আত্নমর্যাদার জীবন

Comments · 5 Views

জীবনে টাকা পয়সাই বড় না আত্মসম্মান ও আত্নমর্যাদা অনেক কিছু।

"খবরদার তুমি আমার পরিবার তুলে কথা বলবে না!"

 

হঠাৎ ছেলের রুম থেকে উচ্চস্বরে কথার আওয়াজ শুনে আমি থমকে দাঁড়ালাম।

আমি জানি কারো রুমে, কারো কথায় আড়িপাতা ভালো অভ্যাস নয়। কিন্তু কেন যেন আজ আর এড়িয়ে যেতে পারিনি।

 

আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। আমাদের দোতলা ঘরের উপরতলার দক্ষিণ পাশের বারান্দা লাগোয়া প্রশস্ত রুমটার দিকে। যেখানে আমার একমাত্র ছেলে আসাদ তার বউ নিয়ে থাকে।

 

আসাদ বিয়ে করেছে মাস দুয়েক হবে। বিয়েটা আমরা করাইনি। অথচ অনেক শখ ছিল ধুমধাম করে একমাত্র ছেলেকে বিয়ে করানোর।

 

আমার তিন মেয়ে, এক ছেলে। বড় দুই মেয়েকে আমি নিজে পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছি।

কিছু চাহিদা ছিল আমার। যে ছেলে আমার মেয়ের বর হবে তাকে সে সে চাহিদা পুরন করতে হবে।

 

আলহামদুলিল্লাহ্ আমার চাহিদা অনুযায়ীই পরের ছেলেরা আমার মেয়েদের বিয়ে করে নিয়েছে। তারাও স্বামী সংসার নিয়ে বেশ সুখেই আছে।

 

চাহিদা কিন্তু বেশি কিছু না। শুধু নারীকে মানুষ মনে করতে হবে, নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। পুরুষ বলে নিজেকে ভিন গ্রহের প্রাণি মনে করলে চলবে না।

 

ছেলের বউয়ের জন্য আমার তেমন কোনো চাহিদা ছিল না। শুধু একটা ফুটফুটে মিষ্টি মেয়ে হলেই চলবে। যার আত্মসম্মানবোধ থাকবে,যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানবে। এর বেশি শর্ত দিয়ে বিয়ে করানোর কোনো যোগ্যতাই আমার ছেলেটার। ছিল না। 

 

যদিও সে ইংরেজি সাহিত্য এমএ পাশ করেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ভালো গান করে, টুকটাক লেখালেখি করে। দেখতে বেশ সুদর্শন। কিন্তু...

 

কী বলব আর নিজের ঘরের কথা! বাবার মতো মুখ খারাপ। স্বভাবও মাশাল্লাহ বাবারটাই পেয়েছে। আমি না হয় ৩৫ বছর আগে এতিম ছিলাম। তাই বাধ্য হয়ে কত কিছু সহ্য করেছি মুখ বুঝে। আজকাল কার মেয়েরা কেন মানবে?

 

আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে, বিয়ের পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হওয়ায় তিনি তার মাকে গিয়ে নালিশ করলেন

 

" তোমার পছন্দের নবাবের বেটি কিন্তু এখনো ঘুমায়।"

 

আমারর বিস্ময়ের ঘোর পরের কয়েক সপ্তাহেও কাটেনি। যার সাথে রাতে আমার ফুলশয্যা হয়েছে। মা, খালা, নানীদের কথা মতো যার মনঃরঞ্জন করাই ছিল আমার সারা রাতের দায়িত্ব। সেই লোক দুই ঘণ্টার ব্যাবধানে এটা কী বলল! কাকে বলল?

 

বলার অবশ্য কারণ ছিল। পিতৃহারা এতিম, অসুন্দর মেয়েকে সে বিয়ে করতে চায়নি। নেহাৎ মায়ের অবাধ্যতা করতে পারেনি।

 

সেই লোকের সাথেই আমি বাধ্য হয়ে ৩৫ বছর সংসারও করেছি সাথে চার সন্তানের মাও হয়েছি। ও ভালো কথা আমার সাহেবও কিন্তু উচ্চ শিক্ষিত এবং সরকারি চাকরিজীবী ছিল।

 

সমাজে ভদ্র মানুষ হিসাবেও বেশ নাম ডাক ছিল। অনেকে বিভিন্ন সালিসেও ডেকে নিয়ে মধ্যস্ততা করাত। বেশিরভাগই পারিবারিক সমস্যার সমাধান। অথচ সে সমস্যাগুলোই সে প্রতিনিয়ত সংসারে সৃষ্টি করত।

 

অথচ ঘরের খবর আমি চাপা রেখেছি। ইটের দেয়ালের ভেদ করে উঠোনেও বের হতে দেইনি।

 

সে কারণে মেয়েদের বিয়ের জন্য যত প্রস্তাব এসেছে। যত বায়োডাটা জমা পড়েছে। সবার মতো আমি ছেলের সার্টিফিকেট দেখিনি, চাকরির পদমর্যাদা দেখিনি। ছেলের ছবি দেখিনি। শুধু বংশ দেখেছি। কোন বংশের ছেলে? স্বভাব কেমন? আচরণ কেমন? শুধু বই পড়েই পাশ করেছে না-কি আদব কায়দাও কিছু শিখেছে?

 

আলহামদুলিল্লাহ আমি নিরাশ হইনি। বড় মেয়ের জামাই যেমন ভদ্র, তেমন ব্যাবহার। সে মনে হয় জীবনে কোনে মেয়েকে তুই বলেও সম্বোধন করনি। কারণ বেয়াই আমার একজন সৎ, আদর্শবান স্কুল শিক্ষক। ছেলে তো বাবার মতোই হবে।

 

মেজো মেয়ের বরও আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো। পরিবারে ব্যলেন্স করে চলতে জানে। মাকেও সে অসম্মান করে না, স্ত্রীকেও অমর্যাদা করে না। ছোট মেয়ে অনার্সে পড়ে তার জন্যও আমার তেমন ছেলেই চাওয়া। বাকিটা আল্লাহ তাআলার ইচ্ছে।

 

জেনেটিক একটা ব্যাপার আছে না। সেটাকে আমি কোনোভাবেই ঠিক করতে পারিনি। এত ব্রিলিয়ান্ট ছেলে অামার। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সব সময় ভালো ফলাফল করছে। অথচ নারীদের প্রতি তার একধরনের বিদ্বেষ। সে নারী স্বাধীনতা পছন্দ করে না। নারীদের পুরুষের উপর কথা বলা পছন্দ করে না। ছেলের দোষ দিয়ে অবশ্য লাভ নেই। 

 

সে সারা জীবন তার মাকে মিনমিন করতে দেখেছে। বাবার চড়া গলার নিচে মায়ের গলার স্বর চাপা পড়ে যেতে দেখেছে।

সে হয়তো ভেবেছে দুনিয়ার সব মেয়েই বুঝি তার মায়ের মতোই হবে।

আমি অনেক বুঝিয়েও ছেলের স্বভাব পরিবর্তন করতে পারি না। এটা তেমন কোনো দৃশ্যমান দোষ নয়। তাই হয়তো প্রেমিকার চোখে ধরা পড়েনি।

 

মারিয়ার সাথে তার তিন বছরের জানা শোনা ছিল। ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করবে, সেটা নিয়ে আমাদের দ্বিমত ছিল না। কিন্তু একা একা বিয়ে করবে সেটা মানতে পারিনি।

 

মারিয়ার বাবা অন্যত্র তার বিয়ে ঠিক করেছে। সে কারণে মেয়েটা রাতারাতি এসে আসাদের কাছে হাজির হয়েছে। পরে বাবা- মা কাউকে না জানিয়ে নিজেরাই বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে।

 

নিজের একমাত্র ছেলে ধুমধাম করে বিয়ে করাব। সে '

আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। ছেলে বা ছেলের বউ কাউকে কিছু বলিনি।

 

ভয়ে হোক বা লজ্জায় হোক মেয়েটা আমাকে ভীষণ এড়িয়ে চলে। আমিও অপ্রয়োজনে কখনো কথা বলিনি।

সে হয়তো ভাবছে সংসারে শাশুড়ির কর্তৃত্ব চলে। তাকে ভয় না পেয়ে উপায় নেই।

অথচ এই কর্তৃত্বটুকু অর্জন করতে আমাকে অনেক কাঠ খড় পোহাতে হয়েছে।

 

বছর পাঁচেক আগে আফজাল সাহেব স্ট্রোক করে প্যারালাইসিস হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত সংসারের নুন, তেলটুকুও তার পছন্দে কিনতে হয়েছে।

 

চলার ক্ষমতা, বলার ক্ষমতা হারিয়ে হুইল চেয়ারে জীবন আবদ্ধ করে এখন এতটাই নির্ভরশীল হয়েছে আমার উপর। আমাকে সঙ্গে না নিয়ে ওয়াশরুমেও যেতে পারে না। একক কর্তৃত্বে চলা সিঃহ পুরুষকে এভাবে লেজ গুটিয়ে চলা দেখতে আমার পছন্দ হচ্ছে না।  

 

আমি সব কাজে তার পরামর্শ নেই, অনুমতি নেই। ছেলের বউতো আর এত কিছু জানে না।

 

আমার পায়ের শব্দ শুনে দুজনেই চুপ হয়ে গিয়েছে। আজই কিন্তু নতুন নয়। আমি প্রায় ওদের রুমে উচ্চস্বরে কথা শুনতাম। সবসময় স্বর আমার ছেলেরই চড়া থাকত। ভেবেছি হয়তো, জামা কাপড় পছন্দ মতো হাতের কাছে না পেয়ে বউয়ের উপর রাগ করছে। ছেলেটা একসময় এমন রাগ আমার উপরও করতো। এখন বউয়ের উপরও করছে ভেবে আমি খুশি হতাম না। ছেলে এখনো নিজের দায়িত্ব নিতে শিখেনি।

 

আজই ব্যতিক্রম হয়েছে। ভয়ে আমার বুকের ভেতর ধুকপুক করছে সাথে আনন্দও লাগছে।

 ভয়ে ধুকপুক করার কারণ, নিজের পছন্দের বউকে এমন কি বলেছে যে মেয়েটা এমন রেগে গেল?

 

আনন্দের কারণ হলো ত্রিশ বছর আগে প্রতিনিয়ত আমার বুকের ভেতর চাপা পড়ে যাওয়া যে বিদ্রোহী কন্ঠস্বর মরে কঙ্কালসার হয়ে গেছে, সে স্বরই আমি নতুন করে অন্যের কণ্ঠে শুনতে পেলাম।

 

" খবরদার তুমি আমার পরিবার তুলে কথা বলবে না।"

 

ত্রিশ বছর আগে যদি এই মেয়েটার মতো এমনি করে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলতে পারতাম

 

" খবরদার, কথা মুখ সামলে বলবে..."

 

তাহলে হয়তো স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য আমাকে ত্রিশ বছর অপেক্ষা করতে হতো না।

দুঃখজনক হচ্ছে, কেউ নিজের ভুল বুঝে স্বেচ্ছায় আমার স্বাধীনতা মেনে নেয়নি। বাধ্য হয়ে আমার উপর দায়িত্ব হস্তান্তর করেছে মাত্র।

 

কিছুক্ষণ পর সিঁড়ির কাছে মারিয়ার হাই হিলের শব্দ শুনতে পেলাম। মেয়েটা এগিয়ে আমার কাছে এলো।

বাম হাতে একটা ব্যাগ আর ডান হাতের পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছছে।

 

" মা আমি এলাম।"

 

আমি ওকে ফিরানোর চেষ্টা করিনি। যাক, ওর যাওয়াই উচিত। ফুলশয্যার পরের রাতে যদি এভাবে সাহস করে আমিও চলে যেতে পারতাম। তাহলে হয়তো এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হতো না আমাকে। আফজাল সাহেব আমাকে ফিরিয়ে আনলে নাকে খত দিয়েই ফিরিয়ে আনত। জীবনেও আর বাবা-মা তুলে কথা বলত না।

কী মনে করে কয়েক পা এগিয়ে মারিয়া আবার ফিরে এলো।

 

" মা আপনি নিশ্চয়ই আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি বাধ্য হয়েছি ফিরে যেতে। আপনার ছেলেকে বলবেন আমাকে ফিরানোর চেষ্টা না করতে।"

 

আমি শান্ত হয়েই জানতে চাইলাম

" যদি কিছু মনে না কর, কী হয়েছে মারিয়া।"

" মা আপনার ছেলে একটা অসভ্য, বর্বর, সাইকো। আমি রোজ অফিসে যাওয়ার আগে তার ফাইল, ঘড়ি, শার্ট জুতো সব রেডি করে রাখি। আজ রাখতে পারিনি। তাতেই....."

 

মারিয়া নাক টেনেটেনে কাঁদছে। আমার খুব মায়া হলো মেয়েটার জন্য।

" তাতে কী হয়েছে..."

" আমার মা চাকরিজীবী। তিনি বাবা ঘুম থেকে উঠার আগেই অফিসে চলে যেতেন। বাবা নিজেই নিজের শার্ট,প্যান্ট, ঘড়ি, চশমা, জুতা রেডি করতেন। মাঝেমধ্যে চা পর্যন্ত বানিয়ে খেতেন। দুই দিন পর আমার চাকরি হলে কে তার এসব রেডি করে দেবে। তার কত বড় সাহস সে আমাকে আমার মায়ের মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন বলছে।"

 

আমি একটুও অবাক হইনি। কারণ আমার ছেলেতো দেখেছে। আমি সারারজীবন তার বাবার হুকুমের চাকর হয়ে ছিলাম। চুলার উপর দুধ রেখেও তার বাবার গলার শব্দ শোনা মাত্র সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়েছি।

 

আসাত হয়তো জানে না, বুঝতে পারেনি কোনোটাই তার মা ভালোবেসে করেনি। ভয়ে করেছে, বাধ্য হয়ে করেছে।

 

আমার সাহসী, আত্মসম্মানে ভরপুর মেয়েটাকে বুকে টেনে নিয়ে কপালে চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু করিনি। যে মেয়েটাকে আমার অত ভালো লাগেনি। যার উপর কষ্ট ছিল। আজ তার উপর শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালোবাসা কাজ করছে।

আমি তো ছেলেটার জন্য এমনই একটা মেয়ে চেয়েছি। যে দীর্ঘদিন ধরে আমার ছেলের রক্তে লালিত আধিপাত্যের অহংকারের দেয়াল ভেঙে চুরমার করে দিয়ে সত্যি কারের মানুষ বানাবে।

 

তিনমাস পর আসাদ মারিয়াকে ফিরিয়ে এনেছে। তিনমাস আগে যে মেয়েটা আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। তার চোখে, মুখে যে আত্মসম্মানবোধ আমি দেখেছি, সে যে এমনি এমনি ফিরে আসেনি সেটা আমি ঢের বুঝতে পেরেছি।

 

আশা করি আর কখনো ছেলের রুম থেকে উচ্চবাক্য বাইরে বের হবে না। আমার ছেলেটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে, মেয়েদের আর যাই হোক অসম্মান করে কথা বলা যায় না।

Comments
Read more