বাণিজ্যের দায়িত্বে আল-আমীন
চাকরি ও ব্যবসার জন্যে মানুষ সবসময় সৎ ও বিশ্বস্ত লোক চায়।
এই ধরনের গুণের লোকের কদর সকলের নিকট। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের কাছে একটু বেশি। যুবক আল-আমীনের প্রশংসা হযরত খাদীজা (রা)-এর কানে পৌঁছতে দেরি হলো না। হযরত খাদীজা (রা) তাঁর ব্যবসা পরিচালনার জন্যে এমন একজন যুবককেই খুঁজছিলেন।
আল-আমীন হযরত খাদীজা (রা)-এর দূর সম্পর্কের চাচাত ভাই। যুবকটি যেমন সৎ ও বিশ্বস্ত তেমনি জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান। বৈদেশিক বাণিজ্যের ভার তাঁকে দেয়ার জন্যে খাদীজা মনে মনে স্থির করলেন। মনে আছে তো আল-আমীনের আসল নাম?
হ্যাঁ, তাঁর আসল নাম মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ।
তারপর একদিন হযরত খাদীজা (রা) তাঁকে ডেকে এনে বললেন : আমার তেজারতির দায়িত্বভার আপনাকে দিতে চাই। এজন্যে আমি আপনাকে অন্যের দ্বিগুণ বেতন দেব। কি বলেন, রাজি?
বেকার যুবক হযরত মুহাম্মদ (সা)। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোন রুজি-রোজগারের পথ করতে পারেন না। হঠাৎ এমন চাকরির প্রস্তাব শুনে তার মন আনন্দে নেচে উঠলো। তিনি খু-ব খুশি হলেন। প্রফুল্ল মনে হাসিমুখে তিনি বললেন: উত্তম প্রস্তাব। তবে আমার চাচাজানের মতামত শুনে তারপর আপনাকে উত্তর জানাবো।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম গিয়ে তাঁর চাচা আবূ তালিবকে একথা জানালেন। তিনি শুনে ভীষণ খুশি হলেন। কারণ, তাঁর সাংসারিক অবস্থা সচ্ছল ছিলো না। পরিবারে তিনি ব্যতীত আর কেউ উপার্জনক্ষম ছিলো না। এমন অবস্থায় এতিম ছেলেটির একটি রুজির পথ ধরতে পারলে মন্দ কি? আবু তালিব রাজি হয়ে গেলেন। তারপর তিনি গিয়ে হযরত খাদীজা (রা)-কে চাচার সম্মতির কথা জানালেন। চাকরি করতে রাজি-এ কথা শুনে হযরত খাদীজা খুব খুশি হলেন। তারপর তিনি তাঁকে ব্যবসায় নিযুক্ত করলেন।
বলতে পার, পড়ালেখা না-জানা একজন যুবককে হযরত খাদীজা কেন ব্যবসায় নিযুক্ত করলেন? শুধু সততা, বিশ্বস্ততা ও বুদ্ধির জন্যেই। জান, সততাই গরীবের মূলধন। মিথ্যা সকল পাপের উৎস। সৎ মানুষের কদর সকলের কাছে সর্বকালেই থাকবে। সততাই মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ।মরুর কাফেলা
বাণিজ্যসম্ভার নিয়ে মুহাম্মদ শ্যাম দেশে যাত্রা করলেন। সঙ্গে গেলেন খাদীজার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় খুযায়মা ও প্রবীণ গোলাম মায়সারা। অন্য বণিকদের সঙ্গে তাঁরা রওয়ানা হলেন। সব বণিক মিলে তৈরি হলো বিরাট বণিক কাফেলা। এই কাফেলা যাচ্ছে শ্যাম দেশে।
কাফেলা চলছে।
ধূ-ধূ মরুভূমি। চারদিক শুধু বালু আর বালু। মাঝে মাঝে দু'চারটি খেজুর গাছ। আর দেখা যায়, যেন আকাশে হেলান দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি কালো পাহাড়।
দেখতে দেখতে কাফেলা মক্কা ছেড়ে বহু দূরে চলে এলো। বেলা প্রায় দ্বি- প্রহর। সূর্যের তেজ বেড়ে গেছে। প্রচণ্ড রোদে মরুভূমির বালু গেছে তেতে। রোদে চারদিক কেবল খাঁ খাঁ করছে। কোথাও একটু ছায়া নেই। নেই এক ফোঁটা পানির চিহ্ন। রোদ ও পিপাসায় সকলে কাতর হয়ে পড়লো।
কিন্তু কী আশ্চর্য! মুহাম্মদের উপর কোন রোদ নেই। তিনি সব সময় একটা ছায়ার নিচ দিয়ে চলছেন। তাঁর কোন ক্লান্তি নেই। নেই কোন পেরেশানী। ব্যাপার কী! সকলে অবাক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলো। দেখলো, আকাশে এক খণ্ড মেঘ। তারই ছায়া মুহাম্মদ ও তাঁর পাশের কয়েকজনের উপর পড়েছে। কাফেলা যেদিকে যাচ্ছে মেঘ খণ্ডটিও সেদিকে যাচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো-এ সময় তো আকাশে মেঘ থাকার কথা নয়! আর মেঘ থাকলে তো শুধু এক খণ্ড মেঘ থাকার কথা নয়। তারা ভাবল,-উড়ন্ত মেঘ। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো উড়ে কোথায় কোন্ দেশে চলে যাবে। অথবা আকাশেই বিলীন হয়ে যাবে। এতে আশ্চর্য হবার কী আছে?
কিন্তু না, মেঘখণ্ডটি তাঁর উপর থেকে কোথাও যাচ্ছে না। সব সময় মুহাম্মদের উপরই থাকে। তাঁকে ছেড়ে অন্য কোথাও যায় না। এবার সকলে সত্যি সত্যিই অবাক হয়ে গেলো। এ তো এক আজব কাণ্ড। তাদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেলো। এভাবে চলতে চলতে তারা শ্যাম দেশে গিয়ে হাযির হলো।হযরত খাদীজা (রা)
শ্যামে পৌঁছার পর তারা এক জায়গায় তাঁবু গাড়তে লাগলেন। ইত্যবসরে একটু ক্লান্তি দূর করার জন্যে মুহাম্মদ একটি অর্ধমৃত গাছের মূলের উপর বসলেন। তারপর তাঁবু ঠিক করে সকলে বিশ্রাম করতে লাগলেন। কয়েক দিনের মধ্যে ঐ অর্ধমৃত গাছটি আবার তরতাজা হয়ে উঠতে লাগলো। পাতায় পাতায় ভরে গেল গাছটি। গাছটি তাজা করার জন্যে কোন চেষ্টাই করা হয় নাই। মুহাম্মদের বসার পর থেকেই গাছটির পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে-এটা কাফেলার কয়েকজন লোক লক্ষ্য করেছেন। বিশেষ করে মায়সারা খুব ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছে। এ ঘটনা দেখে তারা সকলে তাজ্জব হয়ে
গেলো। তারপর তাঁরা বাণিজ্যের পণ্যসামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় করে অতি অল্প দিনেই স্বদেশ রওয়ানা হলেন। কাফেলা আবার ফিরে চললো মক্কার দিকে। মরুভূমির মধ্য দিয়ে কাফেলা চলছে তো চলছেই।খাদীজা (রা)-এর স্বপ্ন
খাদীজা (রা) এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন।
পূর্ণিমা রাত। আকাশ নির্মল। চাঁদের আলোতে তামাম জগৎ আলোকিত। কী চমৎকার জ্যোৎস্না রাত। আসমানের চাঁদটি রূপোর থালার মতো ঝক্ করছে। সেই চাঁদটি ধীরে ধীরে আসমান থেকে নেমে এসে খাদীজার বুকে আশ্রয় নিলো। চাঁদের আলোতে তাঁর সমস্ত দেহ আলোকিত হয়ে গেলো। তিনি সেই চাঁদকে বুকে চেপে ধরে পরম শান্তি পেলেন। হঠাৎ তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেলো। জেগে দেখেন তিনি একাকী বিছানায় শুয়ে আছেন।
এ কী দেখলেন তিনি। ভাবতে লাগলেন, এ স্বপ্নের ফলাফল কি হতে পারে। তা জানার জন্যে তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো
খাদীজার চাচাত ভাইয়ের নাম অক্কা।
তিনি খুব জ্ঞানী ও বিদ্বান ছিলেন। স্বপ্নের তাবীর তিনি বলতে পারতেন। সকালে খাদীজা তাঁর নিকট গেলেন এবং স্বপ্নের সমস্ত ঘটনা বললেন। অরকা স্বপ্নের বিবরণ শুনে মৃদু হেসে বললেন: তুমি বড় ভাগ্যবতী, বোন। খুব ভালো স্বপ্ন তুমি দেখেছো। এ স্বপ্নের তাবীর খুব ভালো। এমন এক মহাপুরুষ তোমার স্বামী হবেন, যাঁর দ্বারা তামাম দুনিয়ার অন্ধকার দূর হবে। তুমি তাকে চিনতে পারবে। তোমার নিকটেই তিনি ঠাঁই নেবেন। অচিরেই তার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হবে। আর সেই মহাপুরুষই হবেন আখেরী নবী।
স্বপ্নের তাবীর শুনে খাদীজার মন আনন্দে নেচে উঠলো। প্রফুল্ল মন নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরলেন। তারপর থেকেই তাঁর মনে নতুন চিন্তার উদয় হলো। আমার স্বামী হবে! আমি তো আর বিয়ে করবো না। কিভাবে আমার স্বামী হবে। তাহলে কি আমার আবার বিয়ে হবে? না, আর বিয়ে করবো না।
তিনি আবার ভাবতে লাগলেন-মহাপুরুষের সঙ্গে বিয়ে হবে। কে সেই মহাপুরুষ? কে সেই আখেরী নবী? নবী আমাকে বিয়ে করবেন! আমি নবীর স্ত্রী হবো! আমি যে বিধবা! নবী কী আমাকে পছন্দ করবেন? আমি কী তাঁর চরণ সেবিকা হতে পারবো? ভাঙ্গা কপাল কি আবার জোড়া লাগবে? কবে কোন্ দিন তাঁর সঙ্গে দেখা হবে? আর কতো দিন পরে? এরূপ নানান কথা খাদীজার মনে দানা বেঁধে উঠলো। আস্তে আস্তে তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।হযরত খাদীজা (রা)
একদিন মরুপথ পানে তাকাতেই খাদীজা (রা) দেখতে পেলেন, একদল বণিক আসছে। কোন বণিক কাফেলা? মুহাম্মদের কাফেলা নয় তো! সে কি করে হয়? এত তাড়াতাড়ি তাঁদের কাফেলা ফিরে আসার কথা নয়। এর আগে কেউ তো এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসেনি! তিনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
ধীরে ধীরে কাফেলা নিকটবর্তী হলো। দেখলেন, ঠিকই তো মুহাম্মদ ফিরে আসছে। কিন্তু তাঁর সঙ্গীরা কোথায়? তবে কি কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে? তার বুকটা সহসা ধুক্ ধুক্ করতে লাগলো।
এমন সময় আর একটি আজব ঘটনা খাদীজা দেখলেন। এরূপ ঘটনা তিনি ইতিপূর্বে আর কখনও দেখেন নাই। ঘটনাটি এরূপ :
প্রচণ্ড রোদ। অথচ মুহাম্মদ ছায়ায় ছায়ায় আসছেন। ব্যাপর কি? ছায়া পড়ছে কোথেকে? খাদীজা ভাল করে লক্ষ্য করলেন। দেখলেন, বায়ুশূন্যে একখণ্ড মেঘ মুহাম্মদের উপর ছায়া ফেলছে। অথচ আকাশ তখন পরিষ্কার। বৃষ্টি-বাদল হওয়ার কোন লক্ষণই নেই। আর মেঘটিও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আসছে। খাদীজা আশ্চর্য হয়ে গেলেন।
কিন্তু কাউকে কিছু বললেন না। ঘটনাটি দেখে নিজের মধ্যেই চেপে রাখলেন। দেখতে দেখতে মুহাম্মদ এসে হাযির হলেন। তাঁর হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে খাদীজার তাপিত প্রাণ শীতল হলো। কী এক মোহনীয় শক্তি তাঁর মনকে বিগলিত করে ফেললো। খাদীজা এবার শান্তভাবে তাঁর নিকট বসে সব শুনে নিশ্চিত হলেন। মুহাম্মদ সমস্ত টাকা-কড়ি খাদীজাকে বুঝিয়ে দিলেন। খাদীজা হিসেব করে দেখেন-এবার তাঁর মুনাফা হয়েছে দ্বিগুণ। অথচ সময় লেগেছে কম। খাদীজা মুহাম্মদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে উপযুক্ত পুরস্কার দিলেন।
কয়েকদিন পরে খুযায়মা ও মায়সারা ফিরে এলেন। মায়সারা বাণিজ্যের সব ঘটনা খাদীজাকে একাকী ডেকে বললেন। এ সব ঘটনা শুনে খাদীজার মনে আনন্দের বান ডাকলো। মুহাম্মদের আরও কয়েকটি অলৌকিক ঘটনার কথা খাদীজা ইতিপূর্বেও শুনেছেন এবং এবার নিজেও একটি দেখেছেন। এতে মনে হয়, এই মুহাম্মদই আখেরী নবী হবেন। তাঁর যে সব আলামত দেখা যায়-এসব আলামত নবী ব্যতীত অন্য কারো হতে পারে না। সুযোগ জীবনে একবারই আসে। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পারলে সারা জীবন শুধু আফসোস করতে হয়।
মুহাম্মদের কথা ভাবতে খাদীজার খুব ভাল লাগে। তাঁর কথাবার্তা, চালচলন ইত্যাদি সব কিছুই খাদীজার মনঃপূত হতে লাগলো।