১ম খন্ড
আমার বিয়ে। বিয়ে সবার জীবনের একটা কাঙ্খিত দিন, আনন্দের দিন। অথচ আমি লজ্জা পাচ্ছি। আটচল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে হলে, অবশ্য সবাই আমার মতোই আনন্দ না পেয়ে লজ্জাই পেতো। বিয়ে করে মানুষ যৌন চাহিদা মেটানোর জন্য, বংশ বৃদ্ধি করার জন্য, সংসার করার জন্য, ভালোবাসার জন্য। অথচ যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে তার কোনো যৌন চাহিদা আছে কি-না জানি না, তবে আমার নেই।
গত বছর নভেম্বার মাস থেকে আমার মেন্সস্ট্রুয়েশন বন্ধ। বয়স হয়েছে, শরীরে রক্ত শূণ্যতা দেখা দিয়েছে। প্রাকৃতিগতভাবেই বয়স হলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর নারীদের সন্তান ধারন ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। আমার মেন্সট্রুয়েশন বন্ধ হয়ে যাওয়া সন্তান ধারন ক্ষমতা শেষ হয়ে যাওয়ার লক্ষন কি-না জানি না। অবশ্য জানার প্রয়োজনও হয়নি। স্বামী ছাড়া আমি সন্তান পাবো কোথায়?
আমি ফুলশয্যার ঘরে বসে অপেক্ষা করছি আমার স্বামীর জন্য। যার সাথে আজ সন্ধ্যায় আমার বিয়ে হয়েছে। আচ্ছা! আমি যতটা অধির আগ্রহে ভদ্রলোকের জন্য অপেক্ষা করছি। তিনি নিশ্চয়ই ততটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। অবশ্য তার আগ্রহের কোনো কারণই নেই। আমি হচ্ছি তার দ্বিতীয় বউ। তিনি ষাট বছরের একজন বিপত্নীক। বছর পাঁচেক আগে ভদ্রলোকের স্ত্রী রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। বৃদ্ধ বয়সে তিনি আর বিয়ের চিন্তা করেনি। অথচ ছেলেরা দেশের বাইরে থাকে, সেজন্য অসুস্থ বাবাকে কোনো কাজের লোকের কাছে রেখে যেতে চায়নি। বাধ্য হয়ে বিয়ে নামক স্বীকৃতি দিয়ে তারা তার বাবার জন্য একজন পর্মানেন্ট কাজের লোক এনেছে।
যাকে বিয়ের সময় শর্ত দেয়া হয়েছে সে কোনদিন মা হতে পারবে না। বয়স ৪৮ হলেও আমি হচ্ছি কুমারী। মাতৃত্বের আক্ঙ্খা একজন নারী হিসাবে আমার রয়েছে।
আমাকে বিয়ে করাবে তারা একটাই শর্তে আমি কখনো মা হওয়ার চেষ্টা যেন না করি। আমি কষ্ট পেয়েছি, এমন কঠিন শর্তে ঠুকরে কেঁদেছি। তখন অবশ্য ছোটবোন মনে করিয়ে দিয়েছে," বুবু তোর তো মেন্সস্ট্রুয়েশন বন্ধ। এমনি তেই তোর আর মা হওয়ার বয়স নেই। শর্ত দিয়ে ভালোই করেছে। তুই রাজি হয়ে যায়।"
অামার অবশ্য রাজি না হয়েও কোনো উপায় ছিল না। আর কত কাল ছোট ভাই, ছোট বোনের সংসারে তাদের দয়ায়, অনুগ্রহে বেঁচে থাকব। তাদেরও সংসার আছে বউ -বাচ্চা আছে। আমাকে নিয়ে তাদের ছোট হতে হয়। কেউ আসলে পরিচয় দিতে পারে না।
নিজের বোন বলতে লজ্জা পায়, কাজের লোক বললে বিবেকে বাধে। আমি সব বুঝতে পারি, আমার অপমানে, অসম্মানে মরে যেতে ইচ্ছে করে। অথচ এই মধ্য বয়সে কেউ আমাকে বিয়ে করবে সেটাও আশা করিনি। হঠাৎ করে বিয়ের প্রস্তাব আশায় আমার মরুময় জীবনে যেন এক পশলা সুখের বৃষ্টি এসে ঝরে পড়েছে।
আমার চেয়েও বেশি উৎসাহী আমার ভাই- বোন। আপদ বিদেয় হবে ভেবে তারা শান্তিই পেয়েছে। তারা অবশ্য যেনতেন বিয়ে দেয়নি। ভদ্রলোকের ঢাকায় তিনটে বাড়ি, নিজস্ব গাড়ি, ব্যাংকে মোটা অংকের ফিক্সড ডিপোজিট আছে। দুই ছেলেই দেশের বাইরে প্রতিষ্ঠিত। দেশের সবকিছু বলতে গেলে আমিই ভোগ করব। এমন নির্ভেজাল সুখের জীবন তো আমার জন্য স্বর্গতুল্য।
নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে মনে এত বছরেও কেন আমার বিয়ে হয়নি। বিয়ে হয়নি বলব না। বিয়ে একসময় আমি ইচ্ছে করেই করিনি। পরে আমাকে দেয়া হয়নি। এর পরে আর কেউ করতে চায়নি। না না আমি মোটেও অসুন্দর নই বা অযোগ্য নই। এখন অবশ্য সুন্দরের চিটেফোটাও অবশিষ্ট নেই, আমি যৌবন কালের কথা বলছি। যখন চারদিক থেকে সমানে বিয়ের প্রস্তাব আসতো। বিয়ের কনে হিসাবে সবার কেবল আমাকেই পছন্দ হতো। আমি অসম্মতি জানালে অনেকেই বলত
"ঠিক আছে তুমি এখন বিয়ে না করলে, তোমার মতো একজন মেয়ে হলেও আমার ভাইয়ের জন্য দেখে দিও।"
তার মানে আমার মতো মেয়ে চাই সবার বিয়ে করার জন্য। একটা সময় আমার মতো, আমার মতো নয় সব মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে শুধু আমি ছাড়া।
আমার বিয়ের বয়সে হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়াও পুরো পরিবারের দায়িত্ব আমার কাঁধে এসে পড়েছে। তখন আমার বয়স আর কতই বা হবে! বড় জোর আঠারো কী বিশ! সবে মাত্র কলেজের গণ্ডিটা পার করেছি। স্কুল শিক্ষক বাবার স্বপ্ন ছিল আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর। আমিও শিক্ষকতা করব বাবার মতো, তবে স্কুলে নয় কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু বিধি বাম।
বাবার মৃত্যুর পর আমাকে বাধ্য হয়ে নিজ জেলা শহরে ডিগ্রিতে এডমিশান নিতে হয়েছিল। আত্মীয় -স্বজন কেউ মেনে নিতে পারেনি আমার উপজেলা শহরের ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারটা। যে মেয়ে এসএসসি আর এইচএসসিতে স্টার মার্কস পেয়েছে, সে পড়বে ডিগ্রিতে! স্বয়ং মা কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন। মেয়েকে নিয়ে ছোটবেলা থেকে দেখা স্বপ্ন হঠাৎ করে শুকনো পাতার মতো মরমর করে ভেঙে যাওয়ায়।
অথচ আমি ছিলাম চুপচাপ। কারণ বাবার মৃত্যুর পর পুরো পরিবারের একমাত্র অভিভাবক তখন আমি একা। আমরা চার ভাই-বোন। সবার বড় বুবু। সে বুদ্ধি প্রতিবন্ধি। এক জীবনে তার বিয়ে শাদির আর আশা নেই। কে নেবে ওর দায়িত্ব। যে মেয়ে নিজের ভালো বুঝে না। বুদ্ধি নেই, বিবেক নেই, শুধু ক্ষুদা আছে। খেতে বসলে পাতিলে কি আছে না আছে ওসব তার দেখার বিষয় না, তার বড় মাছের টুকরো চাই, প্রতিবেলায় মাংস চাই। খাওয়া একটু কম হলেই শুরু হয় তার উৎপাত। এতদিন বাবা -মা সহ্য করেছেন। পরে আমাকে আর মাকে সহ্য করতে হয়েছে।
আমি মেজো। বাবার মৃত্যুর কয়েকমাস আগে এইচএসসি পাশ করেছি। তার পর ছোট একভাই, একবোন। ভাইয়ের নাম মাসুদ। তখন এসএসসি পড়তো জিলা স্কুলে। বাবার স্বপ্ন ছিল ওকে ডাক্তারি পড়ানোর। সেজন্যই ছোটবেলা থেকে ওকে জেলা শহরের হোস্টেলে রেখে পড়িয়েছে। প্রতিমাসে খরচ হিসাবে দিতে হয় তিনহাজার টাকা। সেও বাবার স্বপ্ন পুরণের পথে হাঁটছিল। অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। এসএসসিতে স্টার মার্কস পেলে নটরডেম কলেজে পড়তে চায়। ছোটবোন তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। সেও ছাত্রী হিসাবে ভালো ছিল। যে এখন দুই সন্তানের জননী। আমার বিয়েটা তার বাসায় থেকেই দিয়েছে।