হাহাকার

তীব্র যন্ত্রণার আরেক নাম হাহাকার

আমার শাশুড়ি কখনোই আমার কোন ভালো কিছু চোখে দেখতেন না। কি করে জানি উনি প্রতিটি ব্যাপারে আমার খুঁত খুজে বের করতেন। উনার ভাষ্যমতে আমি নাকি কোন রান্নাই জানি না। প্রতিবার খাওয়ার সময়, উনি ঘর ভর্তি মানুষের সামনে আমার এমন ভাবে অপমান করতেন, তখন মনে হতো "আচ্ছা এর চেয়ে মরে যাওয়াটাই কি শ্রেয় নয়!" হয়তো তখন দেবরটা এগিয়ে এসে বলতো,

__ " মা থামো তো, মাছের ঝোলটা তো বেশ হয়েছে খেতে। কেন শুধু শুধু অশান্তি করছো। "

তখন উনি আরো ক্ষেপে যেয়ে আমার চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করতে বসতেন। তার ধারনা আমি তার সন্তানদের তাবিজ করেছি, না হলে কেউ মাকে ছেড়ে অন্যের পক্ষে কথা বলে? 

বাসার প্রতিটা মানুষ ঘুম থেকে উঠতো ৯টার পর কিন্তু এক আমিই ছিলাম যে উঠতো ফজরে। শাশুড়ি মায়ের কথা ছিল, সকালে উঠে বাসি থালাবাটি ধুয়ে আটটার মধ্যে নাস্তা যেন টেবিলের উপরে থাকে। প্রচন্ড শীতে যখন সবাই গরম কম্বলের তলে অঘোর ঘুমে, তখন আমি বরফ ঠান্ডা পানিতে হাত ভিজিয়ে থালাবাটি ধোয়ায় ব্যস্ত থাকতাম। নিজের স্বামীকে অনুযোগ কখনো করি নি, এক অজানা অভিমান এসে আঁকড়ে ধরতো। সেইই তো নিয়ে এসেছে আমাকে এই সংসারে আমি তো যেচে আসি নি। তারপরও কেন এত উদাসীনতা আমায় ঘিরে। আর তারই বা কি করার ছিল, সবে মাত্র সে তার নিজের ব্যবসা ধরেছে। চাইলেও আমার জন্য তার কিছু করা সম্ভবই ছিল না। আর সেও হয়তো ভেবেছিলো খামোখা কেনই বা সে অশান্তির কারণ হতে যাবে। 

আমি না খুব মিস্টি পছন্দ করতাম, ঘরে যখন মিস্টি আসতো কেন জানি না আমার আর আমার স্বামীরটা আলাদা করে দিয়ে দিতেন শাশুড়ি মা। অন্যদের খেয়েও অনেক থাকতো, আর আমার মাপা মিস্টি শেষ করে আমি চেয়ে দেখতাম। ফ্রিজটা তালা দিয়ে রাখতো। নিজেকে কেন জানি না কাজের লোক থেকেও অধম মনে হতো। আর হ্যাঁ যেদিন শরীর খুব খারাপ থাকতো, কোন কাজ করার উপায় থাকতো না। সেদিন না খেয়েই থাকতে হতো সারাদিন। যাকে বলে কাজের বিনিময়ে খাদ্য। সারাদিন পর যখন পাশের মানুষটা বাসায় আসতো, তার কাছে চলতো বিচারের বিরাট লিস্ট। " আমি অযথা অযুহাতে শুয়ে থাকি, আমার নাকি ঘরের কাজ করতে ভালোই লাগে না।" আর এদিকে সে আমি আসার পর থেকে ঘরের বুয়া বিদায় করেছিল। দরকার কি অযথা টাকা খরচ করে, বিনা পয়সায় একজন পাওয়া গিয়েছে তো!

একটু একটু করে সহ্য কর‍তে করতে মানুষ প্রতিবাদী হয়। তখন স্বামীর ব্যবসায়ও ভালো হতে শুরু করলো, কেন জানি না শাশুড়ি মায়ের অত্যাচারের মাত্রাও বাড়তে লাগলো। হঠাৎই এক কাপড়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। প্রথম প্রথম একটু এলোমেলো লাগলেও শান্তি ছিলো জীবনে, এখন আর কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে ওঠার কোন তাড়া নেই। নেই প্রতি কাজে কথা শোনার ভয়। জীবনে এমনও গিয়েছে যখন ভাতের চেয়ে কথা বেশি হজম করেছি। 

আমার বড় ছেলের বিয়েতে আমার শাশুড়ি মা এসেছেন, ভরা সংসার দেখে উনি খুশি হয়েছেন নাকি বুঝতে পারি নি। সারাদিন দৌড় ঝাপের পর যখন বিছানায় পিঠ দিয়েছি, ঠিক তখনই দরজার খুটখুট আওয়াজ। আমার স্বামী দরজা খুলে দিতেই দেখি শাশুড়ি মা দাঁড়ানো। বিছানায় বসেই জিজ্ঞেস করলাম,

__ " মা কিছু লাগবে! "

__ " রুমে একা শুতে অস্বস্থি হচ্ছে...."

শাশুড়ি মা আমতা আমতা করে বললেন। মুচকি হেসে কোন কথা ছাড়াই বালিশ নিয়ে চললাম উনার রুমে। যে মানুষটা কখনো তার ধোয়া কাপড় ধরার অনুমতি দেয় নি আমাকে, যার বিছানায় বসার সাহসটাও কখনো আমার ছিল না। সে আজ তার সাথে শোয়ার জন্য ডাকছে আমায়। জীবনের চক্রটা সময়ের সাথে সাথে কত ঘুরে যায় তাই না।

 

ছেলের বউটা বুকে জড়িয়ে কতক্ষন যে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ছোট বেলায় মা হারিয়েছি, শাশুড়ির মাঝে এত এত খুঁজেও মায়ের ছায়া পাই নি। খুব ইচ্ছা ছিল একটা মেয়ে হলে তাকে মা ডাকার। কিন্তু সেই ইচ্ছায় পানি দিয়ে দুই পুত্রের জননী আমি। মায়ের জন্য যে কত তীব্র নেশা থাকতে পারে, সেটা আমি ছাড়া হয়তো কেউ বুঝবে না। আজকে আমার চোখের পানি, কেন জানি না পাশের মানুষটাকেও ছুঁয়ে গেছে। তার চোখের কোনাতেও জমেছে নোনা পানির দানা। বিয়ের পরেরদিনই ছেলের বউয়ের হাত ধরে সারা ঘর ঘুরে দেখালাম। বললাম,

___ " মাগো আজ থেকে এই ঘর তোরও,যখন যা ইচ্ছা হয় করবি। আর হ্যাঁ সাথে আমারেও রাখবি। "

পাগলি মেয়েটা গলা জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে উঠেছিল। কিছু না বলেই যেন অনেক কথা বলে গেল। এখন নিয়ম করে হাঁটতে যাই বউয়ের সাথে, সপ্তাহান্ত একবার শপিং তো মাস্ট। সাথে থাকে ফ্রিজ ভরা মিস্টি, আমার মেয়েটা আমারই মতন মিস্টির পোকা। সেদিন শুনতেছি ছেলে তার বউকে অনুযোগ করতেছে, " মা তোমাকেই বেশি ভালোবাসে। অবস্থা দেখে মনে হয় আমি হলাম মেয়েজামাই! "। সেদিন দুই মা মেয়ে মিলে গল্প করতে করতে আমার রুমেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। সকালে উঠে দেখি বাপ ছেলে দুইজনেই মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। তাদের অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে আমি শেষ। 

 

আমার এই চাঁদের হাট দেখে, আমার শাশুড়ি মা কেমন জানি না আনমনা হয়ে যান। উনি এখন বেশিরভাগই আমার সংসারেই থাকেন।উনাকে দেখলেই কেন জানি না অতীতটা খুব বেশি মনে পড়ে যায়। যখন আমি আর বউমা ডাইনিংয়ে বসে গল্প করতে করতে, হেসে লুটিয়ে পড়ি। উনি উঁকি দিয়ে দেখেন। কিন্তু কেন জানি না নিজের বানানো দেওয়াল ভেঙ্গে বের হতে পারেন না। আফসোস হয়তো মনে মনে করেন, কিন্তু সেই আফসোস মেটাতে পারেন না। খুব ইচ্ছা করে যেয়ে শাশুড়ি মাকে বলি, " আসেন না আমার কাছে, ভাঙেন না অনার্থক সৃষ্টি করা দেওয়ালটা " এক বুক আশা নিয়ে গিয়েছিলাম আপনার ঘরে,আপনি সেই আশাটুকু গলা টিপে ধরেছিলেন। সেই আশা নিজের ঘরে এসে পূরণ হয়েছে। কিন্তু আপনার হাহাকার এখনো তো মেটেনি শাশুড়ি মা। 

 

আপনি এখনো আমার শাশুড়ি মা, কখনোই শুধু মা হয়ে উঠতে পারেন নি। যখন তার কাছে আমি ছিলাম, তখন বুক ভর্তি হাহাকার ছিল আমার। সে হাহাকার কাউকে ছুঁয়ে যেতে পারে নি। আজ সে আমার কাছে, কেন জানি না তার হাহাকারটা আমায় ছুঁয়ে যায়৷ তারপরও আমি পারি না তার সেই অপ্রাপ্তিটুকু পূরন করতে।

 

#হাহাকার 

 


Akhi Akter Mim

313 Blog posts

Comments