দেনা-পাওনা নয়

মন্দির-সংক্রান্ত গোলযোগটা যে ওখানেই মিটিয়া শেষ হইয়া গেল না ষোড়শী তাহা ভাল করিয়াই জানিত; কিন্তু বিপত্তি যেদিক ?

ষোড়শী তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, তার অর্থ?

ফকির বলিলেন, ওই লোকটার অপরাধ ও অত্যাচারের অন্ত নেই, এ ত তুমি জানো! তার শাস্তি হওয়া উচিত।

এবার ষোড়শী বহুক্ষণ পর্যন্ত নিস্তব্ধ হইয়া রহিল, তারপরে মাথা নাড়িয়া আস্তে আস্তে বলিল, আমি সমস্ত জানি। তাঁকে শাস্তি দেওয়াই হয়ত আপনাদের উচিত, কিন্তু আমার কথা কাউকে বলবার নয়—তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে আমি কোনদিন পারব না।

ফকির কহিলেন, ব্যাপার কি ষোড়শী?

ষোড়শী অধোমুখে স্তব্ধ হইয়া রহিল, এবং বহুক্ষণ পর্যন্ত কাহারও মুখ দিয়া কোন বাক্যই বাহির হইল না। দাসী সংসারের কাজ করিতে আসিতেছিল, দ্বারের কাছে তাহাকে দেখিতে পাইয়া ফকির আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, এখন তা হলে আমি চললাম।

ষোড়শী কেবল হেঁট হইয়া তাঁহাকে নমস্কার করিল; তিনি ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেলেন।

তাঁহার প্রশান্ত মুখের গম্ভীর বিষণ্ণতাই শুধু যে কেবল ষোড়শীর সমস্ত দিন সকল কাজকর্মের মধ্যেই যখন-তখন মনে হইতে লাগিল তাই নয়, যে অনুচ্চারিত বাক্য তিনি সহসা দমন করিয়া লইয়া নীরবে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন, তাহাও নানা আকারে নানা ছন্দে তাহার কানে বাজিতে লাগিল। সে যেন স্পষ্ট দেখিতে লাগিল এই সাধু ব্যক্তি যে শ্রদ্ধা, যে স্নেহ এতদিন তাহার প্রতি ন্যস্ত রাখিয়াছিলেন ঠিক কিছু না জানিয়াও আজ যেন তাহাকে খর্ব করিয়া লইয়া গেলেন। এই ক্ষতি যে কত বড়, তাহার পরিমাণ সে নিজে ছাড়া আর কেহই অধিক জানিত না।

কিন্তু তথাপি ইহাকে ফিরিয়া পাইবারও কোন পন্থা তাহার চোখে পড়িল না। তাহার বাল্য ইতিহাস কাহারও কাছে ব্যক্ত করা চলে না, এমন কি এই ফকিরের কাছেও না। কারণ ইহাতে যে-সকল পুরাতন কাহিনী উঠিয়া পড়িবে তাহা মেয়ের পক্ষে যতবড় লজ্জার কথাই হোক, তাহার যে মা আজ পরলোকে তাঁহাকেই সমস্ত পৃথিবীর সম্মুখে একেবারে পথের ধূলায় টানিয়া আনা হইবে। এবং এইখানেই ইহার শেষ নয়। স্বামিস্পর্শ ভৈরবীর একান্ত নিষিদ্ধ। কত যুগ হইতে এই নিষ্ঠুর অনুশাসন ইহাদিগকে অঙ্গীকার করিয়া আসিতে হইয়াছে। সুতরাং ভাল-মন্দ যাই হোক, জীবনানন্দের শয্যাপ্রান্তে বসিয়া একটা রাত্রির জন্যও তাহাকে যে-হাত দিয়া তাঁহার সেবা করিতে হইয়াছে, সেই হাত দিয়া আর যে দেবীর সেবা করা চলিবে না তাহা নিশ্চিত, অথচ এইখানেই এই দেবীর প্রাঙ্গণতলেই তারাদাস যখন তাহাকে অজ্ঞাতকুলশীল একজনের হস্তে সমর্পণ করিয়াছিল তখন সে কোন আপত্তিই করে নাই; এবং সমস্ত জানিয়াও যে সে নিঃসঙ্কোচে এতকাল ভৈরবীর কার্য করিয়া আসিয়াছে, ইহার জবাবদিহি আজ যদি সমস্ত ক্রুদ্ধ হিন্দুসমাজের কাছে করিতে হয়, ত সে যে কি হইবে সে তাহার চিন্তাতীত। আবার এ-সকল ত গেল কেবল একটা দিকের কথা, কিন্তু যে দিকটা একেবারেই তাহার আয়ত্তাতীত, তথায় কি যে হইবে সে তাহার কি জানে? যে জীবানন্দ একদিন তাহাদের বিবাহটাকে কেবল পরিহাস করিয়া গিয়াছিল, সে যদি আজ সমস্ত ইতিহাসটাকে নিছক গল্প বলিয়া হাসিয়া উড়াইয়া দেয়, ত তাহাকে সত্য বলিয়া সপ্রমাণ করিতে সে নিজে ছাড়া আর দ্বিতীয় ব্যক্তি জীবিত নাই।

গৃহস্থালী-সম্বন্ধে রানীর মায়ের দুই-একটা কথার উত্তরে ষোড়শী কি যে জবাব দিল তাহার ঠিকানা নাই। মন্দিরের পুরোহিত কি একটা বিশেষ আদেশ গ্রহণ করিতে আসিয়া অন্যমনস্ক ভৈরবীর কাছে কি যে হুকুম পাইল তাহা ভাল বুঝিতেই পারিল না। নিত্যনিয়মিত পূজা-আহ্নিকে বসিয়া আজ ষোড়শী কোনমতেই মনস্থির করিতে পারিল না, অথচ যে জন্য তাহার সমস্ত চিত্ত উদ্‌ভ্রান্ত এবং চঞ্চল হইয়া রহিল, তাহার যথার্থ রূপটাও তাহাকে ধরা দিল না—কেবলমাত্র কতকগুলা অস্ফুট অনুচ্চারিত বাক্যই সমস্ত সকালটা একটা অর্থহীন প্রলাপে তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিল। রান্নার উদ্যোগ-আয়োজন পড়িয়া রহিল, সে রান্নাঘরে প্রবেশ করিল না – এ-সকল তাহার ভালই লাগিল না। এমনি করিয়া সমস্ত দিনটা যখন কোথা দিয়া কিভাবে কাটিয়া গেল, একপ্রকার ঘোলাটে মেঘলায় শীতের দিনের অপরাহ্ণ যখন অসময়েই গাঢ়তর হইয়া আসিতে লাগিল, তখন সে একাকী ঘরের মধ্যে আর থাকিতে না পারিয়া হঠাৎ বাহির হইয়া আসিল, এবং ফকিরসাহেবকে স্মরণ করিয়া বারুইয়ের প্রপারে তাঁহারই আশ্রমের উদ্দেশে যাত্রা করিল। এমন অনেকদিন হইয়াছে সে একটুখানি ঘুরিয়া তাহার অনুগত বিপিন কিংবা দিগম্বরকে তাহাদের বাটীর সম্মুখ হইতে ডাক দিয়া সঙ্গে লইয়া গিয়াছে; কিন্তু আজ পাড়ার পথ দিয়া তাহাদিগকে ডাকিতে যাইতে তাহার সাহসও হইল না, প্রবৃত্তিও হইল না—একাকীই মাঠের পথ ধরিয়া নদীর অভিমুখে দ্রুতপদে অগ্রসর হইয়া গেল। তাহার মনেও পড়িল না যে, ঘরগুলা খোলাই পড়িয়া রহিল।আরও কিছুক্ষণ কাটিত, সহসা মুক্তদ্বার দিয়া ঘরের মধ্যে একটা দমকা বাতাস অনুভব করিয়া তাহার চৈতন্য হইল, বাহিরে আর একজন হয়ত এখনও তাহার অপেক্ষা করিয়া আছেন।কিন্তু ইতিমধ্যে যে আকাশ এমন মেঘাচ্ছন্ন, অন্ধকার এত প্রগাঢ় হইয়া উঠিতে পারে এবং বাতাস প্রবল হইয়া ঝড় ও জলের সম্ভাবনা আসন্ন হইয়া উঠিতে পারে, ইহা তাহার মনেও আসে নাই। বাহিরে আসিয়া দেখিল অনতিদূরে একটা শুষ্ক বৃক্ষকান্ডের উপর বসুসাহেব বসিয়া আছেন, তাঁহার শুভ্র পরিচ্ছদ ভিন্ন আর কিছুই প্রায় দেখা যায় না। তাঁহাকে এইভাবে বাস্তবিক অপেক্ষা করিতে দেখিয়া ষোড়শী মনে মনে অতিশয় সঙ্কোচ বোধ করিল।

সাহেব উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, কৈ, ফকির ত এখনো এলেন না, আসবেন বলে কি আপনার আশা হয়?

ষোড়শী অতি মৃদুস্বরে উত্তর দিল, কি জানি, বোধ হয় না-ও আসতে পারেন।

বসু কহিলেন, ফকিরসাহেবের জিনিসপত্র কি ছিল আমি জানিনে, কিন্তু তাঁর ঘরটি ত একেবারে খালি – এমন হঠাৎ চলে যাওয়া কি আপনার সম্ভব মনে হয়?

ষোড়শী তেমনি আস্তে আস্তে বলিল, একেবারে অসম্ভবও নয়। এমনি সহসা তিনি মাঝে মাঝে কোথায় চলে যান।

আবার কতদিনে ফিরে আসেন?গেলেন। কিন্তু সে ওই ক্ষণকালমাত্রই। তারপরে সেই প্রসারিত হাতখানি নিঃশব্দ ব্যগ্রতায় আশ্রয় করিয়া আস্তে আস্তে কহিলেন, চলুন। এইবার আমি সত্যি সত্যিই দু’চক্ষু বুজে চলতে পারব।

ষোড়শী ইহার কোন উত্তর দিল না। উভয়ে ধীরে ধীরে কিছুদূর অগ্রসর হইলে বসুসাহেব অকস্মাৎ বলিয়া উঠিলেন, আপনার প্রতি আমি সেদিন ভদ্র ব্যবহার করিনি। তার জন্যে ক্ষমা চাইচি, আপনি আমাকে মাপ করবেন।

ষোড়শী এ কথার উত্তরেও কিছুই বলিল না, তেমনি নিঃশব্দে ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল।

বসু কহিলেন, আপনি হৈমর ছেলেবেলার বন্ধু। আমার সেদিনের আচরণ যাই হোক, আমাকেও ঠিক শত্রু বলেই মনে রাখবেন না। বলিয়া তাহার হাতের উপর একটুখানি চাপ দিলেন।

ষোড়শী একেবারেই নির্বাক। বসুসাহেব নিজেও কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া পুনশ্চ কহিলেন, এঁরা যে আপনাকে সহজে ছাড়বেন তা মনে হয় না। খুব সম্ভব মামলা-মকদ্দমাও হবে। ফকিরসাহেব হয়ত সত্যিই চলে গেছেন, আমিও বোধ হয় থাকব না—

ষোড়শী কিছুই বলিল না। তিনি নিজেও একটু মৌন থাকিয়া পুনশ্চ কহিলেন, আপনি নিজে আর দেবীর পূজো করবেন না বলেচেন, এ কি রাগ করে?

ষোড়শী এবার জবাব দিল, কহিল, না।কথাটাই হয়ত আমাকে অনেকদিন ধরে ভাবতে হবে। কাল আমরা যাচ্চি—

ষোড়শী একমুহূর্ত কি ভাবিয়া কহিল, না। কেবল তার ছেলেকে আশীর্বাদ করচি, যদি ইচ্ছে হয় এইটুকু জানাবেন। বলিয়াই সে আর কোন প্রশ্নোত্তরের অপেক্ষা না করিয়া অন্ধকার বনপথ ধরিয়া নিমেষে অদৃশ্য হইয়া গেল।

সাহেব সেইখানে বিমূঢ়ের মত কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। একটা নমস্কার পর্যন্ত করা হইল যে ফকিরের জন্য এই, তাঁহার উদ্দেশে একটা নমস্কার পর্যন্তও জানানো হইলতনা— না। তাহার পরে নির্দিষ্ট পথ ধরিয়া ধীরে ধীরে অগ্রসর হইলেন।


Akhi Akter Mim

313 Blog posts

Comments