দেখিল, তাহার পর নিঃশব্দে বসিয়া রহিল। নির্বাক তিনজনেই। শুধু গুড়গুড় করিয়া হুঁকার শব্দ হইতেছে, কিন্তু তাহা যেন বড় ভয়ে ভয়ে। বন্ধুমণ্ডলীর মাঝে তর্ক উঠিয়া হঠাৎ নিরর্থক একটা কলহ হইয়া গেলে, প্রত্যেকেই যেমন নীরবে নিজের মনে ফুলিতে থাকে, এবং ক্ষুব্ধ অন্তঃকরণ মিছামিছি কহিতে থাকে, তাইত! এমনি তিনজনেই মনে মনে বলিতে লাগিল, তাইত! এ কেমন হইল!
যেমনই হোক, কেহই স্বস্তি পাইতেছিল না। চুনিলাল হুঁকা রাখিয়া দিয়া নীচে নামিয়া গেল, বোধ করি আর কোন কাজ খুঁজিয়া পাইল না,-তাই। ঘরে দুইজনে বসিয়া রহিল। দেবদাস মুখ তুলিয়া কহিল, তুমি টাকা নাও?
চন্দ্রমুখী সহসা উত্তর দিতে পারিল না। আজ তার চব্বিশ বৎসর বয়স হইয়াছে, এই নয়-দশ বৎসরের মধ্যে কত বিভিন্ন প্রকৃতির লোকের সহিত তাহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হইয়াছে; কিন্তু এমন আশ্চর্য লোক সে একটি দিনও দেখে নাই। একটু ইতস্ততঃ করিয়া কহিল, আপনার যখন পায়ের ধূলো পড়েচে-
দেবদাস কথাটা শেষ করিতে না দিয়াই বলিয়া উঠিল, পায়ের ধূলোর কথা নয়। টাকা নাও ত?
তা নিই বৈ কি। না হলে আমাদের চলবে কিসে?থাক, অত শুনতে চাইনে। বলিয়া সে পকেটে হাত দিয়া একখানা নোট বাহির করিল এবং চন্দ্রমুখীর হাতে দিয়াই চলিতে উদ্যত হইল-একবার চাহিয়াও দেখিল না কত টাকা দিল।
চন্দ্রমুখী বিনীতভাবে কহিল, এরি মধ্যে যাবেন?
দেবদাস কথা কহিল না-বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল।
চন্দ্রমুখীর একবার ইচ্ছা হইল, টাকাটা ফিরাইয়া দেয়; কিন্তু কেমন একটা তীব্র সঙ্কোচের বশে পারিল না, বোধ করি বা একটু ভয়ও তাহার হইয়াছিল। তা ছাড়া, অনেক লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও অপমান সহ্য করা অভ্যাস তাহাদের আছে বলিয়াই নির্বাক নিস্পন্দ হইয়া চৌকাঠ ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। দেবদাস সিঁড়ি বাহিয়া নীচে নামিয়া গেল।
সিঁড়ির পথেই চুনিলালের সহিত দেখা হইল। সে আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল, কোথায় যাচ্চ দেবদাস?
বাসায় যাচ্চি।
সে কি হে?
দেবদাস আরও দুই-তিনটি সিঁড়ি নামিয়া পড়িল।
চুনিলাল কহিল, চল, আমিও যাই।
দেবদাস কাছে আসিয়া তাহার হাত ধরিয়া বলিল, চল।
একটু দাঁড়াও, একবার উপর থেকে আসি।
না, আমি যাই, তুমি পরে এসো-বলিয়া দেবদাস চলিয়া গেল।
চুনিলাল উপরে আসিয়া দেখিল, চন্দ্রমুখী তখনও সেইভাবে চৌকাঠ ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে।
তাহাকে দেখিয়া কহিল, বন্ধু চলে গেল?
হ্যাঁ।
চন্দ্রমুখী হাতের নোট দেখাইয়া কহিল, এই দেখ। কিন্তু ভাল বোধ কর ত নিয়ে যাও; তোমার বন্ধুকে ফিরিয়ে দিয়ো।
চুনিলাল কহিল, সে ইচ্ছে করে দিয়ে গেছে, আমি ফিরিয়ে নিয়ে যাবো কেন?
এতক্ষণ পরে চন্দ্রমুখী একটুখানি হাসিতে পারিল; কিন্তু হাসিতে আনন্দ ছিল না। কহিল, ইচ্ছে করে নয়, আমার টাকা নেই বলে রাগ করে দিয়ে গেছে। হাঁ চুনিবাবু, লোকটা কি পাগল?
একটুও না। তবে আজ কদিন থেকে বোধ করি ওর মন ভালো নেই।
কেন মন ভালো নেই-কিছু জানো?
তা জানিনে। বোধ হয় বাড়িতে কিছু হয়ে থাকবে।
তবে এখানে আনলে কেন?
আমি আনতে চাইনি, সে নিজে জোর করে এসেছিল।
চন্দ্রমুখী এবার যথার্থই বিস্মিত হইল। কহিল, জোর করে নিজে এসেছিল, সমস্ত জেনে?
চুনিলাল একটুখানি ভাবিয়া কহিল, তা বৈ কি! সমস্তই ত জানত। আমি ত আর ভুলিয়ে আনিনি!
চন্দ্রমুখী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া কি ভাবিয়া কহিল, চুনি, আমার একটি উপকার করবে?
কি?
তোমার বন্ধু কোথায় থাকেন?
আমার কাছে।
আর-একদিন তাকে আনতে পারবে?
তা বোধ হয় পারব না। এর আগেও কখনো সে এ-সব জায়গায় আসেনি, পরেও বোধ হয় আর আসবে না। কিন্তু কেন বল দেখি?
চন্দ্রমুখী একটু ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, চুনি, যেমন করে হোক, ভুলিয়ে আর একবার তাকে এনো।
চুনি হাসিল; চোখ টিপিয়া কহিল, ধমক খেয়ে ভালবাসা জন্মাল নাকি?
চন্দ্রমুখীও হাসিল; কহিল, না দেখে নোট দিয়ে যায়-এটা বুঝলে না?
চুনি চন্দ্রমুখীকে কতকটা চিনিতে পারিয়াছিল। ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না-না, নোট-ফোটের লোক আলাদা-সে তুমি নও। কিন্তু সত্যি কথাটা বল ত?
চন্দ্রমুখী কহিল, সত্যিই একটু মায়া পড়েচে।
চুনি বিশ্বাস করিল না; হাসিয়া কহিল, এই পাঁচ-মিনিটের মধ্যে?
এবার চন্দ্রমুখীও হাসিতে লাগিল। বলিল, তা হোক। মন ভালো হলে আর একদিন এনো-আর একবার দেখব। আনবে ত?
কি জানি!
আমার মাথার দিব্যি রইল।
আচ্ছা-দেখব।