না পাওয়া ভালোবাসার গল্প

সব ভালোবাসা কি পূর্নতা পায়?

অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম উন্মুক্ত ওই বুকের দিকে, বারবার চেষ্টা করছি চোখ ফেরানোর কিন্তু পারছিলামই না। নিঃশ্বাস যেন খুব ঘন ঘন পড়তে লাগলো, আমার নাক এমনিতেই বাজে ভাবে ঘামে তারপরও এখন মনে হচ্ছে নাক দিয়ে ঘামের ফোয়ারা ছুটে। হঠাৎ করেই যখন সামনের মানুষটা মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো আমার সব কিছু যেন এক নিমিষেই থমকে গেল৷ কোন মানুষের চোখ এত সুন্দর হয়, তাও আবার ছেলে মানুষের......।  

আমি ইরা, পড়ছি এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকে, বাবা মায়ের এক মাত্র মেয়ে হিসাবে আদরের মোটামুটি কোন কমতি হয় নি জীবনে। আমার মামনি হচ্ছে পৃথিবীর যদি সরল সোজা দশজন থাকে তাদের মধ্যে একজন। উনাকে কোন জিনিস যদি পার্ট পার্ট করে ভেঙ্গে না বলা হয় উনি এই জীবনে সেটা বুঝবেন না। যাই হোক আর আমার বাবাই........ আমার চোখে পৃথিবীর সেরা মানুষ হচ্ছে আমার বাবাই। আমার মামনিকে বাবাই ভালোবেসে বিয়ে করেছিল, কিন্তু নানা কেন জানি না সেটা মানতেই পারে নি। তাই কখনও তার মেয়ের পরিচয়ই সে দেয় নি। মামনিকেও কখনও দেখি নি তার জন্য আফসোস করতে, আর আফসোস করবেই বা কেন আমার বাবাই যে আফসোস করার মতন কোন সুযোগই দেয় নি। প্রচন্ড ভালোবাসে সে মামনিকে, বাবাই মনে হয় মামনি হাঁটলেও ব্যাথা পায়। এই দুই মানুষের ভালোবাসায় কেটে গিয়েছে আমার জীবনের ২১ টি বসন্ত। 

আমার প্রতিদিনের নিয়ম হলো, দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা। তাও আবার মামনি টেনে না তুললে আমি ঘুম থেকে উঠতেই পারি না। কিন্তু আজকের দিনটায় যেন সব অন্যরকম ঘটনার শুরুই হয়েছিল আমার সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠাটা। চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখি সকালে স্নিগ্ধ সূর্যের এক ফালি রোদ আমায় ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে তার মায়ার তাপ দিয়ে। মাথার কাছ থেকে ফোন হাতে নিয়ে চোখের সামনে আনতেই, আমার যেন বিশ্বাস হতে চাইল না। মাত্র সাড়ে সাতটা...... এত আগে আমি উঠলাম কি করে। মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভাবলাম আমি আবার ঘুমাই কিন্তু কি মনে হতেই বিছানা ছেড়ে আস্তে করে সামনে এগিয়ে চললাম আমার রুমের লাগোয়া বারান্দাটাকে মামনি বলে মশার ফ্যাক্টরি। আসলে এই বারান্দার পুরোটা জুড়ে শুধু গাছ আর গাছ। এখানে আসলেই মনে হয় আমি প্রকৃতির এক খন্ড সবুজ চুরি করে এনে বারান্দায় বসিয়েছি। আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা এটা৷ বারান্দায় কতক্ষন দাঁড়িয়ে একটু ফ্রেশ হাওয়া নিয়ে চললাম ফ্রেশ হতে। 

রুমের দরজা খুলতেই ভারী পুরুষালি এর কণ্ঠ যেন হঠাৎই আমার সমস্ত স্বত্তাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। বিশাল পানি ভর্তি টবের মধ্যে খুব উঁচু থেকে যখন এক ফোঁটা পানি পড়ে তখন যে অনুরণ হয় ঠিক তেমন কম্পন যেন সারা শরীরে বয়ে গেল। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে যখন ডাইনিং রুমের সামনে দাঁড়ালাম, তখন মনে হলো আচ্ছা পৃথিবীতে কোন ছেলে এত পারফেক্টলি থাকতে পারে.......

সে আমার সামনে বসে আছে, তারপর স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ঝাড়া ছয়ফুটের উপরে লম্বা। এক হাত তার টেবিলের উপরে অন্য হাতে চায়ের কাপ। লেমনিস টাইপের পোলো শার্টের বুকের উপরের দুই বাটন খোলা। সেখান থেকে স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে বুকের হালকা পশম গুলো। আমাকে দেখেই মামনি হাঁ হয়ে তাকিয়ে বলল,

 " হায় আল্লাহ, সূর্য আজ কোন দিয়ে উঠেছে যে তুই এত সকাল সকাল উঠে পড়লি! ভালো করেছিস উঠেছিস দেখ কে এসেছে।"

এই বলেই সামনে বসা মানুষটার দিকে ইঙ্গিত করলো মামনি। 

" দেখ ইরা, এই তোর রাতুল ভাই.......মনে আছে রাতুলের কথা। সেই যে গ্রামে যেয়ে ওর কোলে উঠে আর নামতেই চাস নি। "

মামনি তার বয়ান দিচ্ছে আর আমি চুপ করে সামনে বসা মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছি। আর্মি ছাটের চুলে কাউকে এত সুন্দর লাগে সেটা আমার ধারনার বাইরে ছিল। পেটানো ঝাড়া ছয় ফুটের উপরে হবে লম্বায়, আর সবচেয়ে সুন্দর যা ছিল সেটা হলো বুক৷ সারাজীবন শুনেছি মেয়েদের বুক দেখে ছেলেরা পাগল হয় আর আমি........ লজ্জায় যেন লাল হয়ে গেলাম নিমেষেই। তাড়াতাড়ি মুখ নিচু করে জিজ্ঞেস করলাম, 

 " কেমন আছো! "

কিন্তু কেন জানি না সম্বোধনটা করতে পারলাম না। মুখটা নিচু করেই টানা স্বরে বললাম,

" ভালো আছো? "

আমার প্রশ্নটা শুনে সামনে বসা মানুষটা যেন মুখ নামিয়ে চোখ উঁচু করে চাইলো আমার দিকে, আর সে দৃষ্টিতে যে আমি আবারও খুন হলাম। গলা বুক যেন শুকিয়ে আসতে লাগলো। 

এই ছিল রাতুলের সাথে প্রথম পরিচয়, আমি প্রথাগত সুন্দরী না হলেও তথাগত মায়াবতী ছিলাম। গায়ে রংটা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের ছিল আর ছিল ঠোঁট আর চোখ। আমার চোখের দিকে তাকালে নাকি যে কোন পুরুষ ডুবে যেতে বাধ্য। কিন্তু এ সমস্ত টোটকাই যে রাতুলের জন্য বৃথা সেটা বুঝেছিলাম তিনদিনের মাথাতেই। মিষ্টি করে যখন হেসে রাতুলের সামনে গিয়েছিলাম চা নিয়ে, আমাকে দেখেই বলেছিল, 

" তোমার চোখ দেখতে গরুর চোখের মতন, কিন্তু গরুর চোখের সাইজ একটু লম্বা আর তোমরাটা এক্কটু খাটো৷"

এইটুকু শুনে হাসবো না মনের দুঃখে সামনে বসা গরুর উপমায় উপমিত করা হনুমানের গলা টিপে ধরবো বুঝতে ছিলাম না। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন তম কাজ হলো এক পাক্ষিক ভালোবাসা, আর তার চেয়ে কঠিন হলো, সেই ভালোবাসাকে অপর পক্ষকে বুঝানোর আপামোর চেষ্টা করা। আমি সেই পৃথিবীর কঠিন তম কাজটাই করে ফেলেছিলাম। এক পাক্ষিক ভালোবাসায় আক্রান্ত হয়ে পড়লাম রাতুলের প্রতি, কিন্তু রাতুলের চারপাশে যে অদৃশ্য দেওয়াল আছে সেটাকে ভাঙ্গার উপায়টাই পাচ্ছিলাম না। কিছুতেই না। 

রাতুল এসেছে প্রায় সাতদিন হতে চলল, আর এই সাতদিনে যেন আমার রাতুল ফোবিয়া হয়ে গেল৷ উঠতে বসতে সব সময় যেন রাতুলকে আমার চাইই চাই, ওকে না দেখলেই যেন পাগলের মতন লাগতো। কিন্তু যেদিনই শুনলাম রাতুল চলে যাবে পাগলের মতন হয়ে গেলাম। রুমের সমস্ত কিছু ভেঙ্গে ফেললাম কিন্ত কিছুতেই যেন নিজেকে শান্ত করতে পারতেছিলাম না। চুপ করে বারান্দায় যেয়ে গাছেদের কাছে মাথা গুজে বসে রইলাম যে কতক্ষন তার কোন আন্দাজ নেই আমার কাছে।

হঠাৎ করে করুণ এক সুরের ধাক্কায় যেন ঘোর ভাঙ্গলো আমার, ভেজা চোখ নিয়েই চললাম সুরের উৎস খুঁজতে। হঠাৎই মনে হল গেস্টরুম থেকে আসছে সেই সুর। ভেজানো দরজাটা মেলতেই চোখে পড়লো খালি গা কাঁধে বেহালা আর চাঁদের আলো এসে পড়েছে সেই শরীরে। ঠিক যেন গ্রীক দেবতার মতন দেখাচ্ছে। নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসতেছিল এই অপরুপ সৌন্দর্য আর বিমোহিত সুর শুনে৷ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। এক ছুটে জড়িয়ে ধরলাম রাতুলকে, আমার চোখের পানি উনার বুকে থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। 

" ইরা রুমে যাও, না হলে সরো আমি লাইট জ্বালাবো!"

গম্ভীর স্বরে বলল রাতুল। 

" লাইট জ্বালিও না আমি তাহলে কিছুই বলতে পারবো না।"

" তোমার কিছুই বলতে হবে না, আমি এতটা ছোট নই যে কিছুই বুঝবো না। "

" সব বুঝেও কেন এই দূরত্ব? আমি যে আর পারছি না।"

এবার আমার চোখের পানি বাঁধ ভাঙ্গলো। হঠাৎ টের পেলাম আমার মাথায় রাতুলের হাত, আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল,

" আমি যে নিঃস্ব ইরা, শুধু আছে এই শরীরটা, মনটাকে যে অন্য কাউকে অনেক আগেই দিয়ে দিয়েছি৷। আর মন ছাড়া কাউকে শরীর দিতে যে বিবেক আমায় বাঁধা দেবে!"

রাতুলের এই উত্তর শুনে আমি যেন খুব বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম, চুপ করে রইলাম পরের টুকু শোনার জন্য,

" ইরা সেই মানবীর কাছ থেকে বাঁচার জন্যই আমি এতদূর এসেছি। কিন্তু পারছি কই, এখ্যনে এসে তোমারও কাঁদার কারণ হয়ে গেলাম। শোনো খালা বলছিল তোমার কোন স্যার যেন তোমাকে খুব পছন্দ করে তাকে বিয়ে করে সুখী হয়ে নিও। "

রাতুলের স্বান্তনা শুনে যেন আমার চিৎকার করে কান্না আসতে লাগলো। আমি ভালো থ্যকবো কি করে, আমার ভালো থাকার কারণটাই যে আজ অন্য কারো হয়ে গিয়েছে। চুপ করে রাতুলের মুখের দিকে এক বার তাকিয়েই ফিরে এসেছিলাম রুমে। পরের দিন বিদায় বেলাতেও রাতুল খুঁজেছিল আমাকে কিন্তু সামনে আসি নি। 

বেলা গড়িয়ে অনেক দূর, আজ আমি অন্য কারো ঘরনী, সারাদিন বাচ্চা সংসার সামলিয়ে যখন নিজের জন্য একটু সময় বের করি, তখন চোখ বুজলেই এক অদ্ভুত অবায়ব চোখে ভেসে ওঠে। খালি গা বেহালা কাঁধে সে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য। জীবনের এই মধ্য গগণে এসেও যেন রাতুলের সেই মায়া কাট্বনি আমার। আচ্ছা ভালোবাসা গুলো এমন হয় কেন? সবসময় সাথেই থাকে চাইলেও যে তাকে ভুলে থাকা যায় না, কখনও না।

 


Akhi Akter Mim

313 Blog posts

Comments