কন্যা সন্তানের পিতা

আমাদের সমাজ এখনো অসভ্য হয়ে রয়েছে।

আমি কোনোভাবেই কন্যা সন্তানের বাবা হতে চাইনি। চাইনি মানে একদমই চাইনি। যেদিন আমার স্ত্রী আমাকে জানিয়েছে আমি বাবা হবো। আমি মুখ ফসকে বলে ফেললাম

 

" কন্যাশিশুর বাবা নয় তো!"

 

অসম্ভব ভদ্র, শান্ত, ব্যক্তিত্ববান, মানবিক হিসাবে আমার যে অবস্থান শ্বশুর বাড়িতে ছিল সেটা মুহূর্তে বদলে গেল। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন আমার স্ত্রী শ্বশুর বাড়িতে ছিল। অফিসের পাশে শ্বশুর বাড়ি হওয়ায় আমার স্ত্রী প্রায় আমার সাথে ওর বাবার বাসায় যেত। অফিস শেষ করে আমি গিয়ে একসাথে শ্বশুরের বাসায় রাতের খাবার খেয়ে ওকে নিয়ে ফিরে আসতাম।

 

আজও সন্ধ্যার পর অফিস টাইম শেষে স্ত্রীর জন্য টুকটাক কিছু কেনাকাটা করে ফুরফুরে মেজাজে শ্বশুর বাড়ি গেলাম।

 

বোনদেরকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে সুমনা অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। সুমনা আমার স্ত্রী। ওরা তিন বোন, এক ভাই। সবার ছোট সুমনা। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই। তাদের সন্তানরাও স্কুলে উপরের শ্রেণিতে পড়ে। ভাইও বিয়ে করেছি বেশ কয়েক বছর আগেই। সংগত কারণে তারা এখনো নিঃসন্তান।

 

সুমনার সাথে তার বোনদের বয়সের পার্থক্য প্রায় একযুগের কাছাকাছি। তাই তারা সুমনাকে বোনের চেয়েও বেশি সন্তানতুল্য মনে করেন।

 

সেই সন্তানতুল্য বোনের ঘরে নতুন অতিথির আগমনী বার্তায়, সবার মনে অনেক বেশি আনন্দের জোয়ার বয়ে এনেছিল।

সেই আনন্দের জোয়ারে আমাকেও ভাসানোর জন্যই সবাই একত্রিত হয়েছিল ড্রয়িংরুমে। কারণ তারা জানে অফিস শেষে এসে আমি সুমনাকে নিয়ে প্রতিবারের মতো এবারও নিজের বাসায় ফিরে যাব।

 

আমাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় একবছর। এই এক বছরে আমি এক রাতের জন্যও শ্বশুর বাড়িতে রাত্রিযাপন করিনি। সুমনা প্রায় বেড়াতে যায়। মাসের মধ্যে তিন চারবারও তার যাওয়া হয়। আমি কখনো তার ঘন ঘন বাবার বাড়ি যাওয়া নিয়ে কোনো আপত্তি করিনি।

 

 মাঝেমধ্যে সে এক -দুই রাত থেকেও যায়। আমিই কেবল থাকি না। নিজের বিছানা ছাড়া আমার ঘুম হয় না। প্রথম প্রথম শ্বশুর বাড়ির লোকজন আপত্তি করেছিল। সুমনা বুঝিয়ে বলায় এখন সবাই বুঝতে পেরেছে আমি আসলেই একটু ব্যতিক্রমী। 

 

হঠাৎ আমার মুখ থেকে এমন কথা শুনে সবার মনে যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। সবাই সবার মুখ চাওয়া চাওয়ি করে একদম চুপ হয়ে গেল।

 

কারণ ওদের দুই বোনের ঘরেও কোনো মেয়ে নেই। বড় আপার দুই ছেলে আর মোজো আপার তিন ছেলে। তারা মনেপ্রাণে আশা করছিল সুমনার সন্তান হলে যেন মেয়েই হয়।

অথচ সন্তানের বাবার মুখে এমন বক্তব্য শুনে ওরা রীতিমত বাকরুদ্ধ।

 

আমি প্রতিবারের মতো রাতের খাবার শেষ করে সুমনাকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। আমি একা মানুষ তিন কুলে আমার কেউ নেই। আমার বিয়ের আগেই বাবা মারা যায়। মাও মারা গেছেন বেশি দিন হয়নি। আগামী মাসের সাত তারিখ তিন মাস হবে। একটা বোন ছিল, সেও....!

 

বাবার বাড়ি থেকে আসার সময় সুমনা ছোট্ট একটা মিষ্টির বাক্স নিয়ে এলো। হয়তো সুখবরটা বাবার বাড়িতে প্রথম জানতে পেরেছে, সে কারণে সবাইকে মিষ্টি মুখ করানোর এই ক্ষুদ্র আয়োজন। আবার নাও হতে পারে। সবাই আর কে! কাজের খালা, ড্রাইভার আর আমি।

 

 সারাটা পথ সুমনা আমার সাথে একটা কথাও বলেনি। রাতের বেলায়ও সে ছিল একদম নিরব।

 

এভাবে প্রায় একসপ্তাহ কেটে গেলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত আমরা কেউই কারো সাথে একটা শব্দও বেশি কথা বলিনি। আসলে কথা বলার সময় কোথায়? আমি সকাল নয়টায় বের হয়ে যেতাম অফিসের জন্য, ফিরতাম রাতের আটটায়। ঘুমের আগ পর্যন্ত একটা সময় একটু কথা হতো, বা নিজেরাই সময় বের করে নিতাম কথা বলার জন্য।

 

অফিসে থাকার সময় সুমনা প্রায় একদুই মিনিটের জন্য কল দিয়ে খোঁজ খবর নিতো। আমার কখনো আলাদাভাবে কল দিয়ে তার খোঁজ নেয়া হতো না। গত একসপ্তাহ সে একবারের জন্যও কল দেয়নি।

 

একসপ্তাহ পর আমি টের পেলাম আমাদের সম্পর্কে একটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। সারাক্ষণ পকপক করা সুমনা একদমই নিশ্চুপ হয়ে গেলো।এটা মাতৃত্বকালিন ধকল না-কি আমার উপর অভিমান, সেটা আমি জানতে পারিনি। আসলে আমি জানার চেষ্টাও করিনি। আমি সুমনাকে আমার জীবনের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছি। ভালোবাসা , স্বাধীনতা , বিলাসীতা সব দিয়েছি।

 

তার জীবনে কোনো ঘাটতি আমি রাখিনি। এবার ভালোবেসে হোক বা যে কারণেই হোক সুমনা আমায় কখনো জিজ্ঞেসও করেনি

 

"আমি কেন কন্যা সন্তান পছন্দ করি না।"

 

তবে সে আর আমার প্রতি আর আগের মতো অান্তরিকতা বা ভালোবাসা প্রকাশ করেনি।

 

 কেমন যেন রোবটিক জীবন-যাপন শুরু করেছিল। আমিও তাকে বিরক্ত করিনি। তার মতামতকে আমি সম্মান দিয়েছি সবসময়ই। তার যেমন পছন্দ, সে তেমনই থাকুক।

 

এভাবে নিরবতা নিশ্চুপতার ভেতর দিয়ে আমার চাওয়া না চাওয়ায় কিছু যায় আসেনি। বিয়ের পাঁচ বছরে আমি দু' দুটো কন্যা সন্তানের বাবা হয়ে গেলাম।

 

সুমনা ভেবেছিল আমি মেয়ে চাইনি। অথচ সে মেয়ের মা হয়েছে। তার মানে আমি তাকে অবহেলা করব না হয় সন্তানদের।

 

অথচ কন্যা শিশু জন্মের পর পরই যেন আমি আট জান্নাতের মধ্যে একক ভাবে এক একটা জান্নাতের মালিক হয়ে গেলাম। স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্মের পর বাবার চেয়ে মায়ের ভূমিকা বেশি থাকে সন্তানদের প্রতি। অথচ আমি আমার জান্নাতদেরকে আমার জন্য সম্পূর্ণরুপে অর্জন করে নিলাম। মেয়ের ন্যাপি পরিষ্কার থেকে শুরু করে সব আমি নিজের হাতে করতে চাইতাম।

 

আমার আচরণে কেবল অবাক নয়, বিস্মিত হয়েছিল সুমনাসহ শ্বশুর পক্ষের প্রায় সবাই।

দুইমেয়েকে বুকের দুই পাশে নিয়ে যখন আমি শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ সুমনা এসে আমার সিথানে বসে জানতে চাইল

" আচ্ছা তুমি কেন চাওনি আমাদের মেয়ে হোক?"

 

যে প্রশ্ন আমি ভেবেছিলাম সুমনা চার বছর আগে করবে, সে প্রশ্ন সে চার বছর পর করল।

 

আমি স্থির দৃষ্টিতে সুমনার দিকে তাকিয়ে বললাম

 

" তুমি তো এটাই জানো না, একসময় আমি চাইতাম না পৃথিবীতে কোনো মেয়ে মানুষ থাকুক!"

সুমনা অবাক হয়ে বলল

" মানে! কী বলছ এসব?"

 

" জি, তুমি ঠিকই শুনেছ। তুমি শুনেছ আমার একটা বড় বোন ছিল, সে ছোটবেলায় মারা গেছে। কিন্তু কিভাবে মারা গেছে, সেটা কি জানো?"

 

" না তো! তুমি না বললে কিভাবে জানব? কী হয়েছিল আপার?"

আমি বাচ্চাদেরকে শুইয়ে রেখে আলমারি খুলে পুরনো মলাটের একটা ডায়রি নিয়ে এলাম। যেখানে আপার অনেকগুলো ছবি আছে। কোনোটা আমার সাথে, কোনোটা বাবা -মায়ের সাাথে আবার কোনোটাতে সে একা। কত বছর আগের ছবিগুলো। অথচ মনে হচ্ছে এখনো কত জীবন্ত। ছবির ভেতর থেকেই আমার বড় আপা কলকল করে হেসে উঠবে।

 

আমি ডায়রি থেকে বের করে ছবিগুলো সুমনাকে দেখালাম।

" দেখ আমার বড় আপাকে। আপা ছিল একটা ছোট্ট সুন্দর পরী মেয়ে।"

 

" বেশ সুন্দর তো বড় আপা। আগে কখনো ছবিগুলো দেখাওনি কেন? খুব মিষ্টি দেখতে।"

 

" শুধু মিষ্টি নয় আমার আপা ছিল পরীর মতো সুন্দর।এই সৌন্দর্যটাই তো তার জীবনে কাল হয়েছিল। আপা ছিল ছোটবেলা থেকে বেশ নাদুসনুদুস। আপাকে আদর করত না, এরকম কেউ ছিল না। বাড়িওয়ালা আঙ্কেল, তাদের ড্রাইভার, দারোয়ান, বাবার অফিসের কলিগ। পাশের বাড়ির আন্টি, আমাদের প্রাইভেট শিক্ষক সবাই। সবাই দেখলেই কোলে তুলে নিতো, চুমু দিত। আমি আপাকে ভীষণ হিংসা করতাম। সবাই ওকে আদর করে, অথচ আমাকে কেউ করে না। 

 

কিন্তু কোনো এক বিশেষ কারণে যখনই একটু বড় হচ্ছিল, যেমন ধরো সাত আট হবে বয়স, আমার মনে হতো ও কারো আদর নিতে চাচ্ছে না। যারাই ওকে আদর করত,তাদের দেখলে সে লুকিয়ে যেত, ভয় পেত।

তার এসব লুকিয়ে যাওয়ার অভ্যাস মা একদম পছন্দ করতেন না। উল্টো ওকে বকাবকি করতেন।

 

আমার কেন যেন অপছন্দ করা আপার প্রতি তখন ভীষণ মায়া হতো। আমি তখন এত ছোট ছিলাম, যে কিছুই বুঝতে পারতাম না, ফ্যালফ্যাল করে একবার মায়ের দিকে একবার আপার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।

 

একবার বাবা-মা আমাদের দুই ভাই বোনকে একা বাসায় রেখে একটু মার্কেটে গিয়েছিলেন ঘণ্টাখানিকের জন্য। আমি টিভি দেখছিলাম। আপা আমাকে রেখে বাগানে খেলতে গিয়েছিল। ঘণ্টা খানিক পর বাবা- মা ফিরে এলেন, কিন্তু আপা আর ফিরে এলো না।

সারা বিকাল, সারা সন্ধ্যায় আপাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে বাবা পুলিশকে ইনফর্ম করলেন।

 

সারারাত পুলিশ তল্লাশি করে পরের দিন বিকালে আপার লাশ পাওয়া গেল বাড়ির পেছনের নর্দমা ভর্তি ডোবায়। কে বা কারা যেন তাকে...."

 

আমি আর কিছুই বলতে পারিনি। টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রুকণা আমার জান্নাতেরদ্বয়ের পবিত্র গায়ে। চোখের জলের উষ্ণতায় ওরা জেগে বসে পড়ল। বাবার এমন অচেনা রূপ দেখে ওরা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল বাবার মুখের দিকে।

 

সুমনাও কাঁদছিল তখন আমার সাথে। ও আস্তে করে আমার কাঁধে ভরসার হাত রেখে সান্ত্বনা দিলো, আলতো করে চোখের পানি মুছে দিলো। পৃথিবীর কোনো সান্ত্বনায় তখন আমার চেপে রাখা শোক আঁটকে রাখতে পারল না।

 

আমি আপার ছবি বুকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ কান্না করলাম। সুমনা আমাকে মোটেও বিরক্ত করেনি। জানি না শ্বশুর বাড়িতে কী বলেছ সুমনা ! শেষ বিকালে ও বাড়ি থেকে সবাই এসে উপস্থিত হলো। পাঁচ বছর পর কিছু পরিচিত হাস্যজ্জল মুখ দেখে আমার মন ভালো হয়ে গেলো ভীষণভাবে।

 

জানি না কোন নরপিশাচের লালসার শিকার হয়েছিল আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে আগে আমার একমাত্র প্রিয় বোন। বাবা অজ্ঞাত পরিচয়ে দশজনকে আসামী করে থানায় মামলা করলেন।

 

পুলিশ কয়েক বছর আদা জল খেয়ে মাঠে নামলেন। কিন্তু সঠিক অপরাধী কে বা কারা আজও আমরা জানতে পারিনি।আমরা সারা জীবনের জন্য হারিয়ে ফেললাম আমার বোনকে। 

 

এরপর থেকে আমি একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। শুধু আমার বোন নয় জীবনের বহু বাঁকে বহু মেয়েকে দেখেছি যাদেরকে পথে ঘাটে, স্কুলে, কলেজে, অফিসে, বন্ধু মহলে নানানভাবে যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয়।

সবাই মুখ বুঝে সহ্য করে, কেউ প্রতিবাদ করে না।

যদি কেউ প্রতিবাদ করে, তাকে হতে হয় নোংরা চরিত্রের অধিকারি এই সমাজের চোখে, সমাজের ভদ্র মানুষের চোখে।

এর পর থেকে আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতাম এই পৃথিবী যেন মেয়ে শূন্য হয়ে যায়।

 

আমি সন্তানের বাবা হবো শুনে আমিও চাইনি, কন্যা সন্তানের বাবা হতে।

আমি পারব তো আমার মেয়ের জান, মাল, ইজ্জত,আব্রুর নিরাপত্তা দিতে! তাকে যে একদল রাহু গ্রাস করার জন্য উঠে পড়ে আছে এই পৃথিবীতে।

 

যখন সৃষ্টিকর্তা খুশি হয়ে আমাকে জান্নাত দিয়েছেন। আমি নিজেই আমার সন্তানের দায়িত্ব নিয়েছি। আমি তাকে ছোটবেলা থেকে নরপিশাচ চেনাব, এদের থেকে বাঁচার উপায়ও শিক্ষা দেব।

মায়ের মতো ভুল আমি কখনোই করব না। এই পৃথিবী সকল মানব শিশুর জন্য নিরাপদ আবাসস্থল হোক।


Akhi Akter Mim

313 Blog posts

Comments