অপরাধ

Comments · 9 Views

অন্যায় যে সয় সে সমান অপরাধী।

 " তুমি কি কিছুই বলতে না তোমার স্বামীকে? অন্তত কিছু তো করতে পারতে! "

কেন জানি না গলায় আক্ষেপের স্বরটা খুব ভালো করেই ভেসে ওঠে। মেয়েটা বুকের মধ্যে জমানো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

 " আপু আমার দোষ হলো আমি নিজের পছন্দে বিয়ে করেছি। বিচার দেওয়ার জায়গাটাই যে আমার নেই। আম্মু আব্বুকে কিছু বললেই বলতো, নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিস নিজে বুঝে নে৷ আর যদি কখনও বরের সামনে প্রতিবাদ করতাম তাহলে মারের মাত্রা যেন আরো বেড়ে যেতো। একবার মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল ওর বাবার সামনে। তখন আমার শশুর আমার নামে থানায় জিডি করতে চেয়েছিল। আচ্ছা আপু মার খেলাম আমি, মাথা ফাটলো আমার আর থানায় কমপ্লেনও করবে আমার নামে। এটাই কি বিচার আপু? "

ডেইজীর প্রশ্ন শুনে যেন আমি আচমকা থেমে গেলাম, আচ্ছা এই সমাজে সব দোষ শুধু মেয়েদেরই হয় কেন? এটাই কি সমাজের নিয়ম? 

 " তারপর কি হলো? তুমি কিছুই বলো নাই তোমার বর বা শশুরকে? "

 " আর বলা....তারা দুই জন মিলে পারে না আমাকে ধরে আবার মারে। চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে হয়েছিল তখন। আমার আব্বু আমারে কিছু গয়না দিয়েছিল, আমার স্বামী সেগুলো বিক্রির চেষ্টা অনেক করেছিল৷ বারবার বলতাম আম্মু দিয়েছে এগুলো কিছু হলে মেরে ফেলবে আমারে। লাস্টে এমন ইমোশনাল ব্লাকমেইল শুরু করলো যে আর গয়না না দিয়ে পারলাম না। আপু এত ধুরন্ধর ছিলও জানেন, আমার স্বর্ণের গয়নার মতন হুবহু রুপার গয়নার উপরে সোনার পালিশ করিয়ে এনে দিয়েছিল আমার আম্মুকে দেখানোর জন্য।"

এটুকু শোনার পরে যেন আমি পুরোই থ হয়ে যাই, এখন আমার রাগ হতে শুরু করলো ডেইজীর উপরে। আচ্ছা মেয়েরা এত বোকা হয় কেন? নিজের বাবা মায়ের সাথে পর্যন্ত স্বামীর কারণে কেউ এমন করে? বেশ রাগি স্বরেই বললাম,

 " এটা কি ঠিক করেছিলে তুমি? বিবেকে বাধে নি একটুও? "

ঠোঁটের কোণে আবছা এক হাসি ফুটিয়ে মেয়েটা ঢুলুঢুলু চোখে আমার দিকে তাকালো তারপর বলল,

 " আপু জানের দাম যে গয়না থেকেও বেশি, গয়না না দিলে জানে মেরে ফেলতো। তাই চুপচাপ দিয়ে দিয়েছিলাম। যখন আমারে মারতো আমি না চুপ করে পড়ে পড়ে মার খেতাম। যেদিন আল্লাহ মাফ করুক একটু প্রতিবাদ করতাম, দরজা খুলে পাশের ফ্লাটের লোকদের ডেকে বলতো আমি চরিত্রহীনা। আমার আরো অনেক অনেক ছেলেদের সাথে সম্পর্ক আছে। জানেন আপু আমার ছোট ভাইটার কাছে পর্যন্ত বলেছে এই কথা। আমার ভাইটার সামনে পর্যন্ত আমার গায়ে হাত তুলেছে। ছোট বাচ্চাটা হওয়ার পরে বিছানা আলাদা করে ফেলে নিজের। একসাথে একটু শোয়ার জন্য কতটুকু যে মন আকুল হতো বোঝাতে পারবো না। তার এক কথা বিছানায় জায়গা হয় না সে ঘুমাতে পারবে না এখানে।"

নিজের অজান্তেই চোখের কোণে কখন যে পানি এসেছে, সেটা নিজেও বুঝতে পারি নি, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে মেয়েটা। ওর সাথে কথা বলতেছি প্রায় ঘন্টার উপরে, টানা মেয়েটা কেঁদেই চলেছে এতটা সময় নিয়ে। কেন জানি না থামাতে মন চাচ্ছে না ওকে, কাঁদুক একটু কাঁদলে যে মন হালকা হয়। সামনে রাখা পানিটা খেয়ে চেয়ারে একটু হেলান দিয়ে বসে ডেইজীর দিকে ভালো করে তাকালাম। এককালে যে চেহারা খুব সুন্দর ছিল সেটা বোঝাই যায়৷ অযত্নে অবহেলায় আজ যেন কেমনই দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। একটু ধাতস্ত হয়ে মেয়েটা আবারও বলা শুরু করলো,

 " আমার আব্বু আম্মু যদি তাদের বাসায় দাওয়াত দিতো, সে কখনও যেত না। খালি বলতো আমার আম্মুর হাতের রান্না খারাপ। মুখে দেওয়া যায় না, তাকে নাকি যত্ন করে না। আমার আব্বু কিপটা ছোটলোক, তাকে কোন টাকা পয়সা দেয় না। আমি একা একাই যেতাম বাপের বাড়িতে, তখন উলটা আরো বাপ মায়ের কথা শোনা লাগতো। একা একটা মানুষ কতজনের কথা শুনবো বলেন তো? মাঝে মাঝে মনে হতো দুই চোখ যেদিকে যায় সেদিকে চলে যাই। কিন্তু ওই যে দুই বাচ্চা ওদের মায়া যে যেতে দিতো না কোথাও। আমাকে ওই লোকটা সব সময় বলতো, তুই যেখানে যাওয়ার যা, আমার বাচ্চা নিবি না। দেখি না কোন দরদী আছে তোর, যে তোরে জায়গা দেয়। এমন একটা অবস্থা হয়ে গেছিল আপু, যে আমাকে কেউ বিশ্বাসই করতো না যে ওই লোকটা এমন। রাস্তায় মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকতো, যদি কখনও সুন্দর মেয়ে দেখতো, আমাকে বলতো,মেয়েটা কত সুন্দর। ওর বুক কতো সুন্দর ওর পিছন সাইড কতো সুন্দর। জানেন আপু, ও ওর বসের বউয়ের সাথে সারারাত জেগে জেগে কথা বলতো, আমি যদি জিজ্ঞেস করতাম তাহলে বলতো জরুরি কথা আছে আমি যেন বিরক্ত না করি তারে। নিজের অফিসের মেয়ে কলিগের সাথে কি কি চ্যাটিং করতো। সব দেখে, সব শুনেও বোবা কালার মতন হয়ে গিয়েছিলাম আমি। মাঝে মাঝে মনে হতো মরে যাই, তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, কিন্তু সাহসেই যে কুলাতো না!"

 মৃত্যু যদি সব কিছুর সমাধান হতো তাহলে তো পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি লোক মরে যেতো তাই না। "

ওর চোখে চোখ রেখে কথাটা আমি বললাম। অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো ও, তারপর বলল,

" এজন্যই তো বেঁচে আছি, আপু আমি না নিজের মুক্তি নিজে বেছে নিয়েছি। বাচ্চা দুটোকে নিজের মায়ের কাছে দিয়ে এসেছি, তারপর এই প্রবাসে আছি। কামাই করি দেশে পাঠাই, মা দেখে ছেলে মেয়ে দুটোকে। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা করে বাচ্চা দের কাছে চলে যেতে। কিন্তু বাপ মায়ের ঘাড়ে বোঝা হতে মন চায় না মোটেও। আর ওই পশুটার নোংরা ছায়া যেন আমার দেখতে না হয়, এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম ওই ঘর থেকে, আর ফেরার ইচ্ছা নেই। নিজেই এখন নিজের মর্জির মালিক, এখন আর ভয় লাগে না যে কেউ এসে মারবে আমাকে ঘর গোছানো না দেখলে। ভালো আছি আপু খুব ভালো।"

এতক্ষনের মধ্যে এই প্রথম আমি ডেইজীর ঠোঁটে পরিতৃপ্তির হাসি দেখলাম। সব গল্পের শেষটা সুন্দর না হলে যেন মনটাই ভরে না৷ আর এই মেয়েটার জীবন যেন গল্পের মতনই এর শেষটা সুখকর না হলে যেন নিজের কাছেই খারাপ লাগতো। আমাদের মধ্যে এমন অনেক ডেইজীই আছে যাদের চোখের নিরব অশ্রু গুলো আমরা কখনও দেখি না। তাদের প্রতি অনুরোধ অন্যের জন্য না, নিজের জন্য নিজেই প্রতিবাদ করুন। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সয় তারা দুইজনই সমান অপরাধী। 

 

 

Comments
Read more