জাতীয় পরিচয় পত্র

একমাত্র মানুষের রিয়েল ছবি জাতীয় পরিচয় পত্রে মিলে?

খালার জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবি যেদিন দেখেছিলাম ভয়ে কেঁপে উঠেছিলাম। অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলাম আর মনে মনে বলতেছিলাম, খালার অরজিনাল চরিত্র এই ছবি দিয়ে বোঝা যায়। বিশাল ফোলা ফোলা নাক মুখ যেন ভালুকার ক্ষুদ্র সংস্করণ। তার সেই পিক নিয়ে বাসায় হাসির ধুম পড়ে গিয়েছিল। সে যাই হোক এবার আসি মেইন কাহিনীতে। আমি এন আইডি কার্ড করতে গিয়েছিলাম ২০১৮ তে ফর্ম পূরন করে আসলাম আমি মিলি জিমি আর পরী ভাবি। তারপর আসল সেই প্রতিক্ষিত দিন ভোটার আইডি কার্ডের ছবি তোলার দিন। সকাল নয়টার মধ্যে এ কে স্কুলে উপস্থিত থাকতে বলছে সবাইরে। মিলি জিমিরে সাতটায় টেনে তুললাম পরী ভাবি তখন অলরেডি সাজতে বসে গেছে। আমিও মাশাল্লাহ সুবহানাল্লাহ হিজাব পরি না এই জীবনে সেদিন হিজাব পরব বলে বসে গেছে আয়নার সামনে। মিনিমাম তিন ডজন হিজাব পিন আর হাফ ডজন সেফটিপিন লাগিয়ে হিজাবরে বানাইলাম পাতাকপির মত। চোখে চশমা লাগাইতে লাগাইতে ভাবলাম বাকি তিনজনের চেয়ে আমারে সুন্দর লাগতেছে বেশি। যেই বের হতে যাবো তাকায়ে দেখি বলিউডের নায়িকা আমার পাশে দাঁড়ানো। পরে ভালো করে তাকিয়ে দেখি না না এরা আমারই গুনধর বোনেরা আর ভাবিজানে। রাস্তায় রিক্সা ঠিক করে যখন উঠলাম তখন আমি আর ভাবি এক রিক্সায় বসলাম। ভাবি আফসোস করে বলল,

 " বুঝলা বাবু চাইছিলাম বিয়ের লেহেঙ্গাটা পরে আসব যত যাই হোক সারাজীবনের ইমপর্টেন্ট ছবি ভাল না হলে কি হয়। তোমার ভাই পরতেই দিল না।"

ভাবির কথা শুনে উওর তো পরের কথা হাসবো না কাঁদবো সেটাই ডিসাইডেড করতে পারলাম না। কিছু না বলে মুখ বুজে বসে বসে ভাবতে লাগলাম হায় আল্লাহ এত সুন্দর করে সেজে এসেছে এরা আর আমি বলদে আযমে পাতাকপি বাঁনতে যেয়ে এক ঘন্টা খুয়াইলাম। স্কুলের সামনে রিক্সা থামতেই দেখি বিশাল লাইন। দাঁড়িয়ে গেলাম চারজন লাইনে। খালা বারেবার বলে দিছে মাথায় যেন কাপড় দিয়ে ছবি তোলা হয় না হলে ঘরে ঢোকা অফ। তাই আমি আর ভাবি হিজাব পরে এসেছি। মিলি জিমিও মাথায় ওড়না দিয়ে পিক তুলবে। 

দাঁড়াইতে দাঁড়াইতে মহিলাদের ভ্যানভ্যান শুনতে শুনতে অবশেষে এলো সেই কাঙ্খিত সময়। কিন্তু যে রুমে পিক তোলে সেই রুমে যে মহিলারাই হাসি হাসি মুখে ঢোকে বের হয় বেজার মুখে। ভাবি আমার আগে তাই ভাবি আমি আর মিলি ঢুকলাম এক লাইনে। জিমি পড়ল পরের লাইনে। ভাবিরে কাপড়ের ওপাশে নিতেই শুনলাম কে যেন কইল

"কান বের করেন।"

মনে মনে ভাবলাম ভাবি এমন কি করল যে কান বের করতে বলতেছে ডলা দেওয়ার জন্য। ভাবি একটু কি যেন বলতে যাচ্ছিল কিন্তু লোকটার ধমকে চুপ হয়ে গেল। একটু পরে যখন ভাবি বের হয়ে এলো দেখে আমি আর মিলি ঢোঁক গিললাম। টাইট করে বাধা হিজাব থেকে যদি টেনেটুনে কান দুটো বের করা হয় তখন তারে দেখতে মনে হয় হ্যারি পটার মুভির গ্যাবলিন দের মত৷ যাদের কান হয় ইয়া লম্বা লম্বা। ভাবিরে সান্ত্বনা দেওয়ার আগেই আমার ডাক পড়ল। ভেতরে আল্লাহর নাম নিয়ে ঢুকতেই দেখি টিংটিংয়ে এক লোক বসে আছে। আমাকে দেখেই বলল,

" ডান আর বাম হাতের বুড়া আঙ্গুল দেন। 

এটুকু বলে আর অপেক্ষা না করেই সোজা আঙ্গুল নিয়ে নিজেই এক চৌকোনা বক্সের সাথে টিপে ধরল। তারপর বলল,

 " চশমা খোলেন।".

এবার নি পড়লাম বিপদে। কোন কথা না বলে টেনেটুনে চশমা খুলতেই টের পেলাম বাঁধাকপিওয়ালা হিজাব পশ্চিমে কাইত হয়ে গেছে। চুপ করে চোখের বাক্সে চোখ দিলাম। তারপর ছবি তোলার হট সিটে বসতেই ওই চেঙ্গিস খান টিটি করে বলল,

 " ম্যাডাম কান বের করেন। "

" আমি তো হিজাব পরা।"" যাই হোক কান বের করতে হবে এটাই সিস্টেম।"

লোকটার কথা শুনে মেজাজ এত খারাপ হল যে বলার মত না। উপায় না পেয়ে ভাবির মত অবস্থা বরন করতে হল আমারেও। কান টেনেটুনে বের করে চশমা ছাড়া নিজেরে নিজে কল্পনা করেই আঁতকে উঠলাম। ছবি তোলার পর বের হবার সময় কোন দুঃখে যে ল্যাপটপের দিকে তাকাই ছিলাম আল্লাহ মালুম। মিলি জিমির ছবি তোলার পরে যখন বাসায় এলাম চারজনে খালা মুখে ফিচলে এক হাসি দিয়ে বলল,

" কি ব্যাপার তোদের দেখে মনে হচ্ছে কারো চল্লিশায় গেছিলি। যাওয়ার সময় তো বিয়া বাড়ির সাজে গেলি এখন এই পালা কেন।"

" আম্মা সব সময় খোঁচাইবা না তো।"

মিলি সোজা এক ঝাড়ি দিয়ে রুমে যেয়ে দরজা দিল। আমি নিজেও বিদ্ধস্ত অবস্থায় রুমের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সেদিন সারারাত ঘুমের মধ্যেও আঁতকে উঠেছি। মিলি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেসই করে বসল হইছে কি আমার। কিন্তু আমি চুপ করে রইল ওরে কেমনে কমু আমার কি হইছে। 

অবশেষে সাত মাস পরে একদিন বাসায় চিঠি আসল আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেবে। এটা শুনে কই খুশি হবো তা না সবার মুখ শুকিয়ে আমচুর হয়ে গেল। ভাবি তো না পারতে বলেই ফেলল,

 " এবার সব শেষ, ধার করলে শোধ করতে হয় নির্ঘাত তোমার ভাইয়া এবার টিটকারি মারবে মিনিটে মিনিটে।"

ভাবির কথা শুনে মনে পড়ল এত দিন ভোটার কার্ডের ছবি নিয়ে ভাইয়ারে কত কথাই না শোনাইছি৷ মিলি তো একদিন ভাইয়ারে বলেই ফেলছিল, 

" ভাইয়া এন আইডি কার্ডের পিক দেখলে তোমারে মনে হয় তুমি গত জন্মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের সৈন্যদের ফেলে যাওয়া বারুদ টানতা আই মিন হিটলারের কামলা আছিলা আরকি।"

ভাইয়া কিছু না বলে বলত, 

 " এই দিন দিন না আরো দিন আছে এই দিনেরে যাইতে হবে সেই দিনেরই কাছে।"

আজকেই মনে হয় ভাইয়ার সেই দিন। সবাই যেয়ে যার যার কার্ড এনে বাসায় হাজির৷ আমার কার্ড তো আমি নিজেও খুলি নাই কাউরে খুলতেও দিচ্ছি না। রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটার কাছাকাছি ভাইয়া আসার আগেই আমি মিলি জিমি তিনজনে বিছানায় কাইত। এখন ঘুম না আসলে জোর করে কতক্ষন পড়ে থাকা যায়। মিলি জিমিরও সেইম অবস্থা। একটু পরে টের পেলাম রুমের লাইট জ্বলে উঠলো। পিনপিন করে দেখলাম ভাইয়া এসেছে। মনে চাচ্ছিল চিক্কুর পাইড়া কান্দি। সে যাই হোক ভাইয়া একা না সাথে ভাবিরেও নিয়ে আসছে। ভাইয়া হাঁক দিয়ে বলল ,

" দুই মিনিটে উঠে বসবি না হয়..... "

ভাইয়া সহসা হুমকি দেয় না তাই দেরি না করে লাফিয়ে উঠে দেখি মিলি জিমিও উঠে বসেছে। ভাইয়া মুখে সরল হাসি ফুটিয়ে বলল,

 " আমার সুপ্রিয় বোনেরা যাও তোমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে লাইন ধরে বসে পড়ো।"

পরী ভাবি কি যেন বলতে চাচ্ছিল তার আগে ভাইয়া বলল,

 " পরী তুমিও সসস্মানে আসন গ্রহন করো ওদের পাশে।"

খালার দিকে তাকাতেই বুঝলাম আজ এখান থেকে কোন সাহায্যই পাওয়া যাবে না। অগ্যত লাইন দিয়ে বসলাম নতুন এন আই ডি কার্ডের মালিকরা। আমি সবার শেষে বসে আল্লাহরে ডাকতে লাগলাম। প্রথমে পরী ভাবির কার্ড বের করেই ভাইয়া হাসতে হাসতে ফ্লোরে বসে পড়লো। তারপর কোন মতে বলল,

" পরী তুমি কি জানো এই ছবিতে তোমারে কেমন লাগতেছে? একদম টেলিসামাদের জমজ বোনের মত। "

ভাইয়ার বয়ান শুনে খালাও মুখে হাত দিয়ে হাসা শুরু করল। এর পরে এলো মিলির পালা ওর কার্ড হাতে নিয়েই ভাইয়া বলল,

 " আমার ছবি দেইক্ষা তো কইতি আমি হিটলারের কামলা আছিলাম আর তোর ছবি তো আইছে গুইট্টাখোরে গো লাহান। স্মাগলিং করতে যেয়ে ধরা খাইছিল তখন রাম বানানি দিয়া তোরে খাড়া করাইয়া দিছে ছবি তুলতে।"

মিলি চুপ করে রইল। কারণ এখন কথা বলা মানেই বিপদ। জিমির আইডি কার্ড হাতে নিয়েই ভাইয়া খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লাগল। জিমি কিছু না বলে উদাস মুখে তাকিয়ে রইল। ভাইয়া পরী ভাবির দিকে তাকিয়ে বলল,

" পরী তাজবিয়া যদি কোন দিন খেতে না চায় তাইলে জিমির এই ছবিটা দেখাইও এমনিতেই গপাগপ করে খেয়ে নেবে। জিমিরে তোর পিক স্বাভাবিক মানুষ দেখলেই কোমায় যাইবো গা তো। "

ভাইয়ার মন্তব্য শুনে আমার কেমন জানি হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসতে লাগল। এবার তো আমার পালা আমার কি হবে । ভাইয়া আমার সামনে এসে কার্ডের প্যাকেট হাতে নিয়ে দেখলো এখনও মুখ সিল করা প্যাকেটের। সিল খুলার সময়ই আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। কার্ডের দিকে তাকিয়েই মনে হয় ভাইয়া জোরে জোরে বলে উঠলো,

 " লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।... আল্লাহ গো আম্মা এডা কেডা??? ".

আমিও মনে মনে এমন কিছুই আশা করতেছিলাম। পরী ভাবি আর খালা যেন আমার পিক দেখে আঁতকে উঠলো। আমি নিজেও টানা দিয়ে দেখে পিছিয়ে গেলাম ভয়ে। ভাইয়া বলল," বাবু তোর সাথে কি ওই বেটার কোন দুশমনি আছিল?? "

আমি মাথা নাড়লাম। ভাইয়া তখন ছবির দিকে ইশারা দিয়ে বলল,

" তাইলে এটা কি? তুই জানস তোরে আলিফ লায়লার শারারা গুলের মত লাগতেছে। মনে হয় এক্ষোনে রক্ত খাইয়া আইছত।"

এখন ভাইয়ারে আমি কেমনে কমু নিজের ছবি নিজে দেখেই ভয়ে কয়েকদিন ঘুমাইতেই পারি নাই। 

 

 


Akhi Akter Mim

313 Blog posts

Comments