সকালের নাস্তা

সকাল টা শুরু হয় সূর্যের উদয়ের সাথে।তারপর ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে কতশত গন্তব্য মানুষ ছুটে।

আমাদের বাসায় সকালের নাস্তার সময় কঠিন এক ক্যাঁচাল বাধে। আমার ফিটনেস সচেতন বড় আপু খায় সিদ্ধ করা সবজি, আমার গুনধর ভাই সে খায় ছয়টা ডিমের ওমলেট প্লাস পরোটা৷ মিলি সে খায় পাউরুটি আর জেলি, খালু যা পায় তাই খায় আর আমি..... আমি তো মাশাল্লাহ ডায়েটের মেনু কার্ড নিয়ে বসি, ওটসের সাথে এই সেদ্ধ সেই সেদ্ধ হাবিজাবি। মাঝখান থেকে খালার বাজে বারোটা, বেচারি সেই ছয়টায় ঢোকে রান্না ঘরে আটটায় বের হয়। আর একটু পরপরই গজর গজর করতে থাকে,

___ " আমি হইছি এই ঘরের কামের পারমানেন্ট বান্দি, বুয়ারা তো কাজ ছেড়ে অন্য জায়গায় কাজ নিতে পারে কিন্তু আমারে তো দলিল দস্তাবেজ করে কওলা করে নিয়ে আসছে। ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারি না কোথাও..."। 

এই টাইপের কমন ডায়লগ সে দিতেই থাকে, একদিন ভাইয়া বলল,

___ " আম্মা এক কাজ করি আপনার তো অন্যজায়গায় যাওয়ার খুব শখ, এক কাজ করতে পারেন। আপনারে আমি কয়েক বাসার কাজ যোগাড় করে দেই। কাজও হইল সাথে টাকাও হইল। এখন এক কাজে ১০০০ টাকা নেয় বুয়ারা! "

এটুকু বলার পরে পুরো টেবিল জুড়ে যেন শোকের বাড়ির মতন নিরবতা নেমে আসে। খালার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, মুখের কালার একবার লাল হচ্ছে আরেকবার বেগুনী হচ্ছে। বুঝলাম আজকে সুনামি না হলেও আইলা আসবে মাস্ট। ভাইয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম এতক্ষন পর ও বুঝেছে, কি ভুল সে করেছে। কিন্তু ওই যে কথায় আছে বন্দুকের গুলি আর মুখের কথা সেইম জিনিস। একবার বের হয়ে গেলের আর ফিরিয়ে নেওয়ার উপায় নেই। কোনরকমে ঢোঁক গিলে ভাইয়া বলল, 

___ " আম্মা আমি আসলে কথাটা এম্মে করে কইতে চাই নাই। হইছে কি.... " 

___ " থাকুক তোর আর কিছু কওয়া লাগবে না। "

খালা এতটুকু কথায় বুঝলাম বিশাল এক বিপদ ইজ কামিং সুন। খালা আস্তে করে একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, 

___ " কালকে শুক্রবার সকালের নাস্তা বানাবে জয়, ঘর মোছা আর থালাবাটি ধোয়া বাবুর, নুমা তুই দুপুরের রান্না করবি। মিলি বিকালের নাস্তা আর রাতের খাবার।"

এটুকু বলেই খালা চলল তার নিজের রুমে। আজকে কেন জানি না মনে চাচ্ছে গলা ছেড়ে ভেউভেউ করে কাঁদি। লাইফে সবচেয়ে অপছন্দের কাজ হলো এই ঘর মোছা সেই কাজই আমার উপরে দিল। সব..এই সব দোষ ভাইয়ার। এদিকে দেখে বড় আপু আর মিলিও ভাইয়ার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। 

মিলি দাঁত পিষতে পিঁষতে বলল, 

___ " এই সব দোষ তোমার, আম্মারে মাইনষের বাড়ির বুয়া বানাইতে গেছিল। এখন এই বাড়ির পারমানেন্ট বুয়া বানাইছে আম্মা আমাদের।"

___ " আরে আমি তো এমনই কইতে গেছিলাম... "

ভাইয়া কেমন জানি সাফাই দিতে গেল৷ তার আগেই বড় আপু বলল, 

___ " তোমার এই এমনেই তো দেখছ কেমনেইই হয়ে গেছে। কালকে আমি সারাদিন ঘুমাবো আমার ভাগের কাজ তুমি করবা! "

এটুকু বলেই বড় আপু সোজা রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলো। মিলিও পিছ পিছ যেতে যেতে বলল, 

___ " আগের হাল যেদিকে যায় পিছের হালও সেদিকেই যায়। "

ভাইয়া করুন চোখে আমার দিকে তাকাতেই, আমি বললাম, 

___ " আমি মাফ চাই,। "

___ " বইন বিশ্বাস কর কালকে তুই শুধু আমার সাথে থাকবি, তোরে নগদ দুই হাজার টাকা দেবো "।

টাকার লোভেই হোক আর ভাইয়ের ভালোবাসাতেই হোক কোন কুক্ষনে যে সেই অফারে রাজি হইছিলাম সেটা পরের দিন টের পাইছিলাম। 

 

পরের দিন সকাল সাতটায় ভাইয়া মোটামুটি টেনে আমারে বিছানা থেকে ধরে রান্না ঘরে নিয়ে গেল। মুখ হাত না ধুয়েই আমি রান্নাঘরের সিংকের পাশে বসে ঢুলতেছি। ভাইয়া বেশ উৎসাহ নিয়ে যে কাজ করতে নামছে সেটা ওর গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। 

___ " শোন বাবু শুক্রবার দিন মানেই স্পেশাল খাওন, আজকে এমন কিছুই একটা করে আম্মারে তাক লাগায়ে দিতে হবে। "

পাউরুটির প্যাকেট ছিড়তে ছিড়তে বলল ভাইয়া। আমি শুধু ঢুলছি আর হু হু করছি।ঘুমের চোখে দেখলাম ভাইয়া খালি ডিম ভাঙতেছে৷ কিন্তু করতেছেটা কি সেটা কেন জানি না বুঝতেছি না। এবার ভাইয়া চরম বিরক্তি নিয়ে বলল,

___ " এই তুই যা তো, যা যা ঘুমা গিয়া। আমি একাই একশ। "

ভাইয়ার এই কথা বলতে দেরি আর আমি যেন বিছানায় যেতে দেরি নাই। বিছানায় শুয়ে কতক্ষন ঘুমিয়েছি মনে নাই, কিন্তু মনে হলো কে জানি আবার ডাকতেছে। চোখ খুলেই দেখি ভাইয়ার হাসি হাসি মুখ, বলল 

___ " তাড়াতাড়ি ওঠ সবাই নাস্তা কিন্তু রেডি আমার।"

ভাইয়ার অতি উৎসাহে হোক কিংবা খালার ভয়েই হোক তাড়াতাড়ি সবাই ফ্রেশ হয়ে টেবিলের দিকে ছুটলাম। যেয়ে দেখি খালা খালু আগের থেকেই চুপ করে বসে আছে। ডাইনিং টেবিলে বড় বড় তিনটা বাটি ঢাকনা দিয়ে ঢাকা। কিন্তু ভেতরে যে কি আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। খালা আড় চোখে ভাইয়ার দিকে তাকাতেই ও বলল, 

___ " আজকে ছুটির দিন, তাই আজকে নাস্তাটাও স্পেশাল। আমি আজকে বানাইছি স্পেশাল স্যুপ।"

এই বলেই ও একটা বাটির ঢাকনা খুলে দিল। বিশ্বাস করেন লাইফে বহুত কিসিমের স্যুপ দেখছি। কিন্তু স্যুপের কালার যে এমন ডাইলের পানির মতন হয় সেটা বাপের জন্মের জানা ছিল না। 

___ " আমার নেক্সট প্রেজেন্টেশন হলো কিপক্লাপ স্যান্ডুইচ। "

এই বলে আরেক বাটির ঢাকনা খুলে দিল। বস্তুডা কি জিনিস তার বের করার আগেই আরেক বাটির ঢাকনা খুলল। 

___ " আর হ্যাঁ শেষ পাতে মিষ্টি না হলে কি জমে, আর করেছি ডিমের হালুয়া।"

খালু কিছু না বলে বিশাল এক দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলল। বউ আর ছেলের দ্বন্দ্বে বিনা কারণে বেচারা পিষতেছে। ভাইয়া নিজ দ্বায়িত্বে সবার পাতে পাতে সেই ডাইলের পানি থুক্কু স্যুপ, ক্যাট ক্যাট স্যান্ডুইচ আর সেই হালুয়া বেড়ে নিল। বড় আপু আর মিলির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুইজন চামচ দিয়ে আবিষ্কার করার চেষ্টা করতেছে জিনিসটা কি। খালা এখনও চুপচাপ বসে ভাইয়াকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেছে। ভাইয়া কিন্তু বিশাল উৎসাহ নিয়ে সবাইকে খাওয়ার জন্য বলতেছে। অগত্যা না পেরেই খালা বাদে আমরা সবাই বিসমিল্লাহ করলাম স্যুপ দিয়ে। এক চামচ স্যুপ মুখে দিয়েই বুঝলাম লাইফের সবচেয়ে বড় ভুল আজকে করেছি ঘুম থেকে উঠে। স্যুপটা মুখের মধ্যে যেয়েই যেন গ্রেনেডর মতন বিষ্ফোরণ করলো। প্রচুর ঝাল আর মিস্টির কম্বিনেশন সাথে টক টক ফ্লেভার শুধু তাইই না মনে হচ্ছে টক মিষ্টি ঝাল ফ্লেভারে ডাইল খাইতেছি। কোনরকমে কোঁৎ করে গিলে খালুর মুখে দিকে তাকাতেই বুঝলাম বেচার অবস্থা আমার চেয়ে খারাপ। বড় আপু ঢকঢক করে পানি গিলতেছে। আর মিলি হাঁ করে নি:শ্বাস নিচ্ছে। খালার চোখে চোখ পড়তেই বুঝলাম, এই মহিলা আমাদের অবস্থা দেখে পৈশাচিক আনন্দ পাইতেছে। 

স্যুপের আশা বাদ দিয়ে স্যান্ডুইচ হাতে নিয়ে বুঝলাম এ আরেক চিজ, পাউরুটিরে চেপে চেপে লোহা বানায়ে ফালানো হইছে৷ 

___ " আব্বা স্যান্ডুইচটা খান, আমি নিজের হাতে বানাইছি। "

ভাইয়া বেশ উৎসাহ নিয়ে বলল খালুরে, ছেলের অনুরোধ রাখতেই হোক আর বউয়ের অগ্নি দৃষ্টি দেখেই হোক খালু এক কামড় দিলেন। 

আমরা তিন বোন বেশ আগ্রহ নিয়ে খালুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি বুঝতেছি নেক্সট এক্সপ্রেশন আর যাই হোক না কেন ভালো হবে না। খালু সেই স্যান্ডউইচ নিয়ে একবার এদিক টানে তো আরেকবার সেদিক টানে। কিন্তু স্যান্ডুইচ তো আর ছেঁড়ে না। ভাইয়া শেষ মেষ বলেই ফেলল, 

___ " আব্বা আপনার দাঁতের জোর কি কমে গেছ্র নাকি "।

___ " বাপরে আমি তো আর বাঘ না যে, ডেইলি কাঁচা গোস্ত টেনে ছিঁড়ে অভ্যাস আছে দাঁতে। এমনিতেই বয়স হইছে দাঁত পড়ে গেলে আরেক ভেজাল। "

মাড়ি চেপে ধরে কোঁকাতে কোঁকাতে খালু বলল। 

___ " আব্বা চাকু এনে দেই.... স্যান্ডুইচ কেটে তারপর খান। "

___ " হ তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়, সুই*সাইড করি এই ভেবে যে কেন তোরে জন্ম দিছিলাম! "

এত সমস্ত কথার মাঝে খালা যেন পাথরের মূর্তির মতন বসে আছে। হাঁ ও করে না হুঁ ও করে না। লাস্টে ভাইয়া কাঁদোকাঁদো স্বরে খালারে বলল,

___ " আম্মা দেখেন এত কষ্ট করে সব কিছু বানাইলাম এরা সবাই কি কি বলতেছে আমারে। আপনি একটু ডিমের হালুয়াটা ট্রাই করেন৷ "

আল্লাহর দুনিয়ায় যত যাই হোক মায়ের মন তো ছেলের কথাতে মনে হয় একটু গললো। 

___ " আচ্ছা দে তোর হালুয়া! "

এই প্রথম খালার মুখ দিয়ে কথা বলল। ভাইয়া বিশাল খুশিতে হালুয়া বাড়তে বাড়তে বলল , 

___ " আম্মা বিশ্বাস করেন হালুয়াটা অসাম হইছে। খাইলে আপনি আমারে আপনার দিলটা দিয়ে দিতে চাইবেন। "

এক চামচ হালুয়া মুখে দিতেই দেখলাম খালার মুখটা কেমন মৃগী রোগির মতন হয়ে গেলো। চোখের পলকেই দেখলাম ভাইয়া দৌড় শুরু করলো পিছনে খালা সেই ডাইল স্যুপের বড় চামচ নিয়ে দৌড়াইতেছে আর বলতেছে, 

___ " জানো*য়ারের বাচ্চা লবন কি আর ডিব্বায় আছে না সব হালুয়াতে দিছস। আজকে তোরে মার্ডার করে আমি মাদার বাংলাদেশ হয়ে যাবো।


Akhi Akter Mim

313 Blog posts

Comments