প্রাণ ঢেলে পিতার সেবা-শুশ্রুষা করলেন। কিন্তু না, কিছুতেই কিছু হলো না।খুয়ায়লিদ বুঝতে পারলেন, তাঁর অন্তিম সময় উপস্থিত। হযরত খাদীজা (রা)- কে নিজের বিছানার পাশে বসিয়ে বললেন: মা খাদীজা! দুনিয়ায় কেউ চিরদিন থাকে না। সবাইকে এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হয়। যারা চলে যায়, তারা আর কোনদিন ফিরে আসে না। আসবেও না। তোমাকেও এক সময় চলে যেতে হবে। আমি তোমার মনের দুঃখ বুঝতে পারি মা। আমি চলে গেলে তোমার আপন বলতে কেউ থাকবে না।
কিন্তু আমার করার কিছুই নেই। এটা তো আল্লাহর বিধান।হযরত খাদীজা (রা)
সঙ্গে সঙ্গে খাদীজা (রা) কেঁদে উঠলেন। অঝোর নয়নে হযরত খাদীজা (রা) কাঁদতে লাগলেন। তাঁর কান্না আর থামে না।
হযরত খাদীজা (রা)-কে একা রেখে এক এক করে সকলেই চলে গেলো। বিষাদ সিন্ধুর বুকে ভাসমান দ্বীপের ন্যায় জেগে থাকলেন হযরত খাদীজা (রা)। এক এক করে সকলকে বিদায় দিচ্ছেন। তিনি যেন বিদায়ী সাক্ষী। বিরাট সংসারে তিনি একা। এক পাহাড় দুঃখ বুকে নিয়ে বেঁচে রইলেন খাদীজা (রা)।
ব্যবসায়ী খাদীজা (রা)
কথায় শাকে কাতর, আর অধিক শোকে পাথর। শোকে শোকে হযরত খাদীজা (রা) পাথরয়ে গেলেনা। সব দুঃখ-বেদনা চাপা দিয়ে হযরত খাদীজা (রা) এবার ব্যবসার এরা পাথারামে দিলেন। ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি পড়ে গেলেন এক সমস্যায়। নাদেশের ব্যবসা না হয় তিনি নিজেই দেখাশোনা করবেন, কিন্তু বিদেশের ব্যবসা চালাবেন কিভাবে? তিনি তো নারী। নারীরা তো পুরুষের মতো অবাধে চলাফেরা করতে পারে না। নারী হয়ে বিদেশে ব্যবসা করা কি আর চাট্টিখানি কথা।
দূর-দূরান্তের পথ ধূ ধূ মরুভূমি পেরিয়ে মাঠঘাট ছাড়িয়ে পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে যেতে হয় সেই ইয়ামেন, সিরিয়া, ইরাক, রোম প্রভৃতি দেশে। যাতায়াতের জন্যে তেমন কোন ভাল রাস্তাঘাট নেই। নেই মোটর গাড়ি, বাস, ট্রেন। কেবল উট, ঘোড়া কিংবা গাধার পিঠে চেপে দেশ-বিদেশ সফর করতে হয়।
সেই পথ কি আর নিরাপদ? পথে আছে চোর-ডাকাতের ভয়, গুণ্ডা, বদমায়েশের ভয়। এমনি তো হযরত খাদীজা (রা) রূপের রাণী। তদুপরি তার সঙ্গে থাকবে মালামাল ও টাকাকড়ি। নারী ও ধন-দৌলতের প্রতি মানুষের দুর্দমনীয় লোভ এ দু'টির জন্যে মানুষ অনেক সময় প্রাণ দিতেও দ্বিধাবোধ করে না। কাজেই খাদীজা (রা) ভীষণ ভাবনায় পড়ে গেলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন কি করা যায়।
গভীরভাবে চিন্তা করে তিনি এক উপায় বের করে ফেললেন। তিনি আত্মীয়- স্বজনদের মধ্য থেকে কিছু সৎ ও বিশ্বস্ত যুবককে বেছে বের করলেন। ব্যবসায় কর্মচারী নিযুক্ত করে তাদের উপর বৈদেশিক বাণিজ্যের ভার অর্পণ করলেন। এ ছাড়াও হযরত খাদীজা (রা) আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্য থেকে আরও কিছু দরিদ্র অথচ সচ্চরিত্র ও কর্মঠ যুবককে খুঁজে নিলেন। তিনি এদেরকেও নিযুক্ত করলেন ব্যবসার কর্মচারী। এ সব কর্মচারীর কাউকে নির্দিষ্ট বেতনে, আবার কাউকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ
প্রদানের চুক্তিতে নিযুক্ত করলেন।
এভাবে তিনি ব্যবসায় নতুন কর্মচারী নিয়োগ করলেন। এমন সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যুবকরা খুব খুশি হলো। তাদের মাতা-পিতা হযরত খাদীজা (রা)-এর উপর বিশেষ সন্তুষ্ট হলেন। ফলে একদিকে হযরত খাদীজা (রা)-এর মান-ইজ্জত ও সুনাম বৃদ্ধি পেল, অপর দিকে ব্যবসার মন্দাভাব কেটে গেলো। ব্যবসায় নব-দিগন্তের সূচনা হলো।
হযরত খাদীজা (রা)-এর ব্যবসার নীতিমালা
নব নিযুক্ত কর্মচারীদেরকে বিভিন্ন ব্যবসা কেন্দ্রে পাঠানোর পূর্বে হযরত খাদীজা (রা) ডেকে এক জায়গায় জমায়েত করলেন। তারপর তিনি বললেন : আমার ব্যবসার কতগুলো নীতি বা নিয়ম আছে। তোমরা অবশ্যই তা মেনে চলবে। নিয়ম বা শর্তগুলো হলো: সততা। সততা হলো ব্যবসার প্রথম শর্ত। এই সততা রক্ষা করে ব্যবসা করবে। কখনও ছল-চাতুরী, প্রতারণা ইত্যাদি অসৎ পন্থার আশ্রয় গ্রহণ করবে না। ক্রেতার নিকট মালের প্রকৃত দোষগুণ বর্ণনা করবে। সামান্য লাভে মাল বিক্রি করবে। অল্প লাভে অধিক বিক্রির মধ্যে ফায়দা বেশি।
ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের সঙ্গে নম্র ও ভদ্র ব্যবহার করবে। কোন ক্রেতার নিকট মাল বিক্রি করতে না পারলেও তার সঙ্গে অসদাচরণ করবে না। কখনও তার সঙ্গে কটু কথা বলবে না। তোমাদের ব্যবহারে যদি সে সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে আপাতত মাল ক্রয় না করলেও অন্য সময় সে পুনরায় আসবে।
অপর দিকে কোন ক্রেতার নিকট মালামাল বিক্রি করল বটে। কিন্তু তোমাদের ব্যবহারে সে সন্তুষ্ট হলো না। তাহলে ঐ ক্রেতা আর কোনদিন তোমাদের পণ্য-সামগ্রী ক্রয় করতে আসবে না। কাজেই প্রত্যেক ক্রেতা ও বিক্রেতার সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করবে। এতে ক্রেতার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে এবং ব্যবসার উন্নতি হবে।
এইভাবে হযরত খাদীজা (রা) নবনিযুক্ত কর্মচারীদেরকে ব্যবসার নীতিমালা
শিক্ষা দিয়ে-তাদেরকে স্ব স্ব স্থলে পাঠিয়ে দিলেন।
তারা মনিবের নির্দেশ মতো ব্যবসা করতে লাগলেন। ফলে অল্প দিনেই ব্যবসার উন্নতি দেখা দিলো এবং দেশ-বিদেশে হযরত খাদীজা (রা)-এর সুনাম ছড়িয়ে পড়লো।
কর্মচারী ও দাস-দাসীদেরকে হযরত খাদীজা (রা) তাঁর ছেলেমেয়ের মত আদর করতেন। এ জন্যে তারা তাঁর একান্ত অনুগত হয়ে পড়লো। তিনি কর্মচারীদের কাজের দক্ষতার জন্যে বেতন বৃদ্ধি ছাড়াও তাদেরকে বিশেষ পুরস্কার দিতেন। এমন কি দাস- দাসীদের পর্যন্ত তিনি পুরস্কার দিতেন। এ জন্যে তারা মনিবের কাজকে নিজের মনে করে করতো এবং দক্ষতা দেখানোর জন্যে এমন কি তাদের মধ্যে চলতো রীতিমত প্রতিযোগিতা। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই হযরত খাদীজা (রা)-এর ব্যবসা জমজমাট হয়ে।আল-আমীন
মক্কার এক তরুণ।
যেমন তাঁর রূপ তেমন তাঁর গুণ। দেহে তাঁর অপরূপ সৌন্দর্য। তাঁর কান্তিময় মুখশ্রী, ভুবন ভুলানো হাসি, স্নিগ্ধ চাহনি-যে কোন দর্শকের মন কেড়ে নেয়। যুবকটির নম্র ও ভদ্র ব্যবহারে সকলে মুগ্ধ। কারো সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ না, কটু কথা না। এমন কি কারো সঙ্গে কর্কশ ভাষায় কথা পর্যন্ত বলেন না। সব সময় মিষ্টি হেসে কথা বলেন। সততায় সমগ্র আরবে তার জুড়ি নেই। জীবনে একটি মিথ্যা কথাও তিনি বলেননি। সকলেই তাঁকে বিশ্বাস করে। লোকেরা তাঁকে 'আল-আমীন' ডাকে। 'আল-আমীন' অর্থ বিশ্বাসী। কী সুন্দর নির্মল নিষ্কলংক চরিত্র ও সুতীক্ষ্ম জ্ঞান-বুদ্ধি তাঁর।
অথচ এই যুবকটি পড়ালেখা জানে না। পড়ালেখা শিখবেনই বা কেমন করে? জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতা ইন্তিকাল করেছেন। বাল্যকালে মাতাও মারা গেছেন। তারপর দাদার স্নেহ-আদরে বড় হয়েছেন। দাদার নাম আবদুল মুত্তালিব। কিছুদিন পর তিনিও ইন্তিকাল করলেন। তখন তাঁর চাচা আবূ তালিব তাঁর লালন-পালন করতে লাগলেন। কিন্তু তাঁর চাচার সাংসারিক অবস্থা সচ্ছল ছিল না। কাজেই তাঁর পড়ালেখার সুযোগ কোথায়? পড়ালেখা না জানার আরও কারণ আছে। সেটা বড় হলে জানতে পারবে।
চাচা আবূ তালিব তাঁকে পুত্রের মতো স্নেহ করেন। যুবকটিও চাচাকে পিতার ন্যায় শ্রদ্ধা করেন। যুবকটির জ্ঞান-গরিমা ও সততার কথা আরবের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো। সেবা, ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, সততা ও চরিত্র মাধুর্য দ্বারা তিনি সকলের মন জয় করে ফেললেন। মক্কার সব মানুষের মুখে মুখে তাঁর প্রশংসা।
বলতে পার এই যুবকটির নাম কি? স্মরণ নেই বোধ হয়? এই যুবকটি তো সেই শিশু-যাঁর জন্মের পর তামাম সৃষ্টি জগৎ "মারহাবা মারহাবা" বলেছিল। হযরত খাদীজা (রা) তাঁকে কোলে নিয়ে আদর করেছিলেন। বিবি আমিনার নয়নের মণি আদরের দুলাল, নাম- 'মুহাম্মদ'।
এখন তিনি তরুণ। তাঁর বয়স প্রায় পঁচিশ বছর। তাঁর সততা ও বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ হয়ে মানুষ তাঁকে 'আল-আমীন' বলে ডাকে।