মানুষিকতার পরিবর্তন হওয়া খুব প্রয়োজন ?

পুরনো ধ্যানধারণা যা সমাজের পথ অবরুদ্ধ করে সেই সবকিছুকে শুচিতার আগুনে পুড়িয়ে আত্মশুদ্ধি করার নামই তো মনুষ্?

__"ইসস বৌমা! দিলে তো ভোরভোর আমাকে ছুঁয়ে। আবার শুদ্ধ হতে হবে আমাকে সব ছেড়েছুড়ে। বলি কবে যে কাণ্ডজ্ঞান হবে তোমার?"; মাথা নীচু করে শাশুড়ি নীনাদেবীর কথার উত্তরে বৌমা টুয়ান বলে,"আমি একদম বুঝতে পারিনি মা, ভেবেছিলাম সকালে স্নান সেরে এসে রান্নাঘরে ঢুকব। আজ তো পয়লা বৈশাখ। কত কাজ পড়ে আছে। তাই ওদিকেই যাচ্ছিলাম তাড়াহুড়ো করে।আচ্ছা আপনি না হয় এই কাপড় ছেড়ে অন্য কাপড় পরে পুজোয় বসুন। চিন্তা করবেন না আমি ওগুলো ধুয়ে দিচ্ছি।"
__"সেটাই বটে ধুলেই যদি সব পাপ চিরতরে মুছে ফেলা যেত তাহলে এতদিনে ঠিক এই চ্যাটার্জী বাড়ি সাফসুতরো হয়ে যেত পুরোপুরি। সবই কপাল। সেই যবে থেকে আমার খোকন তোমাকে বিয়ে করে এই বাড়ির বউ করে নিয়ে এসছে সেই থেকে অলক্ষণ যেন পিছু ছাড়ছেনা আমাদের। আজ পর্যন্ত একটা সন্তানের মুখ পর্যন্ত দেখতে পারলাম না বংশধর আসা তো দূরের কথা!"; ঝাঁজিয়ে উঠে বলেন নীনাদেবী।
টুয়ান মৃদু কণ্ঠে জানায়,"এমন করে বলবেন না মা। আপনার অজানা তো কিছুই নেই। আমার দিক থেকে মা হতে কোনো অসুবিধা ছিল না। আপনার ছেলেও ডাক্তারি রিপোর্টের কিছু লোকায় নি আপনার থেকে। বুঝতেই পারছেন অসুবিধাটা আসলে কার?"
__"খবরদার বলছি বৌমা। রাখ তোমার ওই ছাইপাঁশ রিপোর্ট! বাঁজা মেয়েমানুষ হয়ে আমার খোকনের ঘাড়ে জাঁকিয়ে বসেছ সেই কলেজ জীবন থেকে। এতটাই মোহিনী যাদু করেছ ওর উপর যে আর শেষমেশ ও তোমাকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। আর তোমার মা হবার দোষ ঢাকতে খোকা নিজেকেই নিজে দোষারোপ করে। সেই সাথে তুমিও ওকে দুষছ? আমার হয়েছে যত জ্বালা! যতোসব উটকো আপদ অলক্ষুণেদের সাথে ঝামেলা করতে করতে পয়লা বৈশাখের পুজোয় বসতে কত যে দেরি হয়ে গেল বাপু! নাও সরে যাও এখন আমার পথ থেকে।"; এইবলে টুয়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন উনি।
পাটা একটু টলে যায় টুয়ানের। কাঠের রেলিংটা ধরে নিজেকে কোনমতে সামলে নিয়ে একরাশ মনখারাপকে সঙ্গী করে স্নানের ঘরে ঢোকে টুয়ান।অবশ্য আজ প্রথম নয় শাশুড়ি নীনাদেবীর এই বাক্যবাণ শুনে আসছে ও গত বছর দুই ধরে। আসলে ঠিক যখন থেকে উনি জানতে পেরেছেন টুয়ান আর ওর স্বামীর পরমের মধ্যে কোনো সন্তান আসবেনা সেই থেকে ওকে অপয়া, বাঁজা এসব বদনাম জুটেছে কপালে।যদিও মা হতে না পারার দোষটা ওর নয় বরং পরমের সেটা নীনাদেবী বুঝেও বুঝতে চান না একেবারেই। তবুও টুয়ান আর পরম চেষ্টা চালাচ্ছে বাড়ি ছেড়ে চলে না যেতে। সব একান্নবর্তী সংসার যখন ভেঙে যাচ্ছে তখন যদি অন্তত একটা পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখা যায় এই চিন্তাভাবনার বশবর্তী হয়ে ।কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে বা চালাতে পারবে ওরা? এলোমেলো চিন্তা মাথায় নিয়ে ভিজতে থাকে টুয়ান।এমনসময় নাকে আসে পায়েসের হাল্কা পোড়া পোড়া গন্ধ। ওলি মানে ওর ননদ কোথায় যে গেল পায়েস বসিয়ে? পায়েস পুড়তে বসেছে সেদিকে হুঁশ নেই। ঝটপট বাথরুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে ছোটে টুয়ান। ওভেন বন্ধ করে পায়েস নামাতে থাকে ও কাঁচের বাটিতে। ততক্ষণে হালকা পোড়া গন্ধ পেয়ে ঠাকুরঘর থেকে নেমে এসেছেন নীনাদেবী। চিৎকার করে ওঠেন,"গেল গেল সব গেল আমার। ওই বাঁজা মেয়েমানুষের ছোঁয়া ভোগ আমি ঠাকুরকে কিভাবে নিবেদন করব? সাধে কি বলে কলিকাল। অমঙ্গল ঘোর অমঙ্গল লেগেছে!"
__"না মা আসলে পায়েসটা প্রায় পুড়ে যাচ্ছিল। ওলি দিদিভাই যে কোথায় গেছে তাই আমি এসেই নামিয়ে দিলাম। আমার ছোঁয়া কাটাতে হলে আপনি পায়েসে একটা তুলসী পাতা দিয়ে শুদ্ধ করে নিন না,একেবারে পুড়ে নষ্ট হয়ে যেত তার থেকে এটা তো ভালো হল তাইনা?";টুয়ান বলে ওর শাশুড়ি মাকে।
কাটা কাটা ভাবে নীনাদেবী বলেন,"থাক বৌমা তোমার থেকে ভালো মন্দ জ্ঞানটা আমি নিতে যাবনা। আমার মুখে মুখে চোপা করা হচ্ছে আবার! তোমার মত মেয়েমানুষকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে হয় বাড়ি থেকে বুঝলে?"
নীনাদেবীর কথা এবার আর সহ্য করতে পারে না টুয়ান। এক ছুটে দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল ও এমন সময় ওর সামনে এসে দাঁড়ায় স্বামী পরম। তারপর ওর হাতদুটো ধরে বলে,
__"চলো টুয়ান.."
..."কোথায় যাব পরম"?
__"আশার আলো হোমে যাবে এখন আমার সঙ্গে। ওখানে যে একজন নতুন অতিথি অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।তারপর ওখান থেকে তোমার আর আমাদের নতুন ঠিকানায় যাব। এখানে আর নয়। এত বড় শহরে কোথাও না কোথাও একটা আশ্রয় ঠিক জুটে যাবে আমাদের।"
__"পরম আমি তো তোমার এসব কথার মানে কিছুই বুঝতে পারছিনা। হ্যাঁ 'আশার আলো' নামে একটা শিশুদের হোমের কথা তুমি বেশ কয়েকমাস আগে আমাকে বলেছিল বটে। কিন্তু ওখানে কে আছে?";টুয়ান বলে অবাক হয়ে।
পরম বলে,"একটা ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েকে তোমার কোলে নিয়ে আসবো আজকের শুভদিনে বুঝতে পারলে? এই পৃথিবীতে ওর পরিচয় হবে ও শ্রীমতী টুয়ান আর পরমের সন্তান।"
ছেলে পরম আর টুয়ানের কথা শুনে রাগে চোখ দুটো জ্বলে ওঠে নীনাদেবীর।গজগজ করে উঠে বলেন, "কাকে তুই নিজের মেয়ে বলে এই বাড়িতে জায়গা দিবি খোকন? না জানি কার না কার পাপ,আস্তাকুড়ের জঞ্জাল সে কিনা আসবে এই চ্যাটার্জী বাড়ি?"
__"মা,তুমি বোধয় ভালো করে শোনোনি আমার কথা। বলতে বাধ্য হচ্ছি এই পৃথিবীতে কেউ জঞ্জাল নয়। প্রত্যেকে অমৃতের সন্তান। আর কোনো কেউ তার জন্মের জন্য দায়ী নয়, একমাত্র দায়ী তার কর্মের জন্য। ওইটুকু দুধের শিশুর কোনো দোষ নেই। আর তুমি তোমার ঘরের লক্ষ্মী টুয়ানকেই তার যোগ্য সম্মান দিতে পারনা। আরেকজন লক্ষ্মীকে এই বাড়ি আসব এই চিন্তা ভুলেও করোনা। তুমি থাকো চ্যাটার্জী বাড়ির বস্তাপচা ঘুণধরা চিন্তা ভাবনা নিয়ে। আমরা আমাদের মত করেই ভালো থাকব। তবে আমার আর টুয়ানের পক্ষ থেকে আমাদের নতুন ঠিকানার দরজা তোমাদের জন্য খোলাই থাকবে। ইচ্ছে হলে এসো দেখবে একরাশ খোলা বাতাস পাবে ওখানে।";পরম বলে ওর মায়ের কথার উত্তরে।
__"খোকন তুই আমার মুখের উপরে এতগুলো কথা বলতে পারলি? নিশ্চয় তলেতলে তোর বউয়ের যুক্তিতে..";নীনা চমকে উঠে বলেন।
মৃদু হেসে পরম বলে,"সত্যি কথাগুলো বলার জন্য কারুর কোনো যুক্তির দরকার হয় না। তুমি একদিকে বাইরে ঘটা করে পয়লা বৈশাখের পুজো করছ কিন্তু তার মন থেকে গুরুত্ব উপলদ্ধি করার দরকার নেই তাইতো? পুরনো ধ্যানধারণা যা সমাজের পথ অবরুদ্ধ করে সেই সবকিছুকে শুচিতার আগুনে পুড়িয়ে আত্মশুদ্ধি করার নামই তো পয়লা বৈশাখ। পারলে একটু অন্যভাবে ভেবে দেখ। চলো টুয়ান আর দাঁড়িয়ে থেকোনা।"
বাধাবিপত্তি কাটিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে ওরা দুজনে। একসাথে নতুন প্রভাতের সূর্যের আলো গায়ে মেখে পথ হেঁটে ওরা পৌঁছায় "আশার আলো" হোমে। ছোট ছোট শিশুদের কলকাকলিতে তখন ভরে উঠেছে চারদিক। টুয়ান এক ছুটে কোলে তুলে নেয় একটা নরম তুলতুলে প্রাণকে, চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় ওকে। এই প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করে ও। পরম টুয়ানের কাঁধে ভরসার হাত রেখে ওর পাশে দাঁড়ায়। হোমে তখন শুরু হয়েছে নববর্ষ উপলক্ষ্যে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। জনৈক শিল্পীর গলায় ভেসে আসে রবিঠাকুরের গান,
"মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা"।।

Khadija Akter

38 Blog posts

Comments