(#সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে)
সন্তান হয় নি বলে বিয়ের তিন বছরের মাথায় আমার ডিভোর্স হয়ে গেল। সবাই জানলো, আমি কখনো মা হতে পারব না। কিন্তু, আমি তো জানি, আমার স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত। বিয়ের দুই বছর পর্যন্তও সব ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু, হঠাৎ আমার স্বামীর মধ্যে বেশ পরিবর্তন দেখতে পাই। অহেতুক ঝগড়া বাঁধানো, সবকিছুতে বিরক্তি প্রকাশ। আমি যেন হয়ে উঠলাম তার চোখের বিষ। যে মানুষটি আমাকে ছাড়া থাকতেই পারত না, সে এখন আমার একটি কথাও সহ্য করতে পারে না।
তার অবহেলা, অযত্ন, মানসিক আঘাত সহ্য করতে করতে ক্রমশ আমি যেন অস্থির হয়ে উঠলাম। আমি বুঝতেই পারছিলাম না, আমার ভুলটা কী!
তাকে যত জিজ্ঞেস করি, তত বিশ্রি গলায় চিৎকার করে৷ একটা সময় পর গায়ে হাত তোলাও শুরু করল। মনের দিক থেকে একটুও শান্তি পাচ্ছিলাম না। অবশেষে কয়েকমাস পর জানতে পারি তার প্রাক্তন ফিরে এসেছে। জগতের সবকিছু আমার কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।
আমি আমার স্বামী এবং তার প্রাক্তনের একসাথে তুলা ছবিগুলো যখন দেখলাম, তখন নিজেকে কেমন অসার লাগছিল। জীবনে কোনোদিন কখনো কোনো ছেলের সংস্পর্শে না আসা আমার কপালে এমন একজন জুঠল!
আমার জন্য ছিল এটি পাহাড় সমান বোঝা। ভাগ্যের প্রতি দোষারোপ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি। এ কেমন পরীক্ষা!
আমার বাবা-মা দু'জনেই দেখতে খুব ফর্সা। তাই আমিও তাদের সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলাম। ছোটবেলা থেকে সবাই বলত,
" তোর কপাল অনেক বড় হবে রে! যে মেয়ে যত সুন্দর, তার ততই রাজকপাল হয়। "
বান্ধবীমহলেও আমার ডাকনাম ছিল "রূপসী"। আমাকে দেখে সবাই আফসোস করত। কিন্তু, আমার নিজের কাছে কখনো এটা বড় বলে মনে হয় নি। পাড়া-পড়শীর ঈর্ষার পাত্রী ছিলাম। কতো আত্মীয়-স্বজন আফসোস করত আমায় এক পলক দেখে।
আজ আমি নিজেই আফসোস করছি নিজের জন্য।
মানুষটাকে ধরে রাখতে পারি নি। আমার কান্না তার হৃদয় স্পর্শ করে নি। আমার ব্যাকুলতা, ভালোবাসা তাকে আটকাতে পারে নি৷ আমার যন্ত্রণা তাকে বিগলিত করে নি।
ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে চাই নি। তখনও চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। অসহায়ের মতো ছটফট করেছিলাম। মা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন,
" ছেড়ে দে! মুক্তি দে! সৌন্দর্য থাকলেই কেবল সুখ এসে ধরা দেয় না। "
ওরা আমার থেকে জোর করে সিগনেচার নিয়ে নিলো।
এরপরের জীবন আরো বিভৎস হয়ে উঠল। প্রথম মানুষ, প্রথম ভালোবাসা, প্রথম স্পর্শ এগুলো ভুলে যাওয়া অসহনীয় যন্ত্রণাদায়ক। আমি সবখানে তাকে অনুভব করতে লাগলাম। একটু স্বস্তির ঘুম হয় নি কতদিন! ঘুমালে তার চেহারা ভেসে উঠত। তার সাথে কাটানো মূহুর্তগুলো বড্ড কষ্ট দিত। মানুষটা এখন আমার জন্য পরপুরুষ। কিন্তু, তবুও যে ভুলতেই পারলাম না!
নিজেকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম। নিজেকে হীন-জঘণ্য মনে হতো। আমি যেন সবখানে তার উপস্থিতি টের পাই। আয়নার সামনে দাঁড়ালে মনে হতো আমার দেহে কলুষতা লেপ্টে আছে। একদিন রাগে-দুঃখে, ঘৃণায় আয়নাটা ভেঙ্গে দিলাম। ভাঙ্গা কাচের টুকরোতে হাত দিয়ে তা বুলাতে লাগলাম সর্বাঙ্গে৷ আমি কীভাবে ভুলব?
সেবার হসপিটালে নেওয়ার পর বেঁচে গেলাম। এরপর একদিন গায়ে কেরোসিন ঢেলেও নিজেকে শেষ করতে চেয়েছি। তখনও বেঁচে গেছি।
আমি নিজেকে সহ্য করতে পারি না। মেনে নিতে পারি না। তাকে আমি চাই না। শুধু আমার আগের জীবন ফিরে পেতে চাই। তার স্মৃতিগুলো নিয়ে বাঁচতে পারব না। নিজের হাতটি দেখলেও যেন তাকে দেখতে পাই। নিজেকে ঘৃণা করতে করতে নিঃশেষ হয়ে গেছি।
বান্ধবীরা খুব আক্ষেপ করে বলত,
" তোর মতো সুন্দরীর সাথেই যখন এরকমটা হলো, আমরা কী করব বল? তোর ঘটনার পর আমাদের আতঙ্ক বাড়ছে। "
তাদের কথাগুলো আমার হৃদয়ে বিঁধত। প্রতিবেশীরাও আফসোসের সুরে কত টিপ্পনি কাটত। একদলের ভাষ্যমতে, সুন্দরী হয়েও নিজের স্বামীকে আটকাতে পারলাম না, এটা আমার-ই দোষ। ধীরে ধীরে আমি হয়ে উঠলাম মানসিক রোগী। ডাক্তার বেঁধে দিলো একগাদা ঘুমের ঔষধ। তবুও ঘুমের মধ্যে তাকে দেখতে পাই।
আমার আর্তচিৎকারে ছুটে আসত সবাই। একটাসময় পর আমার শত্রুরাও দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল৷ আমি চিৎকার করে কাঁদতাম, নিজের চুল নিজের ছিঁড়ে ফেলতাম। কোনো মহিলা আমায় দেখতে এলে তার গলা ধরে আকুলস্বরে কান্না করতাম৷ আমার ভেঙ্গে যাওয়াটা ছিল দুঃস্বপ্নের মতোন৷ আমি দূর্বল মনের দূর্বল মানুষ। উঠে দাঁড়াতে পারি নি। শত্রুরাও নিজের চোখ মুছে আমায় বুঝাতো। কিন্তু, আমি কী করব? আমার অস্তিত্বে জুড়ে থাকা তার স্মৃতিগুলো কীভাবে মুছব? এতো চিহ্ন, এতো বিষাদ, এ যেন নরকের চিত্র!
এর মধ্যে আরেকটি দূর্ঘটনা ঘটে গেল৷ আমার বাবা হঠাৎ দ্বিতীয় বিয়ে করে নিলেন। এরপর আমার একমাত্র ভাই রাগ করে বাড়ি থেকে চলে যায়। সে আর ফিরে আসে নি। কোনো খবর নেয় নি। আমি আর আমার মা কয়েকদিন সৎ মায়ের যন্ত্রণা সহ্য করলাম। তারপর একদিন বাবা মা'কে মুক্তি দিয়ে দিলেন। মূহুর্তের মধ্যে সব শেষ হয়ে গেল। মামারা এসে মা'কে নিতে চাইলেন। মা বললেন যেন তার সাথে যাই। এদিকে বাবা জানালেন, মায়ের সাথে গেলে আমার সাথেও সারাজীবনের জন্য সম্পর্ক ছিন্ন করে দিবেন।
মামারা বাবার উপর যথেষ্ট ক্ষীপ্ত ছিলেন বিধেয় মা'কে বললেন, মা যেন একা আসেন। তারা আমার দায়িত্ব নিতে পারবেন না। শেষ পর্যন্ত মা তাদের সাথে গেলেন না। এক কাপড়ে আমরা মা-মেয়ে একসাথে বের হয়ে এলাম। সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। কে দেখে আজ বলবে আমাদের সুন্দর একটি পরিবার ছিল? আমরা দু'টি ভাই-বোনসহ বাবা-মা মিলে অনেক সুখী ছিলাম। মূহুর্তের মধ্যে সব ধ্বংস হয়ে গেল।
মা আর আমার অবস্থা করুণ। আমরা কে কাকে শান্তনা দিব? চেনা-পরিচিত বাবার হঠাৎ অচেনা রূপ মেনে নেওয়াটা ছিল আরো কষ্টকর। মায়ের দিকে তাকিয়ে নিজেকে অনেকটা সামলে নিলাম। শুরু হলো আমাদের সংগ্রাম। শিক্ষকতা হয়ে উঠল পেশা। ভালোই ছিলাম। বাচ্চাদের সাথে দিনগুলো চমৎকার যাচ্ছিলো। তবুও এ জীবনের শেষ কোথায়?
বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল অনেক। এমন মানুষ যাদের স্ত্রী হয়তো মারা গেছে কিংবা ডিভোর্স হয়েছে। এবং তারা নতুন কোনো সন্তান চায় না। আমি রাজি ছিলাম। কিন্তু, বিয়ে পর্যন্ত কথা গিয়ে আবার ভেঙ্গে গেছে। কারণ, আমি এখন দারিদ্র্য। লড়াইটা কেবল আমার এবং মায়ের। আমাদের কেউ নেই, কিছুই নেই৷
প্রথমবারের মতো বুঝলাম মেয়েদের সৌন্দর্য থাকলেই শুধু সব হয় না। আর গরীবের সৌন্দর্য যেন আরো ধ্বংসের প্রতীক। সৌন্দর্যের পাশাপাশি বাবা-ভাই থাকতে হয়, তাদের টাকাও থাকতে হয়।
দাঁতে দাঁত পিষে সহ্য করে কেটে গেল চারটি বছর। কেমন জানি হয়ে গিয়েছিলাম। জগতের কিছুই আমায় টানে না। অভিমানী মামাদের অভিমানও একসময়ে ভাঙ্গলো। আত্মীয়রাও বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে লাগল। কিন্তু, আমার মাথায় যে মৃত্যু ছাড়া আরকিছুই ঘুরে না!
এ ক্লান্ত জীবনের সমাপ্তি কোথায়? আমার যে দমবন্ধ হয়ে গেছে! পৃথিবীর কোলাহল আর ভালো লাগে না। মা'কে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেও কেমন স্বার্থপরের মতো লাগছে৷ তবুও আমাকে যেতে হবে। হাঁটতে হবে অনেক দূরের পথ!
সমস্ত বিষন্নতা, আক্ষেপ এবং যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে ২৫ বছর বয়সে গতবছর এই নারী মারা যান। খুব সাধারণ একটি মৃত্যু হয়েছিল। উনার মা পাথরের মতো স্থীর হয়ে বসেছিলেন। জীবনে আর কখনো মুখ দেখবেন না বলা বাবাও এসেছিলেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল ভাইটিও। কিন্তু, উনার মা তাদেরকে মুখটি দেখতে দেন নি। বাধ্য হয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল দরজার সামনে থেকে। বাবা তার মেয়ের শেষ বিদায়টুকুও দিতে পারেন নি। অভিমানী ভাইটিও তার আদরের বোনকে বিদায় জানাতে পারে নি।
সবাই অনুতপ্ত হয়েছিল। নিজেদেরকে অভিশপ্ত করেছিল। কিন্তু, কোনোকিছুই যে আর বদলাবে না। উনার মা এখন নিজের ভাইদের কাছে আছেন। তিনি নিজেও এখন মানসিক রোগী। চিৎকার করে কেঁদে উঠে মেয়ের কাছে চলে যাওয়ার প্রার্থনা করেন। তার কান্নায় ভারি হয়ে উঠে পৃথিবী। আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশীরা নিজেদের চোখ মুছে। তারাও হয়তো ভাবে নি, এমনটা হবে।
যে মেয়ে দেখতে ছিল পরীর মতো সুন্দর। আচরণ-ব্যবহার, নৈতিকতা ধরে রেখেছিল অষ্টেপৃষ্ঠে, তার জীবন এমন হবে কে জানত? কে-ই বা বুঝেছিল এতো সৌন্দর্যের অধিকারীনী হয়েও চলে যেতে হবে এভাবে চির দুঃখী হয়ে? ভাগ্যের প্রতি একরাশ অভিমান-অভিযোগ রেখে চোখ বন্ধ করে নিল চিরদিনের মতোন।
পৃথিবী আগের মতোই চলছে।
এ পৃথিবী কারো জন্য আটকায় না। আটকে থাকে কেবল প্রতারিত হওয়া মানুষদের জীবন। না পায় বেঁচে থাকার আশ্বাস, আর না আসে তাদের সুন্দর একটি মৃত্যু। যে মৃত্যু মুক্তি দিবে তাদেরকে সমস্ত যন্ত্রণা থেকে। অবসান ঘটাবে জগতের সমস্ত বিতৃষ্ণা।