দেনা-পাওনা ১৩তম খন্ড

Comments · 3 Views

জমিদারের নিভৃত-নিবাস সাজাইতে গুছাইতে দিন-চারেক গিয়াছে। জনশ্রুতি এইরূপ যে

বলিয়া তিনি তাহার প্রতি অঙ্গুলিসঙ্কেত করিলেন।

তারাদাস সাড়া দিল না, জাজিমটার অংশবিশেষের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া নিঃশব্দে বসিয়া রহিল, এবং রায়মহাশয়ের আনত মুখের ‘পরেও একটা ফ্যাকাশে ছায়া পড়িল। কিন্তু মুখরক্ষা করিলেন শিরোমণিঠাকুর। তিনি সবিনয়ে কহিলেন রাজার কাছে প্রজা সন্তানতুল্য, তা দোষ করলেও সন্তান, না করলেও সন্তান। আর কথাটা একরকম ওরই। ওর কন্যা ষোড়শীর সম্বন্ধে আমরা নিশ্চয় স্থির করেচি, তাকে আর মহাদেবীর ভৈরবী রাখা যেতে পারে না। আমাদের নিবেদন, হুজুর তাকে সেবায়েতের কাজ থেকে অব্যাহতি দেবার আদেশ করুন।

জমিদার চকিত হইয়া উঠিলেন; কহিলেন, কেন? তার অপরাধ?

দুই-তিনজন প্রায় সমস্বরে জবাব দিয়া ফেলিল, অপরাধ অতিশয় গুরুতর।

জীবানন্দ একে একে তাহাদের মুখের দিকে চাহিয়া অবশেষে জনার্দনের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, তিনি হঠাৎ এমন কি ভয়ানক দোষ করেচেন রায়মশায়, যার জন্য তাঁকে তাড়ানো আবশ্যক?

জনার্দন মুখ তুলিয়া শিরোমণিকে চোখের ইঙ্গিত করিতেই জীবানন্দ বাধা দিয়া কহিলেন, না, না, উনি অনেক পরিশ্রম করেচেন, বুড়োমানুষকে আর কষ্ট দিয়ে কাজ নেই, ব্যাপারটা আপনিই ব্যক্ত করুন।

রায়মহাশয়ের চোখে ও মুখে দ্বিধা ও অত্যন্ত সঙ্কোচ প্রকাশ পাইল, মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, ব্রাহ্মণকন্যা—এ আদেশ আমাকে করবেন না।

্জীবানন্দ হাসিমুখে কহিলেন, দেব-দ্বিজে আপনার অচলা ভক্তির কথা এদিকে কারও অবিদিত নেই। কিন্তু এতগুলি ইতর-ভদ্রকে নিয়ে আপনি নিজে যখন উপস্থিত হয়েচেন, তখন ব্যাপার যে অতিশয় গুরুতর তা আমার বিশ্বাস হয়েচে। কিন্তু সেটা আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই।

কিন্তু জনার্দন রায় অত সহজে ভুল করিবার লোক নহেন; প্রত্যুত্তরে তিনি শিরোমণির প্রতি একটা ক্রুদ্ধদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন, হুজুর যখন নিজে শুনতে চাচ্চেন তখন আর ভয় কি ঠাকুর? নির্ভয়ে জানিয়ে দিন না।

খোঁচা খাইয়া বৃদ্ধ শিরোমণি হঠাৎ ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, সত্যি কথায় ভয় কিসের জনার্দন? তারাদাসের মেয়েকে আর আমরা কেউ ভৈরবী রাখব না হুজুর! তার স্বভাব-চরিত্র ভারী মন্দ হয়ে গেছে—এই আপনাকে আমরা জানিয়ে দিচ্চি।

জীবানন্দের পরিহাস-দীপ্ত প্রফুল্ল মুখ অকস্মাৎ গম্ভীর ও কঠিন হইয়া উঠিল; একমুহূর্ত নিঃশব্দে থাকিয়া ধীরে ধীরে প্রশ্ন করিলেন, তাঁর স্বভাব-চরিত্র মন্দ হবার খবর আপনারা নিশ্চয় জেনেছেন?

তৎক্ষণাৎ অনেকেই একবাক্যে বলিয়া উঠিল যে, ইহাতে কাহারও কোন সংশয় নাই—এ গ্রামসুদ্ধ সবাই জানিয়াছে। জনার্দন মুখে কিছু না কহিলেও চুপ করিয়া মাথা নাড়িতে লাগিলেন। জীবানন্দ আবার ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া তাঁহারই মুখের প্রতি চাহিয়া কহিলেন, তাই সুবিচারের আশায় বেছে বেছে একেবারে ভীষ্মদেবের কাছে এসে পড়েছেন রায়মহাশয়? বিশেষ সুবিধে হবে বলে ভরসা হয় না।জীবানন্দ হাতের শূন্য গ্লাসটা নামাইয়া রাখিয়া হঠাৎ কঠিন হইয়া বলিয়া উঠিলেন, এককড়ি, তোমার গোমস্তাগিরি কায়দাটা একটু ছাড়। তিনি আসবেন না, না?

না।

কেন?

এবার প্রত্যুত্তরে যদিচ এককড়ি তাহার জমিদারি কায়দাটা সম্পূর্ণ ছাড়িল না, কিন্তু সবাই শুনিতে পায় এমনি সুস্পষ্ট করিয়াই কহিল, তিনি আসতে পারবেন না, এ কথা যত লোক দাঁড়িয়েছিল সবাই শুনেচে। বলেছিলেন, তোমার হুজুরকে বলো এককড়ি, তাঁর বিচার করবার মত বিদ্যেবুদ্ধি থাকে ত নিজের প্রজাদের করুন গে। আমার বিচার করবার জন্যে আদালত খোলা আছে।

সহসা মনে হইল জমিদারের এতক্ষণের এত রহস্য, এত সরল ঔদাস্য, হাস্যোজ্জ্বল মুখ ও তরল কণ্ঠস্বর চক্ষের পলকে নিবিয়া যেন অন্ধকার হইয়া গেল। ক্ষণকাল পরে শুধু আস্তে আস্তে কহিলেন, হুঁ। আচ্ছা, তুমি যাও। প্রফুল্ল, সেই যে কি একটা চিনির কোম্পানি হাজার বিঘে জমি চেয়েছিল, তাঁদের কোন জবাব দিয়েছিলে?

আজ্ঞে না।

তা হলে লিখে দাও যে জমি তারা পাবে। দেরি করো না।

না, দিচ্চি লিখে, এই বলিয়া সে এককড়িকে সঙ্গে লইয়া প্রস্থান করিল। আবার কিছুক্ষণের জন্য সমস্ত গৃহটা নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। শিরোমণি উঠিয়া দাঁড়াইয়া আশীর্বাদ করিয়া কহিলেন, আমরা আজ তা হলে আসি?

আসুন।

রায়মহাশয় হেঁট হইয়া প্রণাম করিয়া কহিলেন, অনুমতি হয় ত আর একদিন চরণ দর্শন করতে আসব।

বেশ, আসবেন।

সকলেই ধীরে ধীরে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন। বাহিরে আসিয়া তাঁহারা জমিদারের হাঁক শুনিতে পাইলেন, বেয়ারা—

অনেকখানি পথ কেহই কাহারো সহিত বাক্যালাপ করিল না। অবশেষে শিরোমণি আর কৌতূহল দমন করিতে না পারিয়া রায়মহাশয়কে একপাশে একটু টানিয়া ফিসফিস করিয়া কহিলেন, জনার্দন, জমিদারকে তোমার কিরূপ মনে হয় ভায়া?

জনার্দন সংক্ষেপে বলিলেন, মনে ত অনেক রকমই হলো।

মহাপাপিষ্ঠ—লজ্জাশরম আদৌ নেই।

না।

কিন্তু দিব্যি সরল। মাতাল কিনা! দেখলে, দেনার দায়ে চুল পর্যন্ত বাঁধা, তাও বলে ফেললে।

জনার্দন বলিলেন, হুঁ।

শিরোমণি বলিলেন, কিছুই থাকবে না, সব ছারখার হয়ে যাবে, তুমি দেখে নিয়ো।

জনার্দন বলিলেন, খুব সম্ভব।

হয়ত বেশীদিন বাঁচবেও না।

হতেও পারে।

কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলিয়া শিরোমণি পুনশ্চ বলিলেন, যা ভাবা গিয়েছিল, বোধ হয় ঠিক তা নয়—নেহাত হাবাবোকা বলে মনে হয় না। কি বল?

জনার্দন শুধু জবাব দিলেন, না।

কিন্তু বড় দুর্মুখ। মানীর মান-মর্যাদার জ্ঞান নেই।জনার্দন চুপ করিয়া রহিলেন। উত্তর না পাইয়াও শিরোমণি কহিলেন, কিন্তু দেখেচ ভায়া কথার ভঙ্গী—অর্ধেক মানে বোঝাই যায় না। সত্য বলচে, না আমাদের বাঁদর নাচাচ্চে ঠাওর করাই শক্ত। জানে সব, কি বল?

রায়মহাশয় তথাপি কোন মন্তব্য প্রকাশ করিলেন না, তেমনি নীরবে পথ চলিতে লাগিলেন। কিন্তু বাটীর কাছাকাছি আসিয়া শিরোমণি আর কৌতূহল সংবরণ করিতে পারিলেন না, আস্তে আস্তে বলিলেন, ভায়াকে বড় বিমর্ষ দেখাচ্চে—বিশেষ সুবিধে হবে না বলেই যেন ভয় হচ্চে, না?

রায়মহাশয় যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটু দাঁড়াইয়া কহিলেন, মায়ের অভিরুচি।

শিরোমণি ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, তার আর কথা কি? কিন্তু ব্যাপারটা যেন খিচুড়ি পাকিয়ে গেল—না গেল একে ধরা, না গেল তাকে মারা। তোমার কি ভায়া—পয়সার জোর আছে—কিন্তু বাঘের গর্তের মুখে ফাঁদ পাততে গিয়ে না শেষে আমি মারা পড়ি।

জনার্দন একটু রুক্ষকণ্ঠে কহিলেন, আপনি কি ভয় পেয়ে এলেন নাকি?

শিরোমণি বলিলেন, না না ভয় নয়, কিন্তু তুমিও যে খুব ভরসা পেয়ে এলে, তা ত তোমার মুখ দেখেও অনুভব হচ্চে না। হুজুরটি ত কানকাটা সেপাই—কথাও যেমন হেঁয়ালি, কাজও তেমনি অদ্ভুত। ও যে ধরে গলা টিপে মদ খাইয়ে দেয়নি এই আশ্চর্য। এককড়ির মুখে ঠাকরুনটির হুমকিও ত শুনলে? আমিও মেলা কথা কয়ে এসেচি—ভাল করিনি। কি জানি, এককোড়ে ব্যাটা ভেতরে ভেতরে সব বলে দেয় নাকি! দুয়ের মাঝে পড়ে শেষকালে না বেড়াজালে ধরা পড়ি!

জনার্দন উদাসকণ্ঠে কহিলেন, সকলই চণ্ডীর ইচ্ছা। বেলা হয়ে গেল—ও-বেলায় একবার আসবেন।

তা আসবো।

গলির মোড় ফিরিতে বাঁ দিকের গাছের ফাঁকে মন্দিরের অগ্রভাগ দেখা দিতেই বৃদ্ধ শিরোমণি হাত তুলিয়া যুক্তকরে প্রণাম করিলেন, কানে এবং নাকে হাত দিলেন, কিন্তু অস্ফুটে কি প্রার্থনা যে করিলেন তাহা শোনা গেল না। তার পরে ধীরে ধীরে বাড়ি চলিয়া গেলেন।

Comments
Read more