ক্যাফে খাওয়া

Comments · 6 Views

হাজারো মানুষ আছে যারা দিন শেষে বাড়ির খাবারের থেকে বাহিরের খাবারকে প্রাধান্য দেয়।

আমাদের বাসায় প্রতিবার বাইরে খাইতে গেলে, এক প্রকার মারামারির মতন বেঁধে যায়। ধরেন আমি চাইনিজের বিশাল ফ্যান তো ভাইয়া হচ্ছে দেশি খাবারের এসি৷ আবার আমার বড় আপু আর মিলি তারা দুইজন কাবাব আর নানরুটির এতবড় ফ্যান যে, মাঝে মাঝে দুইজন মিলে আলোচনা করে এই বলে যে, বিয়ে বসলে কাবাবের রান্ধুনির সাথেই বসবে। খালা এসব কিছুই পছন্দ করে না, সে আল্লাহর দুনিয়ার যেখানেই যাক না কেন ভাত ভর্তা শুটকি এসব খাবে। আমার খালুর ভাষ্যমতে, তারে যদি জান্নাতে দেওয়া হয়, তখনও সে উপরওয়ালার কাছে ভর্তাই খাইতে চাইবে। খালার ট্রাক রেকর্ড এতই ভালো যে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে যেয়েও সে ভর্তা খোঁজে মেনুতে, আর সেটা না পেয়ে মাথা ঝুলায় আর বলে,

___ " রোম্বা খাওয়াইতে লইয়া আইছে আমারে "। 

মাঝখানে খালু বেচারা পড়ে গ্যাড়া কলে সে যে কোন পক্ষে যাবে, সেটা নিয়েই ভাবতে ভাবতে দিন শেষ। বউয়ের পক্ষে গেলে পোলাপান অনশনে বসে। আবার পোলাপানের সুরে সুর মিলালে খালা হোপ দিয়ে বসে থাকে৷ আল্লাহ মাফ করুক যদি কখনও প্লান হইতো, যে বাইরে যাবো খাইতে তখন শুরু হতো কাহিনি। কেউ মুখ ফুলাইছে, কেউ ঠ্যাং উপরে মাথা নিচে দিয়ে পড়ে আছে আরো কত কি! লাস্ট মোমেন্টে খালা বাঁধাইতো ক্যাঁচাল, উনি অল্প দামে অধিক টেকসই কাকলি ফার্নিচার চাইতো। মানে হইল উনি যাবেন হোটেল সালাদিয়াতে সেখানে টাকাও কম খাওন ভালা। 

 

যাই হোক অবশেষে আমাদের বাসার এই সমস্যার সমাধান পাওয়া গেল একদিন। আমার খালু মাসের স্যালারি পাওয়ার পরেই ঘোষণা দিলেন, সে আমাদের নিয়ে বাইরে খাইতে যাবেন। বরাবরের মতন আমার জোর দাবি, "চাংপাই রেস্টুরেন্টে যাইমু"। আমারে সেই দাবি মোটামুটি ফুঁ দিয়ে উড়ায়ে ভাইয়ার কথা হলো সে " হীরাঝিলে " যাবে৷ মিলি আর বড় আপুর কথা হলো পুরান ঢাকার " ইসলাম কাবাব ঘর " তাদের কলিজা ঠান্ডা করা ডেস্টিনেশন। খালা বরাবরের মতন চুপ, কিন্তু খালু এবার সরব। 

___ " দেখ মাতারিরা, তোগোরে এমুন এউক্কা যায়গায় লইয়া যাইমু, যেহানে বেবাকের বেবাক জিনিস থাকবো "।

খালু এই কথায় মোটামুটি সারারাত ধরে চার ভাইবোনের ঘুম চাঙ্গে, এমন কোন জায়গা আছে, যেখানে সব একসাথে পাওয়া যায়। প্রতিবার দেখা যায়, চাইনিজ পাওয়া যায় তো কাবাব গাট্টি নিয়ে সেই এলাকা ছাড়া হইছে। আবার কাবাব পাওয়া গেলে ভর্তা খোঁজ খবর নিয়ে হারায়ে গেছে। খালুর এই অফার শুনে খালাও মোটামুটি বেশ আগ্রহী। সে নানান ভাবে তেল দিয়ে খালুর কাছ থেকে সারপ্রাইজ সম্পর্কে জানার ট্রাই করেছে, শেষমেষ না পেরে সে হুমকির রাস্তায় নামছে। কিন্তু খালু মোটামুটি এবার মুখে আলু দিছে। সারপ্রাইজ এবার সে দিয়েই ছাড়বে। যাই হোক পরের দিন বিকালে দুই সিএনজি রওনা দিলাম ধানমন্ডির দিকে। এক সিএনজিতে আমি বড় আপু আর ভাইয়া, অন্যটায় খালা খালু আর মিলি৷ সিএনজিতে উঠার পর পরই ভাইয়া একটু পর পর মাথা ঝুলায় আর বিড়বিড় করে কি জানি বলে। ভাইয়ার এই অবস্থা দেখে বড় আপু শেষ মেষ বলেই ফেলল, 

___ " ভাইয়া এমন করে মাথা ঝুলাইও না তো টুপ করে ঘাড় থেকে মাথা খুলে কোলের উপরে পড়বে৷ "

___ " আর মাথা খুলে পড়া...., বাচ্চাকাচ্চা কয়দিন পরে বলবে বাপ দাদা ঘুষখোর ছিল! যে লোক দুই হাজার টাকার বেশি খুয়ায় না, সে আজকে ধানমন্ডি নিয়া যাইতেছে ট্রিট দিতে।কেমনে কি! "

ভাইয়ার কথায় অবাক হয়ে আমি আর বড় আপু ঘুরে ওর মুখের দিকে তাকালাম। এদিকে সিএনজিওয়ালাও গাড়ি চালাইতে চালাইতে সামনের আয়নায় আমাদের দেখার ট্রাই করতে লাগলো।

___ " ভাইয়া তুমি বিয়ে করছো??? বাচ্চাও আছে? ইয়া আল্লাহ বলো নাই তো। "

আমি এই কথা বলে সারতেই বুঝলাম না ভাইয়া আর বড় আপু দুইজনই কটমট করে আমার দিকে তাকালো। ভাইয়া এবার সিএনজির ড্রাইভাররে বলল,

___ " ড্রাইভার সাহেব আপনার নাম কি? "

___ " আহাম্মেদউল্লাহ..! "

___ " আহাম্মকউল্লাহ ভাই, আপনি সোজা পাবনা যান, সাথে এক পাগল ভদ্রমহিলা আছে। তারে পাবনা ভর্তি করে এর পর আমরা ধানমন্ডি ফিরবো। "

ভাইয়ার কথা শুনে এবার বড় আপু আমি আর ড্রাইভার তিনজনেই ওর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালাম৷ নিজের নাম আহাম্মেদ থেকে আহাম্মক হইছে এই দুঃখে বা পাবনা যাওয়া লাগবে সেই শকে ড্রাইভার ক্ষেপে যেয়ে বলল, 

___ " এক্কেরে চুপ কইরা বসেন আমনেরা, এমুন করলে কিন্তু একসিডেন্ট হইয়া যাইবো। "

এরপর সে বিড়বিড় করতে করতে বলল, " আজকে যে কার মুখ দেইক্ষা ঘরের থন বাইরাইছিলাম রে! "

ড্রাইভারের সেই ভয়াবহ হুমকিতে মোটামুটি স্পিক নট হয়ে বসলাম।

 

সিএনজির ভাড়া দিতে গেলে, ড্রাইভার পুরা ১০০ টাকা বেশি নিলো আমাদের কথার কাফফারা হিসাবে৷ তার ভাষ্যমতে আমরা তারে আর একটু হলে মেরেই ফেলতাম। যাই হোক বেশ বড় সড় একটা বাফেট রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম, খালু আর ভাইয়া এর আগে ব্যুফে ট্রাই করলেও আমাদের জন্য সেটা ছিল একদম নতুন এক্সপেরিয়েন্স। আমরা তো ঢুকেই অবাক এত এত খাবার থরে থরে সাজানো, দেখলেই চোখের সাথে মনও ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। সবাই যখন এক টেবিলে যেয়ে বসলাম, এবার খালু বলল, 

___ " চলো সবাই খাবার নিয়ে আসি। "

___ " হ্যাঁ ক্যা আমরা যামু ক্যা! এত টাকা দেতেয়াছি খাওন টেবিলে আইন্না দিয়া যাইবে! "

খালা মোটামুটি গোঁ ধরে বসলো। এখন যতই তারে ভাইয়া আর খালু বুঝায় তার এক কথা সে যাবে কেন। এদিকে প্লেট নিয়ে ততক্ষনে আমরা তিনবোন ফুড কাউন্টারের সামনে। এত খাবার দেখে মুখ তো ভালোই মাথাও কেমন জানি ৩৬০° তে ঘোরা শুরু করছে। কি যে নেবো আর কি যে খাবো তাই ভাবতে ভাবতে দশমিনিট পার। পরে বহুত চিন্তা ভাবনা করে আমি মোটামুটি প্লেট ভরে স্প্রিং রোল আর অন্থন নিয়ে টেবিলে হাজির। আমার প্লেট দেখে ভাইয়া মুখ বাঁকায়ে শেয়ালের মতন খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে হাসতে বলল, 

___ " তুই কি খালি এই আটা ভাজা খাবি নাকি, অন্য কিছু খাবি না?"

মনডায় কইলো গরুডারে সেই আটা ভাজা ছুড়ে মারি৷ কিন্তু কিছু বলার আগে দেখি মিলি প্লেট ভর্তি করে ফুচকা নিয়ে আসছে। আর বড় আপু কাবাব নান রুটি আর সালাদ। খালার প্লেটের দিকে তাকায়ে দেখি, সেখানে দুই তিন পদের ভর্তা আর ভাত। আর আমার ভাই মাশাল্লাহ প্লেট টুয়াটুয়া করে খালি গরুর মাংস নিয়ে আইছে। খালু ভাইয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকায়ে বলল, 

___ " তুই কি নিজের মানুষ পদবি বাদ দিয়ে, রাক্ষস পদবি নিছত নাকি?"

___ " আম্মা দেখছেন আব্বা কি কি বলতেছে আমারে! "

ভাইয়া এবার খালার কাছে বিচার দিলো৷ অনেকক্ষন যাবত দুই বাপ পুতের কথা শুনে বিরক্ত হয়ে ফিসফিস করে বলল, 

___ " রাক্ষস আর রাক্ষসের বাপ দুইটাই একদম চুপ। ছাতার জায়গায় নিয়ে আইছে, না আছে লবন না আছে টালা মরিচ। "

খালু এবার বিস্ফারিত চোখে তাকালো খালার দিকে। নির্ঘাত মনে মনে ভাবতেছে, কি এক চিজ বিয়া করছে যে ব্যুফেতে এসেও টালা মরিচ আর নুন চায়। 

 

খালার ঝাড়ি হোক আর পেটের ক্ষিধায় হোক সবাই মোটামুটি চুপচাপ করে খেতে লাগলাম৷ তিনটা স্প্রিং রোল চাবানোর পরে চোয়াল কেমন জানি আমারে অভিশাপ দেওয়া শুরু করলো। মিলির দিকে তাকায়ে দেখি ও খাওয়া বাদ দিয়ে সামনের টেবিলের দিকে তাকায়ে আছে। ওর দেখাদেখি ওদিকে তাকায়েই দেখি.... এক মহিলা মিনিমাম চাইর প্লেট খাওন নিয়ে বসা। দেখতে তালপাতার সেপাই কিন্তু খাইতেছে সেই লেভেলের।  

___ " এতডি খাওন যাইতেছে কই রে?"

ভাইয়ার কথা শুনে খালু এবার দাঁত কিড়মিড় করে বলল, 

___ " আরেক মাতারির খাওন না দেইখা নিজেরে দেখ। তুই তো নির্ঘাত পলিথিন বানছত। নাইলে তিন প্লেট মাংস গেল কই "।

___ " আমার পোলারে না বইলা, নিজের প্লেটের দিকে তাকাও। কোদাইল্লা দাঁতের লোক একটা...... খাবার আনার কি ছিরি! একপাশে ভাজা ভাত, তার পাশে ডাইল ভুনা, ওই পাশে কাবাব। তার পাশে কেক৷ বাপের জন্মে শুনি নাই যে কেউ ফ্রাইড রাইস, ডাল চচ্চড়ি আর কেক এর সাথে কাবার সাথে গিলে।"

খালার কথা শুনে আসলেই খালুর প্লেটের দিকে তাকায়ে দেখি, উনি কেক আর ফ্রাইড রাইস একসাথে নিয়ে বসে আছে। কোন রকমে এক ঘন্টা হালকা পাতলা খেয়েই পেট ঢোল। সামনে এত এত খাবার, কিন্তু ওদিকে তাকালেই মনে হচ্ছে মাথা ঘুরতেছে। ভাইয়া এবার এক প্লেট ভর্তি করে চিকেন ফ্রাই নিয়ে এসে হাজির। হাতে চামচ আর প্লেটে চিকেন ফ্রাই নিয়ে যেই না খাওয়ার মিশন শুরু করতে যাবে, হঠাৎই চিকেন ফ্রাই কেন জানি না হেলিকাপ্টারের মতন উড়াল দিল। আর উড়ে যেয়ে পড়লো একদম ঠিক অপজিটে থাকা খালুর কোলের উপরে। এবার খালু খাওয়া বন্ধ করে কটমট করে ভাইয়ার দিকে তাকায়ে বলল, 

___ " লাট সাহেবের নাতি, কষ্ট করে হাত দিয়ে খান চিকেন ফ্রাই। এই বাপের জন্মে কাউরে দেখছেন কাঁটা চামচ দিয়ে ফ্রাই খাইতে৷ "

 

ভাইয়া আর খালুর এসব কাহিনীর মধ্যেই, মিলি আফসোস করে বড় আপুরে বলল, 

___ " বড় আপু ফুচকা এমন করে না দিয়ে, বাসায় পার্সেল করে নিয়ে যাওয়া গেলে ভালো হইত। "

বড় আপুর মুখ দেখে মনে হইল, উনিও কাবাব পার্সেল করে নিয়ে যাইতে দিলে অখুশি হইত না। কামের কাম করছে ভাইয়া, মিনিমাম দুই কেজি মাংস খাইছে। তার পেটরে দেখলে মনে হইতেছে ছোট খাটো সাইজের একটা মাইট। আমাদের সবার মাঝে খালুর চেহারাই কেন জানি না ভচকায়ে গেছে। একটু পর পর বুকের বা পাশটা টিপে ধরতেছে। ব্যুফে শেষ হওয়ার বেশ আগেই আমরা বের হয়ে আসলাম। 

 

বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে, সবাই গোল করে বসলাম ড্রইংরুমে। খালু আসতে চাইছিল না মোটেও, তারপর মিলি জোর করে খালুরে ধরে নিয়ে এসে বসালো আমাদের সাথে। খালা চোখ মুখ কুঁচকে বলল, 

___ " চেহারা দেখলে মনে হইতেছে, মুখের উপরে কে জানি রাস্তা সমান করার মেশিন চালায়ে সমান করে দিয়ে গেছে। "

___ " আম্মা আব্বারে এসব বইলেন না, আব্বার কি দোষ এইখানে। উনি তো এমন না উনার চেহারাটাই এমন। "

ভাইয়া খালুরে ঠেস দিয়ে হাসতে লাগলো। 

___ " না রে বাপ আমার চেহারাতো এমনই, আর তোর চেহারা তো খুব সুন্দর এক্কেবারে রাক্ষসের মতন। "

খালু দাঁত পিষে পিষে বলল। খালা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠলো,

___ " যা মন লয় হ্যা কইতেয়াছে। করছি ডা কি তোমারে? "

___ " কি করছে তাই জিজ্ঞেস বলে জিজ্ঞেস করে এই মহিলা। একেক জনের ১২শ টাকা করে খাওয়ার বিল নিল। একজন ফুচকা খাইয়া পেট ভরাইছে, আরেকজন পান্তা ভাত ভর্তা আর টালা মরিচ খাইলো। "

এটুকু বলে খালু দম নিলো। আমরা সবাই মোটামুটি পড়ে না চোখের পলক দিয়ে খালুর দিকে তাকানো। এজন্যই বেচারারে বিল নিয়ে এত বার জিজ্ঞেস করার পরেও কোন শব্দ করে নাই। কথা না বলার কারণ এখন বুঝলাম।

___ " শুধু কি তাই, একজন উল্টা খরচ বাড়ায়ে নিয়ে আইছে। যত স্প্রিং রোল আর অন্থন আছিলো সব চাবাইছে। এখন সারা রাস্তা শুনছি তার মাড়ির চামড়া গেছে দাঁতে ব্যাথা করতেছে। "

কথাগুলো খালু আমার দিকে তাকায়ে বলল। কিছু না বলে চুপচাপ নিচের দিকে তাকায়ে রইলাম। আসলে খালুর কথাগুলো চরম সত্যি। দাঁত আর মাড়ি সত্যিই চরম ব্যাথা আর জ্বালা করতেছে। 

___ " আর কি আরেকজন টাকা উসুল করতে যেয়ে রাক্ষসের মতন খালি মাংস গিলে আমারে উদ্ধার করছে। বিল দেওয়ার সময় ম্যানেজারটা পারে না আমারে চোখ দিয়ে ভস্ম করে দেয়। আল্লাহ এগুলারে নিয়ে নি আমি গেছিলাম ব্যুফে খাইতে?!"

খালুর স্বর শুনে মনে হইলো উনি যেন উপরওয়ালার কাছে আমাদের নামে বিচার দিতেছেন। 

 

 

Comments
Read more