দেবীর সেবা সমভাবে চলিতেছে, গ্রাম-গ্রামান্তর হইতে যাত্রীরা দল বাঁধিয়া তেমনি আসিতেছে, যাইতেছে, মানস করিতেছে, পূজা দিতেছে, পাঁঠা কাটিতেছে, প্রসাদের ভাগ লইয়া পূজারীর সহিত তেমনি বিবাদ করিতেছে, এবং ঠিক তেমনি মুক্তকণ্ঠে আপনার খ্যাতি ও প্রতিবেশীর অখ্যাতি প্রচার করিয়া দেহ ও মনের স্বাস্থ্য ও স্বাভাবিকতার প্রমাণ দিতেছে। বস্তুতঃ কোথাও কোন ব্যতিক্রম নাই; বিদেশীর বুঝিবার জো নাই যে, ইতিমধ্যে হাওয়ার বদল হইয়াছে, এবং ঝঞ্ঝার পূর্বক্ষণের ন্যায় চণ্ডীগড়ের মাথার আকাশ গোপন ভারে থমথম করিতেছে। এ গ্রামের সাধারণ চাষাভূষারাও যে ঠিক নিশ্চয় করিয়া কিছু বুঝিয়া লইয়াছে তাহা নহে, কিন্তু ষোড়শীর সম্বন্ধে মোড়ল-পদবাচ্যদের মনোভাব যা-ই হোক, এই দীনদুঃখীরা তাহাকে যেমন ভক্তি করিত, তেমনি ভালবাসিত। এককড়ি নন্দীর উৎপাত হইতে বাঁচিবার সেই কেবল একমাত্র পথ ছিল। ছোটখাটো ঋণ যখন আর কোথাও মিলিত না, তখন ভৈরবীর কাছে গিয়া হাত পাতিতে তাহাদের বাধিত না। তাহার বাড়ি ছাড়িয়া আসার জন্য ইহাদের সত্য সত্যই বিশেষ কোন দুশ্চিন্তা ছিল না, তাহারা জানিত পিতা ও কন্যার মনোমালিন্য একদিন না একদিন মিটিবেই। ষোড়শীর দুর্নামের কথাটাও অপ্রকাশ ছিল না। কেবল সে-ই বলিয়া ইহা না রটিলেই ভাল হইত; না হইলে দেবীর ভৈরবীদের স্বভাব-চরিত্র লইয়া মাথা গরম করার আবশ্যকতা কেহ লেশমাত্র অনুভব করিত না—দীর্ঘকালের অভ্যাসবশতঃ ইহা এতই তুচ্ছ হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু ইহাকেই উপলক্ষ সৃষ্টি করিয়া মায়ের মন্দির লইয়া যে তুমুল কাণ্ড বাধিবে, কর্তারা তারাদাস ঠাকুরকে সঙ্গে লইয়া সকাল নাই, সন্ধ্যা নাই হুজুরের কাছে আনাগোনা করিয়া কি-যেন-কি-একটা ওলটপালট ঘটাইবার মতলব করিবেন, এবং ওই যে অচেনা ছোট মেয়েটাকে কোথা হইতে কিসের জন্য আনিয়া রাখা হইয়াছে—এমনি সব সংশয়ের বিদ্যুৎ কথায় কথায় ক্ষণে ক্ষণে যখন চমকিতে লাগিল, তখন চোখের আড়ালে কোথায় আকাশের গায়ে যে অকালের মেঘ জমিয়া উঠিতেছে এবং তাহাতে দেশের ভালই হইবে না, এই ভাবটাই সকলের মধ্যে ক্রোধ ও ক্ষোভের মত আবর্তিত হইতে লাগিল।
সেদিন অষ্টমী তিথির জন্য মন্দির-প্রাঙ্গণে লোকসমাগম কিছু অধিক হইয়াছিল। প্রতিমার অনতিদূরে বারান্দার একাধারে বসিয়া ষোড়শী আরতির উপকরণ সজ্জিত করিতেছিল, তারাদাস ও সেই মেয়েটিকে সঙ্গে করিয়া এককড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল। ষোড়শী কাজ করিতে লাগিল, মুখ তুলিয়া চাহিল না। এককড়ি কহিল, মা মঙ্গলা, তোমার চণ্ডীমাকে প্রণাম কর।
পূজারী কি একটা করিতেছিল, সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইল। ষোড়শী চোখ না তুলিয়াও ইহা লক্ষ্য করিল। মেয়েটি প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইতে পূজারী কহিল, মায়ের সন্ধ্যারতি কি তুমি দেখবে মা? তাহলে দেবীর দক্ষিণে ওই যে আসন পাতা আছে ওর ওপরে গিয়ে বসো।
এককড়ি ষোড়শীর প্রতি একটা বাঁকা কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া সহাস্যে কহিল, ওঁর নিজের স্থান উনি নিজেই চিনে নেবেন ঠাকুর, তোমাকে চেনাতে হবে না, কিন্তু মায়ের জিনিসপত্র যা যা আছে দেখিয়ে দাও দিকি।
পূজারী একটু লজ্জিত হইয়া কহিল, দেখিয়ে দিতে হবে বৈ কি, সমস্তই একটি একটি করে দেখাতে হবে। লিস্টির সঙ্গে মিলিয়ে সব ঠিক আছে, কোন চিন্তা নেই। মা, ওই যে ও-দিকে বড় সিন্দুক দেখা যাচ্চে, ওতে পূজার পাত্র এবং সমস্ত পিতল-কাঁসার তৈজসাদি তালাবন্ধ আছে, বড় বড় কাজকর্মে শুধু বার করা হয়। আর এই যে গুলবসানো ছোট কাঠের সিন্দুকটি, এতে মখমলের চাঁদোয়া, ঝালর প্রভৃতি আছে, আর এই কুঠরিটির মধ্যে সতরঞ্চি, গাল্চে, কানাত—বসবার আসন এই-সব—
এককড়ি কহিল, আর—
পূজারী বলিলেন, আর ওই যে পূবের দেওয়ালের গায়ে বড় বড় তালা ঝুলচে, ওটা লোহার সিন্দুক, মন্দিরের সঙ্গে একেবারে গাঁথা। ওর মধ্যে মায়ের সোনার মুকুট, রামপুরের মহারানীর দেওয়া মোতির মালা, বীজগাঁর জমিদারবাবুদের দেওয়া সোনার বাউটি, হার, আরও কত শত ভক্তের দেওয়া কত কি সোনা-রূপার অলঙ্কার, তা ছাড়া টাকাকড়ি, দলিলপত্র, সোনা-রূপার বাক্স—অর্থাৎ মূল্যবান যা-কিছু সমস্তই ওই সিন্দুকটিতে।
এককড়ি কহিল, আমি আজকের নয় ঠাকুর, সব জানি। কিন্তু ও-সব কেবল তোমার মুখেই আছে, না সিন্দুকটা হাতড়ালে কিছু পাওয়া যাবে! ওই ত উনি বসে আছেন, চাবিটা চেয়ে এনে একবার খুলে দেখাও না। গ্রামের ষোল আনার প্রার্থনা মঞ্জুর করে হুজুর কি হুকুম দিয়েচেন শোননি? চৈত্রসংক্রান্তির পূর্বে সমস্তই যে একদফা মিলিয়ে দেখতে হবে।
পূজারী হতবুদ্ধির ন্যায় চুপ করিয়া রহিল। মন্দির হইতে ষোড়শীর কর্তৃত্ব যে ঘুচিয়া গেছে তাহা সে শুনিয়াছে এবং নন্দী মহাশয়ের প্রত্যক্ষ আদেশ অমান্য করাও যে অতিশয় সাংঘাতিক তাহাও জানে, কিন্তু কর্মনিরতা ওই যে ভৈরবী অনতিদূরে বসিয়া স্বকর্ণে সমস্ত শুনিয়াও শুনিতেছে না, তাহাকে মুখের সম্মুখে গিয়া শুনাইবার সাহস তাহার নাই। সে ভয়ে ভয়ে কহিল, কিন্তু তার ত এখনো দেরি আছে নন্দীমশাই। এদিকে সূর্যাস্ত হয়ে এল—
তারাদাস এতক্ষণ কথা কহে নাই, এবং সঙ্কোচ ও ভয়ের চিহ্ন কেবল পূজারীর মুখে-চোখেই প্রকাশ পাইয়াছিল, তাহা নয়। আস্তে আস্তে কহিল, মিলিয়ে নিতে অনেক বিলম্ব হবে নন্দীমশাই, একটু সকাল করে এসে আর একদিন এ কাজটা সেরে নিলে হবে না? কি বলেন?
এককড়ি চিন্তা করিয়া কহিল, আচ্ছা, তাই না হয় হবে। পূজারীকে কহিল, কিন্তু মনে থাকে যেন চক্রবর্তীমশাই, এই শনিবারেই সংক্রান্তি। ষোল আনা পঞ্চায়েতি নাটমন্দিরেই হবে। হুজুর স্বয়ং এসে বসবেন। উত্তর ধারটা কানাত দিয়ে ঘিরে দিয়ে তাঁর জন্যে মখমলের গালচেটা পেতে দিতে হবে। আলোর সেজ-কটাও তৈরি রাখা চাই।
এককড়ি একটু জোর গলায় কথা কহিতেছিল, সুতরাং অনেকেই কৌতূহলবশে বারান্দার নীচে প্রাঙ্গণে আসিয়া জমা হইয়াছিল। সে তাহাদের শুনাইয়া আরও একটু হাঁকিয়া পূজারীকে কহিল, সেদিন ভিড় ত বড় কম হবে না—ব্যাপারটা খুবই গুরুতর। মঙ্গলা মেয়েটাকে আদর করিয়া কহিল, কি গো মা ক্ষুদে ভৈরবী! দেখেশুনে সব চালাতে পারবে ত? তবে আমরা আছি, হুজুর এখন থেকে নিজে দৃষ্টি রাখবেন বলেছেন, নইলে ভার বড় সহজ নয়। অনেক বিদ্যেবুদ্ধির দরকার। বলিয়া ষোড়শীর প্রতি আড়চোখে চাহিয়া দেখিল সে ঠাকুরের পূজার সজ্জায় তেমনি নিবিষ্টচিত্ত হইয়া আছে। তারাদাসকে লক্ষ্য করিয়া হাসিয়া বলিল, কি গো ঠাকুরমশাই, নূতন অভিষেকের দিনক্ষণ কিছু স্থির হয়েচে শুনেচ? লোকে ত আমাদের একেবারে ব্যস্ত করে তুলেচে, নাবার খাবার সময় দিতে চায় না।
প্রত্যুত্তরে তারাদাস অস্ফুটে কি যে বলিল বুঝিতে পারা গেল না। তাহার সদর দরজা দিয়া যখন বাহির হইয়া গেল, তখন পিছনে পিছনে অনেকেই গেল এবং গুঞ্জনধ্বনি তাহাদের প্রাঙ্গণের অপর প্রান্ত পর্যন্ত স্পষ্ট শুনা গেল, কিন্তু চণ্ডীর আরতির প্রতীক্ষায় যাহারা অবশিষ্ট রহিল তাহারা দূর হইতে ষোড়শীর আনত মুখের প্রতি শুধু নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল; এমন ভরসা কাহারও হইল না কাছে গিয়া একটা প্রশ্ন করে।
যথাসময়ে দেবীর আরতি শেষ হইল। প্রসাদ লইয়া যে যাহার গৃহে চলিয়া গেলে মন্দিরের ভৃত্য যখন দ্বার রুদ্ধ করিতে আসিল, তখন ষোড়শী পূজারীকে নিভৃতে ডাকিয়া কহিল, চক্রবর্তীমশাই, ঠাকুরের সেবায়েত আমি, না এককড়ি নন্দী?
চক্রবর্তী লজ্জিত হইয়া বলিল, তুমি বৈ কি মা, তুমিই ত মায়ের ভৈরবী।
ষোড়শী কহিল, কিন্তু তোমার ব্যবহারে আজ অন্য ভাব প্রকাশ পেয়েছে। যত দিন আছি, গোমস্তার চেয়ে আমার মান্যটা মন্দিরের ভেতর বেশী থাকা দরকার। ঠিক না?
পূজারী কহিল, তাতে আর সন্দেহ কি মা! কিন্তু—
ষোড়শী কহিল, ওই কিন্তুটা তোমাকে সে ক’টা দিন বাদ দিয়ে চলতে হবে।
এই শান্ত মৃদুকণ্ঠ পূজারীর অত্যন্ত সুপরিচিত; সে অধোমুখে নিরুত্তরে রহিল, এবং ষোড়শীও আর কিছু কহিল না। মন্দিরদ্বারে তালা পড়িলে সে চাবির গোছা আঁচলে বাঁধিয়া নীরবে ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।
পরদিন সকালে স্নান করিয়া ফিরিয়া আসিয়া দূর হইতে দেখিতে পাইল, এইটুকু সময়ের মধ্যে তাহার পর্ণকুটীরখানি ঘেরিয়া বহু লোক জড় হইয়া বসিয়া আছে। কাছে আসিতেই লোকগুলা ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া পদধূলির আশায় একযোগে প্রায় পঁচিশখানি হাত বাড়াইয়া দিতে ষোড়শী পিছাইয়া গিয়া হাসিয়া কহিল, ওরে, অত ধূলো পায়ে নেই রে নেই, আবার আমাকে নাইয়ে মারিস নে, আমার মন্দিরের বেলা হয়ে গেছে। কি হয়েচে বল্?
ইহারা প্রায় সকলেই তাহার প্রজা; হাত জোড় করিয়া কহিল, মা, আমরা যে মারা যাই! সর্বনাশ হয় যে!
তাহাদের মুখের চেহারা যেমন বিষণ্ণ, তেমনি শুষ্ক। কেহ কেহ বোধ করি সারারাত্রি ঘুমাইতে পর্যন্ত পারে নাই। এই- সকল মুখের প্রতি চাহিয়া তাহার নিজের হাসিমুখখানি চক্ষের পলকে মলিন হইয়া গেল। বুড়া বিপিন মাইতি অবস্থা ও বয়সে সকলের বড়; ইহাকেই উদ্দেশ করিয়া ষোড়শী জিজ্ঞাসা করিল, হঠাৎ কি সর্বনাশ হলো বিপিন?
বিপিন কহিল, কে একজন মাদ্রাজী সাহেবকে সমস্ত দক্ষিণের মাঠকে মাঠ জমিদার-তরফ থেকে বিক্রি করা হচ্চে। আমাদের যথাসর্বস্ব। কেউ তা হলে আর বাঁচব না—না খেতে পেয়ে সবাই শুকিয়ে মারা যাবো মা!
ব্যাপারটা এমনি অসম্ভব যে ষোড়শী হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, তাহলে তোদের শুকিয়ে মরাই ভাল। যা, বাড়ি যা, সকালবেলা আর আমার সময় নষ্ট করিস নে।
কিন্তু তাহার হাসিতে কেহ যোগ দিতে পারিল না, সকলে সমস্বরে বলিয়া উঠিল, না মা, এ সত্যি।
ষোড়শী বিশ্বাস করিতে পারিল না, বলিল, না রে না, এ কখনো সত্য হতেই পারে না, তোদের সঙ্গে সে তামাশা করেচে। বিশ্বাস না করিবার তাহার বিশেষ হেতু ছিল। একে ত এই-সকল জমিজমা তাহারা পুরুষানুক্রমে ভোগ করিয়া আসিতেছে, তাহাতে সমস্ত মাঠ শুধু কেবল বীজগ্রামের সম্পত্তিও নহে। ইহার কতক অংশ ৺চণ্ডীমাতার এবং কিছু রায়মহাশয়ের খরিদা। অতএব জীবানন্দ একাকী ইচ্ছা করিলেও ইহা হস্তান্তর করিয়া দিতে পারেন না। কিন্তু বৃদ্ধ বিপিন মাইতি যখন সমস্ত ঘটনা বিবৃত করিয়া কহিল, কাল কাছারিবাটীতে সকলকে ডাকাইয়া আনিয়া নন্দীমহাশয় নিজের মুখে জানাইয়া দিয়াছেন এবং তথায় জনার্দন ও তারাদাস উভয়েই উপস্থিত ছিলেন, এবং দেবীর পক্ষ হইতে তাহার পিতা তারাদাসই দলিলে দস্তখত করিয়া দিয়াছেন, তখন অপরিসীম ক্রোধ ও বিস্ময়ে ষোড়শী বহুক্ষণ পর্যন্ত স্তব্ধ হইয়া রহিল। অবশেষে ধীরে ধীরে কহিল, তাই যদি হয়ে থাকে তোরা আদালতে নালিশ কর্ গে।
বিপিন নিরুপায়ভাবে মাথা নাড়িতে নাড়িতে কহিল, তাও কি হয় মা? রাজার সঙ্গে কি বিবাদ করা চলে? কুমীরের সঙ্গে শত্রুতা করে জলে বাস করলে যার যা কিছু আছে—ভিটেটুকু পর্যন্তও থাকবে না!
ষোড়শী কহিল, তা বলে বাপ-পিতামহের কালের পৈতৃক বিষয়টুকু তোরা মুখ বুজে ছেড়ে দিবি?
বিপিন কহিল, তুমি যদি কৃপা করে আমাদের বাঁচিয়ে দাও মা, দীনদুঃখী আমাদের নইলে ছেলেপিলের হাত ধরে গাছতলায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তাই ত তোমার কাছে সবাই ছুটে এসেচি।
ষোড়শী একে একে সকলের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল। ইহাদের কাহারও কিছু করিবার সাধ্য নাই; তাই এই একান্ত বিপদের দিনে দল বাঁধিয়া অপরের কৃপাভিক্ষা করিতে তাহারা বাহির হইয়াছে। এই সব নিরুদ্যম ভরসাহীন মুখের সকরুণ প্রার্থনায় তাহার বুকের ভিতরে আগুন জ্বলিয়া উঠিল; কহিল, তোরা এতগুলো পুরুষমানুষ মিলে নিজেদের বাঁচাতে পারবি নে, আর মেয়েমানুষ হয়ে আমি যাবো তোদের বাঁচাতে? রাগ করো না বিপিন, কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, এ জমি না হয়ে মাইতিগিন্নীকে যদি জমিদারবাবু এমনি জবরদস্তি আর একজনকে বিক্রি করে দিতেন, আর সে আসতো তাকে দখল করতে, কি করতে বাবা তুমি?
ষোড়শীর এই অদ্ভুত উপমায় অনেকের মুখই চাপা হাসিতে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল; কিন্তু বৃদ্ধের চোখের কোণে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখা দিল। কিন্তু আপনাকে সংবরণ করিয়া সহজকণ্ঠে বলিল, মা, আমি না হয় বুড়ো হয়েছি, আমার কথা ছেড়েই দাও, কিন্তু মাইতিগিন্নীর পাঁচ-পাঁচজন জোয়ান বেটা আছে, তারা তখন জেল কেন, ফাঁসিকাঠের ভয় পর্যন্ত করবে না, একথা তোমাকে মা-চণ্ডীর দিব্যি করেই জানিয়ে যাচ্চি।
সে আরও কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু ষোড়শী বাধা দিয়া কহিল, তাই যদি সত্যি হয় বিপিন, তোমার সেই পাঁচ-পাঁচজন জোয়ান বেটাকে ব’লো এই পিতা-পিতামহের কালের ক্ষেত-খামারটুকুও তাদের বুড়ো মায়ের চেয়ে একতিল ছোট নয়। এঁরা দুজনেই তাদের সমান প্রতিপালন করে এসেছেন।
বৃদ্ধ চক্ষের নিমেষে সোজা উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, ঠিক! ঠিক কথা মা! আমাদের মা-ই ত বটে। ছেলেদের এখনি গিয়ে আমি এ কথা জানাবো, কিন্তু তুমি আমাদের সহায় থেকো।
ষোড়শী মাথা নাড়িয়া বলিল, শুধু আমি কেন বিপিন, মা-চণ্ডী তোমাদের সহায় থাকবেন। কিন্তু আমার পূজোর সময় বয়ে যাচ্চে বাবা, আমি চললুম। বলিয়া সে দ্রুতপদে গিয়া আপনার কুটীরের মধ্যে প্রবেশ করিল। কিন্তু বিপিনের গম্ভীর গলা সে স্পষ্ট শুনিতে পাইল। সে সকলকে ডাকিয়া কহিতেছে, তোরা সবাই শুনলি ত রে, শুধু গর্ভধারিণীই মা নয়, যিনি পালন করেন, তিনিও মা। যা হবার হবে, ঘরের মাকে আমরা কিছুতেই পরের হাতে তুলে দিতে পারব না।