সুরভী একবার এয়ার হোস্টেসের মতো সুন্দর পারিপাটি করে শাড়ি পরছে। আবার খবর পাঠ করা মেয়েদের মতো করে আঁচল ভাঁজ করে উপরে তুলে কীভাবে যেন পরছে। আবার মাথায় কাপড় তুলে গাঁয়ের বধুর মতো করেও শাড়ি পরছে।
আশ্চর্য মেয়েটার এত ধৈর্য একটা শাড়ি প্রায় এক ঘন্টা ধরে পরছেই পরছে।
আমাদের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে সন্ধ্যায় কাছের কিছু আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত করেছি।
আমি ঘুমের ভান করে আড় চোখে সুরভীর দিকে তাকাই। মেয়েটা একা একা বিড়বিড় করে কী যেন বলে আবার হাসে।
এবার চট করে শাড়িটা খুলে ভাঁজ করে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে নিত্যদিনের আটপৌরে থ্রিপিসটা পরে আমার পাশে এসে বসল।
কী মনে করে গায়ে হাত না রেখে আবার বেরিয়ে গেল। সুরভী বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজার পর্দা নড়ে উঠল।ফ্যানের বাতাসে না-কি সুরভীর শরীরের বাতাসে জানি না, পর্দাটা এখনো নড়ছে।
আমি স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম পর্দার দিকে। আমার দু'চোখর কোণ জলে ভেসে যাচ্ছে।
আমি শামীম। ব্যাবসা করছি। জেলা শহরে বড় দুটো দোকান আছে। যেখানে রড ,সিমেন্ট, টিন থেকে শুরু করে ইট আর বালি ছাড়া একটা বিল্ডিং বানানোর প্রায় সব উপকরন পাওয়া যায়।
সুরভী আমার স্ত্রী। আমাদের বিবাহিত জীবনের নয় বছর চলে।
আমাদের একটা পুত্র সন্তানও আছে। ওর বয়স বেশি না। মাত্র চার বছর। নাম সাদ।
এই যে আমি শহরে বড় বড় দুটো দোকানের মালিক। আমার দোকানে সাতজন কর্মচারী কাজ করে। আমি মাসে খরচ বাদ দিয়ে গড়ে এক লক্ষ টাকার বেশি আয় করি।
বিয়ের সময় কিন্তু আমার এই অবস্থা ছিল না। সুরভীকে যখন বিয়ে করি তখন আমার পকেটে স্কচটেপ দিয়ে জোড়া লাগানো একটা পাঁচ টাকার নোট ছিল।
আমি পরিবারের ছোট সন্তান। ভাই বোন সবাই আছে মোটামুটি নিজেদের মতো করে। অভাব না থাকলেও কারো সংসারে উদ্বৃত্ব ছিল না।
বোনরা তো পরের ঘর করে। শুধু আমি বেকার না, বাবাও বেকার। ভাইয়ের উপরই সংসার।
আমি মোটামুটি বয়স হওয়ার পর থেকে কিছু একটা করার জন্য কত চেষ্টা করেছি। কেন জানি কোনো কাজেই আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি।
চাকরি করেছি, ব্যাবসা করেছি। কোনোটাতেই আলোর মুখ দেখতে পারিনি।
এদিকে মেঘে মেঘে আমার বেলাও বেড়ে গেল। কখন যে বয়স ত্রিশ হয়ে গেল বলতেই পারব না। বন্ধু- বান্ধব সবাই বিয়ে করে ফেলেছে।
আমারও একটা সংসার করা প্রয়োজন। অথচ নিজের পকেটে টাকার জোর নেই। সে কারণে মনের ইচ্ছেকে মেঘের আড়ালে ঢেকে রেখেছি। যদি কখনো অবস্থার পরিবর্তন করতে পারি তখন না হয় দেখা যাবে।
কিন্তু না, আব্বা আমার পিছনে লেগেই আছেন, একটা বিয়ে করার জন্য।
আমি কখনো সাহস করিনি। পরের মেয়েকে ঘরে আনলেই তো দায়িত্ব শেষ না।
অানতে অনেক আয়োজন লাগে আর আনলেও সতেরো রকমের আনুষ্ঠানিকতা। সবকিছুতেই টাকার প্রয়োজন। অথচ আমার শুন্য পকেট।
বারবার বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে একবার আব্বা আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
তখন অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রায় শুন্য হাতেই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম।
বাবারও শুন্য হাত আমারও শুন্য হাত ভরসা শুধু আল্লাহর।
প্রায় দশ পনেরোটা মেয়ে দেখা হয়ে গেল। কোনো পরিবারই বেকার ছেলের সাথে আত্মীয়তা করতে রাজি হয়নি।
আমিও আশা ছেড়ে দিয়েছি। আয়ের কোনো পথ বের করতে না পারলে এজীবনে আর বিয়েই জুটবে না আমার কপালে।
হঠাৎ একদিন হাসিমুখে আব্বা খবর নিয়ে এলেন এক পরিবার আমার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে। আগামী শুক্রবার বায়না হবে।
আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে মানে শাড়ি, গয়না, মিষ্টি আরও কত কি। অথচ আমার পকেট তখন শূন্য।
আব্বা ভাই বোনদের কাছে প্রস্তাব করলেন
"তোমরা সবাই মিলে সহযোগিতা করে শামীমকে বিয়েটা করিয়ে দাও। বিয়ে হচ্ছে একটা ফরজ কাজ। সেটা ফেলে রাখা উচিত নয়।
বিয়ের পর দেখবে আল্লাহর রহমতে ওর অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমারও একসময় কিছু ছিল না। আল্লাহ যা দিয়েছেন সব বিয়ের পরেই হয়েছে।"
ভাই বোনও খুশি মনে রাজি হয়ে গেল।
দুর্ভাগ্য আমি ৫০০টা টাকা আব্বার হাতে দিয়ে বলতে পারিনি।
" বাবা,এই টাকা দিয়ে নতুন বউয়ের জন্য একটা শাড়ি কিনবেন।"
উনারা কিভাবে কিভাবে যেন এদিক সেদিক করে আমার বিয়ের আয়োজনটা সুসম্পন্ন করে ফেললেন।
আমি লজ্জায় হোক বা ভয়ে নিজ থেকে কোনো পরামর্শই দেইনি। টাকা পয়সা না দিতে পারলে যা হয় আর কি!
এক শুক্রবার সুরভীর সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। দাসবাড়ি থেকে সন্ধ্যার পর লুকিয়ে আনা একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে আমি ফুলশয্যার ঘরে সুরভীকে প্রেম নিবেদন করেছি।
সুরভীর পরনে ছিল লাল রঙচঙা শাড়ি। বিয়ের শাড়ি হিসাবে আমাদের বাড়ি থেকেই দেয়া হয়েছে।
ডিম লাইটের আলোয় আমার লালই মনে হয়েছিল শাড়িটার রঙ।
দিনের আলোয় মনে হল, না, খানিক ভুল হয়েছে শাড়িটার রঙ খয়েরি।
কিন্তু শাড়িটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। কার পরনে যেন দেখেছি!
মা, বোন, ভাবি.... না, মনে পড়ছে না।
শেষ বিকালে শাড়ি ভাঁজ করতে গিয়ে মনে পড়ল। এটা ছোট আপার শাড়ি। একদিন সে পরেছিল। হিল জুতার সাথে লেগে নিচের দিকে কয়েকটা সূতা উঠে গেছে।
আর আঁচলে একটু লিপিস্টিকের দাগও আছে। এছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই পুরো শাড়ি টাটকা নতুন।
আমার মন খারাপ হয়ে গেল। বোনের পুরনো শাড়ি পরে আমার বউকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হল, শুধু আমি বেকার হওয়ার কারণে।
কষ্টে শুনেছি মেয়েদের কণ্ঠ ভারি হয়ে আসে, চোখ ভরে জল আসে। ছেলে হওয়ার কারণে কি-না জানি না এমন উথালপাথাল কষ্ট কখনো আমার হয়নি।
আজ সত্যি সত্যি আমি কষ্ট পেয়েছি। নিজেকে স্বামী হিসাবেই অযোগ্য মনে হয়েছে। মানুষ হিসাবে অস্তিত্বহীন।
আমি সুরভীর সামনে থেকে দ্রুত সরে গেলাম। বাথরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ কাঁদলাম।
আমি যখন বুঝতে পেরেছি, সুরভী কি পারেনি! অথচ সে আমাকে একটা প্রশ্নও করেনি।
আমি আড়চোখে সুরভীকে দেখি। সে হাসে, মিষ্টি হাসি, সুখের হাসি।
লিপিস্টিকের দাগ লাগা পুরনো শাড়ি নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই, আপসোস নেই।
সে আমাকে নিয়ে সন্তুষ্ট।
বিয়ের দিন শ্বশুর বাড়ি থেকে আসা দশ বছর বয়সি মামাতো শ্যালিকা যখন বলল
" বুবু তোর বিয়ের শাড়িটা একদিন পরেই পুরনো করে ফেললি?"
সুরভী ওর হাত থেকে ছোঁ মেরে শাড়িটা কেড়ে নিয়ে বলল
" বিয়ের শাড়ি মানুষ একদিনই পরে, সে কারণে ইচ্ছে করে পুরনো করে ফেলেছি। এটা নতুন থেকে কি হবে?"
" লিপিস্টিকের দাগও লাগিয়েছ?"
" শুধু লিপিস্টিকের দাগ নয়, ছিঁড়েও ফেলেছি। এদিকে দে আলমারিতে রেখে দেই।"
আমি আড়চোখে সুরভীর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। একরাত সংসার করা উনিশ বছর বয়সি একটা মেয়ে তার স্বামীর, শ্বশুর বাড়ির সম্মান রক্ষা করার জন্য কী অনায়াসে মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে সুরভীর প্রতি আমার শুধু ভালোবাসা নয়, শ্রদ্ধাবোধও জেগেছে কয়েকশগুণ।
আমি সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছি, যেভাবেই হোক আমি নিজের অবস্থানের পরিবর্তন করব।
সুরভীকে শাড়ির স্তুপে ডুবিয়ে রাখব।
আমার ইচ্ছাশক্তি হোক বা সুরভীর ভাগ্য হোক ত্রিশ বছরে যে আমি নিজের ভাগ্যের বিন্দু পরিমান পরিবর্তন করতে পারিনি।
সে আমি বছর না ঘুরতেই শহরে রড সিমেন্টর বড় দোকান দিয়ে ফেললাম। বিয়ের সময় বিভিন্ন আত্মীয় -স্বজন থেকে পাওয়া ২০,০০০ টাকা পুঁজি দিয়ে।
আমাদের বিয়ের নয় বছর চলছে। সুরভীর আলমারিতে প্রায় দুইশ শাড়ি আছে। সব আমার কেনা। আমি প্রতিমাসে তার জন্য কম হলেও একটা শাড়ি কিনে দেই।
আর ফিসফিস করে কানের কাছে গিয়ে অনুরোধ করি
" শাড়িটা পরবে।"
সুরভী হাসে, মিষ্টি হাসি
" অবশ্যই পরব।"
যত শাড়িই আমি নিজের টাকায় সুরভীকে কিনে দিয়েছি। তার এখনো পছন্দের শাড়ি হচ্ছে বিয়ের দাগ লাগা, ছেঁড়া শাড়িটা।
আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে বিয়ের শাড়ির মতো প্রায় সেইম কালারের একটা শাড়ি এনেছি। ভেবেছি সুরভী বুঝি সেই শাড়িটা পরবে।
সেই শাড়িটা অবশ্য পরেছে সন্ধ্যায় আপ্যায়িত অতিথীদের সামনে।
মধ্যরাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে গেছে। সেই নয় বছর আগে বিয়ের দিন পরা শাড়িটা পরে সে চুপিচুপি আমার পাশে এসে বসেছে। আমার হাতে আজও রজনীগন্ধা ফুলের গুচ্ছ। আজ আর কোথাও থেকে চুরি করে আনিনি। ছাদে টবের মধ্যে একটা রজনীগন্ধা ফুলের গাছ লাগিয়েছি।
বিবাহবার্ষিকীতে যেন সুরভীকে উপহার দিতে পারি।