দেনা-পাওনা একাদশ

Comments · 5 Views

সকালে উঠিয়া হৈম নিজের গতরাত্রির ব্যবহার স্মরণ করিয়া লজ্জায় মরিয়া গেল।

হইয়া রাজী হইয়া গেল, এবং সে নিজে জিভ কাটিয়া গদগদ-কণ্ঠে কহিয়া উঠিল, অমন কথা মুখেও আনবেন না রায়মশাই, আপনারাই ত সব! হাতীর সঙ্গে মশার বিবাদ! কি বল মা? বলিয়া সে একটা ভাল কথা কিংবা একটুখানি ঘাড়-নাড়া কিংবা এমনি কিছু একটা শুনিবার প্রত্যাশায় হৈমর মুখের প্রতি চাহিল, এবং সেই সঙ্গে অনেকেরই দৃষ্টি তাহার উপরে গিয়া পড়িল। হৈম কিছুই কহিল না; পরন্তু তাহার মুখের চেহারায় ষোড়শীর সেই প্রথম বিচারের দিনটাই সকলের দপ্‌ করিয়া মনে পড়িয়া অপ্রত্যাশিত একটা নিরুৎসাহের মেঘ যেন কোথা হইতে আসিয়া পলকের নিমিত্ত ঘরের মধ্যে ছায়াপাত করিল—কিন্তু পলকমাত্রই। রায়মহাশয় সোজা হইয়া বসিয়া তামাকের জন্য একটা উচ্চ হাঁক দিয়া কহিলেন—বাবা নির্মল, যাত্রার সময়টা শিরোমণিমশায় দশটার মধ্যেই দেখে দিয়েচেন; মেয়েদের কাণ্ড—একটু সকাল সকাল তৈরি না হতে পারলে বার হওয়াই যাবে না।

নির্মল ঘাড় নাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, এবং আর কিছু বলিবার পূর্বেই হৈম নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল।

মুখ-হাত ধোয়া হইতে স্নান পর্যন্ত সমাধা করিতে বসুসাহেবের বেশী বিলম্ব হইল না। বাটীর মধ্যে পা দিয়াই শাশুড়ীর উচ্চকণ্ঠ রান্নাঘর হইতে শুনা গেল, তিনি মেয়েকে লইয়া পড়িয়াছেন। সে যে ঘরের মধ্যে কি করিতেছে তাহা ভাবিয়া পাইতেছেন না। নির্মল ঘরে ঢুকিয়া দেখিতে পাইল হৈম মেঝের উপর স্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছে; আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ব্যাপার কি, তোমার মা যে ভারী বকাবকি করচেন? তা ছাড়া সময় ত বেশী নেই।

হৈম কহিল, ঢের সময় আছে—আজ ত আমাদের যাওয়া হতে পারে না।

কেন?

হৈম কহিল, কেন কি? ষোড়শীর এতবড় বিপদে তার সঙ্গে একবার দেখা না করেই যাবো?

নির্মল কহিল, বেশ ত দেখা করেই এসো না। তারও ত সময় আছে।

হৈম বলিল, আর তুমিই বা একবার দেখা না করে কি করে যেতে পারবে?

এই যে সেই গতরাত্রির প্রতিক্রিয়া তাহা মনে মনে বুঝিয়া নির্মল কহিল, চেষ্টা করলে তাও বোধ হয় পারা যাবে। অসম্ভব রকমের শক্ত কাজ নয়, কিন্তু আমি একবার দেখা করে গেলেই যে এ বিপদে তার সুবিধে হবে মনে হয় না।

হৈম প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া শুধু কহিল, না, সে কোনমতেই হবে না।

হবে না কেন? তা ছাড়া আমার যে সেই সৈদাবাদের চামড়ার মামলা আছে—

থাক তোমার চামড়ার মামলা, একটা তার করে দাও। আজ তোমার কিছুতেই যাওয়া হবে না।

বেশ ত, চল নাহয় দুজনে একবার দেখা করেই আসি? সে সময় ত আছে।

হৈম মুখ তুলিয়া একটু হাসিয়া বলিল, না, সে তোমার সেখানে হয়, কিন্তু এখানে হয় না। আর এত লোকের সামনে বাবাই বা কি মনে করবেন? রাত্রে আমরা লুকিয়ে যাবো।

নির্মলের যথার্থই অত্যন্ত জরুরি মকদ্দমা ছিল, তা ছাড়া কোন্‌ ছুতায় যে যাওয়া এমন হঠাৎ স্থগিত করা যাইতে পারে, সে ভাবিয়া পাইল না, বিশেষতঃ শ্বশুরের সঙ্গে ইহাতে নিদারুণ বিচ্ছেদ ঘটিবার সম্ভাবনা। চিন্তা করিয়া কহিল, সে হয় না হৈম, যেতে আমাদের আজ হবেই। আর মনে হয় আমরা মাঝে পড়ে বিপদটা হয়ত তাঁর আরও বাড়িয়ে তুলব। আমার কথা শোন, চল, অযাচিত মধ্যস্থতায় কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশী হয়।

হৈম স্বামীর মুখের প্রতি চোখ তুলিয়া কিছুক্ষণ স্থির হইয়া বসিয়া থাকিয়া বলিল, আমাকে ত তুমি জানো, আজ আমি কিছুতেই যেতে পারব না। আর, কালকের অপরাধে যদি আমাকে তুমি শাস্তি দিতেই চাও, ত ফেলে রেখে যাও। আমি আর তোমাকে আটকাবো না।

নির্মল আর কিছু না বলিয়া বাহিরে চলিয়া গেল। শরীর ভাল নয়, আজ যাওয়া হইল না শুনিয়া শাশুড়ীঠাকুরানী আশ্চর্য হইলেন, উদ্বিগ্ন হইলেন, এবং ততোধিক খুশী হইয়া উঠিলেন, কিন্তু বাহিরের ঘরে বসিয়া শ্বশুরমহাশয় শুধু একটা হুঁ বলিয়াই তামাক টানিতে লাগিলেন। তিনি আশ্চর্যও হইলেন না, উদ্বিগ্নও হইলেন না, এবং যাহার কিছুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান আছে, সে তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া খুশির কথা মুখে আনিবে না।

মকদ্দমার ব্যবস্থা করিতে নির্মল তার করিয়া দিল এবং কাজটা যে কেবল নিরর্থক নয়—মন্দ, তাহাও সে মনে মনে বুঝিল, তবুও সেই মনটাই তাহার সারাদিন একান্ত সংগোপনে সেই দিনান্তের জন্যই উন্মুখ হইয়া রহিল। বিগত রাত্রির হৈমর কান্নাটা যে কত হাস্যাস্পদ, কত অসম্ভব, অপেক্ষাও অসম্ভব, সমস্ত দিন ধরিয়া এ কথা তার বহুবার মনে হইয়াছে, তবুও সেই একফোঁটা চোখের জল যেন কোনোমতেই আর শুকাইতে চাহিল না এবং প্রতি মুহূর্তেই সে এমনই একটা অজ্ঞাত ও অচিন্তপূর্ব রহস্যের সৃষ্টি করিয়া চলিল, যাহা একই কালে মাধুর্য ও তিক্ততায় মিশিয়া একাত্ম হইয়া উঠিতে লাগিল।

রাত্রির অন্ধকারেও পিতার চক্ষুকে ফাঁকি দিবার প্রয়াস নিষ্ফল বুঝিয়া হৈম স্বামী ও তাহার পশ্চিমা চাকরটাকে সঙ্গে করিয়া যখন ষোড়শীর নূতন বাসার দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইল, তখনও সন্ধ্যা হয় নাই। ষোড়শী একখানি কম্বলের উপর বসিয়া নিবিষ্টচিত্তে কি একখানা বই পড়িতেছিল, সম্মুখে জুতার শব্দ শুনিয়া মুখ তুলিয়া চাহিল এবং উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, আসুন। এস দিদি, এস। বলিয়া সে গুটানো কম্বলখানি প্রসারিত করিয়া পাতিয়া দিল।সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে নাও মিলতে পারে, এই যেমন কুঁড়ের মধ্যে নিরাশ্রয়, ধূলোবালির ওপর একাকী বাস করা তোমার সহ্য হবে না। বলিয়া সে পুনরায় হাসিয়া কহিল, সত্যিই আমাকে ঘরে থেকে টেনে-হিঁচড়ে কেউ ধরে নিয়ে যায়নি, আমি রাগের মাথায় আপনিই বেরিয়ে পড়েছিলাম।

নির্মল কহিল, কিন্তু আপনার রাগ আছে বলে ত মনে হয় না?

ষোড়শী হাসি চাপিয়া শুধু বলিল, আছে বৈ কি! হৈমকে কহিল, কিন্তু সে তর্ক আমি করচি নে, সত্যিই আমি মিথ্যে বলেছিলাম। কিন্তু ঘোর পাপিষ্ঠ বলে কি তাকে বাঁচাবার অধিকারও কারও নেই? তোমার স্বামী উকিল, তাঁকে বরঞ্চ সময়মত জিজ্ঞাসা করে দেখো।

নির্মল বলিল, সময়মত সাধারণ বুদ্ধিতে একটা জবাব দিতেও পারি, কিন্তু ওকালতি বুদ্ধিতে ত কিছুই খুঁজে পাচ্ছিনে।

ষোড়শী কহিল, তা ছাড়া এমন ত হতে পারে, সজ্ঞানে অনেক কর্মই তিনি করেন না—

হৈম বাধা দিয়া কহিল, তাই বলে কি নিজের বাপের বিরুদ্ধেও যেতে হবে? এও কি সন্ন্যাসিনীর ধর্ম?

ষোড়শী রাগ করিল না, হাসিমুখে কহিল, সন্ন্যাসিনীর হোক না হোক মেয়েমানুষের অন্ততঃ এমন জিনিস সংসারে থাকতে পারে যা বাপেরও বড়। তাই যদি না হতো হৈম, এই ভাঙ্গা কুঁড়ের মধ্যে তোমার পায়ের ধূলোই বা পড়ত কি করে?

হৈম শশব্যস্তে হেঁট হইয়া তাহার পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া কহিল, অমন কথা তুমি মুখেও এনো না দিদি। আমার শ্বশুরকে কোন্‌ এক রাজা একখানি তলোয়ার খিলাত দিয়েছিলেন, ছেলেবেলায় আমি প্রায় সেখানি খুলে খুলে দেখতাম। খাপখানা তার ধূলোবালিতে মলিন হয়ে গেছে, কিন্তু আসল জিনিসে কোথাও এতটুকু ময়লা ধরেনি। সে যেমন সোজা, তেমনি কঠিন, তেমনি খাঁটি—তার কথা আমার তোমার পানে চাইলেই মনে পড়ে। মনে হয়, দেশ-সুদ্ধ লোক সবাই ভুল করেচে, কেউ কিছু জানে না—তুমি ইচ্ছে করলে চোখের পলকে সেই খাপখানা ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারো। কেন দিচ্চ না দিদি?

ষোড়শী তাহার ডান হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসিয়া থাকিয়া কহিল, আজ তোমাদের যাওয়ার কথা ছিল, হলো না কেন? বোধ হয় কাল যাওয়া হবে?

হৈম তাহার স্বামীকে দেখাইয়া কহিল, কাল রাত্রে কে একে হাত ধরে নদী মাঠ প্রান্তর নির্বিঘ্নে পার করে এনে বাড়িতে দিয়ে গেছেন, আমার বাবা তাঁকে পুরো এক টাকা বকশিশ দিতে চেয়েছেন। কিন্তু টাকাটা তাঁর হাতে পড়বে না, কারণ তিনি তাঁকে খুঁজে পাবেন না। এই অন্ধ মানুষটিকে অমন করে দিয়ে না গেলে যে কি হতো সে কেবল আমিই জানি, আর আমিই কেবল তাঁর নাম জানি। কিন্তু টাকাকড়ি ত তাঁকে দেবার জো নেই—তাই কেবল একটু পায়ের ধূলো নিতে—বলিয়া সে তাহার হাতখানি টানিয়া লইবার চেষ্টা করিতেই ষোড়শী নিজের মুঠাটা শক্ত করিয়া রাখিয়া কেবল একটু হাসিল।

হৈম বাঁ হাত দিয়া তাহার চোখের কোণটা মুছিয়া লইয়া হাসিয়া কহিল, পায়ের ধূলো দিতে হবে না দিদি, মুঠোটা একটু আলগা কর—আমার হাত ভেঙ্গে গেল। শক্ত কেবল মনই নয়, হাতটাও কম নয়! ইস্পাতের তলোয়ারটা কি সাধে মনে পড়ে! কিন্তু এই কথাটি আজ দাও দিদি, আপনার লোকের যদি কখনো দরকার হয় এই প্রবাসী বোনটিকে তখন স্মরণ করবে?

ষোড়শী তাহার হাতের উপর ধীরে ধীরে হাত বুলাইতে লাগিল, কিছুই বলিল না।

হৈম কহিল, তাহলে কথা দিতে চাও না?

ষোড়শী বলিল, আমার জন্যে তোমার বাবার সঙ্গে ঝগড়া হয় এই কি আমি চাইতে পারি ভাই?

নির্মল কহিল, ঝগড়া না করেও ত অনেক জিনিস করা যায়?

ষোড়শী বলিল, আমি বলি তা-ও আপনাদের চেষ্টা করে কাজ নেই। কিন্তু তাই বলে প্রবাসী বোনটিকেও আমি ভুলে যাবো না। আমার খবর আপনারা পাবেন।

চাকরটা এতক্ষণ চুপ করিয়া বাহিরে বসিয়াছিল, সে কহিল, মা, কালকের মত আজও ঝড়-জল হতে পারে—মেঘ উঠেচে।

হৈম বাহিরে উঁকি মারিয়া দেখিয়া প্রণাম করিয়া এবার পায়ের ধূলা লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। নির্মল হাত তুলিয়া একটা নমস্কার করিয়া কহিল, আমি চিরদিন ঋণীই রয়ে গেলাম, শোধ দেবার আর কোন পথ রইল না। আদালতের মানুষ, বিষয়-সম্পত্তিওয়ালা ভৈরবীর কাজে লাগলেও লাগতে পারতাম, কিন্তু কুঁড়েঘরের সন্ন্যাসিনীরা আমাদের হাতের বাইরে। সমস্ত না ছেড়েও উপায় ছিল না সত্যি, কিন্তু ছেড়েও যে উপায় হবে তা ভরসা হয় না।ষোড়শী উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, কে বললে আমি সমস্ত ছেড়ে দিয়েচি? আমি ত কিছুই ছাড়িনি।

নির্মল ও হৈম উভয়েই অবাক্‌ হইয়া একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, ছাড়েন নি? কোন স্বত্বই ত্যাগ করেন নি?

ষোড়শী তেমনি শান্তসহজ-কণ্ঠে কহিল, না কিছুই না। আমি স্ত্রীলোক, আমি নিরুপায়, কিন্তু আমার ভৈরবীর অধিকার এক তিল শিথিল হয়নি। তাঁরা পুরুষমানুষ, তাঁদের জোর আছে, কিন্তু সেই জোরটা তাঁদের ষোল আনা সপ্রমাণ না করে আমার হাত থেকে কিছুই পাবার জো নেই—মাটির একটা ঢেলা পর্যন্ত না। নির্মলবাবু, আমি মেয়েমানুষ, কিন্তু সংসারে সেটাই আমার বড় অপরাধ যাঁরা স্থির করে রেখেছেন, তাঁরা ভুল করেছেন। এ ভ্রম তাঁদের সংশোধন করতে হবে।

কথা শুনিয়া দুজনেই স্তব্ধ হইয়া রহিল। ঘরে তখনও আলো জ্বলে নাই—অন্ধকারে তাহার মুখ, তাহার চোখ, তাহার ক্ষীণ দেহের অস্পষ্ট ঋজুতা ভিন্ন আর কিছুই লক্ষ্য হইল না, কিন্তু ওই শান্ত অবিচলিত কণ্ঠস্বরও যে মিথ্যা আস্ফালন উদ্গীর্ণ করে নাই, তাহা মর্মের মাঝখানে গিয়া উভয়কেই সবলে বিদ্ধ করিল।

অনতিদূরে পথের বাঁকটার কাছে একটা গোলমাল শুনা গেল। আগে এবং পিছনে কয়েকটা আলোর সঙ্গে গোটা-দুই পালকি চলিয়াছে।

অন্ধকারে নজর করিয়া দেখিয়া নির্মল কহিল, জমিদারবাবু তাহলে আজই পদধূলি দিলেন দেখচি।

ষোড়শী ভিতর হইতে সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিল, জমিদারবাবু! তাঁর কি আসবার কথা ছিল? বলিয়া সে দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।

নির্মল কহিল, হাঁ, তাঁর নদীর ধারের নরককুণ্ডর ঝাড়ামোছা চলছিল। এককড়ি বলছিল, শরীর সারাবার জন্যে হুজুর আজকালের মধ্যেই স্বরাজ্যে পদার্পণ করবেন। করলেনও বটে।

ষোড়শী নির্বাক্‌ হইয়া সেইখানেই দাঁড়াইয়া রহিল। বিদায় লইয়া নির্মল আস্তে আস্তে কহিল, যত দূরেই থাকি, আমরা বেঁচে থাকতে নিজেকে একেবারেই নিরুপায় এবং নিরাশ্রয় ভেবে রাখবেন না। বলিয়াই সে হৈমর হাত ধরিয়া অন্ধকারে অগ্রসর হইল। ষোড়শী তেমনি স্থির তেমনি স্তব্ধ হইয়াই রহিল, এ কথারও কোন উত্তর দিল না।

Comments
Read more