ফুলির ভয়

Comments · 4 Views

ভয় মানুষকে ভিতো করে।

"কে? কে? কে আপনে? এইহানে কী দেখতাছেন?"

 

ভয়ে, আতংকে রীতিমতো কাঁপছে ফুলি। তার গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। সে কোনোমতে আধ-ভেজা কাপড়টা গায়ে পেঁছিয়ে ছুটে এলো বাইরে। না কেউ নেই, চারদিকে কেমন শুনশান নিরবতা।

 

তাহলে কী ফুলি ভুল দেখেছে? না অসম্ভব, এটা ভুল হতেই পারে না। সে শুধু চোখ দেখেনি আজ একটা হাতও দেখেছে। তার গোসলের সময় ভেন্টিলেটারের ফাঁক দিয়ে একজোড়া চোখ তাকে গিলে খাচ্ছে।

গিলে খাচ্ছিল তার নগ্ন দেহ, সুডৌল বক্ষ।

 

এবাড়িতে ফুলি এসেছে আজ দুই মাস সতেরো দিন। বাড়িতে মানুষ বলতে বড় সাহেব, ম্যাডাম আর তাদের উনিশ বছরের ছেলে সোহান।

ফুলির কাজ বেশি না। ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া, রুটি বানানো আর ছুটির দিনে মাছ, মাংস কাটা।

 

সারাদিন ঘরে ম্যাডাম ছাড়া আর কেউ থাকে না। বড় স্যার আর ভাইজান বেশির ভাগ সময় বাইরেই থাকেন।

তাই ঘর খুব একটা নোংরা হয় না। তিনজন মানুষের কাপড় আর রুটি বানানো খুব একটা কঠিন কাজ নয়।

 

তাই বাইশ বছরের স্বামী পরিত্যক্তা ফুলি একটা নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় এই বাড়িতে কাজ নিয়েছে। অথচ আশ্রয়টা নিরাপদ ভেবে আসলেও এখন সে রীতিমতো আতংকে আছে। কে সে অপরাধী ব্যক্তি, নোংরা এই চোখ জোড়া কার?

 

ফুলি কোনোভাবেই হিসাব মিলাতে পারে না। বড় স্যার তাকে মা বলে সম্বোধন করেন। কী অমায়িক একজন মানুষ। ফুলি শুনেছে স্যার অনেক বড় চাকরি করলেও কেবল মাত্র সততার কারণে তাদের সংসারে তেমন বিলাসিতা নেই।

 

ভাইজানকে তো আজ পর্যন্ত ফুলি ভালো করে দেখেইনি। বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকে, বাসায় থাকলেও সারাক্ষণ নিজের রুমেই থাকে।

 

আজ অবশ্য ছুটির দিন। সবাই বাড়িতে আছে। ভাইজান দরজা বন্ধ করে বন্ধদের সাথে রুমে আড্ডা দিচ্ছে। বড় স্যার ঘুমাচ্ছেন আর ম্যাডাম রান্নাঘরে।

কিছুক্ষণ আগে ম্যাডামের সাথে ফুলিও রান্নাঘরেই ছিল। ছুটির দিনে একটু কাজের পরিমান বেশি থাকে। কারণ বেশিরভাগ চাকরিজীবী পরিবার সপ্তাহের বাজার ঐ ছুটির দিনেই করে থাকে।

 

আজ স্যার বাজার থেকে বড় মাছ, ছোট মাছ ও মুরগি এনেছেন। ফুলি আসার আগে এরা মাছ মাংস বাজার থেকে কেটে আনলেও ফুলি আসার পর সে নিজেই ধোয়া মোছার পাশাপাশি কাটাকাটির দায়িত্বও নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছে।

 

ফুলি আতংকিত আর ভয়ার্ত মুখ নিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে বড় স্যারের ঘরে উঁকি দিয়েছে। না বড় স্যার মনে হচ্ছে এখনো ঘুমাচ্ছেন। ভাইজানের রুমের দরজাও বন্ধু। তিনিও বন্ধুদের সাথে ঘরে বসেই আড্ডা দিচ্ছেন। গোসলে যাওয়ার সময় যেভাবে দরজা বন্ধ ছিল এখনো ঠিক সেভাবেই দরজা বন্ধ আছে।

 

ফুলি গোসল অসমাপ্ত রেখে রান্নাঘরে ম্যাডামের পিছনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে ভেবে মনস্থির করতে পারে না। বিষয়টা কি ম্যাডামকে জানানো উচিত হবে? আজই প্রথম নয় এমন বিশ্রি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি সে রোজ হয়। প্রথম প্রথম মনের ভুল ভেবে এড়িয়ে গেছে। আজ কিন্তু তার মোটেও ভুল হচ্ছে না।

 

" এই কী রে! কী হলো তোর? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এখনো গোসল করিসনি তুই!"

 

" ম্যাডাম! "

 

" এখন কোনো কথা নয়। তাড়াতাড়ি টেবিলে খাবার দেয়। কয়টা বাজে সে খেয়াল আছে?"

 

ফুলি আর কথা বাড়ায় না। সে বুঝতে পারে এই মুহূর্তে কোনো কথা বলা ঠিক হবে না। এর চেয়ে ভালো হয় তাড়াতাড়ি সবাইকে দুপুরের খাবার দিতে ম্যাডামকে সাহায্য করা, সন্ধ্যার সময় ধীরেসুস্থে না হয় সব বলা যাবে।

 

দুপুরের পর আর ফুলি ওয়াশরুমে যায়নি। তার ভীষণ ভয় করছে। কোনো ভৌতিক আলামত নয় তো! মানুষ হলে না হয় এই সমস্যার সমাধান আছে। কিন্তু ভূত হলে কি হবে?

 

ফুলির হাসি পায়। দেয়াল ঘেরা কোনো গোসলখানা তো তাদের বাড়িতে ছিল না। প্রায় খোলা মাঠেই পুকুরপাড়ে তারা গোসল করত। পুকুরের অপর পাড়ে মহিলাদের পাশাপাশি পুরুষরা গোসল করত। সবাই সবাইকে দেখত। অথচ কারো দৃষ্টিতে পাপ ছিল না।

 

অথচ এই অদৃশ্য যে চোখ জোড়া ফুলি দেখেছে দেয়াল ঘেরা ওয়াশরুমের ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে, সেখানে আছে তীব্র নোংরামি, আর হিংস্রতা।

 

সন্ধ্যার সময় বড় স্যার ফুলিকে ডেকে বললেন,

 

" ফুলি, যা তো মা, গ্লাসটা ভালো করে ধুয়ে নিয়ে আয়।"

 

ফুলি পানির গ্লাসটা টেবিল থেকে নিতে নিতে লুকিয়ে স্যারের হাতের দিকে তাকায়। বড় স্যার দুইহাত দিয়ে চোখের সামনে পত্রিকা ধরে আছেন। 

 

ফুলির মনে অপরাধবোধ কাজ করে তার অবচেতন মন কি করে বড় স্যারের মতো একজন মানুষকে নিয়ে এমন ভাবনা এসছে।

 

সে নিজেই নিজেকে শাপ শাপান্ত করল। ফুলির অবচেতন মনকে অবশ্য কোনোভাবেই দোষ দেয়া যায় না।

 

 এর আগে ফুলি যে বাড়িতে কাজ করেছিল, সে বাড়ির বড় স্যারও কম ভদ্রলোক ছিলেন না।

অথচ সুযোগ পেলেই তিনি ফুলির বুকে হাত দিতেন।

 একদিন তো ফুলি অাপনমনে ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিল। বড় স্যার গলা উঁচু করে বকতে বকতে ঘরে ঢুকে ছোঁ মেরে চেপে ধরেছিল ফুলির বুক।

 

ঘটনার আকস্মিকতায় ফুলি হচকচিয়ে গেলো। ষাটোর্ধ বড় স্যার সেদিন পিশাচের মতো দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বললেন,

 

" ঘরটাও তো ঠিকমতো ঝাড়ু দিতে জানিস না। তোকে কাজ দিয়েছে কে?"

 

পিছনে এসে ম্যাডাম নিজের স্বামীকে সামর্থন করে দুজনে মিলে কেবল ফুলির অপারগতা, ব্যর্থতা সব চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

 

তখন ফুলির বয়স বেশি ছিল না। মাত্র ষোলো। শরীরে ভাঁজে ভাঁজে ছিল লজ্জা, ভয়। মনে ছিল চাকরি হারানোর আতংক।

 

এর পর থেকে ফুলি ভদ্রতার মুখোশ পরা কোনো বড় স্যারকেই বিশ্বাস করে না।

 

চা বানাতে বানাতে ফুলি ম্যাডামকে বলল,

" ম্যাডাম আগে হুনছি গেরামের তেতুল গাছের মইধ্য, তাল গাছের মইধ্য ভূত আছে।"

 

জাহানারা বেগম (যাকে ফুলি ম্যাডাম ডাকে) শব্দ করে হাসেন।

" তাই না-কি! তুই কি কখনো ভূত দেখেছিস? "

" হ, ম্যাডাম দেখছি তো! আমার আপনা বইনরেই একবার ভূতে ধরছিল।"

 

" কী বলিস, সত্যি!"

" আচ্ছা ম্যাডাম,শহরের ভূতগুলান কেমন অয়? হেরা কি বাথরুমের মইধ্য থাকে?"

 

"আমি জানি না ফুলি। গ্রামে ভূত থাকে সেটাই আমার বিশ্বাস হয় না। শহরের কথা আর কি বলব!"

 

ফুলি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে

" ভূত আপনে বিশ্বাস করেন না!"

" না, যে দেশের মানুষগুলোই ভূতের চেয়ে ভয়ংকর সেদেশে ভূত আসবে কোথায় থেকে?"

 

ফুলির মন খারাপ হয়ে গেলো ম্যাডামের কথা শুনে। যে মহিলা ভূত বিশ্বাস করে না সে মহিলা কি কখনো বিশ্বাস করবে সে গোসলের সময় কেউ একজন লুকিয়ে তাকে দেখে।

হয়তো ভাববে ভূত-প্রেত নিয়ে গল্প করতে গিয়ে ফুলির মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

 

তারপরও ফুলি সাহস সঞ্চয় করে বলল,

" ম্যাডাম আপনাগো বাসায় আমার ভয় করে।"

" কিসের ভয়? ভূতের ভয় নাতো আবার!"

 

" আপনে কি আমার লগে মশকরা করছেন ম্যাডাম?

 বিশ্বাস করেন ম্যাডাম, আপনে গো বাসায় আসার পর থেইকা আমার মনে অইতাছে আমি গোসলের সময় কেউ যেনো ফাঁক দিয়া আমার শরীর দেহে।"

 

ফুলির কথা শেষ না হতেই জাহানার বেগমের চেহারা কঠিন হতে শুরু করল, তিনি চোয়াল শক্ত করে বললেন,

" অহেতুক আজেবাজে গল্প করবি না। তোকে ওয়াশরুমে উঁকি দিয়ে কে দেখবে। আর কেনই বা দেখবে। বাসায় আমরা তিনজন মানুষ। তোর গোসলের সময় তো কেউই বাসায় থাকে না।

আর আছে দারোয়ান, সে দারোয়ান হলেও একজন ধার্মিক মানুষ। যিনি জামাতে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ে মানুষের দিকে চোখ তুলে কথা পর্যন্ত বলেনি।"

 

" ম্যাডাম আমি ভুল কতা কই নাই, বিশ্বাস করেন আমারে!"

 

"তোর বয়সি কাউকে বাসায় রাখার আমার একদম ইচ্ছে ছিল না। এর আগে তোর বয়সি একটা মেয়ে ছিল বাসায়। সে কোথায় গিয়ে,কার সাথে দূর্ঘটনায় ঘটিয়ে এসে এক একবার এক একজনের নামে মিথ্যা কথা বলেছিল। যাই হোক সে কথা আর বলছি না।"

 

ফুলির বুকের ভেতর ভয়ে ধুকপুক করতে শুরু করল, মিথ্যা অপবাধে এবার তার চাকরিটাই যাবে হয়তো! ম্যাডাম তার কথা যে শুধু অবিশ্বাস করছে সেটাই শুধু নয়, রীতিমতো তাকে মিথ্যাবাদী ভাবছে।

 

ফুলি টুপ করে জাহানারা বেগমের পা জড়িয়ে ধরে বলল,

" বিশ্বাস করেন ম্যাডাম। গত কয়েকদিন থেকে আমার মনে অইতাছে কেউ একজন গোসলের সময় বাথরুমের ফাঁক দিয়ে আমারে দেখে। আমার প্ররথমে বিশ্বাস অয় নাই। ভাবছিলাম বিলাই। আইজ আমি এক বেডার হাত দেখছি ম্যাডাম।"

 

ফুলির ব্যাকুলতা দেখে জাহানারা বেগম পুরো ঘটনা অবিশ্বাস করতে পারলেন না আবার পুরোপুরি বিশ্বাসও তিনি করলেন না।

তবে এ বাসায় বিড়ালের কঠিন উপদ্রব আছে। সারাক্ষণ রান্নাঘরে একজোড়া বিড়াল দম্পতি হুটোপুটি করে।

কোনো বিড়াল দেখে ফুলি ভয় পায়নি তো।

 

"ঠিক আছে ফুলি। এত কান্নাকাটি করার দরকার নেই। আমি দেখছি বিষয়টা।"

 

ঐ যে একটা প্রবাদবাক্য আছে না "ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পায়।"

 

কয়েক বছর আগে এমন একটা অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছিল জাহানারা বেগমের শ্বশুর বাড়িতে। তখন অবশ্য বাড়ি ভর্তি মানুষ ছিল। মেয়েটা কোথায়, কীভাবে যেন বিপদে পড়ে আর প্রকৃত অপরাধীর নাম বলতে পারছিল না ঠিক করে।

পরবর্তিতে জানাগুলো পুরো ঘটনাটাই ছিল পরিকল্পিত। তাদেরকে বিপদে ফেলার জন্য মিথ্যা নাটক সাজিয়েছিল শত্রু পক্ষ।

 

এরপর থেকে জাহানারা বেগম আর বাসায় কোনো কাজের মেয়েই রাখেননি। শহরের বাড়ি চলে আসার পর পুরো বাড়ির সব কাজ তিনি একা করেছেন। তারপরও একটা সাহায্যকারী রাখার সাহস করেননি।

 

প্রায় মাস তিনেক হবে ফুলিকে এনে দিয়েছেন তাদের গ্রামের এক আত্মীয়। মেয়েটা বিপদে পড়েছে। তাদেরও একটা মেয়ের দরকার ছিল। সেকারণে আগে পিছে না ভেবেই মেয়েটাকে রেখে দিয়েছেন।

তিনমাস না যেতেই মেয়েটা এটা আবার কি নাটক শুরু করেছে!

 

জাহানারা বেগম তার স্বামী আলম সাহেবের সাথে ফুলির বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার সাথে সাথে তিনি আর দুইবার ভাবেননি তখনই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। যেভাবেই হোক ফুলিকে যেন পরেরদিনই তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঘরে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলে আছে। এসব কথা সে শুনলে বিব্রত হবে।

 

ফুলির কোনো যুক্তি, কোনো কথা, আর কেউ একবারের জন্যও বিবেচনা করেনি। পরেরদিনই ফুলিকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়ার সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেলো।

সমস্যা হলো জাহানারা বেগম একটা বড় মেয়েকে কোনোভাবেই একা পাঠাবেন না। সিদ্ধান্ত হলো ফুলিকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে দারোয়ান মুন্সি কাকা।

তিনি বয়স্ক, নামাজি মানুষ। গাড়িতে করে দিনের আলোয় ফুলিকে তার বাড়ি পৌঁছে দিলে কোনো সমস্যা হবে না।

জাহানারা বেগম মুন্সিকে ডেকে ফুলিকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলার সাথে সাথে সে রাজি হয়ে গেলো।

 

অসহায় ফুলিও নিরুপায় হয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলো। শহরের বাড়ি এসে খাদ্য আর আশ্রয় পাওয়ার লোভে যদি এবার তার ইজ্জতটাই চলে যায়।

 

মুখভর্তি শুভ্র সফেদ দাড়ি, চোখ ভর্তি সুরমা লাগিয়ে যখন মুন্সি এসে সবার সামনে দাঁড়ালো ফুলিকে দিনে দিনে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য।

 

ষাটোর্ধ নির্ভেজাল বয়স্ক মানুষটার সাথে মায়ের কাছে ফিরে যেতে ফুলিও কোনো আপত্তি করেনি।

বাপের বয়সি লোকটার হাতে ব্যাগ তুলে দিতে গিয়ে হঠাৎ ফুলি চমকে উঠলো। মুন্সি কাকার বাম হাতে ছয়টা আঙ্গুল, আনামিকাতে একটা পাথরের আঙটি যেটা সে বাথরুমের ভেন্টিলেটারের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেয়েছে।

Comments
Read more