুখে নিজের নাম শুনিয়াই ষোড়শী অকস্মাৎ প্রবল বেগে মাথা নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, আপনার টাকা, আপনার সুবিধা আপনার থাক্, আমাকে যেতে দিন। বলিয়াই সে যথার্থই এবার এক পা অগ্রসর হইয়া গেল। কিন্তু যে লোকগুলাকে এই লোকটাও তাহার সঙ্গে দিতে সাহস করে না তাহাদিগকেই সম্মুখে কিছু দূরে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া সে আপনিই থমকিয়া দাঁড়াইল।
তাহার বাক্য ও কার্যের কোন প্রতিবাদ জমিদার করিল না, কিন্তু তাহার মুখ অন্ধকার হইয়া উঠিল।
একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, তুমি মদ খাও?
ষোড়শী কহিল, না।জীবানন্দ জিজ্ঞাসা করিল, তোমার জন-দুই অন্তরঙ্গ পুরুষ বন্ধু আছে শুনেছি। সত্যি?
ষোড়শী তেমনি মাথা নাড়িয়া বলিল, মিছে কথা।
জীবানন্দ আবার ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া প্রশ্ন করিল, তোমার পূর্বেকার সকল ভৈরবীই মদ খেতেন—সত্যি?
ষোড়শী কহিল, সত্যি।
জীবানন্দ কহিল, মাতঙ্গী ভৈরবীর চরিত্র ভাল ছিল না—এখনো তার সাক্ষী আছে। সত্যি না মিছে?
ষোড়শী লজ্জিত মৃদুকণ্ঠে কহিল, সত্যি বলেই শুনেছি।
জীবানন্দ কহিল, শুনেছ? ভাল। তবে হঠাৎ তুমি বা এমন দলছাড়া গোত্রছাড়া ভাল হতে গেলে কেন?
প্রত্যুত্তরে ষোড়শী এই কথা বলিতে গেল যে ভাল হইবার অধিকার সকলেরই আছে; কিন্তু সহসা একটা পুরুষ কণ্ঠস্বর তাহাকে মাঝখানেই থামাইয়া দিল। জমিদার জীবানন্দ সোজা হইয়া উঠিয়া বসিয়া কহিল, মেয়েমানুষের সঙ্গে তর্কও আমি করিনে, তাদের মতামতও কখনও জানতে চাইনে। তুমি ভাল কি মন্দ, চুল চিরে তার বিচার করবারও আমার সময় নেই। আমি বলি চণ্ডীগড়ের সাবেক ভৈরবীদের যেভাবে কেটেছে, তোমারও তেমনিভাবে কেটে গেলেই যথেষ্ট। আজ তুমি এই বাড়িতেই থাকবে।
হুকুম শুনিয়া ষোড়শী বজ্রাহতের ন্যায় একেবারে কাঠ হইয়া গেল। জীবানন্দ কহিতে লাগিল, তোমার সম্বন্ধে কি করে এতটা সহ্য করেচি জানিনে, আর কেউ এ বেয়াদপি করলে এতক্ষণ তাকে পাইকদের ঘরে পাঠিয়ে দিতুম। এমন অনেককে দিয়েচি।
ইহা ভিত্তিহীন শূন্য আস্ফালন নহে, তাহা শুনিলেই বুঝা যায়। ষোড়শী অকস্মাৎ কাঁদিয়া ফেলিল, গলায় আঁচল দিয়া দুই হাত জোড় করিয়া অশ্রুরুদ্ধস্বরে কেবল কহিল, আমার যা-কিছু আছে সব নিয়ে আজ আমাকে ছেড়ে দিন।
জীবানন্দ মুহূর্তকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, কেন বল ত? এ-রকম কান্নাও নতুন নয়, এ-রকম ভিক্ষেও এই নতুন শুনচি নে। কিন্তু তাদের সব স্বামী-পুত্র ছিল—কতকটা নাহয় বুঝতেও পারি।
তাহাদের স্বামী-পুত্র ছিল। শুনিয়া ষোড়শী শিহরিয়া উঠিল।
জীবানন্দ কহিতে লাগিল, কিন্তু তোমার ত সে বালাই নেই! পনর-ষোল বছরের মধ্যে তোমার স্বামীকে ত তুমি চোখেও দেখনি। তাছাড়া তোমাদের ত এতে দোষই নেই।
ষোড়শী যুক্তহস্তেই দাঁড়াইয়া ছিল, অশ্রুরুদ্ধস্বরে বলিল, স্বামীকে আমার ভাল মনে নেই সত্যি, কিন্তু তিনি ত আছেন! যথার্থ বলচি আপনাকে, কখনো কোন অন্যায়ই আমি আজ পর্যন্ত করিনি। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন।
জীবানন্দ হাঁক দিয়া ডাকিল, মহাবীর—
ষোড়শী আতঙ্কে কাঁপিয়া উঠিয়া বলিল, আমাকে আপনি মেরে ফেলতে পারবেন, কিন্তু—
জীবানন্দ কহিল, আচ্ছা, ও বাহাদুরি কর গে ওদের ঘরে গিয়ে, মহাবীর—
ষোড়শী মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়া কাঁদিয়া বলিল, কারও সাধ্য নেই আমাকে প্রাণ থাকতে নিয়ে যেতে পারে। আমার যা-কিছু দুর্দশা, যত অত্যাচার আপনার সামনেই হোক। আপনি আজও ব্রাহ্মণ, আপনি আজও ভদ্রলোক।
কিন্তু এতবড় অভিযোগেও জীবানন্দ হাসিল; সে হাসি যেমন কঠিন তেমনি নিষ্ঠুর। কহিল, তোমার কথাগুলো শুনতে মন্দ নয়, কিন্তু কান্না দেখে আমার দয়া হয় না। ও আমি অনেক শুনি। মেয়েমানুষের ওপর আমার এতটুকুও লোভ নেই—ভাল না লাগলেই চাকরদের দিয়ে দিই। তোমাকেও দিয়ে দিতুম, শুধু এই বোধ হয় আজ প্রথম একটু মোহ জন্মেছে। ঠিক জানিনে—নেশা না কাটলে ঠাওর পাচ্চিনে।
মহাবীর দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হইয়া সাড়া দিল, হুজুর!
জীবানন্দ সম্মুখের কবাটটায় অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল, একে আজ রাত্রের মত ও-ঘরে বন্ধ করে রেখে দে। কাল আবার দেখা যাবে।
ষোড়শী গলদশ্রুনয়নে কহিল, আমার সর্বনাশটা একবার ভেবে দেখুন হুজুর! কাল যে আমি আর মুখ দেখাতে পারবো না।
জীবানন্দ কহিল, দু-এক দিন। তারপর পারবে। সেই লিভারের ব্যথাটা আজ ভারী বেড়েচে—আর বেশী বিরক্ত করো না—যাও।
মহাবীর তাড়া দিয়া বলিল, আরে ওঠ্ না মাগী—চোল্।
কিন্তু তাহার কথা শেষ না হইতেই অকস্মাৎ উভয়েই চমকিয়া উঠিল। জীবানন্দ ভয়ানক ধমক দিয়া কহিল, খবরদার শুয়োরের বাচ্চা, ভাল করে কথা বল্। ফের যদি কখনো আমার হুকুম ছাড়া কোনো মেয়েমানুষকে ধরে আনিস ত গুলি করে মেরে ফেলব। বলিতে বলিতেই মাথার বালিশটা তাড়াতাড়ি পেটের নীচে টানিয়া লইয়া উপুড় হইয়া শুইয়া পড়িল, এবং যাতনায় একটা অস্ফুট আর্তনাদ করিয়া কহিল, আজকের মত ও-ঘরে বন্ধ থাকো, কাল তোমার সতীপনার বোঝাপড়া হবে। এই—যা না আমার সুমুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে।
মহাবীর আস্তে আস্তে বলিল, চলিয়ে।ষোড়শী নিরুত্তরে উঠিয়া দাঁড়াইয়া নির্দেশমত পাশের অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করিতে যাইতেছিল, হঠাৎ তাহার নাম ধরিয়া ডাকিয়া জীবানন্দ কহিল, একটু দাঁড়াও—তুমি পড়তে জানো, না?
ষোড়শী মৃদুকণ্ঠে বলিল, জানি।
জীবানন্দ কহিল, তা হলে একটু কাজ করে যাও। ওই যে বাক্সটা—ওর মধ্যে আর একটা ছোট কাগজের বাক্স পাবে। কয়েকটা ছোট-বড় শিশি আছে, যার গায়ে বাংলায় ‘মরফিয়া’ লেখা, তার থেকে একটুখানি ঘুমের ওষুধ দিয়ে যাও। কিন্তু খুব সাবধান, এ ভয়ানক বিষ। মহাবীর, আলোটা ধর্।
বাতির আলোকে ষোড়শী কম্পিতহস্তে বাক্স খুলিয়া শিশি বাহির করিল, এবং সভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, কতটুকু দিতে হবে?
জীবানন্দ তীব্র বেদনায় আবার একটা অব্যক্ত ধ্বনি করিয়া কহিল, ঐ ত বললুম খুব একটুখানি। আমি উঠতেও পারচি নে, আমার হাতেরও ঠিক নেই, চোখেরও ঠিক নেই। ওতেই একটা কাঁচের ঝিনুক আছে, তার অর্ধেকেরও কম। একটু বেশি হয়ে গেলে এ ঘুম তোমার চণ্ডীর বাবা এসেও ভাঙ্গাতে পারবে না।
ষোড়শী সন্ধান করিয়া ঝিনুক বাহির করিল, কিন্তু পরিমাণ স্থির করিতে তাহার হাত কাঁপিতে লাগিল। তার পরে অনেক যত্নে অনেক সাবধানে যখন সে নির্দেশমত ঔষধ লইয়া কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, তখন নির্বিচারে সেই বিষ হাত বাড়াইয়া লইয়া জীবানন্দ মুখে ফেলিয়া দিল। প্রশ্ন করিল না, পরীক্ষা করিল না, একবার চোখ মেলিয়া দেখিল না।