দেবদাস-এর পঞ্চম খন্ড

পার্বতী এই তের বছরে পা দিয়াছে-ঠাকুরমাতা এই কথা বলেন। এই বয়সে শারীরিক সৌন্দর্য অকস্মাৎ যেন কোথা হইতে ছুটিয়া আস?

তখন পাত্রস্থা করিবার জন্য বড় তাড়াহুড়া পড়িয়া যায়। চক্রবর্তী-বাড়িতে আজ কয়েক দিবস হইতেই সেই কথার আলোচনা হইতেছে। জননী বড় বিষণ্ন; কথায় কথায় স্বামীকে শুনাইয়া বলেন, তাইত, পারুকে আর ত রাখা যায় না। তাঁহারা বড়লোক নহেন, তবে ভরসা এই যে, মেয়েটি অতিশয় সুশ্রী। জগতে রূপের যদি মর্যাদা থাকে, ত পার্বতীর জন্য ভাবিতে হইবে না। আরও একটা কথা আছে-সেটা এইখানেই বলিয়া রাখি। চক্রবর্তী-পরিবারে ইতিপূর্বে কন্যার বিবাহে এতটুকু চিন্তা করিতে হইত না, পুত্রের বিবাহে করিতে হইত। কন্যার বিবাহে পণ গ্রহণ করিতেন এবং পুত্রের বিবাহে পণ দিয়া মেয়ে ঘরে আনিতেন। নীলকণ্ঠের পিতাও তাঁহার কন্যার বিবাহে অর্থ গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু নীলকণ্ঠ স্বয়ং এ প্রথাটাকে ঘৃণা করিতেন। তাঁহার আদৌ ইচ্ছা ছিল না যে, পার্বতীকে বিক্রয় করিয়া অর্থলাভ করিবেন। পার্বতীর জননী এ কথা জানিতেন; তাই স্বামীকে কন্যার জন্য তাগাদা করিতেন। ইতিপূর্বে পার্বতীর জননী মনে মনে একটা দুরাশাকে স্থান দিয়াছিলেন -ভাবিয়াছিলেন, দেবদাসের সহিত যদি কোন সূত্রে কন্যার বিবাহ ঘটাইতে পারেন! এ আশা যে নিতান্ত অসম্ভব, তাহা মনে হইত না। ভাবিলেন, দেবদাসকে অনুরোধ করিলে বোধ হয় কোন সুরাহা হইতে পারে। তাই বোধ হয় নীলকণ্ঠের জননী কথায় কথায় দেবদাসের মাতার কাছে কথাটা এইরূপে পাড়িয়াছিলেন-আহা বৌমা, দেবদাসে আর আমার পারুতে কি ভাব! এমনটি কৈ কোথাও ত দেখা যায় না!

দেবদাসের জননী বলিলেন, তা আর হবে না খুড়ী, দু’জনে ভাইবোনের মতই যে একসঙ্গে মানুষ হয়ে এসেচে।হাঁ মা হাঁ-তাইত মনে হয়, যদি দু’জনের-এই দেখ না কেন বৌমা, দেবদাস যখন কলকাতায় গেল, বাছা তখন সবে আট বছরের; সেই বয়সেই ভেবে ভেবে যেন কাঠ হয়ে গেল। দেবদাসের একখানা চিঠি এলে, সেখানা যেন একেবারে ওর জপমালা হয়ে উঠত। আমরা সবাই ত তা জানি!

দেবদাসের জননী মনে মনে সমস্ত বুঝিলেন। একটু হাসিলেন। এ হাসিতে বিদ্রূপ কতটুকু প্রচ্ছন্ন ছিল জানি না, কিন্তু, বেদনা অনেকখানি ছিল। তিনিও সব কথা জানিতেন, পার্বতীকে ভালও বাসিতেন। কিন্তু বেচা-কেনা ঘরের মেয়ে যে! তার ওপর আবার ঘরের পাশে কুটু’! ছি ছি! বলিলেন, খুড়ী, কর্তার ত একেবারে ইচ্ছা নয় এই ছেলেবেলায়, বিশেষ পড়াশুনার সময়ে দেবদাসের বিয়ে দেন। তাই ত কর্তা আমাকে এখনও বলেন, বড়ছেলে দ্বিজদাসের ছেলেবেলায় বিয়ে দিয়ে কি সর্বনাশটাই করলে। লেখাপড়া একেবারেই হল না।

পার্বতীর ঠাকুরমা একেবারে অপ্রতিভ হইয়া পড়িলেন। তবুও কহিলেন, তা ত সব জানি বৌমা, কিন্তু কি জান-পারু, ষেটের বাছা একটু অমনি বেড়েচেও বটে, আর বাড়ন্ত গড়নও বটে, তাইতে-তাইতে-যদি নারাণের অমত-দেবদাসের জননী বাধা দিলেন; বলিলেন, না খুড়ী, এ কথা আমি তাঁকে বলতে পারব না। দেবদাসের এ সময়ে বিয়ের কথা পাড়লে তিনি কি আমার মুখ দেখবেন!

কথাটা এইখানেই চাপা পড়িয়া গেল। কিন্তু স্ত্রীলোকের পেটে কথা থাকে না। দেবদাসের জননী কর্তার খাবার সময় কথাটা পাড়িয়া বলিলেন, পারুর ঠাকুমা আজ তার বিয়ের কথা পেড়েছিলেন।

কর্তা মুখ তুলিলেন; বলিলেন, হাঁ, পারুর বয়স হল বটে; শীঘ্র বিবাহ দেওয়াই কর্তব্য।

তাইতে ত আজ কথা পেড়েছিলেন। বললেন, দেবদাসের সঙ্গে যদি-

স্বামী ভ্রূকুঞ্চিত করিলেন, তুমি কি বললে?

আমি আর কি বলব! দু’জনের বড় ভাব; কিন্তু তাই বলে কি বেচা-কেনা, চক্রবর্তী-ঘরের মেয়ে আনতে পারি? তাতে আবার বাড়ির পাশে কুটু’-ছি ছি!

কর্তা সন্তুষ্ট হইলেন; কহিলেন, ঠিক তাই। কুলের কি মুখ হাসাব? এ-সব কথায় কান দিও না।গৃহিণী শুষ্কহাসি হাসিয়া কহিলেন, না-আমি কান দিইনে; কিন্তু তুমিও যেন ভুলে যেয়ো না।

কর্তা গম্ভীরমুখে ভাতের গ্রাস তুলিয়া বলিলেন, তা হলে এতবড় জমিদারি কোন্‌কালে উড়ে যেত!

জমিদারি তাঁহার চিরদিন থাকুক, তাহতে আপত্তি নাই; কিন্তু পার্বতীর দুঃখের কথাটা বলি। যখন এই প্রস্তাবটা নিতান্ত অগ্রাহ্য হইয়া নীলকণ্ঠের কানে গেল, তখন তিনি মাকে ডাকিয়া তিরস্কার করিয়া বলিলেন, মা, কেন এমন কথা বলতে গিয়েছিলে?

মা চুপ করিয়া রহিলেন।

নীলকণ্ঠ কহিতে লাগিলেন, মেয়ের বিয়ে দিতে আমাদের পায়ে ধরে বেড়াতে হয় না, বরং অনেকেই আমার পায়ে ধরবে। মেয়ে আমার কুৎসিত নয়। দেখো, তোমাদের বলে রাখলুম-এক হপ্তার মধ্যেই আমি স’ন্ধ স্থির করে ফেলবো। বিয়ের ভাবনা কি?

কিন্তু যাহার জন্য পিতা এতবড় কথাটা বলিলেন, তাহার যে মাথায় বাজ ভাঙ্গিয়া পড়িল। ছোটবেলা হইতে তাহার একটা ধারণা ছিল যে, দেবদাদার উপর তাহার একটু অধিকার আছে। অধিকার কেহ যে হাতে তুলিয়া দিয়াছে, তাহা নয়। প্রথম সে নিজেও ঠিকমত কিছুই বুঝিতে পারে নাই,-অজ্ঞাতসারে, অশান্ত মন দিনে দিনে এই অধিকারটি এমন নিঃশব্দে অথচ এতই দৃঢ় করিয়া প্রতিষ্ঠিত করিয়া লইয়াছিল যে, বাহিরে যদিও একটা বাহ্য আকৃতি তাহার এতদিন চোখে পড়ে নাই, কিন্তু আজ এই হারানোর কথা উঠিতেই তাহার সমস্ত হৃদয় ভরিয়া একটা ভয়ানক তুফান উঠিতে লাগিল।কিন্তু দেবদাসের স’ন্ধে এই কথাটা ঠিক খাটানো যায় না। ছেলেবেলায় যখন সে পার্বতীর উপর দখল পাইয়াছিল, তখন তাহা সে পরিপূর্ণভাবেই উপভোগ করিয়াছিল। কিন্তু কলিকাতায় গিয়া কর্মের উৎসাহে ও অন্যান্য আমোদ-আহ­াদের মধ্যে পার্বতীকে সে অনেকটা ছাড়িয়াই দিয়াছিল। কিন্তু সে জানিত না যে, পার্বতী তাহার সেই একঘেয়ে গ্রাম্য-জীবনের মধ্যে নিশিদিন শুধু তাহাকেই ধ্যান করিয়া আসিয়াছে। শুধু তাই নয়। সে ভাবিত, ছেলেবেলা হইতে যাহাকে নিতান্ত আপনার বলিয়াই জানিয়াছিল, ন্যায়-অন্যায় সমস্ত আবদারই এতদিন যাহার উপর খাটাইয়া লইয়াছে, যৌবনের প্রথম ধাপটিতে পা দিয়াই তাহা হইতে এমন অকস্মাৎ পিছলাইয়া পড়িতে হইবে না। কিন্তু তখন কে ভাবিত বিবাহের কথা? কে জানিত সেই কিশোর-বন্ধন বিবাহ ব্যতীত কোনমতেই চিরস্থায়ী করিয়া রাখা যায় না! ‘বিবাহ হইতে পারে না’, এই সংবাদটা পার্বতীর হৃদয়ের সমস্ত আশা-আকাক্সক্ষা তাহার বুকের ভিতর হইতে যেন ছিঁড়িয়া ফেলিবার জন্য টানাটানি করিতে লাগিল। কিন্তু দেবদাসকে সকালবেলাটায় পড়াশুনা করিতে হয়; দুপুরবেলা বড় গরম, ঘরের বাহির হওয়া যায় না, শুধু বিকেলবেলাটাতেই ইচ্ছা করিলে একটু বাহির হইতে পারা যায়। এই সময়টাতেই কোনোদিন বা সে জামাজোড়া পরিয়া, ভাল জুতা পায়ে দিয়া, ছড়ি-হাতে ময়দানে বাহির হইত। যাইবার সময় চক্রবর্তীদের বাড়ির পাশ দিয়াই যাইত,-পার্বতী উপরে জানালা হইতে চক্ষু মুছিতে মুছিতে তাহা দেখিত। কত কথা মনে পড়িত। মনে পড়িত, দু’জনেই বড় হইয়াছে,-দীর্ঘ প্রবাসের পর পরের মত এখন পরস্পরকে বড় লজ্জা করে। দেবদাস সেদিন অমনি চলিয়া গিয়াছিল; লজ্জা করিতেছিল,তাই ভাল করিয়া কথাই কহিতে পারে নাই। এটুকু পার্বতীর বুঝিতে বাকী ছিল না।


Akhi Akter Mim

313 Blog posts

Comments