আমি আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী। আমাকে বিয়ে করার পরেও অবশ্য তিনি আরেকটা বিয়ে করেছেন। আমি স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে এমন জীবন বেছে নিয়েছি। আমি বুঝতে পেরেছি, স্বামী নামক সম্পত্তিটি আমার একার থাকবে না। তাকে আমার ভাগ করে নিতে হবে অন্য নারীর সাথে।
তার দেহ ভাগ হবে, মন ভাগ হবে, অনুভূতি ভাগ হবে। তিনি আমাকে ভালোবাসার গল্প বলার মাঝপথে এসে অন্য নারীর ডাকে ছুটে যাবেন তার কাছে। আমি দেখব, সহ্য করব। আবার তাকে যেতে সাহায্যও করব। সেখান থেকে ফিরে আসলে আবার তার সেবাযত্নও করব।
আমি রেহানা। দরিদ্র কৃষক পিতার পাঁচ কন্যা সন্তানের মধ্যে সবার বড়। দেখতে মোটামুটি সুন্দর হওয়ায় বাবা জন্মের পর থেকেই আমাদের বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেন। তিনি কখনো আমাদের পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করার চিন্তা করেননি। কোনো রকম খাইয়ে, পরিয়ে পরের ঘরে বিদায় দেয়ার চেষ্টা করেছেন সবসময়।
আমার বয়স যখন মাত্র এগারো বছর। সবে মাত্র বয়ঃসন্ধিকালে পা রেখেছি। শরীরে পরিবর্তন এসেছে, সেই সাথে মনে। বাবা আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এনেছেন মহাজনের বড় ছেলে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সিরাজ মিঞার জন্য। যিনি বয়সে আমার বাবার সমবয়সী হবেন। যাকে প্রায় ভাদ্রমাসে উলঙ্গ হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত।
সবাই পাগল বলত। দুষ্ট ছেলের দল তাকে দেখলেই ঠিল ছুঁড়ে মারত। তাদের দলে কখনো কখনো আমিও সামিল হতাম। তখনই শুরু হতো সিরাজ পাগলার অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ।
মহাজনের টাকার অভাব ছিল না। মেঘনা নদীতে তিনটা মাছ ধরার ট্রলার অাছে। চরে কয়েকশ কানি ধানী জমি আছে। বাড়িতে দোতলা ভবন আছে। এত এত সম্পত্তি থাকার পরও তার বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বড় ছেলে আর নেশাগ্রস্হ নিঃসন্তান ছোট ছেলে ছাড়া আর কোনো বৈধ ওয়ারিশ নেই। বাবা ছিলেন মহাজনের জমির একজন চাষা। বাবার যে পাঁচ মেয়ে ছাড়া স্থাবর-অস্থাবর কোনো সম্পত্তি নেই। এটা মজাজন কোনোভাবে জানতে পেরেছেন। তিনি বাবাকে দশকানি জমি লিখে দেয়ার লোভ দেখিয়ে আমাকে তার পাগল ছেলের বউ করে নেয়ার প্রস্তাব দিলেন।
একজন ভূমিহীন কৃষকের কাছে দশ কানি সম্পত্তির লোভ ছিল অনেক বেশি। যিনি আজীবন পরের জমিতে কৃষকের কাজ করেছেন। মেয়েদেরকে ঠিকমতো খেতে দিতে পারেননি, পরতে দিতে পারেননি, শুতে দিতে পারেননি। তিনি যদি দশকানি সম্পত্তির মালিকানা রাতারাতি কোনো কষ্টের বিনিময়ে পেয়ে যান। সাথে তাঁর মেয়ের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তাহলে চোখ বন্ধ করে যেকোনো প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবেন। আমার বাবাও তার ব্যতিক্রম করেননি।
গীষ্মের এক কাঠফাটা দুপুরে জোহরের নামাজের পরপরই আমার বিয়ে হয়ে গেল। আমি নাবালিকা মেয়ের কোনো মতামতের তোয়াক্কা কেউ করেনি। প্রয়োজনও ছিল না।
মা যখন বলেছিলেন
" আজ তোর বিয়ে। এখন থেকে পেট ভরে ভাত খেতে পারবি। আর কোনো চিন্তা নেই। "
আজীবন ভাতের অভাব দেখে বড় হওয়া আমি ভেবেছিলাম, বিয়ে মানে পেট ভরে ভাত খাওয়া।
ভাতের লোভে আমিও খুশি মনে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়লাম। আমি তখনও জানতে পারিনি। কার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে।
অথচ শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার পর নানী, দাদী আমাকে শুধু একটাই শর্ত দিয়েছেন। বছর ঘুরতেই যেন আমি সন্তানের মা হই। ফুলশয্যার ঘরে স্বামীর সব আবদার যেন বিনা শর্তে মেনে নেই।
সন্তানের মা হবো কি! আমি তো নিজেই তখন প্যান্ট পরা এক ছোট্ট শিশু।
ফুলশয্যার ঘরে সিরাজ পাগলাকে সফেদ পাঞ্জাবি পরা আর ক্লিন সেভ করা দেখেও আমার চিন্তে অসুবিধা হয়নি। মুহূর্তে আমি মূর্ছা গেলাম।
সেই মূর্ছিত অবস্থায় ধর্ষিত হলাম কিছুক্ষণ আগে কালেমা পাঠ করে যে আমার স্বামীর অধিকার পেয়েছে তার কাছে। যে বারো মাসের মধ্যে এগারো মাস পাগল থাকে। যে আমার বাবার বয়সী। যাকে গত কয়েকদিন আগেও বন্ধুদের প্ররোচনায় ঠিল ছুড়ে মেরেছি।
ভোর রাতে যখন জ্ঞান ফিরল, রক্তাক্ত অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম মেঝেতে।
আর পুরো ঘর শূন্য খাক হয়ে পড়ে আছে।
সেদিন ভোরেই আমি লজ্জায়, ভয়ে, আপমানে, ব্যথায়, যন্ত্রণায় দিনের আলো ফোটার আগেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে চলে এলাম বাবার বাড়ি।
আমাকে দেখে যেন বাবা ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন।
"হায় হায় "
রব তুললেন আমার মা নিজেও। আমি সদ্য বিয়ে হওয়া নতুন বউ শ্বশুর বাড়ি থেকে কোন অসুবিধায় বাবার বাড়ি ফিরে এসেছে, সেটা একবারের জন্যও কেউ জানতে চায়নি।
বরং আমি আর যেতে অস্বীকৃতি জানলে যদি দশকানি জমি হাত ছাড়া হয়ে যায়। সেই শোকেই সবাই বারবার বিলাপ করছেন।
আমি অার ফিরে যাইনি ও বাড়ি। কার পরিচয়ে কার কাছে যাব। পাগলা যে ঐদিন রাতের অন্ধকারে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। আমাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ঘরের মেঝেতে ফেলে রেখে। তিনি আর কোনো দিন ফিরে আসেননি।
এভাবে চার মাস ছয়মাস কেটে গেল। আমার শরীরও জানান দিয়েছে নতুন অতিথির আগমনী বার্তায়।
বংশের একমাত্র প্রদীপের আগমনী সংবাদে মহাজনদের পুরো বাড়ি যেন আনন্দের উৎসব পড়ে গেলো।
দিনের মধ্যে চারবারও মহাজন এবং তার নিঃসন্তান ছোট ছেলে দেখতে আসে আমাকে।
আমি তখনও নির্বোধ জড় বস্তুর মতো নিশ্চুপ হয়ে কেবল সব চেয়ে দেখতাম।
কারণ আমি কোনোভাবেই নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে পারলাম না । আমার কী বিয়ে হলো? কার সাথে বিয়ে হলো?কীভাবে আমি সন্তানের মাও হতে চললাম! এই সন্তানের বাবা কে?
ফুলশয্যার ঘরে সফেদ পাঞ্জাবি পরা, ক্লিন সেভ করা লোকটার জন্য বারবার মন খারাপ করে উঠে।
মহাজন বিভিন্ন শহরে -বন্দরে, গ্রামে -গঞ্জে খোঁজ পাঠিয়েও ছেলের কোনো খোঁজ পাননি।
এটাই প্রথম নয় তিনি এরকম প্রায় নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন। কখনো কখনো কয়েকমাস পর ফিরে আসতেন। কখনো কখনো কয়েক বছরেও ফিরতেন না। ফুলশয্যার ঘরে বউ রেখে এভাবে নিরুদ্দেশ হবে কেউ ভাবতে পারেনি। সবাই ভেবেছিল নতুন বউ পেলে হয়তো মনমানসিকতার পরিবর্তন হবে। বউকে একা রেখে কোথাও আর চলে যাবে না। কিন্তু সবার ভাবনায় জল ঢেলে দিয়ে তিনি ফুলশয্যার রাতেই নিরুদ্দেশ হলেন।
নির্দিষ্ট সময়ে আমি রাজপুত্রের মতো এক পুত্র সন্তানের মা হলাম। তখনও সন্তানের বাবা নিঁখোজ ছিলেন। তার দাদ, চাচা এলেন তাকেসহ আমাকে তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে। এতদিন নিশ্চুপ থাকা মেরুদন্ডহীন আমার বাবা হঠাৎ বিদ্রোহ করে বসলেন। প্রয়োজনে দশকানি জমি তিনি ফিরিয়ে দেবেন, তারপরও তিনি কোনোভাবেই আমাকে তার নাতিসহ ও বাড়ি ফেরৎ পাঠাবেন না।
অথচ তারা তাদের একমাত্র বংশধরের জন্য প্রায় মরিয়া হয়ে পড়েছেন। আমার বাবার যে কোনো শর্ত মানতে রাজি। প্রতাপশালী মহাজন বাবার কাছে হাত জোড় করে নাতিসহ পুত্রবধুকে তাদের বাড়ি ফিরিয়ে নিতে চান। প্রয়োজনে স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি আমার নামে লিখে দেবেন।
তখনও আমার বাবা নারাজ। আমি তো মরেছি বছরখানিক আগেই। সেকারণে মৃত আমার মতামত কেউ জানতে চায়নি। যেদিন দেখতে পেলাম সারা রাস্তায় উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ানো লোকটা আমার স্বামী।
বাবা পারিবারিকভাবে বৈঠক ডাকলেন। ঐ পরিবারের সাথে আমার সম্পর্ক শেষ করার প্রস্তাব করলেন। বাবার পক্ষে গ্রামের গন্যমান্য সব লোক ছিলেন। স্বামী ছাড়া শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার কোনো মানে হয় না। সেদিন
মহাজনের নেশাখোর লম্পট ছেলে যাকে রেখে বউ চলে গেছে, সে হঠাৎ ভরা মজলিসে সন্তানসহ আমার দায়িত্ব নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বাবাও রাজি হয়ে গেলেন। আমি আবার ফিরে গেলাম শ্বশুর বাড়ি। তবে এবারও নতুন বউ হয়ে, এখন আর কোনো পাগলের বউ নয়। নেশাখোর লম্পট ছেলের দ্বিতীয় স্ত্রী হয়ে।
সেদিন রাতেরবেলা কাউকে না জানিয়ে একা একা ফিরে এলেন আবার সতীনও, যিনি বিয়ের দশ বছরেও সন্তানের মা হতে না পেরে প্রায় উন্মাদ হয়ে শ্বশুর বাড়ি ছেড়েছেন। মাতৃত্বের যে হাহাকার ছিল তার হৃদয়ে আমার ছেলেকে অষ্টেপৃষ্ঠে বুকের সাথে জড়িয়ে যেন সে সেটা ভুলে গেল।
আমাকে ফুলশয্যার ঘরে দিয়ে সে আমার ছেলেকে নিয়ে দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেল। স্বপ্নের মতো সুন্দর কেটেছিল আমার দিনকাল। সংসার, সন্তান, সম্মান, সতীন, স্বামী নিয়ে আমি যেন দন্ত্য-স বর্ণের মাঝে জীবনকে বেঁধে ফেলেছি।
আমি আর আমার সন্তান ছিলাম মহাজন পরিবারের সবার চোখের মনি। ভাতের অভাব, কাপড়ের অভাব, সম্মানের অভাবে বেড়ে ওঠা আমি সতীনের কষ্টটা মেনেই নিয়েছি। যদিও তিনি আমার ছেলেকে ছাড়া আমার কাছ থেকে কিছুই চাননি কোনোদিন।
ছেলেকে পেয়ে যে মিরাজ বদলে গেলো। নেশা ছেড়ে দিলো, বাবার ব্যবসার হাল ধরল, সংসারী হলো। হঠাৎ করে বিয়ের দশ বছরেও নিজে ঔরষজাত সন্তানের বাবা হতে না পেরে বদলে যেতে শুরু করল সে পূনরায়।
ঠিকমতো ঘরে আসত না, ছেলেকে আদর করত না। নেশা করে পথেঘাটে আগের মতো পড়ে থাকত।
তার পাগল ভাই যদি একরাতে পুত্রসন্তানের বাবা হওয়ার মতো যোগ্য হতে পারে, সুস্থ-সবল সে কেন পারছে না। প্রথম বউ না হয় বন্ধ্যা ছিল। একটা সন্তান জন্মদিতে পারা নাবালিকা আমি এখন তরুনী হয়েও কেন তার সন্তানের মা হতে পারছি না। জিদ করে সে পূনরায় বিয়ে করে নিয়ে এলো আরেক স্ত্রী।
আজীবন বরফ শীতল আমি স্বামীর তৃতীয় বিয়েতেও কোনো উচ্চ বাক্য করিনি।
অথচ বড় হওয়া আমার ছেলে হঠাৎ করে অস্তিত্ব সংকটে ভূগতে শুরু করল।
কে তার মা সেটা সে বুঝতে পারে না। বন্ধু-বান্ধব সবার একটাই মা থাকে তার কেন দুটো মা? বড় মা, ছোট মা! তার বাবা যদি মিরাজ আলি হয়। কাগজপত্রেরর সিরাজ আলিটা কে?
মিরাজ আলি যদি সত্যি তার বাবা হয়ে থাকেন। স্ত্রী সন্তান থাকার পরও কীসের সন্তানের জন্য তিনি আবার বিয়ে করেছেন!
আমার পঞ্চম শ্রেনিতে পড়ুয়া ছেলে এত ঐশ্বর্যের মধ্যে থেকেও নিজেকে একা মনে করছে। তার বাড়ি-ঘর, মা-বাবা, দাদা- দাদী থাকার পরও সে একাকীত্বে ভূগছে। আমি তার মা কি-না সে ব্যাপারে তার সন্দেহ হচ্ছে। সে সৎ মাকেই আপন মনে করে।
এক্ষেত্রে অবশ্য তার কোনো দোষ নেই। আমি সতীনের কাছ থেকে স্বামীকে আগলে রাখার জন্য ছেলের প্রতি উদাসীন ছিলাম।
নেশাগ্রস্থ স্বামীকে সংসারী করার জন্য তার প্রতি যত্নশীল ছিলাম। ফলাফল দিন শেষে ছেলে আমার নয়, স্বামীও আমার নয়। আমি যার জন্য সবকিছু হারালাম। একই বাড়িতে থেকেও আমি তার নাগাল পাই না। সে সারাদিন মেতে থাকে নতুন বউ নিয়ে। ছেলে থাকে তার বড় মাকে নিয়ে।
আমার কাঁধে প্যারালাইসিস শ্বশুর, অসুস্থ শ্বশুড়ি, একরাশ ব্যর্থতা, হতাশা আর সব হারানোর যন্ত্রণা।
নিজেকে বড্ড ব্যর্থ মনে হয় জীবনে। নয়মাস গর্ভে ধারন করে, অমানসিক যন্ত্রণা সহ্য করে আমি কিশোরি মেয়ে যে সন্তানের জন্ম দিয়েছি। সে সন্তান যখন আমার দিকে অভিযোগোর আঙ্গুল তুলে। আমাকে লোভী মনে করে তখন মরে যেতে ইচ্ছে করে। আমি মহাজন পরিবারের তিন বউয়ের সবচেয়ে বেশি বিশ্বস্ত বউ। আমার ব্যাংক একাউন্টে লাখ লাখ টাকা। আমার শাড়ির কিনারায় পুরো বাড়ির সিন্দুকের চাবি। আমার পরনে দামী শাড়ি। অথচ সবকিছু আমার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। ইচ্ছে করে ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কান্না করে সব যন্ত্রণা ধুয়ে ফেলি।
কিন্তু জীবন যুদ্ধে পরাজিত আমার ছেলে আমাকে অপছন্দ করে, সৎ মায়ের বুকের ভেতর লুকিয়ে ঘুমায়।